বুবুমনির বিয়ে হবে, বাজবে কতো বাজনা।
আজকে বুবুর মুখে হাসি, কালকে বুবুর বিয়ে,
বর আসবে পালকি চড়ে বকুলতলা দিয়ে।
আর কি তবে ভাবনা, একটা কথা রাখনা,
ও বুবু তোর লাল শাড়িটা আমায় দিয়ে যা না।।
আমার ষষ্ঠ জন্মদিনে আম্মু আমাকে নওরীন-এর একটা ক্যাসেট কিনে দিয়েছিল আমার সঙ্গীতপ্রীতি দেখে। সেই ক্যাসেটের সাত দুগুনে চৌদ্দটা গান আমার শুধু মুখস্থ ছিলনা, একেবারে ঠোটস্থ ছিল।
যাইহোক এখন আমার সঙ্গীতপ্রীতির কথায় আসি। আম্মু সবসময়ই রবীন্দ্রসঙ্গীতের দারুন ভক্ত। সেইসময়ও ছিল। তাই ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট ছাড়া তেমন কোন ক্যাসেট ছিল না। তাই সেগুলোই শুনতাম। কিন্তু সুর ছাড়া গানের একটা কথাও আমার মাথার আশেপাশের ৪০০ কিমি এর মধ্যে ঢুকতো না। তাই বিশাল ক্যাসেট প্লেয়ারখানার একপাশের ছোট্ট রেডিও নবটাই ছিল আমার একমাত্র সম্বল। তখন তো আর এখনকার মতো এতো রেডিও স্টেশন ছিল না। তাই বাংলাদেশ বেতারই শুনতাম। প্রতিদিন দুপুরবেলা খুব সম্ভবত ১২টার দিকে সিনেমার গান দিতো। সেই গান শুনে আমার যে নাচ...তা আর নাই বলি। :!> :#> যাইহোক বরাবরের মতো সেই গানগুলোও আমার মাথার ধারেকাছে আসতো না। কিন্তু ভাষাগত কারনে সেগুলো আমার মুখস্থ হয়ে যেতো। বুঝি আর না বুঝি সারাক্ষনই তাই গাইতে থাকতাম। আর সুরগুলি!!! সেগুলো তো মাথার মধ্যে কিলবিল কিলবিল করতো।
এমনিতেই রাতের বেলা ছাড়া আমাকে ঘরে আটকে রাখা যেতনা। তাই রাতের বেলা নিজেকে কেমন বন্দী বন্দী লাগতো। তাই রাতের বেলা পড়ার টেবিলে বসে বসে দোয়া করতাম যাতে বেশি বেশি কারেন্ট যায়। কারন কারেন্ট গেলেই সবাই উঠোনে এসে জড়ো হতো। সবার আম্মুরা দাঁড়িয়ে গল্প করতো, আব্বুরা দোকানে যেত। আর আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে চিৎকার করে করে গাইতাম, “আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, তাই তোমার কাছে ছুটে আসি।“
কখনো যদি ঘুরতে বের হতাম, রাস্তার দুপাশের দোকানের নামগুলো সুরের তালে তালে পড়ে যেতাম। আর মানুষ-জন মনে করতো আমি বুঝি স্বরচিত গান গাচ্ছি। আমার কিছু সঙ্গীতানুরাগী (যারা স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আমার গানগুলো উপভোগ বা হজম করতেন ), তারা এখনো আমাকে দেখলে সেইসব দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন। :#>
আমার এ হেন সঙ্গীতপ্রীতি দেখে আম্মু আমাকে ক্যাসেটখানা কিনে দিয়েছিল। কারন তার ধারনা গিয়েছিল, এসমস্ত আব-জাব গান শুনে তার অতি আদরের একমাত্র কন্যা গোল্লায় যেতে পারে। যাইহোক, ক্যাসেটখানার আমি কিন্তু ব্যাপক সদব্যবহার করেছিলাম। আমার (!)মধুর কন্ঠের গান শুনে আব্বু খুশি হয়ে রেকর্ড করতে বসে গেলেন। আমি যাই গাই, আব্বু তাই রেকর্ড করে আমাকে শুনায়...আহা!!! বড়ই (!) সৌন্দর্য্য।
পরের বছর স্কুলের হামদ-নাত প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহন করে ফাইনালে উঠলাম। কিন্তু যেদিন ফাইনাল ছিল, সেদিন পড়লো হরতাল। হরতালে স্কুল বন্ধ, তাই আম্মু আমাকে আর স্কুলে যেতে দিলনা। আমি তো কান্নাকাটি করে ঘর মাথায় তুললাম। আম্মু আমাকে বোঝালো যে হরতালে স্কুল বন্ধ থাকে তাই ফাইনাল হবে না। কিন্তু পরদিন আমি স্কুলে গিয়ে দেখি যে আগের দিন ফাইনাল হয়ে গেছে। এমনিতেই মন খারাপ করে বসে ছিলাম। তারউপর ম্যাম আসলো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে। এসে বললো, “তুমি কালকে আসো নাই কেন? তাহলে তো শিওর সেকেন্ড প্রাইজ পেতে।“ হায়রে এভাবেই আমার সংগীতজীবনের প্রথম পুরস্কারখানা হাতছাড়া হয়ে গেলো।
এর কিছুদিন পর নানু আসলো বেড়াতে। আর আমি তার মেয়ের নামে রাজ্যের নালিশ নিয়ে বসলাম। নানু তার মেয়ের কাজের ক্ষতিপূরন হিসেবে আমাকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিল। সারাটাদিন আমার যেতো ঐ সাদা-কালো কীগুলো চেপে নানান ধরনের সুর বের করতে করতে। আম্মুর শখ হলো আমাকে গান শেখাবে। দিল ভর্তি করে গানের স্কুলে। আমিও নাচতে নাচতে গেলাম গান শিখতে। কিন্তু কোথায় গান কোথায় কি। :-< গান শেখানোর নাম করে আমাকে প্রতিদিন সা-রে-গা-মা-পা শেখায়। একদিন যায়, দুদিন যায়, তিনদিন যায়, স্যার আর গান শেখায় না। আমি বলি স্যার গান শেখান। স্যার বলে এটাই তো গান। বলি, ঠকানোর আর জায়গা পাও না। এটা যদি গানই হবে তাহলে রেডিও-টিভিতে জীবনে এতো গান শুনলাম, কই কাউকে তো সা-রে-গা-মা-পা গাইতে শুনলাম না। আম্মুকে গিয়ে বললাম আমি অন্যকোথাও গান শিখবো। আম্মু বলে কেন? আমি বললাম এ স্যার গান পারেনা। আম্মুতো অবাক। তারপর আম্মুকে বিস্তারিত বললাম। কোথায় আম্মু রেগেমেগে স্যারকে গিয়ে ঝাড়ি মারবে তা না করে আম্মু ওনার সুরেই গাইতে লাগলো। অতঃপর রাগে-দুঃখে-অভিমানে দীর্ঘ এক বছর পর আমি সঙ্গীত স্কুলে যাওয়া ক্ষ্যান্ত দিলাম। আর আম্মুর সব স্বপ্ন জলাঞ্জলি গেল।
কিছুদিনের মাথায় ঢাকায় চলে আসলাম। হঠাৎ করে ব্যস্ত এ শহরটায় এসে আমরাও ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তবুও প্রথম প্রথম স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোতে গাওয়া হতো। বিল্ডিং এর পিচ্চিগুলো সব জড়ো হয়ে বসতো গান শুনবে বলে। অনেকের সামনে শেষ গান গেয়েছিলাম কলেজ লাইফে। গানের কলি খেলতে গিয়ে ‘সেই তুমি’ গেয়েছিলাম। ফ্রেন্ডদের খুব মনে ধরলো সে গান। কেন যে মনে ধরলো আল্লাহ মালুম। :#> প্রায়ই ধরতো গানটা শোনার জন্য। আমারও খুব ফেবারিট গান ছিল তাই না করতাম না। আমার কাছে শুনতে শুনতে ওদেরও প্রিয়র তালিকায় চলে গেল গানটা। এখন তেমন যোগাযোগ নেই কলেজ লাইফের ফ্রেন্ডদের সাথে কিন্তু প্রায়ই মেসেজ আসে গানটার কথা মনে করিয়ে দিয়ে। ভালোই লাগে।
কিন্তু শেষমেশ সেটাও ছেড়ে দিলাম। রেওয়াজ ছাড়া কোকিলের কন্ঠও কাকের মতো কর্কশ শোনায় আর আমি তো কোন ছাড়। এখনো গাই, নিজে নিজে, যখন একা থাকি তখন। এককথায় যাকে বলা যায় বাথরুম সিঙ্গার।
.
.
.
.
.
.
হারমোনিয়ামটা এখনো পড়ে আছে আমার ঘরের এককোনায়। ধুলোবালির আস্তর পড়ে আছে। কখনো মন চাইলে পরিষ্কার করি। তা নাহলে এমনিতেই পড়ে থাকে অযত্নে-অবহেলায়। এখন আর আমার হারমোনিয়াম বাজালে তা থেকে মিষ্টি মধুর সুর বেরোয় না...বেরোয় শুধু অনেক দিনের জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস...