খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। প্রতি মাসের শুরুতে যেদিন ব্যাংকে বেতন দিতে যেতাম সারাদিন কিছুই ভাল লাগতনা। বৃত্তির সুবাদে স্কুল কলেজে বেতন দিতে হয়নি। প্রাইভেট মেডিকেলের সেই বেতন দেয়ার দিনগুলো কবে শেষ হবে অপেক্ষায় থাকতাম। বাবার অবর্তমানে মায়ের প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস বড় বুকে লাগত। পাস করলাম, চাকরি হল। আজ সেই বেতন দেয়ার যন্ত্রণা নেই কিন্তু বদলির জন্যে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয় প্রতি নিয়ত।
এ গল্প আমার একার নয়। আমার মত অনেক বাবাহীন মধ্যবিত্ত ডাক্তারের জীবনের গল্প যাদের শৈশবের রুপকথা কৈশোরের কঠিন বাস্তবতায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। উচ্ছল যৌবন দায়িত্বের ভীড়ে বার্ধক্যের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল।
দীর্ঘদিনের উচ্চরক্তচাপ ও ডায়বেটিসে ভোগা বাবা নিজের বেখেয়ালেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আর আমি প্রতিদিন অগণিত বাবার রক্তচাপ, রক্তের সুগার ফলো আপ করি। আমার অসুস্থ নিঃসঙ্গ মাকে ঘরে একা রেখে আমি হাসপাতালে অসংখ্য মায়ের সেবা করি দিনে রাতে। দিনের পর দিন দুই বোনের সুখ-দুঃখের গল্প হয়না। অথচ প্রতিদিন সময় কেটে যায় কত সংসারের নিত্যদিনের কাহিনী শুনে। বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে আড্ডা মেরে কাটিয়ে দেয়ার দিনগুলো হারিয়ে গেছে সেই কবে! পড়ে থাকে ইনবক্সে, হোয়াটসএপে তাদের মেসেজ, ফেসবুক নোটিফিকেশন। রিপ্লাই দেয়া হয়না সময়ের অভাবে। অথচ প্রতিদিন ফোনে অনেক চিকিৎসা, পরামর্শ দিয়ে যাই কথায় কিংবা টেক্সটে। সবাই যখন ঘুমের দেশে আমি তখন কোন মৃতপ্রায় রোগীর জীবনের আলো জ্বালাতে কিংবা কোন নতুন জীবনকে পৃথিবীর আলো দেখাতে নির্ঘুম রাত পার করে দিই। সবাই বলে হাসপাতালে খুব দুর্গন্ধ! আর এর মধ্যেই খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। সবাই বলে হাসপাতাল ভীষণ ভয়ের জায়গা! আর এই ভয়ের জায়গাকেই বসত বাড়ি করে নিয়েছি।
সাধারণ জীবনের বাইরে দুই ধরণের জীবন আছে, উত্তম ও অধম। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে মনে হয় শেষেরটাই অধিকতর শ্রেয়। তাই ডাক্তারদের অভিধানে মহাপুরুষ বলে কোন শব্দ নেই, আছে লোভী, আছে কসাই!
আমি একজন লোভী ডাক্তার!
আমি একজন কসাই!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:৫৩