somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

অজ্ঞ বালক
আমি আসলে একজন ভীষণ খারাপ মানুষ। তবে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে দুর্দান্ত অভিনয় করতে পারি বলে কেউ কিছু বুঝতে পারে না। সে হিসাবে আমি একজন তুখোড় অভিনেতাও বটে!!!

থ্রিলার উপন্যাসিকাঃ চারুলতা - পর্ব দুই

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

০৪

না। আমি আধুনিক কোন ব্যাটমান বা ডেয়ারডেভিল না। রবিন হুড বা জোরোর মত কেউ না। কিন্তু, সত্যি বলতে কি সময় আর পরিস্থিতি কখনো কখনো মানুষকে বাধ্য করে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে। আমি আইনের রক্ষক। কিন্তু, যেখানে আইন তার সরল পথে হাঁটতে গিয়ে কোন অপরাধীর সাজানো গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলে তখন রক্ষক হিসেবে আমি ব্যর্থ হই। আর তখনই মানুষ থেকে অমানুষ হতে হয় আমাকে।

ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা নিয়ে কাজ করছি আজ পাঁচ বছর হল। আর এই পাঁচ বছরে আমি কতটুকু সফল আর কতটুকু ব্যর্থ সেই প্রশ্ন আমি প্রতিদিন নিজেকে করি। পাঁচ বছরে কমপক্ষে তিনশ ধর্ষণের মামলার আমি সরাসরি তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলাম। এর মধ্যে শাস্তি পেয়েছে মাত্র ছাপ্পান্ন জন। হাসার কিছু নেই। শতকরা হিসেবে আমি কমবেশি প্রায় বিশ ভাগ অপরাধীদের শাস্তি দিতে পেরেছি। আমার আগের দশ বছরের হিসাবে সেই শাস্তি পাওয়ার হার ছিল মাত্র আট শতাংশ। কাজেই আমি সফল, অন্তত সমীকরণ আর পরিসংখ্যান তাই বলে। কিন্তু, এসবই ফাঁকা কথা। নিজের কাছে জবাব চাইলে মনে হয় চিৎকার করে পৃথিবীকে বলি আমি কতটা ব্যর্থ একজন পুলিশ অফিসার। আমি ক্লান্ত। বছরের পর বছর কাঠগড়া থেকে হাস্যোজ্বল মুখে ধর্ষকদের নেমে যেতে দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। তাদের উঁচু করা হাতে কাদের মোল্লার মতন তুলে ধরা বিজয়ের চিহ্ন, মুখে বিগলিত ভাব। তাদের পিতা-মাতা নামের কলঙ্করা অশ্রুসজল চোখে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে নিজেদের গুণধর সন্তানকে। তাদের ইয়ার দোস্তদের মুখের হাসি আরেকটু চওড়া, প্রতিদিন আড্ডায় আরও একবার রসালো গল্পটা জমিয়ে শোনা যাবে।

এইসব মামলায় নির্যাতিত মেয়েদের সাথে আমার অনেকটা সময় কাঁটাতে হয়। যেমনটা ঘটেছে আয়েশার ক্ষেত্রেও। আয়েশার জীবনের শেষ দিনগুলোতে আমিই মনে হয় ওর সাথে সবচাইতে বেশি সময় কাটিয়েছি। যেহেতু রায় একরকম অনুমিতই ছিল, আমি খুব একটা অবাক হই নি যখন রফিক বেকসুর খালাস হয়ে যায়। ওর বিজয়গর্বে ঝলমল করতে থাকা মুখ, জোর পায়ে কোর্টের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়া, ওর টয়োটার ড্রাইভিং সীটে ওঠার আগে পত্রিকার ফটোগ্রাফারদের দিকে ফিরে দেয়া সেই মুচকি হাসি আর চোখটিপ যা পরের দিন সবগুলো পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয়। একটা ছোটখাটো নারী নির্যাতন মামলা টিকে গিয়েছিল কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে "যথেষ্ট পরিমাণে আলামত পাওয়া যায় নি" বলেই আদালত খালাস। অর্থাৎ আমাদের আইন ঠিক করে বলতে নারাজ যে আয়েশার সাথে রফিকের ওইদিনের শারীরিক সম্পর্কটা বলপ্রয়োগ করে করা হয়েছিল নাকি যৌথ সম্মতিতে ছিল। আমাদের আইন যখন যৌন সম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষণে ব্যস্ত, আমাদের মিডিয়া যখন রফিকের হ্যান্ডসাম ছবি এডিট করে ছাপাতে ব্যস্ত, সোশ্যাল সাইটে যখন রফিকের ছবির নীচে কিছু মেয়েদের কমেন্ট ভেসে বেড়াচ্ছে "এমন ছেলে করতে চাইলে না করে কোন দেমাগে?"; তখন আয়েশা ভাবল, লড়াই অনেক হয়েছে এবার ছুটি নেয়া যাক। পরেরদিন সকালে আমার কাছে আয়েশার আত্মহত্যার খবরটা আসে।

আমাদের প্রায়ই শিখানো হয় কোন মামলার সাথে নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি জড়ানো যাবে না, আমিও তাই বিশ্বাস করি। কিন্তু, শিট হ্যাপেনস। রাতের পর রাত আমি ঘুমাতে পারি নি। রফিকের চেহারা আমাকে ঘুমাতে দেয় নি। আয়েশার কালশিটে পড়া দেহের ছবি আমাকে ঘুমাতে দেয় নি। আয়েশাকে চির-শয্যায় শায়িত করার ছবি, পাশেই দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা ওর পরিবারের ছবি আমাকে ঘুমাতে দেয় নি। আমি মনে করি ঠিক কিসের জন্য আমি পুলিশ হতে চেয়েছিলাম। আমার শপথ। রফিকের ক্ষেত্রে কোন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না, কোন প্রমাণ ছিল না, কোন অভিযোগই তার ঠিক করা আইনজীবীর সামনে ধোপে টিকে নি। আর তাই আমি খুব ভেবে-চিন্তে পরিকল্পনা করে আজকে রফিকের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যাই। এবার দেখি, কত বড় আইনজীবী যোগার করতে পারে রফিক। রাস্তায় একজন ছিনতাইকারী রফিকের টাকা-পয়সা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, সেটা দেয়া হয়নি দেখে রফিককে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে সে চলে যায়। ব্যস, এটাই ঘটেছে। এখন যদি রফিকের এই দুর্মতি হয় যে সে আমার ব্যাপারে নালিশ করতে পুলিশের কাছে যাবে আর সেখানে অভিযোগ জানাবে যে আমিই তার এই দুর্গতির জন্য দায়ী তাহলে কেন পুলিশের ব্যাপারে "কাক কাকের মাংস খায় না" প্রবাদ বাক্যটি বলা হয় সে ঠিক বুঝে যাবে। কেউ যখন তাকে বিশ্বাস করবে না, করলেও সামনে সেটা বলবে না, মুখের উপর হাসবে, উড়িয়ে দিবে - কিছুটা হলেও আয়েশার কষ্টটা রফিক বুঝতে পারবে। অবশ্য আমার মনে হয় না, রফিক পুলিশের কাছে যাবে। ওর মতন ছ্যাঁচড়া কাপুরুষ এই কাজ করার সাহসই পাবে না।

মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম। বেশ কয়েকবার জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে বুকের মধ্যে রেখে আস্তে আস্তে ছাড়লাম। নিজেকে শান্ত করতে চাচ্ছি। আজকে রাতে বেশ ভালো ঘুম হবে আমার। অন্যান্য দিন এরকম সময় আমি আমাদের এলাকার জিমটাতে ঘাম ঝরাই, ঘুমের আগে নিজেকে পরের দিনের জন্য গড়ে-পিটে নেই। আজকে সেই ঘামটা রফিককে চোখে তারাবাতি দেখিয়ে ঝড়িয়ে এসেছি। হাত-পায়ের পেশীগুলো আজকে একটু বেশিই কাজ করেছে কাজেই এতটুকু বিশ্রাম ওদের প্রাপ্য। কুমারখালির মোড়ে লাল বাতিতে দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। পুলিশ হওয়ার এই এক ঝামেলা। আইন অন্যদের চাইতে বেশিই মানা লাগে। আমার একটু আগের কাণ্ড ভেবে আবার মুচকি হাসবেন না যেন। এটাই সত্যি কথা। ওইপাশের রাস্তায় কয়েকজন টোকাই ফুটপাতেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কয়েকজন অল্পবয়স্কা মেয়েকে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে দেখলাম, আমার মোটরসাইকেলের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি জানি ওরা কেন ওখানে দড়িয়ে আছে, আর ওরাও মনে হয় জানে আমি কোন ঝামেলা পাকাতে আসি নি। কমলা বাতি জ্বলে উঠেছে, এখনই সবুজ হয়ে যাবে সিগন্যালটা এমন অবস্থায় ফোনটা বেজে উঠলো। ব্লুটুথ হেডসেট দিয়ে ধরে ফেললাম ফোনটা।

"চারু..."

বসের ফোন। মুহূর্তেই টের পেলাম শরীরের প্রতিটি কোষ সজাগ হয়ে উঠেছে। "স্যার।"

"একটা লোকেশন পাঠাচ্ছি হোয়াটস এপে। গিয়ে দেখো অবস্থাটা। খুনের ব্যাপার। বুঝেছ। একটু খেয়াল করে।"

"ওকে স্যার।" দীর্ঘশ্বাস ফেললাম ফোনটা রেখে। হোয়াটস এপে মেসেজ চলে এসেছে। একবার ঠিকানাটা দেখে, ইউ টার্ন নিলাম। গেল আমার সাধের ঘুম।



০৫


রাতের বেলা বাইক চালানোর মজাই আলাদা। এখনো রাস্তা একদম ফাঁকা হয় নি। তবে দিনের বেলার মত মাথা নষ্ট করা জ্যাম নেই। পার্কের মোড় ঘুরে, শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে সোজা নাক বরাবর টান দিলাম আমি। লাইট পোস্টের সাদাটে আলো দেখে অতীতের কথা মনে পড়লো আমার, সেই যখন কিনা লাইট পোস্টের আলো হতো ঘোলাটে হলদে। নীচে রাস্তায় একটা অদ্ভুত রহস্যময়তা ছড়িয়ে পড়তো রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে। এই জায়গাটা আমার হাতের তালুর মতন চেনা। আমি যখন হাই স্কুলে পরতাম তখন এই পাশেই আলমগঞ্জেই বাসা ভাড়া করে থাকতাম। তখনের শহর আর এখনের শহরের তফাতের কথা ভাবলে মাথা ঘুরে ওঠে। কি থেকে কি হল!

এই এক শহরের মধ্যে এত এত জায়গায় আমি থেকেছি যে কোন একটা জায়গা আমার পরিচিত বলাটা ভুল হবে। আসলে এই পুরো শহরটাকেই নিজের হাতের তালুর মত চিনি আমি। তবে হাই স্কুলের কথা মনে পড়ছে কারণ স্কুলটা ছিল কম্বাইন্ড। কাজেই আমি আর চয়ন - আমার ছোট ভাই, একসাথেই ভর্তি হয়েছিলাম স্কুলটাতে। আমি ক্লাস সেভেনে ও সিক্সে। স্কুলের ইউনিফর্ম ছিল নীল ফ্রক, সাদা পায়জামা আর সাদা স্কার্ফ। ছেলেদের জন্য নীল জামা, সাদা প্যান্ট। এই সাদা প্যান্ট আর পায়জামাকে স্কুলের ইউনিফর্ম করার কথা যেসব বেকুবের মাথা থেকে বের হয়েছিল তাদের আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। প্রথম যেদিন স্কুলে ঢুকি - সবার উৎসুক দৃষ্টি শেলের মত শরীরে এসে লাগছিল আমার। অবশ্য সবাইকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বছরের মাঝামাঝি, জুলাই মাসে এসে স্কুলে নতুন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হলে সেটা সবার কাছেই একটা বেশ গরম খবর হয়ে দাঁড়ায়।

আগের স্কুল থেকে আমাদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল যাকে বলে। আফসোস আমার মা সেই সাহস বা ইচ্ছা কখনো জোগাড় করে উঠতে পারেন নি। তা না হলে, আম্মুও মনে হয় আমাদের গলা ধাক্কা দিয়েই বের করে দিত বাসা থেকে। অবশ্য আমি গলা ধাক্কার অপেক্ষা খুব বেশি দিন করি নি। ছোট বেলা থেকেই বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার অভ্যাস ছিল আমার। দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি, মামা, খালা কিংবা ফুফুর বাড়িতে গিয়ে উঠতাম। প্রথমদিকে সবাই আদর যত্নই করতো, কিন্তু কতদিন। তারপর একসময় কিছু বন্ধু পাতালাম আমি। আমার মতনই। উড়নচণ্ডী, স্বেচ্ছাচারী, উদ্দাম, স্বাধীন। তাদের বাসায় কিংবা একসাথে মেস করে দিনের পর দিন থেকেছি। বাসার বাইরে যে কোন জায়গাই আমার কাছে বেহেশত মনে হত। বাসায় চয়ন সারাক্ষণ খিটমিট করতো আম্মুর সাথে। আমাদের গরিবি হালত নিয়ে, পরিবারে আব্বার অনুপস্থিতি নিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে - যেন সবকিছুর সমাধান হল বাসায় এসে আম্মুর সাথে ঝগড়া করা আর বাসার জিনিসপত্র ভাংচুর করা। এরকম সমস্যাসংকুল পরিবারকে কোন বাড়িওয়ালা আর বাসায় রাখতে চাইবে?

আর স্কুল থেকে বের করে দেয়ারও কারণ ছিল। আমার আর চয়নের এক কথা ছিল। আমরা যেই ক্লাসে থাকবো সেই ক্লাসে আমরাই হব রাজা। আর বাকী সব প্রজা। কেউ ঘাড়ত্যাড়ামি করলে তাদের কপালে শনি ছিল। আমি আর চয়ন তখন ট্যাগ টীম সেজে মহড়া দিতাম সবার সাথে। একসময় সবাই আমাদের মিলিত শক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হত। কিন্তু, কখনো কখনো এক দুইটা পিস বের হয়ে আসতো যাদের বাগে আনা যেত না। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে গিয়ে অনেক সময়ই একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলতাম আমরা। আর তার ফলে অর্ধচন্দ্র দেয়া ছাড়া আর উপায় থাকতো না কর্তৃপক্ষের কাছে। অবশ্য কপাল ভালো যে পড়াশোনায় আমরা দুইজনই ভালো ছিলাম, ফলে আরেকটা স্কুল খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা কখনোই হত না আমাদের।

মূল রাস্তার শেষ মাথার দিকে পার্ক করে রাখা কয়েকটা পুলিশের গাড়ি চোখে আসলো আমার। কাছে এসে থামলাম আমি। এক তরুণ পুলিশ কনস্টেবল দাঁড়িয়ে ছিল গাড়িগুলোর পাশে। মনে হয় পরে যারা আসছে তাদের পথ দেখিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে এই বেচারার কাঁধে। আমি কাছে এসে পকেট থেকে আমার ব্যাজ বের করে দেখালাম। সর্বনাশ। হাতে যে কাপড় পেঁচিয়ে নিয়েছিলাম রফিককে পেটানোর আগে, এখনো খোলা হয় নি। সাদা ব্যান্ডেজটা লালচে হয়ে গিয়েছে রফিকের রক্তে। এই ব্যাটা লক্ষ্য না করলেই বাঁচি। হাতটা তাড়াতাড়ি ওর চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিলাম। অবশ্য এদিকে নজর ছিল না ছেলেটার।

"ম্যাডাম, আপনি সোজা এই পথ ধরে যান। কিছুদূর গিয়ে দেখবেন রাস্তাটা শেষ হয়ে গিয়েছে। এরপর একটা মাটির রাস্তা। খোয়া বিছানো আছে। ঐ রাস্তাটা সামনে গিয়ে বাঁ দিকে বেকে গেছে। সোজা শেষ হয়েছে মনহারা নদীর কিনারায় গিয়ে। ওখানে গেলেই দেখবেন।"

"নদীর কিনারায়?" আমার হাতের লোমগুলো, ঘাড়ের চুলগুলোর মতন সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল। তবে কি... "খুন হয়েছে কে জানা গেছে?"

কনস্টেবল ছেলেটা আমাকে হাত নেড়ে সামনে এগিয়ে যেতে বলল। দূর থেকে আরেকটা গাড়ি আসছে, লুকিং গ্লাসে দেখতে পেলাম আমি। জোড়ে বাইক হাঁকালাম, সোজা রাস্তার শেষে গিয়ে খোয়া বিছানো রাস্তাতে নেমে আসলাম। বাঁয়ে মোড় নিলাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুনের অকুস্থলে পৌঁছাতে চাইছি আমি। যদি কোন তরুণী মেয়ে খুন হয়ে থাকে তবে তার মানে সে আবারো হামলা করেছে। অবশেষে, ওকে ধরার একটা সুযোগ পেয়েছি আমি।


০৬


কাছাকাছি এসে মোটরসাইকেল থামিয়ে দিলাম আমি। আস্তে ধীরে নামলাম। আগে হাতের ব্যান্ডেজটা খুলে পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। দূরে অন্য কোথাও দেখে শুনে ফেলে দিতে হবে। হাত কাঁপছে আমার, উত্তেজনায়। বুকের ধুকপুকানিটা যেন নিজের কানে শুনতে পাচ্ছি আমি। একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় এখানে এসে হাজির হয়েছি আমি। ইউনিফর্ম পড়ে নেই, এই ধরনের অপরাধ-স্থলে আসার আগে যেসব প্রস্তুতি নেয়া লাগে তার কোনটাই নেয়া হয় নি তাও এই মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে যেতে চাইছি আমি। হাতটা ঘেমে গেছে, গায়ের জামায় মুছে নিলাম সেটা। সে যদি আবার একটা খুন করে থাকে তবে এইবার আমার হাত থেকে ওর নিস্তার নেই। ওর কথা খবরের কাগজে, অনলাইনে দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়েছে। যেমনটা ছড়িয়ে পড়েছে পুলিশের ব্যর্থতার কথা, তাদের অদক্ষতার কথা, শহরে মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার কথা। আমাদের হোমিসাইড বিভাগের তথাকথিত তুখোড় অফিসাররা খুনির হদিস বের করতে গিয়ে নাকাল হয়ে যাচ্ছে।

এই ধরনের কেস-এ সবাই যুক্ত হতে চায়। এইসব কেস যেখানে মিডিয়ার সাথে উঠাবসার সুযোগ অনেক বেশি, সেইসব কেস-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা সহজেই লাইম-লাইটের নীচে চলে আসতে পারে। তবে আমার উদ্দেশ্যটা সম্পূর্ণই ভিন্ন। আমি এই শুয়োরের বাচ্চাটাকে ধরতে চাই। আমাদের দেশে এর আগেও সিরিয়াল কিলারদের দেখা মিলেছে। কিন্তু ধারে ও ভারে কেউই এই সিরিয়াল কিলারের কাছে ধারেও থাকবে না। সাবহাটের খুনি। এই শহরটার নাম অনেক আগে ছিল 'সাহেব হাট'। সেটাই সময়ের সাথে সাথে পালটে গিয়েছে সাবহাট-এ। সেই সাবহাট শহরটাকে ভয়ের শিকল পড়িয়ে রেখেছে খুনিটা। শহরের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, উপকূলীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একের পর এক সুন্দরী তরুণী উধাও হয়ে যাচ্ছে। তাদের ক্ষতবিক্ষত দেহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে মনহারা নদীর কিনারায়, তাদের নিখোঁজ হওয়ার তিন-চারদিন পর। চয়ন এখন উবিপ্রবিতে সিএসই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে আছে। ও একদম কাছ থেকে দেখেছে এই খুনির কারনে ঘটা পরিবর্তনটা। অবস্থা অনেকটা এরকম হয়ে গিয়েছে যে পারলে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। মেয়েরা-তো ভয়ে একদম সিটিয়ে আছে। একসাথে দুই-দশজন না হলে কোথাও যাচ্ছে না, নিজেরা যেসব মেসে আছে সেইসব মেসে সিসিক্যামেরা লাগাচ্ছে, রাতে কোথাও বের হতে চাচ্ছে না, অপরিচিত মানুষ দেখলে যেন পালাতে পারলে বাঁচে।

আমি অনেকটা বোকার মতন আচরণ করছি। এমন একটা ভাব যেন আমি কেস-এর দায়িত্ব হাতে নিলেই খুনি আর পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। কিন্তু, জিনিসটাকে ঠিক কি বলা যায় আমি জানি না; আমার মাথার ভেতর একটা অনুভূতি টিকটিক করে বারবার বলছে যে আমি দায়িত্ব নিলে কোথাও না কোথাও, কোন না কোন, কিছু না কিছু উপায়, পথ, সূত্র ঠিকই বের করে ফেলব। হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত ধর্ষণের মামলায় আমার কাজ অনেকের চোখে পড়েছে। তবে সেটা যথেষ্ট না। খুনের মামলায় এর আগে আমি কখনো কাজ করি নি। সেখানে একেবারে সিরিয়াল কিলার! কিন্তু এই খুনির কাজ প্রথম থেকেই আমি দেখেছি, ওর সব কাণ্ড কীর্তি আমি পত্রিকায় পড়েছি, হেডকোয়ার্টারে বসে সব উড়ো কথা কিংবা গুজব শুনেছি। আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছে ওর চরিত্রের ছাপ, ওর ট্রেডমার্ক আচরণ, খুনের কেতা, ধরণ। হারামজাদাটাকে যখন হ্যাণ্ডকাফ পড়ানো হবে আমি ঐ জায়গায়, ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই। ওকে বলতে চাই যে আইনের হাত থেকে ওর নিস্তার পাওয়ার কোন সম্ভাবনা কখনো ছিল না।

দূর থেকেই খুনের জায়গাটা দেখে কিছু একটা মিলছিল না। পুলিশি হলুদ টেপের বাইরে ভিড় বড্ড বেশি। যেসব অফিসার আর গোয়েন্দাদের ঐ টেপের ভেতরে থাকার কথা তারা সবাই দেখি টেপের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছে, সিগারেট টানছে, এদিক সেদিক তাকাচ্ছে, হেঁটে বেড়াচ্ছে অলস ভঙ্গিতে। আমাদের এক ফটোগ্রাফারকে দেখলাম নদীর কিনারার দিকে কোন এক গানের সুর গুণগুণ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। এক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞকে দেখলাম একটা গাছের গোঁড়ায় বসে ঘাসের ডগা খুব মনোযোগ দিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। সবার হয়েছেটা কি? ইয়ে খেয়ে এসেছে নাকি সবাই? এটা যদি সাবহাটের খুনির কাজ হয় তাহলে তো সবার মারাত্মক ব্যস্ততার ও মনোযোগের সাথে কাজ করার কথা। এই শেষ সুযোগ। এরপর ঢাকা থেকে ডিবি আর সিআইডির গোয়েন্দারা এসে তদন্ত আমাদের হাত থেকে নিয়ে যাবে নিজেদের কাছে। সবার কাছে উপহাসের পাত্র হয়ে উঠবো আমরা। মাথা গরম হয়ে গেল আমার। আমি হলুদ টেপের নিচ দিয়ে অকুস্থলে ঢুকে মৃতদেহটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। একজন অফিসার উপুড় হয়ে বসে মৃতদেহটাকে কাছ থেকে দেখছে।

লোকটা ঘুরে তাকাল আর আমিও বুঝতে পারলাম কেন এই ঘেরাওয়ের ভেতর আর কোন পুলিশ অফিসার এসে ঢুকে নি। রহমান তৌফিক।

ত্যাড়া তৌফিক এখানে কি করছে?

(চলবে...)

প্রথম পর্ব পড়তে পারবেন এখান থেকে!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১২:৪৭
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×