রোগী দেখে শীতের বিকেলে ফিরছিলাম বাসে করে। কিন্তু কেন যেন আজ কানে এয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে মন চাচ্ছিল না। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমাতেও ইচ্ছে করছিল না। শূন্য দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। একে একে মনে পড়ছিল আজ দুপুরে আইসিইউতে দেখে আসা দৃশ্যটা। সবার প্রিয় মানুষটাকে ধরে রাখার কী আপ্রাণ চেষ্টা! সেইসাথে তাঁর সেই হাসিমুখ, অসম্ভব স্মার্ট সেই কথা বলার ভঙ্গী, গ্যালারিভর্তি ছাত্রদের প্রতিটি নিউরনে অনুরণন তৈরি করা সেই পারভিন ম্যাডাম!
ডাঃ পারভিন সহিদা খানম, একজন সফল ডাক্তার, একজন শত সহস্র প্রাণের প্রিয়মুখ, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে যাওয়া একজন অসামান্য নারী! ২০১২ সালের ৬ই আগস্ট সামুতে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলাম ম্যাডামের অসুখ নিয়ে। অসংখ্যবার পঠিত সেই লেখায় অসংখ্য লাইক ও কমেন্ট পড়েছিল। আমাদের পাশাপাশি অনেক মানুষ ম্যাডামের পাশে এসে দাঁড়ানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। আমরা ম্যাডামের ছাত্ররা ও বর্তমান ইন্টার্ন ডাক্তাররা আমাদের বেতনের সামান্য একটি অংশ দিয়ে তাঁর ব্যয়বহুল ক্যান্সার চিকিৎসায় পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, আমাদের সাথে দাঁড়িয়েছিলেন অন্যান্য প্রফেসর ও নর্থ ইস্ট মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্ররা। ম্যাডাম আমাদের সবাইকে তখন শুধুমাত্র দোয়া করতে বলেন এবং টাকাগুলো ফিরিয়ে দেন। এরপর ম্যাডামকে প্রায়ই দেখতাম হাসপাতালে। শুনতাম এত অসুস্থতার মাঝেও তিনি নিয়মিত ক্লাস নেন, চেম্বারে রোগী দেখেন। অবাক হতাম একটা মানুষ এত জীবনীশক্তি নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল! শেষবার যখন আমার বান্ধবীকে নিয়ে ম্যাডামের কাছে যাই তখন উনি আমাদের বলেছিলেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ভ্যাকসিন নেবার কথা। আমাদের হাসপাতালে এই নিয়ে একটা ক্যাম্পেইন করার কথা বলছিলেন তিনি। এমনই একটা মানুষ ছিলেন তিনি। শুধু নিজের কথাই ভাবেননি, অন্যদের মধ্যেও সচেতনতা জাগানোর চেষ্টা করে গেছেন সবসময়। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম তাঁর কথা। আম্মা এবার হজ্বে যাবার সময় বারবার বলে দিচ্ছিলাম তাঁর কথা। আমার আম্মাও কথা রেখেছিলেন, দোয়া করেছিলেন সেই পবিত্রে স্থানে এই চমৎকার মানুষটির জন্যে, আলাদা করে তাঁর জন্যে জমজমের পানি ও আজোয়া খেজুর নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের তাঁর জন্যে আর কিছুই করার ছিলনা, মন থেকে প্রার্থনা করা ছাড়া। শেষ মূহুর্তে ম্যাডাম যখন আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে তাঁকে দেখে ভীষণ আক্ষেপে আমার বান্ধবীকে বলেছিলাম, এত মানুষের দোয়া কই যায়! ও তখন বলেছিল, এই জীবনই তো সব নয়। আমার অশান্ত মন সেদিন থেকেই সান্ত্বনা খুঁজে নিয়েছিল, অনেক ভাল অনেক সুন্দর কিছুই এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে নয়, অনন্ত জীবনে তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু মেনে নিতে পারছিলাম না। আজ যখন অবস্থা খারাপ শুনে ম্যাডামকে দেখতে গেলাম তখন তাঁকে CPR(Cardio-pulmonary resuscitation) দেয়া হচ্ছিল। বারবার মনিটরে চোখ চলে যাচ্ছিল, অবচেতন মনেই আশা করছিলাম এই বুঝি ‘0’ এর বদলে স্বাভাবিক Heart rate দেখতে পাব! এই বুঝি Flat lineগুলো আঁকাবাঁকা হয়ে উঠবে! এই বুঝি ম্যাডাম চোখ মেলে তাকাবেন! ৯ বছর আগে এমনভাবেই আশা নিয়ে বসে ছিলাম বাবার যাওয়ার সময়টাতে। কিন্তু যে চলে যাবার তাকে কেউ ঠেকাতে পারেনা।
উনি চলে গেছেন, এই অনুভূতির চেয়েও আমার ভেতরে যে ভয়াবহ অনুভূতি কাজ করছে তা হলো উনি আর আসবেন না। আমার চোখ প্রতিদিন পারভিন ম্যাডামের সেই হাসিমুখ খুঁজে যাবে। প্রতিবার শিশু ক্লিনিকের সামনে তাঁর চেম্বারের সাইনবোর্ড দেখে যাব। একদিন এই সাইনবোর্ডও নেমে যাবে, হয়তো ঐখানে অন্য কোন ডাক্তার বসবেন, তবু খুঁজে যাব তাঁকে কারণ চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়।
ম্যাডামকে নিয়ে আমার আগের ব্লগে লিখেছিলাম, ইট-কাঠ-পাথরের এই যান্ত্রিক জীবনে বড়ই প্রয়োজন একটি হাসিমুখের, কিছু সুন্দর কথার। আজ মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীটা বড় খারাপ জায়গা। তাই বুঝি বিধাতা ভাল মানুষগুলোকে খুব তাড়াতাড়ি নিজের কাছে টেনে নেন। পারভিন ম্যাডাম তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের ছেলেমেয়ের মত ভাবতেন এবং এদের মধ্যেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস তাঁর ছেলেমেয়েদের মনে তিনি আমৃত্যু বেঁচে থাকবেন কারণ সন্তানেরা কখনও মাকে ভুলতে পারেনা আর পারভিন ম্যাডাম তেমনই একজন মা ছিলেন। জীবনের সবটুকু পুণ্যের বিনিময়ে এক সন্তানের তাঁর জন্যে প্রার্থনা, মৃত্যুর ওপারে যে জীবন তা যেন তাঁর জন্যে সর্বসুন্দর হয়।
আগের পোস্টঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:১৫