তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যয়ের একটি কালজয়ী উপন্যাস 'কবি''। তৎকালীন নিম্নবর্গের মানুষের জীবনের পটভূমি নিয়ে এই উপন্যাস এগিয়েছে। শুরুটা হয় একটা আশ্চর্য সংবাদের ভিত্তিতে। ডোম বংশের ছেলে নিতাইয়ের হঠাৎ কবি হওয়া নিয়ে।
সেসময়ে কবিয়াল বলে এক ধরণের গোষ্ঠী ছিল।বর্তমানে আমাদের বাউল শিল্পীদের মত। আরেক গোষ্ঠী ছিল "ঝুমুরের দল" বর্তমানের যাত্রপালার মত ঘুরিয়া ঘুরিয়া বিভিন্ন মেলায় গান পরিবেশন ও দেহ ব্যবসা করত। গ্রামের সাধারণ জনতা রাতের গভীরতার সাথে সাথে কবিয়ালদের গালাগালি আর মেয়েদের অর্ধ-উলঙ্গ নাচের সাথে মিলিয়া যাইত।
এর ফাঁকে আবার পেছনে তাবু খাটিয়ে চলত দেহ ব্যবসা। তারাশঙ্করের বর্ণনায় সেই ক্ষণস্থায়ী যৌনপল্লী।
"সে যেন একটা বিরাট মধুচক্রে অবিরাম গুঞ্জন উঠিতেছে।"
কবি একটি সামাজিক নিম্নবর্গের উপন্যাস। এখানে তাদের রুচিবোধ, দিনযাপন থেকে শুরু করে ভাষার ব্যবহার খুব যত্নসহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।
নিতাই চরণের কবি হওয়া নিয়ে উপন্যাসের যাত্রা। শেষ পর্যন্ত আমরা তার দুদর্শাগ্রস্ত প্রত্যাবর্তন দেখতে পাবো। নিতাইয়ের জীবনের উত্থানের সাথে তার ভেতরকার পরিবর্তন আবার পতনমুখ হবার সাথে তার বোধোদয়ের দিয়ে লোকায়ত দর্শনের সাথে পরিচয় ঘটবে। আদ্যোপান্ত একটি ভালো মানুষ নিতাইয়ের জীবন দর্শনের পালাবদল যেন তৎকালীন ওই সব সমাজের চিত্র ধারণ করে। তৎকালীন বাঙ্গলার নিম্নবর্গের মেয়েদের যৌনতার খানিকটা বিবরণ দেখা যায় এ উপন্যাসে।
কবি উপন্যাসের সব থেকে সুন্দরতম বচনঃ-
এই খেদ আমার মনে মনে।
ভালোবেসে মিটল না এ আশ—কুলাল না এ জীবনে।
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?
উপমাঃ-
প্রথম দিকে কবির মন কেড়ে নেয়া মেয়েটিকে অপূর্ব উপমায় ফুটিয়ে তুলতে মোটেও কার্পণ্য করেনি লেখক
"মেয়েটির রঙ্গ কালো, কিন্তু দীঘল দেহভঙ্গিতে ভুঁইচাপার সবুজ সরল ডাটার মত একটি অপরূপ শ্রী।"
কবির কোন কথায় যখন সে আহত হত তখন তার রূপের যে অনিন্দ্য উপস্থাপন করেছেন, তা অনবদ্য।
"বর্ষার রসপরিপুষ্ট ঘনশ্যাম পত্রশ্রীর মত তাহার সে মুখখানি মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে পরিবর্ত্তিত হেমন্ত শেষের পাতার মত পান্ডুর হইয়া আসিল।"
বিচ্ছেদের সময়ে কবির মনের মানুষের প্রস্থানও যে কতটা বেদনাময় ও সুন্দর হতে পারে তা লেখকে যথার্থই ফুটিয়ে তুলেছেন।
"জোৎস্নার রহস্যময় শুভ্রতার মধ্যে দ্রুত চলন্ত কাশফুলটি যেন মিশিয়া মিলাইয়া গেল।"
দ্বিতীয় ধাপে এসে আমরা নিতাইয়ের আর একজন মনের মানুষের সন্ধ্যান পাবো। তার সম্পর্কে তারাশঙ্করের বর্ণনা আমাকে বিহ্বলিত করেছে।
★ মেয়েটা শুধু মুখ ভরিয়া হাসেনা, সর্বাঙ্গ ভরিয়া হাসে।
★ সঙ্গে সঙ্গে সিক্তবাসের স্বচ্ছতার আড়ালের তাহার সু পরিস্ফুট সর্বাঙ্গও হাসিয়া উঠিল।
★মধ্যরাত্রির নিস্তরঙ্গ স্তব্ধ জোৎস্নার মধ্যেও একটা ভয় আছে। সে ভয় সে করিল না।
এই মেয়েটির নাম ছিল বসন্ত তাকে বসন নামে ডাকত সবাই। বসনের মৃত্যুতে মূলত কবি উপন্যাসের সমাপ্তি ঘনিয়ে আসে। এর পরে কবি তার গ্রামের দিকে যাত্রা করেন এবং তার প্রথম মনের মানুষ ঠাকুরঝির মৃত্যু সংবাদে হতবিহ্বল হয়ে যান। যার জন্য কবি লিখেছিলেন "কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?" কবি জীবনের বাস্তবতায় নিতাই চরণের নীচ বংশের কারণে অনন্য কবিয়ালদের থেকে তার পার্থক্য স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।
কবি উপন্যাস সবার পড়া উচিত। এটি গ্রামীণ মানুষের জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ভোর ৬:৩১