অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আমার মনে প্রায়ই নানাধরনের অদ্ভুত সব ইচ্ছে জাগে। তাও চলে কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র ভেদে যখন সেই ইচ্ছেগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন আর আমার কোন হুঁশজ্ঞান থাকেনা,বলতে গেলে মরিয়া হয়ে উঠি সেই অবাস্তুব ইচ্ছাটাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য। বড় অদ্ভুত এ আমি, আর তার চেয়েও অদ্ভুত আমার এই ইচ্ছেগুলো। এই যেমন এখন আমার ইচ্ছে হয়েছে দুচোখ যেদিকে যায় হারিয়ে যাওয়ার। হুমম, হারিয়ে যাবো আমি, সত্যি সত্যি হারিয়ে যাবো।
কি? ভাবছেন সুইসাইড করবো?? আররে না। আমি এতোটা ভীতু নই যে জীবন থেকে পালিয়ে যাবো, আমি শুধু হারিয়ে যাবো। কেন? তার প্রথম কারন আজ সকালে অভ্রর সাথে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছে। এবং বলতে গেলে প্রায় সব দোষই সে আমার ঘাড়ে চাপিয়েছে। আমি বলছিনা যে আমার কোন দোষ নেই, দোষ আমার অবশ্যই আছে। এক হাতে তো আর তালি বাজে না। কিন্তু ও ও তো কম যায় না। অভ্র দোষটা স্বীকার করে নিলেই তো আমি আর কিছু বলতাম না। কিন্তু যখন দেখলাম ও আমাকেই একটানা দোষ দিয়ে যাচ্ছে তখন আমিও আর চুপ থাকতে পারিনি। এতোগুলো বছরের জমে থাকা সমস্ত অভিযোগ একসাথে উগড়ে দিয়েছি। এতো ভালোবাসলাম যাকে সেই যদি বুঝতে না পারে, তাহলে কি লাভ ভালোবেসে। তাই হারিয়ে যাবো। আমিও দেখবো আমাকে ছাড়া ও কেমন করে থাকে। ও যদি আমাকে ছাড়া থাকতে পারে তাহলে আমিও পারবো।
মন-মেজাজ এমনিতেই খারাপ। তাই বাসায় এসে মুখ গোমড়া করে নিজের রুমে বসেছিলাম। আম্মু এসে দেখলো মুখটা পাতিলের তলার মতো কালো করে বসে আছি আমি। কারন জানতে চাইতেই আমার মনের আকাশে জমে থাকা কালো মেঘ থেকে অবিরাম বর্ষন শুরু হলো। আম্মু তো দেখে পুরো হাঁ হয়ে গেলো। অতঃপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করার পালা। যদিও আমাদের ফ্যামিলিতে আব্বু-আম্মুর ছেলে-মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই, তবুও ছেলে বা মেয়ে যাকে পছন্দ করে তার যদি কোন দোষ খুঁজে পায় তখন আর কথা শোনাতে ছাড়ে না। তাই নিয়ম মোতাবেক আমাকেও শত-সহস্র বানী হজম করতে হলো। যার ফলাফলস্বরূপ হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা আরো বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঠিক করেছি কাল সকালে ক্লাস শেষে আর বাসায় ফিরবো না। তাই শেষবারের মতো আব্বু-আম্মুকে দেখার জন্য পা টিপে টিপে আব্বু-আম্মুর রুমে গেলাম, পাছে ঘুম ভেঙ্গে যায়। অঘো্রেই ঘুমুচ্ছে দুজনে আর আমি অবাক নয়নে চেয়ে আছি সেই প্রিয় মুখদুটোর দিকে। চোখের কোল বেয়ে দু-ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু পরক্ষণেই সন্ধ্যার ঘটনার কথা মনে পড়তেই আবার কঠোর হয়ে গেলাম। নাহ, আর নয় যারা আমাকে একটুও বোঝেনা, একটুও ভালোবাসে না, কেন তাদের সাথে থাকবো আমি। চলেই যাবো আমি, যেদিকে দুচোখ যায়।
ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ মেলে দেখি আম্মু পাশে বসে আছে। চোখের কোনে চিকচিক করছে নোনা জল। আমি অবাক হয়ে যাই। কি ব্যাপার আম্মু এতো সকালে আমার পাশে বসে কাঁদছে কেন? নিশ্চয়ই কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছে আমাকে নিয়ে। আম্মুটাও না বড্ড সেকেলে। হঠাৎ আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সবকিছু অচেনা লাগছে। আররে এটা তো আমার রুম না। কোথায় আমি? আমার কি স্মৃতিশক্তি লোপ পেলো নাকি সিনেমার মতো!
“আমি কোথায় আম্মু? এটা তো আমার রুম না।”
“হসপিটালে।”
কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাই আমি। চোখ আটকে যায় দরজায়। আব্বু আর অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
আজকে যেন আমার অবাক হওয়ার দিন। রুমে ঢুকেই আব্বু ছুটে আসে আমার কাছে।
“কেমন আছিস, মা? ভালো লাগছে এখন? কি দুশ্চিন্তায় ফেলে দিলি বল তো? আমি তো ভয়ে...”, বলেই আব্বু ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। আমার একুশ বছরের জীবনে এই প্রথম আমি আব্বুকে কাঁদতে দেখলাম। আম্মুর দিকে তাকিয়ে দেখি চোখের কোলে এখনো জল জমে আছে কিন্তু ঠোটে ফুটে উঠেছে এক চিলতে হাসি।
কিছুক্ষন পর ডাক্তার এসে চেক-আপ করে বলে যে আমি পুরোপুরি সুস্থ এখন। শুনে সবার মুখে নিশ্চিন্ত হাসি ফুটে উঠে। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলতে আব্বু বেরিয়ে যায়। আম্মুও যেন অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বলে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। এতোক্ষনে আমার মনে পড়ে যে এখানে আরো একজন আছে। অভ্রর দিকে তাকাতেই দেখি ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যেন নিজের সাথে সাথে আমার সব দোষও ও মাথা পেতে নিয়েছে।
“কি হল? ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে অভ্র। আলতো করে আমার হাতটা ধরে।
“আম স্যরি। কথা দিচ্ছি আর কক্ষনো এমন হবে না। বিশ্বাস করো। শুধু কথা দাও আর কক্ষনো আমাকে ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাববেনা। কক্ষনো না।“
এ কি! এ কথা অভ্র জানলো কি করে? আমি তো একবারের জন্যও ওকে বলিনি আমার প্ল্যানের কথা। আর কতো অবাক যে হতে হবে আজ আল্লাহ জানে।
“আচ্ছা কি হয়েছে বলো তো? আমি না কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।“
কেন? তুমি জানোনা? কিচ্ছু মনে নেই তোমার?” অবাক হয়ে যায় অভ্র।
“না তো।”
“ও। সেদিন তোমার সাথে কথা-কাটাকাটি হওয়ার পর বাসায় গিয়ে আমার মনটা ভীষন খারাপ ছিল। ফোনে তোমাকে অনেকবার ট্রাই করেছি। কিন্তু তুমি ফোন সুইচড অফ করে রেখেছিলে। তাই বাধ্য হয়ে মেসেজ দিয়েছিলাম, যাতে এটলিস্ট ফোনটা অন করলে বুঝতে পারো। কিন্তু তোমার আর কোন খোঁজ-খবর নেই। ভাবলাম ক্লাসে তো আসছোই তখন না হয় কথা বলবো। যখন দেখলাম ক্লাসেও আসার কোন পাত্তা নেই তখন বাধ্য হয়ে তোমার বাসার নম্বরে ফোন করলাম। তোমার ভাই বললো তুমি হসপিটালে। রাতে তোমার ভীষন জ্বর এসেছে। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছিলে। সেন্স বলতে গেলে প্রায় নেই-ই। খবর পেয়ে আমি চলে আসলাম হসপিটালে। এসে দেখি আন্টি ভীষন কান্নাকাটি করছে। আঙ্কেলও পুরো চুপচাপ। আমাকে দেখে আন্টি আরো বেশি কান্নাকাটি শুরু করলো। আমি তো ভয়েই মরে যাচ্ছিলাম। কি যে দুর্বিষহ দুটো দিন কেটেছে আমাদের। বলার মতো না। নাওয়া-খাওয়া-ঘুম সব উধাও হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর আজ দুদিন পর তোমার জ্ঞান ফিরলো। এরপরে তো সবকিছু তুমি জানোই।“
সব শুনে কয়েকমুহুর্তের জন্য আমার মস্তিষ্ক যেন পুরো শব্দহীন হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে আমি যেন কথা বলতেই ভুলে গেছি। আম্মুকে রুমে ঢুকতে দেখে একটা একটা করে শব্দ খুঁজে পেতে শুরু করলাম।
“বাসায় যাবো কখন আম্মু?”
“এইতো বিকেলে ডাক্তার এসে চেক-আপ করবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে রিলিজ দিয়ে দিবে বলেছে।“
“ও।“
আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অভ্রর সাথে কথা বলতে থাকে আম্মু। কিছুক্ষন পর আব্বুও এসে যোগ দেয় সেই কথারূপী আড্ডায়। আমি দেখতে থাকি আর ভাবতে থাকি আমার সেই প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে যাদেরকে অনেক ভালোবাসা যায়, ভালোবেসে গাল ফুলিয়ে অভিমানও করা যায় কিন্তু তাদের ফেলে ভুলেও কখনো হারিয়ে যাওয়া যায় না.....
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:০১