somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি হাসিমুখের প্রস্থান...

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রোগী দেখে শীতের বিকেলে ফিরছিলাম বাসে করে। কিন্তু কেন যেন আজ কানে এয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে মন চাচ্ছিল না। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমাতেও ইচ্ছে করছিল না। শূন্য দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। একে একে মনে পড়ছিল আজ দুপুরে আইসিইউতে দেখে আসা দৃশ্যটা। সবার প্রিয় মানুষটাকে ধরে রাখার কী আপ্রাণ চেষ্টা! সেইসাথে তাঁর সেই হাসিমুখ, অসম্ভব স্মার্ট সেই কথা বলার ভঙ্গী, গ্যালারিভর্তি ছাত্রদের প্রতিটি নিউরনে অনুরণন তৈরি করা সেই পারভিন ম্যাডাম!
ডাঃ পারভিন সহিদা খানম, একজন সফল ডাক্তার, একজন শত সহস্র প্রাণের প্রিয়মুখ, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে যাওয়া একজন অসামান্য নারী! ২০১২ সালের ৬ই আগস্ট সামুতে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলাম ম্যাডামের অসুখ নিয়ে। অসংখ্যবার পঠিত সেই লেখায় অসংখ্য লাইক ও কমেন্ট পড়েছিল। আমাদের পাশাপাশি অনেক মানুষ ম্যাডামের পাশে এসে দাঁড়ানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। আমরা ম্যাডামের ছাত্ররা ও বর্তমান ইন্টার্ন ডাক্তাররা আমাদের বেতনের সামান্য একটি অংশ দিয়ে তাঁর ব্যয়বহুল ক্যান্সার চিকিৎসায় পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, আমাদের সাথে দাঁড়িয়েছিলেন অন্যান্য প্রফেসর ও নর্থ ইস্ট মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্ররা। ম্যাডাম আমাদের সবাইকে তখন শুধুমাত্র দোয়া করতে বলেন এবং টাকাগুলো ফিরিয়ে দেন। এরপর ম্যাডামকে প্রায়ই দেখতাম হাসপাতালে। শুনতাম এত অসুস্থতার মাঝেও তিনি নিয়মিত ক্লাস নেন, চেম্বারে রোগী দেখেন। অবাক হতাম একটা মানুষ এত জীবনীশক্তি নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল! শেষবার যখন আমার বান্ধবীকে নিয়ে ম্যাডামের কাছে যাই তখন উনি আমাদের বলেছিলেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ভ্যাকসিন নেবার কথা। আমাদের হাসপাতালে এই নিয়ে একটা ক্যাম্পেইন করার কথা বলছিলেন তিনি। এমনই একটা মানুষ ছিলেন তিনি। শুধু নিজের কথাই ভাবেননি, অন্যদের মধ্যেও সচেতনতা জাগানোর চেষ্টা করে গেছেন সবসময়। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম তাঁর কথা। আম্মা এবার হজ্বে যাবার সময় বারবার বলে দিচ্ছিলাম তাঁর কথা। আমার আম্মাও কথা রেখেছিলেন, দোয়া করেছিলেন সেই পবিত্রে স্থানে এই চমৎকার মানুষটির জন্যে, আলাদা করে তাঁর জন্যে জমজমের পানি ও আজোয়া খেজুর নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের তাঁর জন্যে আর কিছুই করার ছিলনা, মন থেকে প্রার্থনা করা ছাড়া। শেষ মূহুর্তে ম্যাডাম যখন আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে তাঁকে দেখে ভীষণ আক্ষেপে আমার বান্ধবীকে বলেছিলাম, এত মানুষের দোয়া কই যায়! ও তখন বলেছিল, এই জীবনই তো সব নয়। আমার অশান্ত মন সেদিন থেকেই সান্ত্বনা খুঁজে নিয়েছিল, অনেক ভাল অনেক সুন্দর কিছুই এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে নয়, অনন্ত জীবনে তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু মেনে নিতে পারছিলাম না। আজ যখন অবস্থা খারাপ শুনে ম্যাডামকে দেখতে গেলাম তখন তাঁকে CPR(Cardio-pulmonary resuscitation) দেয়া হচ্ছিল। বারবার মনিটরে চোখ চলে যাচ্ছিল, অবচেতন মনেই আশা করছিলাম এই বুঝি ‘0’ এর বদলে স্বাভাবিক Heart rate দেখতে পাব! এই বুঝি Flat lineগুলো আঁকাবাঁকা হয়ে উঠবে! এই বুঝি ম্যাডাম চোখ মেলে তাকাবেন! ৯ বছর আগে এমনভাবেই আশা নিয়ে বসে ছিলাম বাবার যাওয়ার সময়টাতে। কিন্তু যে চলে যাবার তাকে কেউ ঠেকাতে পারেনা।
উনি চলে গেছেন, এই অনুভূতির চেয়েও আমার ভেতরে যে ভয়াবহ অনুভূতি কাজ করছে তা হলো উনি আর আসবেন না। আমার চোখ প্রতিদিন পারভিন ম্যাডামের সেই হাসিমুখ খুঁজে যাবে। প্রতিবার শিশু ক্লিনিকের সামনে তাঁর চেম্বারের সাইনবোর্ড দেখে যাব। একদিন এই সাইনবোর্ডও নেমে যাবে, হয়তো ঐখানে অন্য কোন ডাক্তার বসবেন, তবু খুঁজে যাব তাঁকে কারণ চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়।
ম্যাডামকে নিয়ে আমার আগের ব্লগে লিখেছিলাম, ইট-কাঠ-পাথরের এই যান্ত্রিক জীবনে বড়ই প্রয়োজন একটি হাসিমুখের, কিছু সুন্দর কথার। আজ মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীটা বড় খারাপ জায়গা। তাই বুঝি বিধাতা ভাল মানুষগুলোকে খুব তাড়াতাড়ি নিজের কাছে টেনে নেন। পারভিন ম্যাডাম তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের ছেলেমেয়ের মত ভাবতেন এবং এদের মধ্যেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস তাঁর ছেলেমেয়েদের মনে তিনি আমৃত্যু বেঁচে থাকবেন কারণ সন্তানেরা কখনও মাকে ভুলতে পারেনা আর পারভিন ম্যাডাম তেমনই একজন মা ছিলেন। জীবনের সবটুকু পুণ্যের বিনিময়ে এক সন্তানের তাঁর জন্যে প্রার্থনা, মৃত্যুর ওপারে যে জীবন তা যেন তাঁর জন্যে সর্বসুন্দর হয়।

আগের পোস্টঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:১৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×