somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি ভ্রুনহত্যার গল্প এবং আমার নিজের প্রতি ঘৃণাবোধ...(কাল রাতে করা এই পোস্টটি সামুর বাগে খেয়ে ফেলায় আবার রিপোস্ট করতে হলো)

১৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি আজকাল প্রায় সকালেই দেরী করে ঘুম থেকে উঠি।আজও দিবানিদ্রাতেই থাকার প্রাণপন প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলাম।কিন্তু ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো নোকিয়া ফোনের কড়কড় রিংটোনে।সাধারণত এরকম ক্ষেত্রে আমি ঘুমের ভান করে পরে থাকি।কিন্তু আজকের ঘটনা ভিন্ন।কারণ ফোনটা করেছে মুনিয়া খালা।আমাকে যদি আমার দেখা পৃথিবীর দশজন ভালো মানুষের তালিকা করতে বলা হয় তাহলে আমি উনাকে এই তালিকাতে রাখতে পারবোনা।আমার কাছে উনি কারো সাথেই তুলনীয় নন।খালা আমাকে এতটাই ভালোবাসেন যে আম্মা মাঝে মাঝে উনাকে বলেন,"মুনিয়া আমার ছেলেরে তুই নিয়ে যা,তোকে আমি দিয়ে দিলাম।" মজার ব্যাপার হলো উনি আমার আপন খালা না।বিভিন্ন লতায়-পাতায় পেঁচানো খালা।প্রকৃতির কি অদ্ভুত লীলা যার মনটা এত মায়া দিয়ে গাঁথা,তাকেই খোদা কখনো নিজের সন্তানের মা ডাক শুনতে দেননি।খালার প্রথম সন্তান মারা যাওয়ার পর কি কারণে যেন উনি আর কখনোই মা হতে পারেননি।খালার সেই সন্তানটি ছিলো ছেলে,যে পৃথিবীতে আসার পূর্বে নাম প্রাপ্ত হয়েছিলো অর্ক।এর কিছুদিন পর আমার জন্ম হলে এই খালাই আমাকে তার সন্তানের জন্য রাখা নামটি দেন।শুনেছি জন্মের পর মুনিয়া খালা আমাকে নিয়ে যান কিনা এটা ভেবে আম্মা বেশ ভয়ে ছিলেন।হয়তো তার হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে আমার মাঝে খুঁজে পান বলেই প্রতিবার বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,"আব্বা গেলাম,তুমি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া কইরো।পড়াশোনা বাদ।"

আসল কথায় ফিরে আসি।আমি খালার ফোন ধরে সালাম দিতেই খালা কান্না কান্না কন্ঠে আমাকে অনেকগুলো কথা একসাথে বলতে লাগলেন।অস্পষ্টভাবে যা বললেন তাতে আমি যা বুঝলাম তা হলো,রিমি হাসপাতালে।আজকে ওর abortion করা হয়েছে।সমস্যা হয়েছে ওর জ্ঞান এখনো ফেরেনি।

রিমির পরিচয় দেয়া দরকার।রিমি আমার খালার পালিত কন্যা।ওকে দত্তক নেয়ার ঘটনাটা খুবই বিচিত্র।খালার সন্তান মারা যাওয়ার পর খালা একটু কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন।তখন ঘরের কাজের জন্য একজন বুয়া রাখা হয়।বুয়ার মাসখানেক আগে একটা মেয়ে হয়েছিলো।খালা বুয়ার বাচ্চাকে নিজের খাটে শুইয়ে ঘুম পাড়াতেন,কোলে নিয়ে রাখতেন,এমনকি খাইয়েও দিতেন।খালু এই ব্যাপার নিয়ে মহা পেরেশান ছিলেন।আমার আম্মাকে প্রায় বলতেন "আপা বুয়ার বাচ্চার জন্য আমি আজকাল ঘুমাইতে পারিনা,আমাকে আপনার বোন সোফায় ঘুমাইতে বলে নিজে বাচ্চারে আমাদের খাটে রেখে দেয়।বলেনতো এইটা কিছু হইলো?"।

দুঃখজনকভাবে বুয়া কাজ করার দুইমাস পরে তার শরীরে লিউকিমিয়া ধরা পড়ে।খালা শুধু বুয়ার কন্যাসন্তানটির জন্য হলেও বুয়ার অনেক চিকিৎসা করিয়েছিলেন।কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি। মৃত্যুর কয়েকঘন্টা আগে হঠাৎ করে বুয়া খুব হাসতে শুরু করে।একসময় খালার হাত ধরে বলে,"আপনে কিন্তু ওর মা আছেন,আপনারে কীরা দিয়া গেলাম"। আমার মমতাময়ী খালা এভাবেই রিমিকে পান। রিমি আর আমার বয়স প্রায় সমান।খুব বেশি হলে বছরখানেক ছোট হবে।ওর আপন মা মারা যাওয়ার পর খালা কখনো ওকে এতটুকু কষ্ট দিয়ে মানুষ করেননি।আমরা এবং খালার আত্নীয়স্বজনদেরকে খালা প্রথমেই বলে দিয়েছিলেন,উনাকে যদি কেউ আপন মনে করে তাহলে এই বাচ্চাকেও আপন ভেবে নিতে হবে।একবার আমার এক মামা কিছু একটা বলেছিলেন,মুনিয়া খালা চোখের পানি নাকের পানি এক করে তাকে ত্যাজ্য করেন।ওই মামা পরে রিমির জন্য ১০ কেজি চমচম কিনে খালার বাসায় রওনা হোন।খালা তো তার দরজা খুলেননা কোনভাবেই।পরে খালুজান অনেক কষ্টে খালাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে মামার সাথে ভাব করায় দেন।খালা শর্ত দিছিলেন,মামা যেন তার বাসায় কখনো মিষ্টি ছাড়া না আসে।আমরাও মামার বদৌলতে প্রায়ই চমচম খেয়ে তৃপ্তিভরা ঢেঁকুর তুলতাম।উল্লেখ্য রিমির প্রিয় খাবার ছিলো চমচম।

সবই ঠিক ছিলো,শুধু সমস্যা ছিলো খালুজান।খালা মনে করতেন খালুজান রিমিকে আপন মেয়ের মত ভালোবাসেননা।যদিও রিমি কখনো অভিযোগ করেনি,বরং খালুর সাথে দেখতাম তার বেশ ভালোই ভাব।খালু তার এই পালক কন্যাকে কখনো একবারের জন্যও সামান্য ধমক দেয়নি।তবুও খালা রিমিকে নিয়ে খালুজানকে প্রায়ই বকাঝকা করতেন।

সেই রিমির চার মাস আগে আকদ হয়ে গেছে আর আজকে কি ভয়ঙ্কর কথা শুনলাম।আমি খালাকে হাসপাতালের নাম জেনে এখুনি আসছি কথা দিয়ে ফোন রাখলাম।এর এক ঘন্টা পর আমি মনোয়ারা হাসপাতালে রিমির কেবিনের পাশের খোলা বারান্দায় দাঁড়ানো।আমার পাশে রিমির জামাই মুখ কাঁচুমাঁচু করে বসে আছে।আমি তাকে মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করলাম, abortion এর সিদ্ধান্ত কেন নিলো! উনি আমার দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে বললো, "এখনো তো ঘরে তুলে নেইনি।আম্মা বলছে অনুষ্ঠান করে বউ ঘরে নেবেন।তাই অনুষ্ঠানের আগে বাচ্চা হয়ে গেলে সমস্যা।এইজন্যই আর কি..."।আমি এহেন জবাব শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম।তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও আর ইচ্ছা হলোনা।খালা আর খালুর পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম। খালা তখন অঝোরে কাঁদছে মেয়ের পাশে বসে।খালু খালার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন চুপ করে।আমাকে দেখে খালা কাছে টেনে এনে বসালেন।তারপর কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, "তোমার খালুজানরে জিজ্ঞেস করো সে কেন কিছু করলোনা।এখন আমার সাথে আহলাদ দেখায় বলে মেয়ের কিছু হবেনা।কোনদিন এই লোক মেয়েটাকে নিজের মেয়ে ভাবেনাই।" খালু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ায় বলে, "আমি কি করবো?তোমার মেয়ের জামাই এমন সিদ্ধান্ত নিলে ওদের মধ্যে আমি কি কিছু বলার হক রাখি?" খালা এবার রেগে গেলো, "তুমি আমার সামনে থেকে দূর হও।তোমার মুখ দেখাও পাপ"। খালু আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন,তারপর কেবিনের বাহিরে হাঁটা দিলো।খালা আমাকে এরপর জিজ্ঞেস করলো,নাস্তা করছি নাকি।হালকা পাতলা কথা বললো।

এর একটু পর রিমির প্রথমবারের মত সেদিন জ্ঞান ফিরলো।খালা হন্তদন্ত হয়ে রিমির মাথার কাছে যেয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, "মা এখন কেমন লাগতেছে?ব্যাথা আছে?"। রিমি একটা কেমন অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে খালার দিকে তাকালো।তারপর খেব মৃদু কন্ঠে বললো, "আম্মু ভাইয়াকে অনেকদিন পর দেখলাম।ও তো বোনের কথা একবারও ভাবেনা।" আমি রিমির দিকে হাসি দিয়ে তাকিয়ে বললাম, "সময় পাইনারে।বাসাতেও আজকাল থাকিনা তেমন"। রিমির চোখ দিয়ে দেখলাম টপ টপ করে পানি পড়ছে।আমাকে কান্না কান্না গলায় বললো, "ভাইয়া জানিস ডাক্তার না মানা করছিলো বাচ্চাটাকে না মারতে,আমি সকালে আসলে ডাক্তার আমাকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে দেখায় আমার বাচ্চার ছোট্ট মুখখানা,তার হৃদপিন্ডের ধুক ধুক শুনায়।জানিস ভাইয়া অনেক ছোট্ট ছোট্ট হাত ছিলো।এমন কেন হলো রে?আমার বাচ্চাটা কি কোনদিন আমাকে মাফ করবেরে ভাইয়া?আমি অনেক কাঁদছিলাম যেন বাচ্চাটাকে না মারে,কিন্তু আমার কথা কেউ শুনেনাই।ভাইয়া আমার বাচ্চাটা এখন কই আছে বলতো?বেহেশতে না ভাইয়া?"

আমি চোখের পানি ঢাকার জন্য কেবিনের বাহিরে চলে আসি।পিছনে শুনলাম খালা অঝোরে কাঁদছে।বাহিরে এসে শার্টের কোনা দিয়ে চোখ মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ।একটু স্বাভাবিক হলে পিছন ফিরে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলাম।আমার খালুজান হাসপাতালের করিডোরের আরেক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।আমি উনার কাছে আস্তে আস্তে হেঁটে গেলাম।দেখলাম উনি রিমির আসল বাবা ফরিদ উদ্দিন সাহেবের কাঁধে হাত দিয়ে কান্নাভেজা চোখে এক গাদা কথা বলছেন। "বুঝলা ফরিদ আমার মেয়েটাকে যখন স্কুল থেকে নিয়ে আসতাম তখন প্রায় সে মিস্টির দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকতো।প্রতিদিন আমরা মিস্টির দোকানে যেয়ে একসাথে চমচম খেতাম।ওর জন্য প্রতিরাতে চমচম কিনে আনতাম।ওর মা ঘুমায় থাকতো,তখন আমি ওকে কোলে করে নিয়ে বারান্দায় ঘুরতাম আর মিস্টি ভেঙ্গে ভেঙ্গে মুখে দিতাম।ও আমার কোলেই খেতে খেতে ঘুমায় পড়তো।আজকে আমার এই মামুনীটা এভাবে হাসপাতালে শুয়ে আছে আর আমি ওর জন্য কিছু করতে পারছিনা।" ফরিদ সাহেব মাথা নিচু করে খালুজানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিইয়ে বললো, "কাইন্দেন না।আমাগো মাইয়ার কিছু হইবোনা।"

আমি এই দুই অশ্রসজল পিতার ভালোবাসার দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখলাম।কিছু সময় মানুষ অনুভূতিহীন হয়ে যায়।আমারো ঠিক এই মুহূর্তে এমনটাই মনে হচ্ছিলো।কত কথা মনে পড়ে গেলো।আমার এস.এস.সি,এইচ.এস.সি পরীক্ষার সময় রিমি প্রতিদিন বাসায় এসে এটা-ওটা রান্না করতো।আমাকে বলতো, "আমার ভাইয়া হলো সবসময় ফাস্ট।তাই এখন পরীক্ষার জন্য ওর খাবারও হবে ফাস্টক্লাস।" আমি এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে বললাম , "বোনরে আমি কোনদিন ফাস্ট হইতে পারিনাই।কিন্তু তুই সবসময় বোন হিসেবে আমার কাছে ফাস্ট ছিলি"।

আরেকবার চোখে পানি মুছতে মুছতে খালার চিৎকার শুনতে পারলাম।আমি হুড়মুড় করে কেবিনের দিকে দৌড় দিলাম।দেখি রিমির শরীর কেমন কুঁকড়িয়ে যাচ্ছে।হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।ডাক্তার ডেকে আনা হলো।রিমির জামাই আফসার সাহেব ছুটাছুটি করতে থাকলেন।ডাক্তার সবাইকে রুম থেকে বাহিরে যেতে বললে আমরা কেবিনের বাহিরে জমায়েত হলাম।আমার খালা অঝোর ধারায় তখন কাঁদছে। "আমার মেয়েটার এমন সর্বনাশ হয়ে গেলো আমরা কিচ্ছু করতে পারলাম না।কেমন ছেলের কাছে বিয়ে দিলাম।আজকে বিয়ে বাঁচাতে মেয়েটাকে মনে হয় মেরেই ফেললাম।"...খালার এইসব কথা শুনে রিমির জামাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।আমি উনাকে যেয়ে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলাম, "বউ বলে কি রিমির সাথে যা ইচ্ছা করার অনুমতি পায়া গেছেন।ওরে মানুষ মনে হয়না?নিজের বাচ্চারে এভাবে মারতে ঘৃনা হলোনা?" আমি এই কথা বলে সোজা হাসপাতালের বাহিরে চলে আসলাম।আমার কিচ্ছু তখন ভালো লাগছিলোনা।কি অসহ্য এই মানব জীবন।আমরা মানুষগুলো দিন দিন কেমন যেন অমানুষ হয়ে যাচ্ছি।আজকে রিমির সাথে যা হয়েছে,সামাজিকতার দায়ে না জানি আর কত মেয়ের সাথে এমন হয়ে চলছে প্রতিদিন।

রাত আটটার দিকে রিমির কেবিনে আমরা সবাই।অতিরিক্ত রক্তপাতের জন্য ওর অবস্থা তখন মুমূর্ষ।সেই সময় পান খেতে খেতে আবির্ভাব ঘটে রিমির শ্বাশুরীর।উনি রিমির কপালে হাত দিয়ে বলেন, "এখুন কিমুন আছে মাইয়া?" খালা কটমট চোখে তাকিয়ে বলেন, "আমি যদি আগে জানতাম আপনারা আমার মেয়ের সাথে এই কাজ করবেন তাহলে..." ।রিমির শ্বাশুরী খালার দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে বলেন, "আমি কি জানতাম আপনার বাসায় আমার পোলা যায়া থাকে?আর মাইয়া তো বড় হইছিলো।তার বুদ্ধি থাকলেইতো পোয়াতি হওয়া লাগতোনা।আমার পোলাটাও যে বেকুব এইটাও খাটি সত্য।" রিমির আসল পিতা ফরিদ সাহেব মহিলার দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বললো, "আমার স্যান্ডেলটা কিন্তু চামড়ার না প্লাস্টিকের।মুখে পড়লে দাগ যাইবোনা।আমি যদি বুজতাম আগে,আমার মাইয়ারে বিয়া বইতে দিতামনা।আপনার পোলারে থুতু দিয়া আসতাম।" রিমির শ্বাশুরী এই কথার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।তিনি সাথে উঠে উঠে দাঁড়িয়ে গজগজ করতে করতে হাঁটা দিলেন।পিছন থেকে তার ছেলে "আম্মা আম্মা" করে নপুংশকের মত হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে গেলো।

রাত্রি নয়টায় রিমির জ্ঞান কিছুটা ফিরে আসে।সে "আব্বু আব্বু" বলে ডাকা শুরু করে।খালুজান রিমির খাটের পাশে বসে শক্ত করে ওর হাত ধরে আছেন যেন কেউ তার মেয়েকে তার থেকে কেঁড়ে নিতে না পারে।রিমি খালুজানের আঙ্গুলগুলো আস্তে আস্তে দুর্বল ভাবে ধরে মৃদু কন্ঠে খালুকে আরো কাছে আসতে বললো।ওর দুর্বল গলার স্বর আমরা ঠিকই শুনতে পাচ্ছিলাম।কেমন যেন তীব্র হয়ে তা কানে বিঁধছে। "আব্বু তুমি যে আমাকে মার থেকে বেশি ভালোবাসো এটা আমি কিন্তু জানি।তোমার মনে আছে আমি যখন ছোট্ট কালে টাইফয়েড জ্বরে অজ্ঞান হয়ে ছিলাম,তখন তুমি সব কাজ রেখে সারাদিন আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরেছিলে?যে ভালোবাসা তুমি আর আম্মু আমাকে দিছো আমি হাজার জনমেও এর ঋণ শোধ করতে পারবোনা।আমি মারা গেলে তুমি কিন্তু আম্মুর অনেক খেয়াল নিবা।তুমি আর ভাইয়া ছাড়া আম্মুজানের কেউ নাই।আর আব্বু আমার বাচ্চাটা খুব সুন্দর হইতো জানো।ওর তো বয়স দুই মাস হয়ে গেছিলো।আমার মনে হতো,ও হালকা নড়াচড়াও করতো।আমি ওর সাথে প্রতিদিন রাতে কত কথা বলছি।গতরাতে ও আমাকে স্বপ্নে বলছিলো আম্মু আমার হার্ট ধুকধুক করে।তুমি বেশি নড়াচড়া কইরোনা ঘুমের সময়।"

আমার খালাখালু অসহায় চোখে রিমির পাশে বসে তার কথা শুনছিলো।রিমি শ্বাস টেনে টেনে এতগুলো কথা অনেক কষ্ট করে কিভাবে বললো জানিনা।আমি নিজের চোখের পানি আটাকাতে পারছিলাম না।সবাই রিমিকে বলছিলো ও যেন চুপ করে থাকে।ওর কিচ্ছু হবেনা।কিন্তু আমি জানতাম,অনেক আগেই জানতাম এই নোংরা পৃথিবী ওর জন্য না।

আমার জানাটা মিথ্যা ছিলোনা।রাত তিনটায় রিমি মারা যায়।দিনটি ছিলো ১৯শে অক্টোবর,২০০৮।মারা যাওয়ার আগে সে শেষবার আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, "ভাইয়া আমার বাবুর কাছে যাচ্ছিরে"। আমি এখনও রিমিকে অনেক মনে করি।আমার বোনটা কোথায় আছে,কেমন আছে জানিনা।কিন্তু আমি সবসময় প্রার্থনা করি যেন আমার সকল পুণ্য ও আর ওর অনাগত সন্তানটি পায়।ওর স্বামীকে আমরা কখনো ক্ষমা করিনি।অবশ্য সেও রিমিকে কবর দেয়ার পর থেকে কখনো আর আমাদের সামনে মুখ দেখায়নি।শুনেছি ভদ্রলোক(?) এখন সুইডেনে আছে।আরেকটা বিয়ে যে করেছে এটা না বললেও চলে। আর আমার মুনিয়া খালা সারাদিন তার বাসার বারান্দায় বসে থাকেন।কারো সাথে তেমন কথা বলেননা।শুধু আমি বাসায় গেলে আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করেন,"তোরা সব এমন কেন?"।এরপর কান্নাকাটি করেন অনেক, যা আমি সহ্য করতে পারিনা বলে নিজেই দুফোঁটা চোখের জল ফেলে বাসা থেকে বের হয়ে আসি।পিছনে শুনতে পাই আমার খালু গম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকেন, "কাইদোনা মুনিয়া।আমার মেয়েটা কষ্ট পাবে"।

[লিখায় বর্ণিত ভ্রুণহত্যার ঘটনাটি কল্পিত নয়।নামগুলো আর কিছু চরিত্র পালটে দিয়েছি।গল্পের রিমি মারা গেলেও বাস্তবের রিমি বেঁচে আছে।কিন্তু যে মানসিক যাতনার সে স্বীকার হয়েছে তাকে বেঁচে থাকা বলে কিনা বলতে পারছিনা।তার গুণধর স্বামীও তাই পার পেয়ে গেছেন এবং আপাতত ইউরোপে যাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছেন।Abortion এর জন্য আমাদের দেশে অনেক মায়ের মৃত্যু ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।আমার জানামতে ব্যাপারটা খুবই কমন।এই লেখাটা সেই মা আর তাদের অনাগত সন্তানের জন্য।আরো বলে নিচ্ছি গল্পতে বর্ণিত অর্ক আমি নই।অর্ক সেই মানুষটি যার থেকে পুরো ব্যাপারটি জানা গেছে।রিমি ও তার অনাগত সন্তানের জন্য সবাই আশা করি একবারের জন্য হলেও প্রার্থনা করবেন।লেখার সময় আমার নিজের প্রতি বেশ ঘৃণাবোধ হয়েছে।কারণ এই নোংরা সমাজের আমিও এক অংশ।] ******************************************************************** সবশেষে আমার কিছু একান্ত দুঃখবোধ ব্লগ সম্পর্কিত।কাল রাতে পোস্টের নিচের অংশে এডিট করতে গিয়ে ফিরে এসে দেখি আমার লিখা গায়েব হয়ে গেছে।এমনকি ড্রাফটেও নেই।আমি ব্লগে সমস্যা অংশে যেয়ে তাদের কাছে মেইল করলাম আমার পোস্টটি ফিরিয়ে আনার।দুপুর ১২টার দিকে তারা আমার পোস্ট ফিরিয়ে দেয় মন্তব্য সহ কিন্তু তা ছিলো সম্পূর্ণ পোস্টের অর্ধেক।বাকি অর্ধেক কোথায় গেল জানিনা।তাই আবার পোস্ট এডিট করতে গেলাম এবং বিরক্তিকর ভাবে আবার পোস্ট উধাও।এ ব্যাপারে তাদের কাছে সমাধান চেয়ে মেইল করলাম,কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার তাদের কোন সাড়াশব্দ পেলামনা এই অব্দি।এভাবে এতগুলো মানুষের মন্তব্য এবং আমার লিখাটি উধাও হয়ে গেলো দেখে আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছি।আমি জানিনা ব্লগের মডারেটররা কেন এই সমস্যাগুলো থেকে নিজেদের দূরে রাখেন।আমি কাল রাতে করা আমার পোস্টটি ব্লগে প্রকাশ করতে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়েছি।পাক্কা দুঘন্টা লেগে গেছে লিখাটি ব্লগে আনতে।আমার জানা মতে বাংলা ব্লগের মধ্যে এই ব্লগের ব্যবহারকারী সর্বাধিক।কিন্তু এই যদি হয় ব্লগের হাল আর মডারেটরদের সেবার হাল,তাহলে আপনার আমার মত ব্লগাররা কেন এই ব্লগে আসবেন আর লিখা দিবেন?

আমি কালকে রাতে যারা পোস্টে মন্তব্য করেছেন তাদের কাছে অত্যন্ত দুঃখিত।যারা আমাকে দোষারোপ করেছিলেন "অর্ক" মনে করে তাদের জন্য লিখার শেষ অংশে সারকথায় কিছু এডিট করে দিয়েছি।আমার এই পোস্টটি লিখার উদ্দেশ্য ছিলো ভ্রুণহত্যার ব্যাপারটি মানুষের সামনে তুলে আনা।বারবার পোস্ট মুছে যাওয়ায় বিরক্ত হয়েছেন তাদেরকে সামহোয়ার ইন ব্লগের মডারেটরদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করার নিতান্ত কাতর অনুরোধ জানাচ্ছি।ম্যাভেরিক ভাইয়ের ব্লগে গিয়েও একইরকম সমস্যা তার ক্ষেত্রেও হয়েছে বলে শুনেছি।

সবশেষে একটাই প্রশ্ন ব্লগের এহেন বাঘ ভালুক থেকে আমাদের বাঁচার উপায় কি বলতে পারেন?
৫১টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×