অক্টোবরের এক তারিখ রাত তিনটা তেইশ মিনিটে ন্যাশনাল হেল্প-লাইন নাম্বার ৯৯৯-এ, বনশ্রীর সাত নম্বর রোডের তেরো নম্বর বাসার ফ্ল্যাট ডি টু থেকে মিসেস শান্তা রহমানের একটা ফোন গেলো। মিসেস শান্তা কম্পিত গলায় স্বল্প ভাষায় অপারেটরকে বললেন এই মাত্র, তিনি তার ঠিক পার্শ্ববর্তী ফ্ল্যাট ডি ওয়ান থেকে একটা প্রচণ্ড শব্দ শুনে জেগে উঠেছেন। যদিও তার এধরনের শব্দের সাথে খুব একটা জানাশোনা নেই, তবে তিনি মোটামুটি নিশ্চিত যে শব্দটা একটা পিস্তল থেকে ছোড়া গুলিরই হবে। খুব সম্ভবত পাশের বাসায় কোন চোর বা ডাকাত প্রবেশ করেছে ও বাধার সম্মুখীন হয়ে গুলি ছুঁড়ে নিজেদের পথকে নিষ্কণ্টক করে নিয়েছে। সেই সাথে মিসেস শান্তা এটাও জানাতে ভুললেন না যে পাশের বাসার মিস্টার ও মিসেস শওকত সপ্তাহ খানেকের জন্য থাইল্যান্ড ভ্রমণে গিয়েছেন। বাসায় এখন শুধুমাত্র তাদের ছেলে অর্ণব ছাড়া আর কেউ থাকার কথা নয়। হেল্প-লাইনের অপারেটর দ্রুতগতিতে নিকটস্থ থানায় খবরটা জানিয়ে দিল। সেই সাথে এটাও জানতে পারলো সেই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স থেকে এরই মধ্যে আরও দুইজন ব্যক্তি ফোন করে নিজেদের সন্দেহের কথা জানিয়েছেন। পুলিশ চোখ ধাঁধানো তৎপরতা দেখিয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যে ফ্ল্যাট ডি ওয়ান-এর সামনে হাজির হয়ে গেল। দরজা আধখোলা ছিল, সেই সাথে দরজা ভেঙে জোর করে কেউ প্রবেশ করেছে এমন আলামতও পাওয়া গেল না। অর্ণবকে সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। ড্রইং আর ডাইনিং এর ঠিক মাঝামাঝি থাকা পর্দার পাশেই তার রক্তাক্ত দেহ উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। একটাই মাত্র গুলি ছোড়া হয়েছে, সেটাও বেশ কাছ থেকে – সবচাইতে বড় কথা পেছন থেকে। মাথার পিছনের বেশ খানিকটা চুল পুড়ে গেছে উত্তাপে, মাথার খুলিটা গুঁড়িয়ে দিয়ে গুলিটা রক্ত আর মগজকে ছিটকে ফেলেছে চারপাশে। হাসপাতালে পাঠানোর কোন প্রয়োজন ছিল না অর্ণবকে। দেখা মাত্র যে কেউই বুঝতে পারবে, সব রকমের সাহায্যের অনেক ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছে সে।
পুলিশ প্রথমেই সবগুলো রুমে তল্লাশি চালিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলো যে আততায়ী এখনো কোথাও ঘাপটি মেরে নেই। তবে রান্নাঘরের ঠিক পাশের লম্বাটে, চিকন স্টোররুমের দরজায় ঝোলানো মস্ত বড় দুটো কিকো তালা, একটা ইয়েল লক আর একটা ডেডবোল্ট তাদের আগ্রহী করে তুলল। অনুমতির তোয়াক্কা না করে তারা দরজার তালাগুলো ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করলো ও এক পর্যায়ে দরজাটাকেই ভেঙ্গে স্টোররুমের ভেতরে প্রবেশ করলো। বুঝা যাচ্ছিল, স্টোররুমের ভেতরে কোন মালপত্র স্টোর করা নেই। বেশ ফাঁকা একটা ভাব। বাইরের আলোতে হালকা বোঝা যাচ্ছিল একপাশে থাকা ছোটখাটো টেবিল আর প্লাস্টিকের টুলটাকে। কোন বদ্ধ গন্ধও নেই, তার জায়গায় এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধটা বেশ টাটকা যেন এক-দুই ঘণ্টার মাঝেই দেয়া হয়েছে। পুলিশের একজন অফিসার হাতড়ে খুঁজে স্টোররুমের বাতিটা জ্বালিয়ে দিলেন।
স্টোররুমের দুইপাশের দেয়ালে হাজারো ছবি আর ছোট ছোট চিরকুট খুব সারিবদ্ধ ভাবে, সুন্দর করে গুছিয়ে সাজিয়ে রাখা। এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে সুতো টেনে জোড়া লাগানো। পাশেই চিরকুটে সময় লেখা। ডানদিকের দেয়ালে আটতলা ফ্ল্যাটের প্রতিটা তালার বেজোড় ইউনিটগুলোর নাম লেখা, আর বামদিকের দেয়ালে জোড় ইউনিটগুলোর। প্রতিটা তালার, প্রতিটা ফ্ল্যাটের যত বাসিন্দা আছে, তাদের ছবি, যাতায়াতের সময়, শিডিউল, রুটিন, তাদের প্রত্যেকের রুমের বিস্তারিত, ব্যক্তিগত নানান তথ্য, তাদের বুয়া, ড্রাইভার, দুধ ওয়ালা, পেপার ওয়ালা, নীচের গার্ডদের প্রতি রাতে তালায় তালায় ঘুরে আসার সময় – বাদ নেই কোন কিছুই।
ঘরের একমাত্র টেবিলে ছোট্ট ল্যাপটপ রাখা, পাশেই কালার প্রিন্টার। ল্যাপটপের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা ডকুমেন্ট পড়ে আর প্রিন্ট করে পাশেই রাখা কাগজের তাড়াগুলো উল্টেপাল্টে দেখে পুলিশের অফিসার ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারলেন। তার ফোনে থানার এস আই নিজেই এবার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। রুম দেখে ও কাগজগুলো পড়ে তিনিও নিশ্চিত হলেন যে সেকেন্ড অফিসারের সিদ্ধান্তই ঠিক। এই ছেলে, অর্ণব, খুব সম্ভবত এদেশের ইতিহাসের সবচাইতে বড় একটা হত্যাকাণ্ড ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এসব কিচ্ছা-কাহিনী পাশ্চাত্য দেশগুলোতে প্রচুর দেখা যায়। এদেশে কিছু জঙ্গি হামলা বাদে তেমন কিছু কখনো শোনা যায় নি। বিদেশে যেমন প্রায়ই দেখা যায় বন্দুক নিয়ে এসে সহপাঠীদের ব্রাশ-ফায়ার করে মেরে ফেলছে কোন অস্থির-মতি কিশোর। কিংবা রাস্তায় চলতে থাকা পথচারীদের উপর দিয়ে স্বেচ্ছায় ট্রাক চালিয়ে দিল কোন পাগলা ড্রাইভার। কিন্তু, এইভাবে একই বিল্ডিং-এ থাকা চোদ্দটা ফ্ল্যাটের একান্ন জন মানুষকে একই রাতের মধ্যে হত্যা করার এমন নিখুঁত পরিকল্পনা কেউ সুস্থ মস্তিষ্কে করতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না।
পরিকল্পনাটা সত্যি বলতে ভীতিকর রকমের নিখুঁত। এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকা নিজের সকল প্রতিবেশীর উপর যতরকমভাবে গোয়েন্দাগিরি করা যায়, করেছিল অর্ণব। তাদের ভেতরের ও বাইরের সব খবরই তার কাছে মজুদ ছিল। এখন শুধু সে এমন একটা রাতের জন্য অপেক্ষা করছিল যেদিন সব ফ্ল্যাটের সকল বাসিন্দাই নিজেদের বাসায় উপস্থিত থাকবে। তার মাথায় একটা তারিখ বেশ ঘোরাফেরা করছিল, অক্টোবর সাত। পরের দিন পূজার ছুটি। সকলেরই বাসায় থাকার কথা। এর মধ্যে তার বাবা-মাও থাইল্যান্ড থেকে চলে আসবেন, তারাও এই হত্যা-তালিকার বাইরে নন। তারপর সে একেবারে উপরের তালা থেকে শুরু করবে। একটা একটা বাসা শেষ করে, এক একটা তালার সকল বাসিন্দাদের খুন করা শেষে তার পরের তালা। এভাবে সকাল হওয়ার আগেই শেষ করবে একান্নটা হত্যাকাণ্ড। ভোরের প্রথম আলো দেখার মতন কেউ বেঁচে থাকবে না এই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। এমনকি প্রতিটা খুন ঠিক কিভাবে করবে তারও বিস্তারিত সে লিখে গিয়েছে। ডার্কনেট থেকে নামানো হরেক রকম পদ্ধতি, বেশ কয়েক রকমের ছুড়ি, চাপাতি, পিস্তলের বিস্তারিত খুঁজে পাওয়া গেল তার ল্যাপটপের ফোল্ডারে। প্রথম এক-দুই তালা সে নিঃশব্দে খুন করার কথাই মাথায় রাখছিল। বালিশ চাপা দিয়ে, কিংবা গলা টিপে। গীটারের তার দিয়ে গ্যারট তৈরি করার কথাও সে ভেবে রেখেছিল। পরের দিকে ছুড়ি, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল ব্যবহার করার কথাও লেখা আছে চিরকুটে। আবার নিজের বাবা-মাকে যন্ত্রণা কম দেয়ার জন্য বন্দুকের দুইটা গুলি বরাদ্দ করে রেখেছিল অর্ণব।
তবে এই সব হত্যার বর্ণনার মাঝখানে দুইজন মানুষের ব্যাপারে কিছুই লেখা ছিল না। তাদের নিয়ে হয়তো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল সে। একজন হচ্ছে জি ওয়ান এর মাসুদ নামের এক ছেলে, অর্ণবের ছোটবেলার খেলার সাথী ও সবচাইতে কাছের বন্ধু। একই সাথে স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে এখন অবশ্য মাসুদ সিলেটে শাবিপ্রবিতে পড়ছে। আরেকজন হচ্ছে ই টু-র সায়মা সুলতানা নামের এক মেয়ে। তার ব্যাপারে বিস্তারিত লেখা না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে অর্ণব হয়তো মনে মনে সায়মাকে পছন্দ করতো। তাই এই দ্বিধা। তাদের নাম আর ছবির পাশে বড় বড় করে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে রেখে নিজের দ্বিধাকে প্রকাশ করে রেখে গিয়েছে সে।
পরের দিন সকালে আর সবার মতন আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছিল পুলিশ। তারা অবশ্য এতকথা আমাকে বলেনি। কিছু রুটিন প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করতে এসেছিল, তাদের মতে। যদিও আমি জানি, অর্ণবের ব্যাপারে কিছু জানতে হলে আমার কাছেই আসতে হবে ওদের। হাজার হোক আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ইদানীং যদিও পড়াশোনার জন্য সিলেটে থাকার কারণে কথাবার্তা কমই হতো আমাদের, তবে অনলাইনে আমরা দুজনই খুব একটিভ থাকতাম। ফেসবুক, হোয়াটস এপ আর ইমো দিয়ে আড্ডা কম দিতাম না। পূজার ছুটিতে বাসায় এসে রাতেই ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি। আঙ্কল-আন্টিও বাসায় ছিলেন না, দেশের বাইরে গিয়েছেন বেড়াতে। তাই ভাবলাম, সারা রাত জম্পেশ আড্ডা হবে। অর্ণব আবার কোথা থেকে হগ-এর একটা বোতল যোগাড় করে রেখেছিল। দুজন মিলে সাবরে দিলাম কয়েক পেগ করে। অর্ণবের আবার এসব সয় না, সেই প্রথম থেকেই দেখছি। তাই মাতাল হয়ে সব উগড়ে দেয়ার পরও আমি বিশ্বাস করি নি। বিশ্বাস করলাম যখন নিজের চোখে দেখলাম। সায়মার ছবিটা দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম আমি। ভেবেছিলাম আজকেই ওকে জানাবো সায়মার সাথে আমার সম্পর্কের কথাটা। কপাল ভালো বলে বেঁচে গেলাম। আগে বললে আমার নামের পাশে থাকা প্রশ্নচিহ্নটা যে কোন নিপুণ পরিকল্পনায় বদলে যেত তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু, এই উন্মাদকে এভাবে ছাড় পেতে দেয়া যায় না। বন্ধু হোক আর যাই হোক, প্রেম আর যুদ্ধে নিয়মের কোন বালাই নেই। সেখানে আমি তো শুধু আত্মরক্ষা করব।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৩১