“এতোক্ষন শুনলেন আমাদের আজকের গেস্ট রাইমার ভালোবাসা গল্প। প্রোগ্রামের এই পর্যায়ে নেবো ছোট্ট একটা ব্রেক। কোথথাও যাবেন না, ফিরে আসছি একটু পরেই......লিসেনার ফ্রেন্ডদের রিকুয়েস্টে আমার ভালোবাসার গল্প নিয়ে। শুনতে থাকুন রেডিও মাস্তি, ৯১.৪।”
স্টার্টিং দিতে গিয়েও থেমে যায় বৃত্ত। ও কি ভুল শুনলো কিছু!
“হ্যালো ফ্রেন্ডজ ব্রেকের পর আবার ফিরে এলাম আপনাদের পছন্দের শো “ভালোবাসার গল্প” এর ভ্যালেন্টাইন্স এপিসোড নিয়ে আর সাথে আছি আমি আরজে বিন্দু। আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি যে, প্রোগ্রামের এই পর্যায়ে কোনরকম ফোন কল অর এস.এম.এস রিসিভ করা হবে না।
রোজ সকাল আটটায় ঘুম ঘুম চোখে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম শুধু একটিবার দেখবো বলে। ফুলস্লিভ টি-শার্ট, ব্লু/ব্ল্যাক জিন্স, মাথার চুলগুলো এলোমেলো, চোখে হাই-পাওয়ারের একটা চশমা – যদিও তাতে বিন্দুমাত্র আতেল আতেল ভাব ছিল না। চশমা জিনিসটা আমি দুইচোখে দেখতে পারি না। যদিও বহুদিনের পর্যালোচনায় আমি লক্ষ্য করলাম যে, এ পর্যন্ত যতজনকে আমার ভালো লেগেছে, তাদের সবার নাকের ডগাতেই চশমা বাবাজী ছিলেন। কোন ভালো লাগাই অবশ্য মাসখানেকের বেশি টিকেনি। হাহাহাহা...কি ভয় পেলেন? ভয় পাওয়ার কিছু নেই, যে কাউকে ভালো তো লাগতেই পারে। ভালোবাসা আর ভালো লাগা তো আর এক না। যাইহোক আমি খেয়াল করে দেখলাম, এক মাস নয়, দুই মাস নয়, পাক্কা ছয় মাস ধরে আমি রোজ সকালে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। খুব যে আহামরি ছিল তাও নয়, তবুও কেন জানি ভালোই লাগতো ওকে দেখতে। মেডিক্যাল সাইন্সের মতে, “কারো প্রতি তুমি যদি ক্রাশড হও আর সেটা যদি চার মাসের বেশি সময় স্থায়ী হয়, তাহলে বুঝবে তুমি তাকে ভালোবাসো।“ আর সেই থিওরি অনুযায়ী, ততদিনে আমি বৃত্তকে ভালোবেসে ফেলেছি। যদিও কেন ভালোবেসেছি তা জানি না। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, ওর নাম বৃত্ত। আর আমি বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু। আমার ফ্রেন্ডরা সেটা বলেই আমাকে ক্ষ্যাপাতো। কিন্তু মুখে যতই অসন্তুষ্টি দেখাই না কেন মনে মনে ওকে নিয়ে ক্ষেপানোর ব্যাপারটা আমিও এনজয় করতাম।
বৃত্তর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল কলেজের রি-ইউনিয়নে। সাদা একটা গেঞ্জি, তার উপরে কালো টিশার্ট, শার্টের বোতামগুলো খোলা, গেঞ্জির গলায় একটা কালো সানগ্লাস। এনাউন্সমেন্টের পর ও যখন স্টেজে ওঠে তাহসানের “প্রেমাতাল” গানটা গাইলো, মনে হচ্ছিল গানটা বুঝি আমার জন্যই। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম সেদিন ওর গান। এরপর কোথায় যে হারিয়ে গেল ছেলেটা আর খুঁজেই পেলাম না। কিন্তু না বেশিদিন ওকে না দেখে থাকতে হয়নি আমার। ফেসবুকে কলেজের গ্রুপে গিয়ে সার্চ দিতেই পেয়ে গেলাম আমার বৃত্তকে। সেদিনই জানলাম বৃত্ত আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে। অথচ এর আগে ওকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়লো না। রিকুয়েস্ট পাঠানোর সাহস হয়নি, তাই পাঠাইনি। কিন্তু প্রতিবেলা একবার করে ওর প্রোফাইল থেকে ঘুরে আসতাম।
মাসখানেক পর পাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন আসলো। আমাদের এপার্টমেন্টের বয়স বছরখানেক হলেও আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরা কি সমস্যার কারনে জানি প্রথমদিকে ফ্ল্যাটে ওঠেনি। তো ওনারা আসার পর আম্মু একদিন বললো আমাকে নিয়ে ঘুরে আসবে। তারপর আম্মুকে নিয়ে সময় করে একদিন গেলাম। আম্মু আর পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি বসে বসে গল্প শুরু করলো। বসে বসে বোর হওয়ার কোন মানে হয়না ভেবে আমি উঠে ঘরে ঘুরতে লাগলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই চোখ আটকে গেল একটা রুমে। কারন সেই রুমের ওয়ালে যে ছবিটা ঝোলানো ছিল তা থেকে আর যার পক্ষেই সম্ভব হোক অন্তত আমার পক্ষে চোখ সরানো সম্ভব ছিল না। বুঝতেই পারছেন কেন? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, ওটা বৃত্তরই ছবি ছিল।
সেদিনের আগ পর্যন্ত বৃত্ত ছিল আমার কাছে টিভির নাটক-সিনেমার হিরোদের মতো যাদেরকে মন ভরে দেখা যায়, কল্পনা করা যায় কিন্তু কখনো ছোঁয়া যায়না। কিন্তু সেদিনের পর ওকে পাওয়ার একটা ক্ষীন আশা আমার মনের প্রাসাদে টিমটিম করে জ্বলে উঠলো।
সেই থেকে বৃত্তদের বাসায় আমি প্রায়ই যেতাম। আন্টি মানে বৃত্তের মাও ভীষন স্নেহ করতো আমাকে। মিষ্টি খাবার খেতে আমার একদম ভালো লাগে না। কিন্তু আন্টির হাতের পায়েস ছিল যেন এক অমৃত। সেই পায়েস যে না খেয়েছে তার জীবনের এক আনা কনফার্ম বাকি আছে। বৃত্তদের সারা ঘরে ঘুরে বেড়াতাম আমি। চেষ্টা করতাম ওর অস্তিত্বটাকে উপলব্ধি করার। অথচ এসবের কিছুই ও জানতোনা।
বৃত্তরা আমাদের এলাকায় আসার পর থেকে একটা দিনও ওকে না দেখে কাটাই নি আমি। কোনদিন সকালে যদি ঘুম থেকে উঠতে দেরি হত অথবা কোন কারনে ও আটটার বাসে না যেতো, সেদিন ক্যাম্পাসে ওদের ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে ফ্রেন্ডদের নিয়ে আড্ডা দিতাম। দেখা না হয়ে যাবে কই! নিজেকে তখন খুব বখাটে বখাটে মনে হতো। কিন্তু তাতে কি?? এসব আমি থোড়াই কেয়ার করতাম।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, আমার এই এত্তোসব পাগলামির কথা বৃত্ত জানতোই না। জানবেই বা কি করে বলুন? ও তো আমাকে চিনতোই না। আমি জানতাম, ওকে যদি কখনো ডেকে জিজ্ঞেস করতাম আমাকে আগে দেখেছে নাকি, ও সেটাও বলতে পারতো কিনা সন্দেহ ছিল। কিন্ত তা নিয়ে আমার কোনদিনও কোন মাথা ব্যথা ছিল না।
বৃত্তের সবচেয়ে যে জিনিসটা আমার ভালো লাগে তা ওর চোখ। ঐ চোখের দিকে তাকানোর কখনো সাহস হয়নি আমার, যদি ধরা পড়ে যাই। কিন্তু ধরা পড়া সে তো আমার ভাগ্যে খোদাই করা ছিল, না পড়ে উপায় আছে। কথায় আছে না, চোরের দশ দিন আর সাধুর একদিন।
থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বরের রাতে পুরো এলাকায় যেন আতশবাজি পোড়ানোর মহড়া বসেছিল। আম্মুকে অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছাদে গিয়ে বাজি পোড়ানো দেখছিলাম। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। ঠিক কানের পাশ দিয়েই ভেসে গেলো কথাটা, “হ্যাপি নিউ ইয়ার”। ফিরে তাকাতেই দেখি বৃত্ত। শীত যেন আরো দ্বিগুন হয়ে জেঁকে বসলো আমার উপর। পালটা উইশ যে করবো সে অবস্থাও নেই। গলা দিয়ে কোন শব্দই বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে উইশের রিপ্লাই দিলাম। এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো ওর ঠোঁটে। তারপর ভুতের মতো উধাও হয়ে গেল ছেলেটা। বুঝতে পারলাম না সেই হাড় কাপানো শীতের রাতে একা ছাদে দাঁড়িয়ে আমি কি স্বপ্ন দেখলাম নাকি সত্যি দেখলাম। ভুত-টুতও তো হতে পারে – এই কথা মাথায় আসতেই পড়ি কি মরি করে দিলাম ছুট। বড্ড বাঁচা বেঁচেছিলাম সেদিন। সেদিন উপর থেকে কেউ একজন হয়তো হেসেছিলেন, এমন ভীতু মেয়ের প্রেম করার শখ দেখে। কে জানতো এই মেয়েই একদিন এতো সাহসী হয়ে উঠবে।
ওক্কে ফ্রেন্ডজ, ভালোবাসা গল্পের এই পর্যায়ে নেবো ছোট্ট একটা ব্রেক। কোথথাও যাবেন না, ফিরে আসছি একটু পরেই। শুনতে থাকুন রেডিও মাস্তি, ৯১.৪।”
***
বিন্দুর অনেক আগে থেকেই বৃত্ত ওকে চিনতো। ভালোই লাগতো ওর বিন্দুর চঞ্চলতা দেখতে। এতো চঞ্চল মেয়ে বৃত্ত আগে কখনো দেখেনি, এমনকি এখনো পর্যন্ত না।
রোজরোজ বিন্দুর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকাটা বৃত্তর বেশ লাগতো। ও কখনো ভাবেনি যে ওর জন্যও কেউ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। বিন্দুর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা, ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে আড্ডা মারা সবই বৃত্ত দেখতো কিন্তু কখনোই ওকে তা বুঝতে দেয়নি।
হুমম...থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বরের রাতটার কথা বৃত্তর আজো মনে আছে। ও সেদিন সত্যিই ছাদে গিয়েছিল, বিন্দুকে উইশও করেছিল। কিন্তু বিন্দু এতোটাই চমকে গিয়েছিল যে পরে ও মন খারাপ করে দরজার আড়ালে চলে গিয়েছিল। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো বিন্দু ওকে ভুত মনে করে ভয়ে পালিয়ে গেল সেই মুহুর্তে হাসতে হাসতে ওর গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। বিন্দুকে প্রায়ই এই কথা বলে ক্ষেপাত ও।
তুমি আমায় বেঁধেছো বৃত্তের পরিধিতে (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:১৩