somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

| | ছায়াবিথী | |

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অন্যান্যদিনের মতোই আজোও ছোট্ট মেয়েটা দৌড়ে দোকানে যায়। বাড়ির খাবারের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, যত আগ্রহ তার, সব ঐ বাইরের হাবিজাবি জিনিসের উপর।

বিথী, ছয় পেরিয়ে সদ্য সাতে পা রেখেছে সে। অসম্ভবরকমের চঞ্চল আর মিষ্টি ফুটফুটে এই মেয়েটাকে পুরো এলাকায় সবাই এক নামেই চেনে। আর তা হলো দুষ্টের শিরোমনি লঙ্কার রানী। বলতে গেলে জন্মের পর থেকেই এই এলাকায় বড় হয়েছে বিথী। তাই এখানকার অলিগলি, মানুষজন, আকাশ-বাতাস সবকিছুই তার ঠোটস্থ।

স্কুল ছুটি হওয়ার পর থেকে মাগরিবের আযান পর্যন্ত পুরো এলাকা দাপিয়ে বেড়ায় সে। সন্ধ্যা হলে ওর মা ওকে ডাকতে ডাকতে প্রায়ই তিনতলা থেকে মাঠে নেমে আসে তবুও ওর বাড়ি ফেরার কোন পাত্তা থাকেনা।

বিথীদের বাসার সামনে বাদশা মিয়ার ছোট্ট এক দোকান। সেও এই এলাকারই একজন। বিথীকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে সে। চকোলেট, চিপস থেকে শুরু করে ঘরের টুকিটাকি যা যা জিনিস লাগে বিথী একদৌড়ে গিয়ে বাদশা মিয়ার দোকান থেকে নিয়ে আসে। আর পরে তার বাবা সেই টাকা দিয়ে দেয়। লাল-নীল-সবুজ রঙের সুইট বল বিথীর দারুন প্রিয়। প্রায়ই তার হাতে দিয়াশলাই এর প্যাকেটের আকৃতির সুইট বলের প্যাকেট দেখা যায়। আজোও বিথী তার প্রিয় সুইট বলই কিনতে গেছে দোকানে।

দোকানে অনেক মানুষ-জন দেখে বিথী দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা ১৭-১৮ বছরের ছেলে এসে বিথীকে সুইট বলের একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয়। এই ছেলে বিথী আগে কখনো দেখেনি। অন্য কেউ হলে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দৌড় লাগাতো সে। কিন্তু মায়ের কড়া নিষেধ অচেনা কেউ কিছু দিলে যাতে না নেয়। ও জানে কিছু মানুষ আছে যারা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে চকোলেট, চিপসের লোভ দেখিয়ে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের বাবা-মাকে ফোন দিয়ে টাকা চায়। এদেরকে ছেলেধরা বলে। যদিও বিথী এখনো জানে না ছেলেধরারা কেন মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। মাকে অনেক জিজ্ঞেস করার পরও সে তার মনঃপূত কোন জবাব পায় নি। সেই ছেলেধরার কথা মনে হতেই ভয়ে পিছন ফিরে দৌড় দেয় বিথী।

খেলা বাদ দিয়ে বাসায় গিয়ে হাঁপাতে থাকে ও। ওর মা এসে জিজ্ঞেস করতেই সবকিছু খুলে বলে বিথী।

“আম্মু আমি ঠিক করেছি না!”
“একদম ঠিক করেছো। সাবধান! ভুলেও কখনো অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু নেবে না। মনে থাকবে?”
“হুম।“


পরদিন বিথী মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলতে যায়। দেখে মাঠের একপাশে সেই ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা ভয় পেয়ে যায় ও। ওর সব বন্ধুদের বলে সাবধান করে দেয় যে ঐ ছেলেটা একজন ছেলেধরা, যাতে ওদেরকে কিছু দিলে না নেয়। ভয় পেয়ে সবাই যে যার ঘরে চলে যায়। এরপর থেকে ঐ ছেলেকে দেখলেই ওরা সবাই যে যার ঘরে চলে যেতো।


***


বেশ কিছুদিন পর বিথী আবার দোকান থেকে চিপস আনতে যায়। ও দোকানে গিয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটা ওর হাত ধরে বলে, “আসো তোমাকে সুইট বল কিনে দেই।“

হাত ছাড়তে বলার পরও সেই ছেলে হাত ছাড়ে না দেখে “আঙ্কেল আঙ্কেল” বলে বাদশা মিয়ার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করে বিথী। এই ঘটনা দেখে বাদশা মিয়া ঐ ছেলেটাকে ধমক দিয়ে দোকান থেকে বের করে দেয়। কিন্তু বিথী তারপরও কাঁদতে থাকে।

“কাঁদেনা আম্মু। ওকে বকা দিছি না। আর আইবো না। এই নাও চিপস নাও।“ বলে বিথীর হাতে একটা চিপস দিয়ে ঘরে যেতে বলে। বিথী চিপস নিয়ে বাসায় এসে ওর মাকে সব বলে। সব শুনে বিথীর মা চুপ হয়ে কি যেন ভাবতে থাকে। ও জিজ্ঞেস করতেই বলে, “কিছু না, মা।“

দু-তিন দিন পর বিথী আবারো মাঠে খেলতে যায়। কিছুক্ষন পর ঐ ছেলে তার বন্ধুদের নিয়ে মাঠের দিকে আসে। তাকে দেখে বিথী দৌড়ে পালাতে যাওয়ার আগেই আবার ওর হাত ধরে ফেলে ছেলেটা। বিথী আবার কান্না-কাটি শুরু করে। ওর কান্না দেখে সবাই হো হো করে হাসতে থাকে। তখন ছেলেটা বলে ওঠে, “এটা হল আমার বউ। বল তো কেমন?” এই কথা শুনে বিথীর তো মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। দেয় এক লাত্থি ছেলেটাকে। লাথি খেয়ে হাতটা ছেড়ে দিতেই বিথী দৌড়ে পালিয়ে যায়।

এরপর থেকে ভয়ে আর ঘর থেকে বের হয় না বিথী। সারাদিন এঘর ওঘর করেই কাটিয়ে দেয়। স্কুলে যাবার পথে কখনো যদি ছেলেটাকে দেখে ভয়ে সিঁধিয়ে থাকে ও। চঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ করেই দমে যায়।



বেশকিছুদিন পরঃ
বিথী অনেকদিন পর আজ সাহস করে ঘর থেকে খেলতে বেরিয়েছে। ঠিক হলো সবাই মিলে লুকোচুরি খেলবে। “ওবু দশ-বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ” গুনে চোর ঠিক করা হলো। এবার লুকানোর পালা। বিথী ভাবে, ভাগ্যিস সে চোর হয় নি। তা নাহলে পুরো এলাকা চষে বেরিয়ে এক-একটাকে খুঁজে বের করতে করতে সন্ধ্যেই হয়ে যেত। ভাবতে ভাবতে ওর বাবার বন্ধুর বাড়িতে ঢুকে পড়ে ও। পাঁচিলে ঘেরা একতলা সেমিপাকা বাড়ি, তার সামনে বিশাল উঠোন। আর পেছনে আছে রান্নাঘর আর গোসলখানা। লুকানোর জন্য একদম পারফেক্ট জায়গা। মুনমুন আপু বাড়িতে থাকলে বিথীকে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখে যে কারো সাধ্যি নেই খুঁজে বের করার। কিন্তু বাড়িতে আজ কেউ নেই। তাই বাড়ির ভেতরে লুকানোর কোন উপায় নেই। উঠোনেই কোথায় লুকানো যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ও দেখে সেই ছেলেটা গেইট দিয়ে ঢুকছে। অজানা এক ভয়ে হাত-পা জমে যায় বিথীর। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না ও। ছেলেটাকে এগিয়ে আসতে দেখে দৌড়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে যায় ও। গোসলখানায় ঢুকে শক্ত করে ছিটকিনিটা আটকে দিয়ে দেয়াল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ও। বাহির থেকে অনবরত দরজায় আঘাত করতে থাকে ছেলেটা। দরদর করে ঘামতে থাকে বিথী।


***


সন্ধ্যা থেকে পুরো বাড়িটা থমথম করছে। কিছুক্ষন পরপর বিথীর মায়ের ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রাত বারোটা বাজে। এখনো বিথীর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। থানায় ডায়েরি করে ফিরেছে বিথীর বাবা মুরাদ সাহেব। পুরো এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। কিন্তু কেউই বিথীকে দেখেনি। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতেই ঘরের ভেতর একটা হালকা গুঞ্জন ওঠে। এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরে বিথীর বাবা।

“হ্যালো।“
“হ্যালো মুরাদ। আমি সিরাজ বলছি। বিথী আমাদের বাড়িতে। তোমরা জলদি এসো।“
“কি!!! বিথী আপনার ওখানে? আসছি। আমরা এক্ষুনি আসছি।“ বলেই ফোনটা রেখে দেয় মুরাদ সাহেব।

“বীনা, বিথীর খবর পাওয়া গেছে। জলদি এসো।“ ছুটতে ছুটতে সিরাজ সাহেবের বাড়িতে যায় তারা। ঘরে ঢুকেই দেখে বিথী কম্বল গায়ে জড়িয়ে খাটে শুয়ে আছে। আর সিরাজ সাহেবের স্ত্রী ওর মাথায় পানি ঢালছে। মেয়েকে দেখে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় বীনা। “কোথায় ছিল আমার বিথী? কি হয়েছে ওর?”

“জানি না। আমরা তো বাড়িতে ছিলাম না। মাত্রই এসেছি। হাত-মুখ ধুতে বাথরুমে যাবো। গিয়ে দেখি ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকানো। অনেক ধাক্কানোর পরও খুলছেনা দেখে বাইরে থেকে আড়াল দিয়ে ছিটকিনি ভেঙ্গে ফেললাম। তারপর দরজা খুলে দেখি ভেতরে বিথী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।“ চিন্তিত মুখে সিরাজ সাহেব বললেন।
“আচ্ছা ঠিক আছে। যা কিছু জানার কাল সকালে জানা যাবে। আগে মেয়েটাকে সুস্থ করতে হবে। জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে ওর।“ বলে সিরাজ সাহেবের স্ত্রী বিথীর মাথায় পানি ঢালতে থাকে।


***


ভয়ের কিছু নেই। বিথী ভালো আছে। পরদিন সকালে ওর কাছ থেকে সবকিছুই জানা যায়। সেদিন অনেকবার ধাক্কানোর পরও বাথরুমের দরজা খোলেনি বিথী। একপর্যায়ে দরজায় ধাক্কানো বন্ধ হয়ে গেলেও ভয়ে আর দরজা খোলেনা বিথী পাছে ছেলেটা লুকিয়ে থাকে। কিন্তু রাত হয়ে গেছে। এদিকে বাবা-মাও চিন্তা করছে। সবকিছু মিলিয়ে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ও।
সেদিনের পর থেকে ঐ ছেলেকে আর এ পাড়ায় দেখা যায় নি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:১৪
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×