somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাপানের এক টুকরো সুইডেন ,নিসর্গ শহর সুইডেন হিল - নুরুন নাহার লিলিয়ান

০৩ রা মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জাপানের অভিজাত শ্রেণির অন্যতম তীর্থভূমি হল হোক্কাইডো আইল্যান্ডের সুইডেন হিল।

বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত বিদেশিদের কাছে সুইডেন হিল ভীষণ আকর্ষনীয় এক জায়গা। ধীরে ধীরে তা সাধারন মানুষের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। । বলা যায় জাপানে বসবাসরত ধনী দেশ থেকে আসা ভিনদেশিদের সেকেন্ড হোম। একটা নিভৃত নিসর্গ নিস্তব্ধতার চাঁদরে ঢাকা শহর বা গ্রাম।

একদা জাপানি আত্মজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম সুইডেন হিল নামক নিস্তব্ধ গ্রামে। এর আগে প্রচুর মানুষের মুখে ব্যয়বহুল জায়গা হিসেবে

সুইডেন হিলের অনেক গল্প শুনেছিলাম । গল্প শুনতে শুনতে এর প্রেমে পড়েই বরং ঘুরতে যাওয়া। মন ভরে সুইডেন হিলের নিস্তব্ধ সৌন্দর্য দেখা।

পুরো গ্রামের সব কিছু সুইডেনের স্টাইলে তৈরি । পাহাড়ি পরিবেশে সারি সারি সুন্দর সব একই ধরনের লাল কাঠের বাড়ি।

সুইডেন হিল হল সুইডিশ স্টাইলে তৈরি গ্রাম। যেখানকার কাঠের বাড়ি গুলো Falu red রঙে সজ্জিত। সাদা ও লালের অদ্ভুত সংমিশ্রণে তৈরি নিভৃত গ্রাম সুইডেন হিলের বাড়ি গুলো। সেখানকার বাড়ি ঘর, ক্রাফট, ট্রাডিশনাল জিনিসপত্র সব কিছু সুইডেনে অনুরূপ। বলা যায় জাপানে এক টুকরো সুইডেন।

জাপান থেকে ৮০০০ কিমি ও ৫০০০ মাইল দূরের দেশ সুইডেনটা যেনো নিজ শহরের বুকে।

১৯৮৪ সালে সুইডেন এম্বাসেডর হোক্কাইডো আইল্যান্ডের অন্যতম বড় শহর তোবেতসুর ইশিকারি ঘুরতে যান৷ তখন তিনি অনুভব করেন তোবেতসুর এলাকাটার জলবায়ু ও ভূমির স্থাপত্য পুরোটাই যেন সুইডেনের মতো। সেখান থেকেই আরও একটি ছোট্ট দেশ সুইডেন তৈরি হয় জাপানের হোক্কাইডো আইল্যান্ডের তোবেতসু শহরে। ১৯৮৪ সালে এটা তৈরি হলেও এর পরিকল্পনা হয় ১৯৭৯ সাল থেকে।

হোক্কাইডোর সাপ্পোরো শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার বা ১৯ মাইল দূরে তোবেতসু নামক শহরে এই সুইডেন হিল অবস্থিত।আর হোক্কাইডোর নিউ ছিতোস এয়ারপোর্ট থেকে তোবেতসু ইশিকারির দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। বাস, ট্রেন, প্রাইভেট কার অথবা প্লেন সব কিছুরই সুবিধা আছে সুইডেন হিলে যাওয়ার। এছাড়াও আন্তর্জাতিক অনেক সরাসরি ফ্লাইট আছে। চীনের সাংহাই, বেইজিং, তাইওয়ানের তাইপাই, হংকং, কোরিয়ার শিউল থেকে সরাসরি হোক্কাইডোর এই নিভৃত গ্রাম সুইডেন হিলে যাওয়া যায় প্লেনে চড়ে । বলা যায় যেকোন বিদেশি পর্যটকের জন্য নিসর্গভূমি।

আমি তখন আমার স্বামীর সাথে সাপ্পোরো শহরের কিতাকু ওয়ার্ডে থাকি। নিত্যদিনের জীবনের প্রয়োজনেই একদল বৃদ্ধ সেচ্ছাসেবকের সাথে আমার সুসম্পর্ক হয়। চিয়ো সাইতো ও রিউহে সাইতো দম্পতি ছিলেন আমার স্থানীয় জাপানি অভিভাবক।আমাকে উনারা নাতিন বানিয়েছিলেন। আমি ছিলাম উনাদের আদরের নাতনি।

পৃথিবীতে চলার পথে আমরা কতোইনা হিসেব নিকাশ করি। অথচ কিছু মানুষ সব হিসাব কিতাব রেখে মানুষের জন্য , মানুষকে ভালবাসার মধ্যেই জীবনের নিগুঢ় সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চান ।দিনে শেষে মানুষের পাশে মানুষ থাকবে। এটাই সত্য যে মানুষ ছাড়া মানুষের জীবন অকল্পনীয়।

তারা মানুষের জন্য মানুষ এই আদর্শেই জীবন পার করেন। তাদের নিঃসবার্থ ভালোবাসার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

জাপান জীবনের পুরোটা সময় এই দম্পতি ছিল আমার পরম আপন জন। তারা নিয়মিতই আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গিয়েছেন। নিজ দায়িত্বে নিজ দেশের সুন্দর দিক গুলো উন্মোচন করেছেন।

চিয়ো সাইতো মানে আমার জাপানি দাদির মাধ্যমেই পরিচয় হয় আরও অনেক বিভিন্ন বয়সী জাপানি বন্ধুর সাথে। তাঁদের মধ্যে তেরুকো সান, কেইকো সান,কাজুহা সান সহ অনেকেই ছিলেন। যাদের সাথে নিয়মিতভাবে আমি হোক্কাইডো আইল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম।

একদিন হোক্কাইডো আইল্যান্ডের বিভিন্ন সুন্দর জায়গা নিয়ে গল্প করতে করতেই হঠাৎ সিদ্ধান্ত হল সুইডেন হিল যাওয়ার।

২০১৫ সালের জুলাই মাসের ২৮ তারিখ ভোর ছয়টায় জাপানি দাদি চিয়ো সান, তাঁর স্বামী রিউহে সান, কেইকো সান ও তেরুকো সান আমার বাসা থেকে আমাকে নিয়ে গেলেন। বরাবরের মতো চিয়ো সানের স্বামী রিউহে সান ড্রাইভ করছিল।

গাড়িতে উঠার পর বরাবরের মতো চিয়ো সান একটা ফটো কপি চিরকুট হাতে দিলেন। সেখানে পুরো দিনের শিডিউল ইংরেজিতে লেখা আছে।সেই সাথে ইংরেজিতে লেখা তোবেতসু ও সুইডেন হিল নিয়ে সাপ্পোরো সিটি সেন্টারের কয়েকটা গাইড বই ও ম্যাপ হাতে দিল।

আমরা হোক্কাইডোর সাপ্পোরো শহরের কিতাকু ওয়ার্ড থেকে রওয়ানা হওয়া থেকে বিকেলে বাসায় ফেরা পর্যন্ত সব কিছু ইংরেজিতে টাইপ করা আছে। যেনো আমার বুঝতে অসুবিধা না হয়।

মোটামুটি সময় তো লাগবে। কারন সাপ্পোরো শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে আর ভিন্ন আরেকটা শহরে অবস্থিত সুইডেন হিল।

গাড়িতে ব্যাপক উত্তেজনা নিয়ে আমি সবার সাথে উঠে বসলাম৷ সময়টা জুলাইয়ের শেষের দিক। হোক্কাইডোর আবহাওয়ায় যেন সবর্গীয় সুখ বিরাজমান। একটু গরম থাকলেও বাতাস বহমান আছে। শীতকালে সব সময় শীতের ভারী জ্যাকেট, হাত ও পা মুজা, মাফলার সহ কতো কি বাইরে বের হওয়ার সময়ে পড়তে হতো। কিন্তু সেই সময়টায় চারপাশে এতো মুগ্ধকরা আবহাওয়া। রোদ, বাতাস আর হালকা গরমের অদ্ভুত মিতালি।

আমি বরাবর চেষ্টা করতাম জাপানিদের কাছে আমাদের দেশের মেয়েদের মনের রঙ আর উচ্ছলতার সাথে পরিচয় করাতে৷

বাংলাদেশে আমার মতো একজন তরুণী কেমন করে সাজতে ভালোবাসে, কোন ধরনের রঙ মেয়েদের প্রিয়। আমি গ্রীস্মকালীন সুন্দর পরিবেশ থাকায় গাঢ় বেগুনি রঙের থ্রি পিস পড়লাম। গলায় পাথরের মালা, হাতে চুড়ি কাম ব্রেসলেট, কানে শামুকে দুল, মাথায় নেট কাপড়ের রাউন্ড ব্যান্ড। একজন বাঙালি পরিচিত তরুণীকে যেমন দেখতে লাগে। আমার সাথে তিনজন জাপানি নারী।

তাঁরা যেতে যেতে পথে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ নিয়ে নানা কৌতুহলী প্রশ্ন করতে লাগল।অদ্ভুতভাবে আমার থ্রি পিসের কাপড় ধরে দেখতে লাগল।

ওদের এসব সহজ সরল আচরণ সব সময় আমাকে আনন্দ দিত।সেদিনও ওদের যাপিত জীবন বাস্তবতার সাথে পরিচয় ও বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ নিয়ে নানা রকম গল্প গুজব করতে করতেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

গাড়িতে বসেই চিয়ো সাইতোর সাথে করে নিয়ে আসা কমলার জুস, আপেল ফ্লেভারের চা, নানা রকম কুকিজ, চকোলেট, কেক খেতে খেতে কথা হতে লাগল।তোবেতসু ও সুইডেন হিল নিয়ে ইংরেজিতে লেখা যে ছোট ছোট গাইড বুক ও ম্যাপ হাতে ছিল আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলাম ।

জাপানের খুব গুছানো একটা আইল্যান্ড হোক্কাইডো। আর হোক্কাইডো আইল্যান্ডের ধনীদের জন্য অন্যতম বিচিত্র বিলাসবহুল জীবন জগতের নাম সুইডেন হিল। সেখানকার বিলাসবহুল জীবনের সৌন্দর্যের নিস্তব্ধতা যেকোন পর্যটকের মনের ভেতরটা রঙিন করে দিবে।

সাপ্পোরো শহর থেকে তোবেতসু শহরে যাওয়ার তিন ধরনের সহজ পথ আছে।সাপ্পোরো স্টেশন থেকে ট্রেন, ট্যাক্সি ও কার করে তিন ভাবেই তোবেতসুর সুইডেন হিলে যাওয়া যায়। তিন পথেই আলাদা অভিজ্ঞতা।

তবে ট্রেনে গেলে খরচ তুলনামূলক কম ও দ্রুত সময়ে যাওয়া যায়। সেখানে যেতে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা সময় লাগে। তুলনামূলক একটু খরচ বেশি ট্যাক্সিতে গেলে। একই দূরত্ব হলেও খরচ হয় ট্যাক্সিতে প্রায় ৭৫০০ ইয়েন থেকে ৯৫০০ হাজার ইয়েনের মতো । নিজের, আত্মীয় অথবা বন্ধুর কারে গেলে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টার মতো সময় ব্যয় হয়।

সুইডেন হিল তৈরি হওয়ার পর থেকে আনুমানিক ১০০০ এর বেশি বাড়ি সেখানে তৈরি হয়। ১১৬৫ এর ও বেশি হোটেল আছে। যে হোটেল গুলোতে এক রাত থাকতে হলে দশ হাজার ইয়েন গুনতে হবে।

তিন ভাগের এক ভাগ বাড়ি ব্যবহৃত হয় ছুটি কাটানোর জন্য। পর্যটকদের অবকাশ যাপনের জন্য এই বাড়ি গুলো বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছে। অবকাশ যাপনের বাড়ি গুলো দুই সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ দুই মাস ভাড়া নেওয়া যায়। গ্রীস্মকালীন ও শীতকালীন পার্থক্যে এই ভাড়া আবার দুই রকম হয়।

দুই সপ্তাহের জন্য গ্রীস্মকালীন ভাড়া ১,২৮,৭৫০ ইয়েন ও শীতকালীন ভাড়া ১,৪৩,৭৫০ ইয়েন। দীর্ঘদিন থাকতে হলে ভালো রেটে ভাড়া পাওয়া যায়। গ্রীস্মকালীন সময়ে এই ভাড়া ১,৭০,০০০ ইয়েন এবং শীতকালীন ভাড়া ১,৯০,০০০ ইয়েন।

প্রথম দিকে সুইডেনের Dalarna County প্রভিন্সের Leksand এ ঐতিহ্যবাহী Red Wood Houses গুলো তৈরি করা হয়েছিল। এই লাল রঙের সুন্দর বাড়ি গুলো তৈরির দায়িত্বে ছিল জাপানিজ কোম্পানি। পরবর্তীতে তা জাপানে স্থানান্তর করা হয়।

যে কারনে পরবর্তীতে ৪২০ টির ও বেশি চোখ ধাঁধানো আইকনিক ডিজাইনের সুইডিস হাউজ তৈরি হয়।

৩০ বছর আগে সুইডেন হিলের পুরো এরিয়া সুইডিস ভাষা ও ঐতিহ্যের জন্য বিশেষ ভাবে স্থানীয় ও পর্যটকদের কাছে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে।

সুইডেন হিলে পার্ক, টেনিস কোর্ট, সুইডেন হিল গলফ ক্লাব, লসন কনভিনিয়েন্স স্টোর সহ নির্মল বিনোদনের জন্য অনেক কিছু আছে। স্থানীয় জাপানি ও যারা সেখানে বসবাস করে Fika, Midsummer Festival, Lucia, Crayfish Parties সহ নানা রকম সংস্কৃতি ও উৎসব কে উপভোগ করে।

Midsummer Festival শুরু হয় জুন মাসের ২১ তারিখ থেকে। এই সময়ে পুরো সুইডেন হিল সুইডিশ স্টাইলে খাবার, লোকজ সংস্কৃতি প্রদর্শন, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, হ্যান্ড ক্রাফট ও গ্লাস ওয়ার্ক প্রদর্শন করা হয়। আর এই আয়োজনে থাকে সুইডিশ সেন্টার ফাউন্ডেশন। সেখান থেকেই বিভিন্ন উৎসবে সুইডিশ ঐতিহ্যবাহী জিনিস পত্র গুলো কেনা বেঁচা হয়।

আমরা পথে যেতে যেতে গাড়িতে খেয়েছিলাম। এরপর টয়লেটে যাওয়া ও ফ্রেশ হওয়ার জন্য পথে একটা স্টোর ও ক্যাফের মতো দেখতে জায়গায় থামি। পথে পথে একটু থেমে আমরা বিশ্রাম ও গল্প গুজব করি। এতে আমাদের সবারই একঘেয়েমি ভাবটা আর থাকে না। ততোক্ষনে প্রায় দুপুর হওয়ার পথে।

আমাদের পরিকল্পনা ছিল সুইডেন হিলের ভেতরে যে পার্ক ও রেঁস্তোরা আছে সেখানেই মধ্যাহ্ন ভোজ করব। কিন্ত জাপানের কোন একটা হলি ডে ছিল সে সময়টায়। খুব সম্ভবত গোল্ডেন উইক বা অন্য কোন সরকারি ছুটি । বন্ধের কারনে আমরা আর পার্ক ও রেঁস্তোরায় প্রবেশ করতে পারলাম না৷

এদিকে গাড়িতে নিয়ে আসা খাবার ফুরিয়ে গেছে। পেটের ক্ষুধা তো নিবারন করতে হবে। আমাদের গাড়ি তখন সুইডেন হিল এরিয়ায় এগিয়ে যেতে যেতে সুইডিশ হাউজ লেখা নামের একটি বাড়ির কাছে থামল৷ খুব সুন্দর দু'তলা কাঠের বাড়ি। সাইন বোর্ডে জাপানি ও ইংরেজি ভাষায় সুন্দর করে লেখা " Swedish House". আমরা সবাই ঢুকে পড়লাম। দেয়ালে দেয়ালে সুইডেনের নানা রকম ছবি, সুইডিশ স্টাইলে কিচেন, বেড রুম, বেবি বেড রুম, ড্রইং রুম আর নানা রকম আসবাবপত্র। একটা বাড়িতে যা যা থাকে সবই সুইডিশ স্টাইলে আছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম৷ সেই হাউজে আমাদের ছবি তোলা ও ভিডিও করা তো চলছেই।তেমন কাউকে দেখছিলাম না। চিয়ো সান দুষ্টুমি করে ডাকছিল, " কেউ কি আছেন? এই বাড়িতে কেউ কি আছেন?

হঠাৎ একজন মহিলা বের হয়ে এলেন ভুতুরে স্টাইলে। আমরা তো সবাই আৎকে উঠলাম। উনি আমাদের আৎকে উঠা দেখে হেসে ছিলেন। লাল রঙের স্কার্ট পরিহিতা প্রায় ষাট সত্তর বয়স ছুঁই ছুঁই নারীটি এখানকার কেয়ারটেকার ও ম্যানেজার। উনিও আমাদের ভয় পাওয়া দেখে মজা পেলেন। তারপর আন্তরিকভাবে স্বাগত জানালেন।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম ঠিক এমন আসবাবপত্র সহ উন্মুক্ত একটা বাড়ি যদি আমাদের দেশে থাকতো তাহলে মুহুুর্তে সব তছনছ হয়ে যেতো।ভাবা যায় না প্রথম দিকে এতো নিরব ঘন্টা খানিক সময় ধরে আমরা ঘুরাঘুরি করছি অথচ বাইরে কোন মানুষই চোখে পড়েনি।

এতোক্ষণে আমাদের পেটে ক্ষুধা চো চো করছে। তখন সুইডেন হাউজের মহিলা ম্যানেজারের কাছে চিয়ো সান জানতে চাইল একটা ভাল দুপুরে খাওয়ার জন্য কোন রেঁস্তোরা পাওয়া যাবে কিনা।

উনি তাঁর লাল গাড়িটা বের করলেন। আর আমাদের বললেন তার পেছনে পেছনে যেতে। আমার তখন আমেরিকান ভৌতিক ও রহস্যময় সিনেমার কথা মনে পড়ছিল। যদি লাল স্কার্ট পড়া লাল গাড়ি ওয়ালা মহিলা কোন বিপদে ফেলে!আমি হাসতে হাসতে আমার পাশে বসা কেইকো সানকে ইংরেজিতে বলছিলাম। তিনি সহ সবাই হো হো করে হেসে দিল। আর আমাকে আস্থা দিল জাপান দেশটা নিরাপদ। স্বাভাবিকভাবে এদেশে এসব ধরনের ঘটনা তেমন হয়না। তবে ব্যতিক্রম দুই একটা বিষয়ের কথা আলাদা। কেইকো সানের মেয়ে আমেরিকার টেক্সাসে পড়াশুনা করে। তিনি আমেরিকার নানা রকম অভিজ্ঞতার গল্প বলা শুরু করল।

নাহ! দশ পনেরো মিনিটের মধ্যে মনে আসা কথাটা মিথ্যা হল। আমরা কয়েকজন অল্প সময়ের মধ্যে দু'তলা একটা রেঁস্তোরা চোখে দেখতে পেলাম। লাল স্কার্ট পড়া বৃদ্ধা ম্যানেজার মহিলা আমাদেরকে আন্তরিক ভাবে রেঁস্তোরায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন।

সেখানে ঢুকেই যা চোখে পড়েছিল তা হল রেস্তোরাঁয় কোনায় কোনায় বইয়ের তাক ।

যদিও পুরো জাপানে যে কয় জায়গায় ঘুরেছি হোটেল, রেঁস্তোরা, ক্যাফে, স্টোর সব জায়গায় কিছু হলেও বইয়ের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। বুঝা যায় জাপানিরা বই পড়তে ভালোবাসে। বই পড়াও তাদের সংস্কৃতির বড় অংশ। যেকোন বিদেশি পর্যটকেরই এই বিষয়টার দিকে মনোযোগ যাবে। জাপান দেশটা ঘুরে দেখার জন্য সব জায়গায় পর্যটকদের জন্য নানা রকম গাইড বুক ও ম্যাপতো থাকেই। সাথে ম্যাগাজিন ও বই থাকে যাতে তাঁদের সংস্কৃতিটা সবাই সহজেই জেনে নিতে পারে। তাদের দেশের রাস্তাঘাট, আইন কানুন, সংস্কৃতি, নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র সহ সব কিছুর ধারনা বই, ম্যাগাজিন ও গাইড বুকে সহজেই পাওয়া যায়।

আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে মনে মনে ভাবি উন্নত মানুষেরা বই পড়ে । শুধু উন্নত আলোকিত মানুষেরাই বই পড়ে ।

সেখানে আমরা মিৎস্যু স্যুপ, শ্যামন ফিসের কাটলেট, ডিমের পুডিং, চিকেন ফ্রাই, এভি ফ্রাই, ওদন বা নুডুলস, ওনিগিরি, টুনা ফিসের সালাদ সহ নানা পদের জাপানি প্লেট উপভোগ করলাম। আমার জাপানি দাদি চিয়ো সাইতো বরাবরের মতো আমাকে জাপানি প্লেট গুলো সম্পর্কে পরিচয় তুলে ধরল। সেই সাথে তেরুকো সান জাপানের কোন এলাকায় কোন খাবার জনপ্রিয় বলতে লাগলেন। এদিকে রিউহে সাইতো খেতে খেতে একটা ম্যাগাজিন পড়তে শুরু করলেন।সব জায়গায় আমাকে দেখে জাপানিরা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তখন চিয়ো সান জাপানি ভাষায় সুন্দর করে উপস্থাপন করে। সেদিন সেই রেঁস্তোরার নামটা এই মুহুর্তে ভুলে গেছি। কিন্তু সেখানকার মহিলা মালিকটি আমাকে একটা বাঘ আকৃতির শো পিস উপহার দিয়েছিল।

আর বলেছিল তুমি তো রয়েল বেঙ্গলের দেশের মেয়ে তাই তোমাকে দিলাম। তুমি এখানে অতিথি হয়ে এসে আমাদের মনকে মুগ্ধ করেছো। তোমার প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে ভালোবাসা। আমি ভীষণ রকম অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। যা আজীবন মনে থাকবে।

বেশ খানিকটা সুন্দর সময় সেখানে পার করে আমরা আবার সুইডেন হিলের বাকি জায়গা গুলো দেখতে গাড়ি এক জায়গায় রেখে হাটতে লাগলাম। পাহাড়ি টিলা উঁচু জায়গা গুলোতে কি সুন্দর সাজানো বাড়ি গুলো। একটা বাড়ির সামনে এতো সুন্দর ফুল বাগান চোখ অভিভূত হয়ে যায়। আমরা সেখানেই একটু থামলাম।আর বাগানের ফুল গুলো দেখছিলাম। প্রচুর বিচিত্র ধরনের ফুল গাছ, এরমধ্যে ফ্লক্স, গোলাপ, ক্যাকটাস সহ বেশ কিছু ফুলের বিলাসি রূপ চোখে লাগার মতো। এমন কি কুমড়া গাছ ও গাছে ফোটা ফুল ও মনকে মুগ্ধ করছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বেশ লম্বা করে একজন ব্রিটিশ মহিলা এগিয়ে এলেন। তাঁর স্বামী ও একজন ব্রিটিশ ডাক্তার। মহিলা নিজের নাম পরিচয় দিলেন। জানা গেলো তাঁর নাম জায়মা সারাহ। দুই সন্তান নিয়ে সুইডেন হিলে বাড়ি কিনে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। তাঁরা স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই পেশায় ডাক্তার। অনেক বছর আগে এখানে সেচ্ছাসেবক হয়ে এসেছিলেন চিকিৎসা দিতে। তারপর জাপানের সুইডেন হিলের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েন।

সেই থেকে এই দম্পতি সন্তানদের নিয়ে এখানেই ভালোবাসার বসতি গড়েছেন। প্রায় ৫৫৬ টির বেশি স্থায়ী পরিবার আছে যারা এখানে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। অধিকাংশ বাড়ি গুলো কোম্পানির৷ আওতায় ডিজাইন করা ও কেনাবেঁচা হয়। অনেকক্ষণ জায়মা সারাহর সাথে সুইডেন হিলের জীবন নিয়ে গল্প গুজব হল।

এরপর আরও কিছুটা সময় চারপাশের সবুজ প্রকৃতি আর নানা রকম শৈল্পিক স্থাপত্য দেখতে দেখতে বাড়ির পথে রওয়ানা হলাম।গাড়ি থেকে যে দিকে চোখ বিস্তৃত হয়েছে শুধু মুগ্ধতায় বিস্মিত হয়েছে।

তারপর হৃদয়ের মনিকোঠায় একটা সুন্দর নিভৃত গ্রাম সুইডেন হিল আজীবনের সমৃদ্ধ স্মৃতি হয়ে রইল।যা সব সময় মুগ্ধকর অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রাখে।




ইউটিউবে দেখতে লিংকে ক্লিক করুন
https://www.youtube.com/watch?v=a-k75BRA5UM


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৪:৪০
১১টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×