দশ তলার এই এপার্টমেন্ট থেকে লাফিয়ে পড়লে কেমন লাগবে? থেঁতলে যাবো? ব্যথা কেমন পাবো? ব্যথার অনুমান করতে পারলাম না। তবে এই অনুমান করতে পারলাম একটা সাময়িক যন্ত্রণা আমাকে একটা তীব্র প্রচণ্ড স্থায়ী যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিবে।
আমি কি চিরস্থায়ী মুক্তির উদ্দ্যেশে পা বাড়াবো...............???
টানা এক সপ্তাহ ঘুমের কোন সমস্যা হয় নি। খুবই শান্তিতে ১২ টা থেকে ১২-৩০ এর মধ্যেই ঘুমের জন্য চোখ মেলে রাখতে পারতাম না। আনন্দিত অনুভব করলাম অবশেষে ২বছর পর ঘুম আমার কাছে ধরা দিলো। কিন্তু না হল না, ঘুম আমার কাছে কারাবন্দী হয়ে বেশি দিন থাকল না। পারলাম না আমার একসময়ের অতি প্রিয় ঘুমকে ধরে রাখতে। যেমন কোন কিছুই বা কাউকেই আমি ধরে রাখতে পারি না। ঘুম নামক একটা জিনিশ যে আছে, তা জানান দেওয়ার জন্য কয়েকদিনের জন্য এসেছিলো।
সময় এখন মনে হয় ৩ টা। প্রতি রাতে এই সময় একটা বাচ্চা খুবই কুৎসিত ভাবে কেঁদে উঠে। ইচ্ছে করে গলাটা টিপে ধরি। আর এই সময় শুরু হয় আরও বিকট চিৎকার। “সেহেরীর সময় হয়ে গেছে, মুছলমান ভাই বোনেরা উঠে পড়েন” পৃথিবীর এমন কোন গালি নাই যা দিতে ইচ্ছে করে না।
২ ঘণ্টা ধরে বিছানায় গড়াচ্ছি। একটু যদি তন্দ্রাও আসতো!
বারান্দায় গিয়ে বসলাম। আন্ধকার ছিল আশেপাশে। আস্তে আস্তে প্রায় সব জানালায় আলোর আনাগোনা দেখা দিলো। চাঁদের আলোটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেলো। যেন খুবই বিষণ্ণ ভাবে জেগে আছে, অহেতুক ভাবে আলো দিতে চাচ্ছে। কিন্তু কারো সেই আলোর প্রয়োজন নেই। আমার ও দেখতে ইচ্ছে করলো না। বিরক্ত লাগে সব কিছু, বিরক্ত লাগে প্রকৃতির সব বিস্ময়কর সৃষ্টি। যেমন বিরক্ত লাগে আমার এই বিস্ময়কর জীবন। অহেতুক বেঁচে থাকা, অহেতুক নিঃশ্বাস নেওয়া, অহেতুক সকাল থেকে রাত গড়ানো।
হঠাৎ মনে হলো আমি বেঁচে থাকার একটা কারণ খুজচ্ছি। বেঁচে থাকার জন্য কি একটা কারণ প্রয়োজন? খুব ভালো ভাবে বুঝে গেছি আমার বেঁচে থাকাটা সম্পূর্ণ ভাবে অত্যন্ত শোচনীয় পর্যায়ের নিরর্থক। আমি যদি আজ রাতে মরে যাই কি হবে তাতে? পৃথিবীর কোথাও কি কোন পরিবর্তন হবে? কোথায় কি কোন কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে? হাহাকার জেগে উঠবে কোথায়? শূন্যতা বোধ করবে কেউ আমার জন্য? কেউ কি আমার অভাব বোধ করবে? কেউ কি মনে করবে আমি ছিলাম একসময়?
না কেউ করবে না। হয়তো আমার বাবা মা কাঁদবে আমার জন্য কিছু দিন, তারপর আবার সব স্বাভাবিক। ঠিকই সকালে সূর্য উঠবে, মানুষ নিজ নিজ কাজে সীমাহীন ভাবে ব্যস্ত থাকবে, রাতে চাঁদ উঠবে, ক্লান্ত ভাবে তার ম্রিয়মাণ দুর্দান্ত সাদাটে শীতল আলো ছড়াবে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়বে।
তাহলে একটু না থেকে দেখি না। হাস্যকর... না থাকলে যদি দেখা যেতো ... কিন্তু এ তো হবার নয়। একবার না থাকা মানে আর কখনো না থাকা। কিছুই জানবো না বুঝবো না দেখবো না শুনবো না। কিন্তু এখন যে দেখছি জানছি বুঝছি তাতে কি হচ্ছে। এই যে দিনের পর দিন একই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি তাতো কখনও শেষ হবার নয়। একটা নিঃসঙ্গ শোচনীয় কুৎসিত বীভৎস আজীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির চেয়ে যে ভয়াবহ জীবনটাকে বয়ে বেড়াচ্ছি তাতে আমি ছাড়া আর তো কেউ জ্বলছে না। কেউ তো যন্ত্রণার আগুনে দগ্ধ হচ্ছে না। বয়স আমার কতো হবে, ২৩ বা ২৪। কিন্তু মানুষিক ভাবে তো মনে হচ্ছে আমি ৮০ পেরিয়ে গেছি। যেখানে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু নেই। যেখানে অতীত মনে করা ছাড়া আর কিছুই নেই। যেখানে সময় কাটানো মানে কিছু অপূর্ব চমৎকার অতুলনীয় এবং পচে গলে যাওয়া কিছু দুর্বিষহ স্মৃতি মন্থন করা। এমনই এক সময়ে পৌঁছলাম যেখানে বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ মনে হচ্ছে। যেখানে মনে হচ্ছে “অনেক তো বাঁচলাম, অনেক তো সহ্য করলাম, অনেক তো ভেঙে চুড়ে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছি, আর কতো” প্রতিনিয়ত আঘাত সহ্য করা ছাড়া তো এই জীবনে কিছুই অবিশিষ্ট নেই।
আমার জন্ম কি হয়েছিলো শুধু সহ্য করে যাওয়ার জন্য? এতই কি দুর্বল হয়ে জন্মেছিলাম যে কোন আঘাতের প্রতিউত্তর দিতে পারি নি? প্রতিটি আঘাতের একমাত্র সমাধান ছিল কি শুধুই সহ্য করে যাওয়া? একটা ছুরির আঘাতের পর নিজেকে তৈরি করা আরেকটা চাপাতির আঘাতের জন্য।
পাশের বাসায় কেউ যেন খুব মিষ্টি গলায় গান গাচ্ছে। কিছুটা চমকে উঠলাম এমন সময় কেউ গান গাচ্ছে। সুন্দর মিষ্টি গলা। কিন্তু শুধু আওয়াজই শুনছি, যে গাচ্ছে তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। হিংসা বোধ করলাম। কিছুটা রাগে কেঁপে উঠলাম। এই সুর যার গলা থেকে বের হচ্ছে তাঁকে খুব সুখী মনে হচ্ছে। আমার গলা দিয়ে তো এমন সুখ বের হয় না। পৃথিবীর সবাই কি সুখী আমি ছাড়া ? সবাই কি রাতে খুব শান্তিতে ঘুমায়? কেউ কি নির্ঘুম থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে না? আমার আসে পাশে এতো মানুষের বসবাস তাঁরা সবাই কি সুখী? সবাই নির্ভাবনায় দিন অতিবাহিত করে? নিশ্চিন্তে ঘুমায়? হয়তো , হয়তো না।
পাশের বাসার এই সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী যিনি তিনি কি জানেন কেমন লাগে যখন কাউকে তীব্র ভাবে ভালোবেসে বিনিময়ে ছিটেফোঁটা ভালো ব্যবহারও না পাওয়া? তিনি কি জানেন কেমন লাগে দিনের পর দিন প্রিয়তম মানুষের মুখ থেকে শুনা তাঁর নতুন নতুন প্রেমের কথা? কেমন লাগে যখন খুব নিষ্ঠুর ভাবে প্রিয়তম মুখের উপর বলে দেয় “তুমি বাঁচো মর , আমার কিছু যায় আসে না” কেমন লাগে যখন প্রিয়তম বলে “ বিছানায় সে খুব চমৎকার”।
সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী এই মানুষটা কি জানেন কেমন লাগে যখন চোখের সামনে প্রিয়তমকে কারো সাথে বিছানায় দেখি???
সেই প্রিয়তম, যার জন্য পৃথিবীর সব চেয়ে করুণ নিষ্ঠুর নিকৃষ্ট বীভৎস অত্যাচার সহ্য করেছি। সেই প্রিয়তম , যে কারো সাথে বিছানা থেকে উঠে ফোন করে আমাকে বলে “কেমন আছো, আজকে কার সাথে ডেটিং করছো” । আর আমি হেসে জবাব দেই “ তুমি ছাড়া আমি কারো সাথে কিছুই করি না, এই আমি, মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার থাকবো”
বাচ্চার চিৎকার থেমে গেলো। সুরেলা কণ্ঠও থেমে গেলো। আমি বারান্দার রেলিঙে উঠে দাঁড়ালাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:৫৯