somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অমানুষ

৩১ শে মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৪:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করলাম।লাল রঙের জ্যাকেট।সাথে গলায় মেরুন রঙের মাফলার জড়ানো। একটু পরপর নাক টানছে,অথচ এখন মোটেই শীতকাল না। গাড়িতে উঠে সে পিছনে ভয়ে ভয়ে তাকাল। তারপর জ্যাকেটটা খুলে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে মনে হয় কিছু বলতে চাইলো। একবার মনে হয়েছিলো ভদ্রতা করে নামটা জিজ্ঞাসা করি। পরে মনে হলো, ওদের কাছে ভদ্রতা শব্দটার খুব একটা হয়তো মূল্য নেই। এসবের এরা ধার ধারেনা।
প্রায় আট মিনিট পর মেয়েটা আমার দিকে না তাকিয়ে খুব নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে বললো, “সিগারেট খাবেন?”
আমি হাসিমুখে বললাম, “আমি সিগারেট খাইনা। তবে গন্ধে সমস্যা নেই। আপনি চাইলে খেতে পারেন”।
মেয়েটা মাথা নেড়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সিগারেট ধরালো।আমি গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালাটা খুলে দিয়ে বললাম, “আপনার নাম জানা হয়নি। জানার প্রয়োজন নেই। কারণ জিজ্ঞাসা করলে আপনি আমাকে বানিয়ে একটা নাম বলবেন। আমার মিথ্যা পছন্দ না”।
মেয়েটা আমার দিকে চমকিয়ে তাকিয়ে বললো, “মিথ্যা নাম বলবো কেন? আমার নাম মিথিলা। পুরা নাম মিথিলা শারমীন। আপনার নাম জানতে পারি?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “ইন্তিহাব মির্জা। আমাকে সবাই ইন্তিহাব নামে ডাকে। আপনি আমাকে এই নামে ডাকতে পারেন”।
মেয়েটা একটু ইতস্তত করে বললো, “কিছু মনে করবেন না। আমাকে আমার ম্যানেজার সঠিকভাবে বলেনি আপনার সাথে কোথায় কোথায় যেতে হবে। আর কতদিনের জন্য......”
আমি মাথা নেড়ে বলি, “আপনাকে আমি অন্যভাবে নিয়েছি। কোন দিনক্ষণ ঠিক নেই। যদি আমাদের দুজনের দুজনকে ভালো লাগে তাহলে এক সপ্তাহও হতে পারে। না লাগলে হয়তো এক ঘন্টা পরে আপনাকে আমি ড্রপ করে দিবো”।
মিথিলা গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে ধোঁয়া বের করে দেয়। একবার মনে হলো যেন হাসলো, কিন্তু কোন কথা হলোনা পরবর্তী আধা ঘন্টা। আমি একটু পর বললাম, “রাতে লাঞ্ছ করা হয়নি। আমি একটু পর মীরসরাইয়ের দিকে গাড়ি থামাবো। আপনি কিছু খাবেন?”
মিথিলা মাথা নেড়ে বলে, “নাহ খুব একটা ক্ষুধা নেই। তবে যদি এক কাপ চা খাওয়া যায় মন্দ হয়না। আচ্ছা আমরা কি এখন ঢাকার দিকে যাচ্ছি?”
আমি ওর প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। সামনে একটা গাড়ি উলটে পড়ে আছে দেখে সেটাকে ভালো ভাবে দেখছিলাম। আস্তে করে আমার করোলা জি ২০১০ মডেলের গাড়িটা রাস্তার একপাশে নিয়ে থামালাম। মিথিলা মনে হয় একটু ভয় পেয়েছে। আমাকে আস্তে আস্তে বললো, “এখানে সমস্যা আছে। বিশ্বাস করেন। প্রায় দিন ডাকাতি হয় মিথ্যা এক্সিডেন্ট দেখিয়ে”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আমি জানি। সামনের গাড়িটা আমার এক বন্ধুর। ও আমার একটু আগেই বের হয়েছিল আমার মতই ঢাকা যাবে বলে। যদি বেঁচে থাকে আমার হাসপাতালে নিতে হবে”।
মিথিলা বললো, “কিছু মনে করবেন না আমি নামবোনা। এখন ওই ভাঙ্গা গাড়ির পাশে যারা আছে তারা মানুষ না। এরা যাকে এখন পাবে তার থেকে সব নিয়ে এরপর মেরে ফেলবে। যদি আপনার সাথে এমন কিছু হয় আমি আপনার গাড়ি নিয়ে চলে যাবো। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। দয়া করে চাবিটা দিয়ে যাবেন? আমি যেই হোটেল থেকে আমাকে পিক করেছেন সেখানে গাড়ি পৌছে দেবো, আই সয়্যার”।
আমি মিথিলাকে গাড়ির চাবি দিয়ে নেমে পড়লাম। মজনু আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। আজকে চিটাগাং এসে ওর সাথে দেখা করেছিলাম। মিথিলাকে নেয়ার আগে ওর সাথেই ছিলাম আমি আজকে সারাদিন।আমার একটু আগেই ও গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলো মীরসরাই ওর শ্বশুরবাড়ি যাবে বলে।আমি ওর গাড়ির পাশে যেয়ে দাঁড়িয়ে দেখি ভেতরে শুধু রক্ত। ডান দিকের দরজাটা একটু খোলা, সেখানে মজনুর মাথার অর্ধেকটা বেওয়ারিশের মত হেলান দিয়ে পড়ে আছে। একটা চোখ আর আরেক চোখের অর্ধেক দেখতে পাছি। বাকিটা মনে হয় গাড়ির ভেতর। আমাকে দেখে ২৭-২৮ বছরের কয়েকটা ছেলে এগিয়ে এলো। আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, “ভাই দেখছেন কেমনে মারছে? আপনেরে যদি কেউ এমনে মারতো, চিন্তা করেন খালি”।
আমি মাথা নেড়ে বলি, “কামরুল কোথায়?”
ছেলেগুলো মনে হয় হতচকিত হয়ে গেলো। আমি আবার শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, “কামরুল কই?”
একটা ছেলে আমার গালে একটা থপাস করে চড় দিলো। তারপর বললো, “বেশ্যার পুলা নাম ধর‍্যা ডাকোস তোর এত্ত সাহস?”
আরেকটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো, “ওই নটির পো কামরুল ভাই কত্ত বড় আরটিস্ট জানোস। এই যে এই মরা ব্যাটার মাথাটা চাপাতি দিয়ে কোপায় ভাংছে কয় মিনিট লাগছে জানোস? সাড়ে নয় মিনিট। হেয় কোন মন্ত্রী, এমপিরে মানেনা। রাউজানের কমিশনাররে গত পরশু কুপায় আইছে। আজকে তুই লাস্ট খেপ। এরপর দেখ কি হয়”।
একটু পর কামরুল নামে লোকটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “উস্তাদ হাগতে গেছিলাম। পানি লইতে পারিনাই। তাই একটু দেরী হইছে আসতে”।
এরপর ওর সাথে তিনটা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো, “এইটারে আজকে চার টুকরা করুম। তাকায় দেখবি কেমনে করি। তোগো দিয়া এরপর কোপানোর কাজ করমু। আমার আর ভাল লাগেনা”।
আমি বললাম, “কামরুল ভালো আছো?”
কামরুল আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “উস্তাদ আমারে কি চিনেন কোনভাবে?”
আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে আমার যেই গালে থাপ্পর লেগেছিলো সেই গালটা ভালো ভাবে মুছি। এভাবে সময় নষ্ট হচ্ছে তাই খুব বিরক্ত লাগছিলো। রুমালটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে বলি, “আমি তোমাদের সবাইকে তোমাদের কাজ দিয়ে চিনি। সমস্যা হলো, গাড়ির লোকটা আমার ভাইয়ের থেকেও বেশি ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন এক হলে এক রুমে কাটিয়েছি। কাজটা ঠিক করোনাই”।
কামরুল আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “আজকে তোরে খুব মজা কইর‍্যা কুপামু। শুদ্ধ ভাষা মারাস আমার লগে, ভাব দেখাস”।
আমি মাথা নেড়ে বলি, “ওইযে গাড়িটা দেখছো ওটা আমার। একটা মেয়ে সেখানে বসে আছে। আমার স্ত্রী। ও ভালো গাড়ি চালায়। তুমি আমার সাথে কিছু করলে ও গাড়ি নিয়ে চলে যাবে। টাকা পয়সা সব কিন্তু গাড়িতে, তোমার কোন লাভ হবেনা। তার থেকে আমি তোমাকে গাড়িতে রাখা টাকা আর আমার বউয়ের গয়না সব দিয়ে দিচ্ছি। এরপর আ্মি আমার রাস্তায় তুমি তোমার রাস্তায়। চলবে?”
কামরুল মাথা চুলকায়। ওর সঙ্গীসাথীদের দিকে তাকিয়ে বললো, “হালায় পুরাই বোকচোদ আছে”। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একটা ক্রুর হাসি দিয়ে বললো, “চল তোর গাড়ির কাছে যাই”।
আমি কামরুলকে নিয়ে আমার গাড়ি যেটা ১০০ মিটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে নিয়ে যাই। গাড়িতে যেয়ে দেখি মিথিলার চোখ মুখে অবর্ণনীয় ভয় কাজ করছে। ও এক হাতে শক্ত করে গাড়ির চাবি ধরে রেখেছে। আমি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলি, “কিছু হয়নি। ভয় পেওনা”।
কামরুল গাড়ির বনেটে হাত বুলিয়ে বলে, “করোলা হইলো ফকিন্নীগো গাড়ি। তারমধ্যে ছয় সাত বছর আগের মডেল। এইটার এখন কোন ভেলু নাই”।
আমি মাথা নেড়ে বলি, “সঠিক। আমি এখন গাড়ির ভেতর ঢুকবো, টাকা পয়সা বের করবো। এই নাও গাড়ির চাবি। আমি যে পালিয়ে যাচ্ছিনা সেটা আশ্বস্ত করতে তোমাকে এটা দিচ্ছি”।
কামরুল হাত নেড়ে বলে, “তুমি চান্দু আমার থেকে আজকে বাঁচবানা। কথা কম, সব বাহির করো”।
আমি আমার সিটটা তুলে এক সপ্তাহ আগে কেনা Rossiটা খুজতে থাকি। ২০১৬ তেই এই রিভলবারটা বের হয়েছে। ফিনিশিং চমৎকার, দামে সস্তা এবং খুব দ্রুত ফায়ার করে। রিভলভার পকেটে ভরে আমি কামরুলের দিকে তাকাই। খেয়াল করলাম কামরুল মিথিলার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি শান্ত কন্ঠে বললাম, “একটু সমস্যা হয়েছে”।
কামরুল কফ ঝেড়ে বলে, “রাখ তোর সমস্যা। তোর বউটারে একটু টিইপ্যা দেই। ভাল লাগছে খুব। জামা কাপড় খুব একটা পড়েনাই মনে হইতাছে। আধ ঘন্টার জন্য নিমু। ঝামেলা করলে আগে তোরে মারমু তারপর ওরে নিমু”।
কামরুল জানালা দিয়ে হাত বের করে মিথিলার গলার নিচে হাত দিতে গেলে আমি ওর হাতটা ধরি। আস্তে আস্তে বলি, “কামরুল হাতটা সরাও।আমার স্ত্রীর গায়ে হাত দেবেনা।তার চেয়ে আমি যেটা বলি মন দিয়ে শোন। আমি এখন তোমার পায়ে একটা গুলি করবো। আমি চাই তুমি আহত হয়ে সাথে সাথে যেন শুয়ে পড়ো। ব্যাথায় তুমি শব্দ করবে, এটাতে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি ঠিক সাড়ে নয় মিনিট নেবো তোমার ছেলেদের মেরে চোখ খুলতে। সময় একটু কম নিতে পারতাম, কিন্তু তাহলে ব্যালেন্স হয়না। তোমরা যতটুকু সময় নিয়ে একজন ভালো মানুষকে মেরেছো, আমি ঠিক ততটাই সময় নেবো তিনজন পিচাশকে মারতে। চলবে?”
কামরুল হাত সরিয়ে নেয়। আমার দিকে তাকিয়ে এই প্রথম যেন একটু ভয় পায়। আমার চোখের মণি বিড়ালের মত। খুব একটা দেখতে হয়তো প্রীতিকর না। যদিও ভার্সিটিতে থাকতে মুনাকে যখন হাত ধরে বলেছিলাম, ভালোবাসি তখন সে আমার চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। এরপর হাত ছাড়িয়ে বললো, “তোমার চোখ খুব সুন্দর জানো। আমি খুব দুঃখিত তোমাকে আমি ভালোবাসতে পারবোনা। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। ক্লাসে কেউ জানেনা এখনও। আমি অনুষ্ঠান করে সবাইকে এমনিতেই বলতাম”।
মূল গল্পে ফিরে আসি। মিথিলা গাড়িতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, আমি কামরুলের পায়ে খুব দ্রুত একটা গুলি করি। রিভলভার Rossiএর আরেকটা বিশাল সুবিধা হলো, আওয়াজ খুব কম হয়। একবারে মিনিমাল।
গাড়ি থেকে বের হয়ে আমি দেখলাম কামরুলের তিন সাগরেদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোমাদের বয়স কম। আমি খুব দুঃখিত তারপরেও তোমাদের বাঁচিয়ে রাখা যাবেনা । কারণ তোমরা এখন ট্রানজিশান স্টেজে আছো। সামনের জীবনে মানুষের রক্ত না দেখলে হয়তো ঘুমাতে পারবেনা। এই নেশা আমি বুঝি। আচ্ছা এটাও জানিয়ে দিচ্ছি তোমাদের মারার পর আমি মাথা কেটে চোখ তুলে ফেলবো। তবে তখন কিন্তু তোমাদের জ্ঞান থাকবে।একটু ব্যাথা হবে। তবে তোমরা একটু পরেই মারা যাবে, পঙ্গু হয়ে ভিক্ষা করতে হবেনা”।
ওরা দৌড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে আমি সবার শরীরের পিছনে গুলি করলাম। তারপর একটা করে ঠিক পায়ের রগে যেখানে আহত হলে মানুষ আর হাঁটতে পারেনা। আমার হাতে আর সময় আছে আট মিনিট। অনেক সময়। যেই ছেলেটা আমাকে চড় মেরেছিলো তার পকেট থেকে একটা ধারালো চাকু নিয়ে কাজ শুরু করি। আমি নিশ্চিত মিথিলার জ্ঞান ফেরেনি,সে এসব সহ্য করতে পারতোনা।
কাজ শেষ করে আমি কামরুলের কাছে যেয়ে বলি,”কামরুল তোমার জন্য ১৫ মিনিট। আমি তোমাকে যত্ন করে মারবো। কিছু মনে নিওনা”।
কামরুল আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “বাবা ও বাবা আপনি কে একটু কইবেন?”
আমি আমার সাদা শার্টে রক্তের দাগ মুছতে মুছতে বলি, “আমার নাম ইন্তিহাব। তুমি আমাকে চেনোনা। আমার চেহারা আর নামে কেউ আমাকে চেনেনা। কাজে চেনে। এখন তোমার মত বেজন্মাকে আমার নিজের পরিচয় দিতে ইচ্ছা হচ্ছেনা। কাজ শুরু করি তাহলে”।
আমি কথা শেষ করে কামরুলের চোখে ধারালো ছুরিটা ঢুকিয়ে দেই। অনেকদিন যত্ন করে কাউকে মারিনি।কামরুল গোঙ্গাতে থাকে। আমি খুব দ্রুত ওর চোখ তুলে মাথা এবং দুই পা আলাদা করে ফেলি। সময় নিলাম চৌদ্দ মিনিট, টুকরো করলাম চারটা।একদম ও যেমন আমাকে চেয়েছিলো। রাস্তা এতোটা শুনশান। দুয়েকটা গাড়ি অতিক্রম করেছিলো, কিন্তু কেউ ভয়ে থামায়নি।আমি নিশ্চিন্তে কাজ শেষ করি।
গাড়ির পেছনে আমি প্রায় দশ লিটার পানি নিয়েছিলাম। কাপড় চোপর খুলে সেগুলা দিয়ে হালকা একটা গোসল সেরে নতুন জামা কাপড় পড়ে নেই। আমার ছোটকাল থেকে পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালো লাগে। আমি যতবার খুন করি, এরপর গোসল করে নেই। রক্তের দাগ ভালো লাগেনা।কেমন বাজে একটা বোটকা গন্ধ।ওয়াক থু!
মিথিলা একটু পর জেগে উঠে। আমি তখন গাড়ি নিয়ে মীরসরাইয়ের প্রায় শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। মিথিলা কাঁপতে কাঁপতে আমাকে বলে, “কি হয়েছিলো পরে? আমরা কি বেঁচে আছি?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বলি, “কিছু টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম। ছেড়ে দিয়েছে”।
ও ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, “আমার গায়ে কি হাত দিয়েছিলো?”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “আপনার কি খুব যায় আসে?”
আমার মনটা ভালো ছিলোনা। মজনুর লাশটা এভাবে রাস্তায় বেওয়ারিশ কুত্তার মত ফেলে রেখে এসেছিলাম। অথচ এই বন্ধুটা ভার্সিটি লাইফে আমার জন্য কত কিছু করেছে। কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। মিথিলাকে নিয়ে আমার এক জায়গায় যেতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় যেতে হবে। দেরী হলে সমস্যা।আমার কথা শুনে মিথিলা মনে হয় খুব আহত হয়েছে। ভয় কেটে যাওয়ার পাওয়ার ও খুব ঘৃণা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি টাকার জন্য এই চাকরী করি। কিন্তু আমি সস্তা না। জন্মের সময় মা আমাকে রাজকন্যা বলতো। অন্য আট দশটা মেয়ের মত আমাকেও অনেক যত্নে মানুষ করেছে। আমিও একসময় ভালোবাসতাম। আমার মনটা এতোটা সস্তা না”।
আমি কিছু বললামনা , এইসব বালছালের কথা শুনতে ভালো লাগছিলোনা। মনটা বেজায় খারাপ।আজকে আমার মায়ের জন্মদিন ছিলো, আমি ভুলে গেছি।আমি এতোটাই অধম যে মায়ের কবর গত তিনবছরে একবারও জিয়ারত করতে পারিনি।
প্রায় ঘন্টাখানেক কেউ কোন কথা বললাম না। কুমিল্লার কাছাকাছি এসে আমি গাড়ি থামালাম। মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমি দুঃখিত। মনটা ভালো নেই। এখন ক্ষুধা লেগেছে। কিছু খেতে হবে।আপনার নিশ্চয়ই যথেষ্ট ক্ষুধা পেয়েছে। আসুন আমার সাথে”।
মিথিলার সাথে চা খেতে খেতে আমি বললাম, “আপনার গায়ে কেউ হাত দেয়নি। আপনি যতক্ষণ আমার সাথে থাকবেন ততক্ষণ নিশ্চিন্তে থাকবেন। কেউ আপনাকে স্পর্শ করবেনা। ঠিক আছে?”
মিথিলা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোট্ট করে একটা হাসি দিয়ে বলে, “ল্যাম্পপোস্টের আলো ভেজা রাস্তায় পড়ে কেমন করে একেঁবেকেঁ গেছে দেখেছেন?”
আমি ওর কথার উত্তর দিলাম না। বোঝার চেষ্টা করলাম সে কি বলতে চাচ্ছে।মিথিলা বলতে থাকলো, “আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমাদের পাশের বাড়ির এক ছেলে আমাকে প্রপোজ করলো। আমি খুব একটা কিছু বুঝতাম না। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালো ছিলো। ডিগ্রী কলেজে পড়তো। সবচেয়ে বড় কথা ওরা বেশ ধনী ছিলো। আমরা তখন অনেক গরীব ছিলাম। বাবা নেই, দাদা পঙ্গু হয়ে একরকম সংসারের বোঝা হয়ে ছিলো। মা কাপড় সেলাই করে সংসার চালাতো। আমি ওকে হ্যা বলে দেই।জানেন ও সুযোগ পেলেই আমার শরীর ধরতে চাইতো। প্রথম প্রথম খুব রাগ করতাম। ওকে বকা দিতাম। পরে বুঝলাম এটাই মনে হয় নিয়ম। আমি মেয়ে তো, আমার মনের সাথে সাথে শরীর দিয়েও প্রেম করতে হবে। মনে হতো, থাক না। ও তো বিয়ে করবেই। একটা ভালো পরিবারে যাবো। আমার অভাব আর ভালো লাগতোনা। মা টাও একটু শান্তি পাবে”।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, “ছেড়ে দিয়েছে?”
মিথিলা মাথা নেড়ে বললো, “নাহ ছাড়েনি। একদিন বাসায় কেউ ছিলোনা। ও আর ওর তিন বন্ধু মিলে ঘরে ঢুকে আমাকে একদম মেরে ফেললো। আমি একটুও চিৎকার করিনি। আমি শুধু কেঁদেছিলাম।ওদের শখ মিটে গেলে ওর হাত ধরে, পায়ে ধরে কেঁদেছিলাম। বলেছিলাম, আমাকে ভালোবাসো নাই জানি। কিন্তু এভাবে অপমান করলে? আমি কি তাহলে মানুষও না তোমার চোখে? একটা সামান্য মানুষও না”।
ও বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে না বুঝার মত হাসে। আমাকে বলে, “এভাবে বললে তো হবেনা। না এভাবে না”।
মিথিলা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখ ভরা জল। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “একটা মজার কথা বলি শুনুন। ছেলেটার জন্য আমার মাঝে এখনও কেমন যেন একটা ভালোবাসা কাজ করে। আমার সব কিছু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। সব কিছু। আপনি কি জানেন একটা মেয়ে যখন তার অস্তিত্ব দিয়ে একজনকে ভালোবেসে তখন তা কতটা তীব্র হয়? ভালোবাসার মানুষটাকে কতটা বিশ্বাস করতে পারে জানেন?”
আমি মাথা নেড়ে বলি, “নাহ। আমি একজনকেই পছন্দ করেছিলাম। মেয়েটার নাম ছিলো মুনা। কিছু বলার আগেই ওর বিয়ে হয়ে যায়। ওর জামাই ছিলো রাজনীতিবিদের ছেলে, বিশাল ক্ষমতাবান। যাই হোক,আমাকে এতো কথা বললে কেন?
মিথিলা চোখ মুছতে মুছতে বলে, “আপনি যখন ওই লোকটাকে বললেন আমি আপনার স্ত্রী, আমার গায়ে যেন হাত না দেয়। তখন কেমন যেন লেগেছিলো। আমি জানি আপনি হয়তো মনে মনে ভাববেন, এইটাইপ মেয়ে দুইদিন পর এই সেই লোকের সাথে থাকে। এদের আবার এইসব অনুভূতি কেন? নাহ, বিশ্বাস করেন। আমি হয়তো আসলেও অনেক সস্তা। কিন্তু মানুষ তো। কেউ যখন এমনটা অধিকার নিয়ে বলে আমি তার স্ত্রী, ভেতরে একটা ঝড় হয়ে যায়। আপনি খুব বিশ্বাস নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছিলেন। কিন্তু মিথ্যা মনে হয়নি। মনে হচ্ছিলো সত্যি আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে পাশে নিয়ে বসে আছি। আমার মনটা এখনও বেঁচে আছে”।
আমি বাকি চা টা এক চুমুকে শেষ করে মিথিলার দিকে তাকিয়ে বলি, “চলুন। আমরা এসব নিয়ে আর কোন কথা না বলি। কারণ সত্যি বললে আপনি যাই বলছেন আমি কিছুই বিশ্বাস করছিনা। কিন্তু আমি বলছিনা আপনি মিথ্যা বলছেন”।
মিথিলা আস্তে আস্তে আমাকে অনুসরণ করে গাড়ির কাছে যায়।মেয়েটার বয়স পচিশ ছাব্বিশ হবে হয়তো। আমার থেকে প্রায় এক দশক ছোট। গাড়িতে উঠে আমি ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। কাল রাতে হয়তো আমার ওকে খুন করতে হবে। কাজটা ভালো লাগবেনা। কিন্তু কিছু করার নেই। আমি মিথিলাকে বললাম, “মিথিলা সিগারেট লাগলে বলো। তোমার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে আমি জানি”।
মিথিলা আমার দিকে একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো, “ধন্যবাদ। আমি সিগারেট খাবোনা আর। আমি দুঃখিত, আপনাকে অনেক আজেবাজে কথা বলে ফেলেছি”।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “কোন সমস্যা নেই। মনে চেয়েছো বলেছো। তুমি করে বলে ফেলেছি, কিছু মনে করোনা”।
মিথিলা মাথা নেড়ে বললো, “কোন সমস্যা নেই। একটা কথা বলি। আমার শরীরে কোন সমস্যা নেই। আপনি এখনও একবারো আমার গায়ে হাত দেননি তাই বললাম। আপনি চাইলে আমাকে ছুঁইতে পারেন”।
আমি গাড়ি থামিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। মিথিলা আমার দিকে ঝুঁকে আছে। ও অপেক্ষা করছে কখন আমি ওর গায়ে হাত দেবো। আমি একটু পর ওর দিকে তাকিয়ে বলি, “ব্যাপারটা এমন না। আমার তোমাকে ঘৃণা হচ্ছে তাও না। কিন্তু আমি তোমাকে এখন ছুঁতে চাচ্ছিনা। যখন আমার ইচ্ছা হবে আমি তোমাকে বলবো। এটা নিয়ে আর কোন কথা বলবেনা। আমার ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছেনা”।
মিথিলা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো।আমি আবারও গাড়ি চালানো শুরু করলাম। নিজেকে অমানুষ মনে হচ্ছে। গত দুইরাত ঘুমানো হয়নি। ঘুম আসছে, তাও না। আমার কিছু ভালো লাগছেনা। কাল ভোর ছয়টার মধ্যে আমার মিথিলাকে নিয়ে ধানমন্ডি অর’স হ্যাভেনে যেতে হবে। সেখানে আমার সাথে আইনুল কাফি ভাইয়ের দেখা করার কথা। হয়তো উনি মিথিলাকে মেরে ফেলবে। একজন মানুষকে মারতে খুব সময় লাগেনা, কিন্তু মানুষটাকে উধাও করতে সময় লেগে যায়। গত বছরের শেষ দিকে সিরিয়ার বিদ্রোহী শহর রাক্কা তে এসডিএফের একজনকে উধাও করতে আমার প্রায় ছয়ঘন্টা সময় নষ্ট হয়। এসডিএফের চীফকে আমি বেশ ভালোই চিনতাম, সব শুওরের গু এক রকম হয়। তাই চেনাজানাটা খুব কঠিন হয়নি। সমস্যা হয়েছিলো যখন আমি ওর লাশটা নিয়ে নদীতে ফেলতে গিয়েছিলাম। চার বছরের একটা শিশুর লাশ পাশে পড়ে ছিলো। গায়ে কমলা রঙের একটা গেঞ্জি। ঠিক এমন একটা গেঞ্জী মা আমাকে কিনে দিয়েছিলো আমার এক কৈশোরের জন্মদিনে। বাবা ছোটকাল থেকেই ছিলোনা আমার সাথে। অভাবেই সংসারে এমন করে একটা নতুন জামা আমার জন্য অনেক কিছু ছিলো। আমি শিশুটাকে তুলে নিয়ে নিজ হাতে কবর দেই। কবরের পাশে বসে ডুঁকরে ডুঁকরে কাঁদি। আমি মাঝে মাঝে মানুষ হয়ে যাই। কিন্তু আমার ইচ্ছা করেনা। এই প্রতারকদের,মানুষ নামক সবচেয়ে ভয়ংকর জানোয়ারদের গ্রহে আমার মানুষ হয়ে বাঁচতে ইচ্ছা করেনা। বিশ্বাস করুন, আমি চেষ্টা করেছিলাম।নায়ক হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আজ আমি প্রতিনায়ক।একজন দুর্লভ মানুষখেকো জন্তু। আমি এখন অপ্রতিরোধ্য, অশ্লীল অমানুষ। কিন্তু আমার একদা মানুষ হওয়ার ইচ্ছা ছিলো। সত্যিকারের মানুষ।
আইনুল কাফি আমার খুব প্রিয় মানুষ। প্রতিবছর অল্প সময়ের জন্য দেশে আসে, তার বাবার সাথে দেখা করে। এরপর আবার মধ্যপ্রাচ্য আর আমেরিকায় চলে যায়। ন্যাটোতে সে সিক্রেট এডভাইজর, ইউএই এর প্রেসিডেন্টের মেয়ের বাগদত্তা। তার জাতীয়তা কেউ ঠিকমত জানেনা, কেউ তাকে ঠিকমত চেনেনা। চিনতে চায়না। নর্থ আফ্রিকার দেশগুলোতে যখন বিদ্রোহ শুরু হয়েছিলো তখন প্রথম যে প্রতিষ্ঠান থেকে অস্ত্র সাপ্লাই করা হয়েছিলো তা কাফি ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান ছিলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, উনি প্রথমে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সাপ্লাই দেন। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “ওদেরকে দিয়ে তো লাভ নেই। তারপরও কেন দেন?”
কাফি ভাই হেসে বলে, “বন্ধু তুমি আগে মঞ্চ বানাও। তারপর নাটক করো। এইযে দেখোনা তিউনিসিয়ায় জেসমিন ফুলের সুবাস যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন এল আবেদিন নামে জারজটাকে কে সরিয়ে দিয়েছিলো বলো তো? আবার ওকে আমিই কিন্তু পালাতে সাহায্য করি। মাঝখানে আমার কত বিলিয়ন ডলার ব্যবসা হয়েছে জানো?”
আমি হেসে জিজ্ঞাসা করি, “এতো ডলার দিয়ে কি করবেন?”
কাফি ভাই কিছু বলেন না। মাথা নাড়েন। পকেট থেকে তার বাবার একটা ছবি বের করে বলেন, “সিলেটি ভদ্রলোক ছিলো। প্রশাসনে কাজ করতো। দুর্নীতি করতে পারতোনা, তাই চাকরী চলে যায়। ইন্তিহাব জানো আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম একটু খাবারের জন্য। আমার আত্নীয় স্বজন সব আমাদের লাথি মেরে বাসা থেকে বিদায় করে দিয়েছিলো। মা একসময় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায় আমাদের। সেখানে আমার বড় বোন একদিন গায়েব হয়ে যায়। ওকে খুব নির্মমভাবে ভিলেজ চীফ হত্যা করেছিলো রেইপ করার পর। আমার বাবা বিচার চেয়েছিলো। চাকরী থেকে বিচ্যুত সরকারী তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীকে কেউ সঠিক বিচার দেয়নি, টাকা দিয়েছিলো। ১৭৫০০ টাকা। ২০০০০ দেয়ার কথা হয়েছিলো সালিশে কিন্তু ইউপি তার নিজের ভাগটা রেখে দিয়েছিলো। আমার মা আত্নহত্যা করে, আমার বাবাও চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলো। আমি ১৮০ টাকা দিয়ে মায়ের কাফনের কাপড় কিনতে পারিনি।বাবা তখন হসপিটালে, ঘাড়ের অনেকখানি ভেঙ্গে গেছে আত্নহত্যা করতে যেয়ে। বুঝলা ইন্তিহাব, এই জগতে টাকা খুব জরুরী। দ্বিতীয় হলো নারী। টাকা তোমাকে ক্ষমতা দেবে, নারী দেবে ভালোবাসা। আর কি চাই জগতে?”
আইনুল কাফি যখন মিথিলাকে তার কাছে পৌঁছিয়ে দিতে বললো আমি অবাক হয়েছিলাম।কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমার কাছে টাকাটা জরুরী বেশি। অনেকদিন সমুদ্র দেখতে যাওয়া হয়না,জ্যোৎস্না রাতে পুকুর পাড়ে বসে ভালোবাসার কথা বলা হয়না কাউকে। মানুষ হয়ে বাঁচার জন্য অনেক টাকা দরকার। অনেক টাকা। একবছর আর কোন লাশের গন্ধ নিতে চাইনা। আমার সাগরের নীল জলের ঘ্রাণ নিতে ইচ্ছা করে।সাথে একটা চমৎকার মেয়ে আর তার নাটকহীন ভালোবাসা। আর কিচ্ছু চাইনা। সমস্যা হলো, আমি এখন প্রকৃতির ঘ্রাণ পাইনা। আর কারো ভালোবাসা বিশ্বাস করিনা। মুনাকে বিশ্বাস করতাম। ওর স্বামী ওকে খুব মারতো। মুনা আমার কাছে এসে কাঁদতো। ভালোবাসা চাইতো। ওকে আমি ভালোবাসতাম। ভালোবাসা দিতাম। আমি তখন চাকরীও খুজতাম, কোথাও পেতাম না। গরীবের ছেলের চাকরী খুব সহজে হয়না।মিথিলা আমাকে টাকা দিতো। একদিন একটা বিশাল সারপ্রাইজও দিলো। বললো,ওর পেটে আমার সন্তান। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম। ওকে বললাম, আমার সাথে পালিয়ে যেতে। ও রাজী ছিলো, কিন্তু আমি পারিনি। আমার কোন যাওয়ার জায়গা ছিলোনা।
তিনদিন পর ওর স্বামী ফোন করে আমাকে বাসায় আসতে বলে। আমি ভয়ে ভয়ে সেখানে যেয়ে দেখি মুনার সারা শরীরে রক্ত। ওর স্বামীর হাতে ইয়া বড় একটা চাপাতি।আমাকে বলে,”তোর নাম যেন কি কুত্তার বাচ্চা? আমারে চিনোস আমি কে?”
আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। ২৪ বছরের একটা ছেলের ভালোবাসার মানুষের এতো রক্ত দেখার অভিজ্ঞতা নেই।মুনাকে সেদিনই খুন করা হয়। খবরের কাগজে আসে, পরকীয়ার প্রতারিত নারী তার প্রতারক প্রেমিকের হাতে খুন। আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু হয়। দেখা হয় আনসারুল্লাহর ফারুক ভাইয়ের সাথে। উনি আমাকে কেন যেন খুব ভালোবাসতেন। যখন আমি তাকে খুন করি সেই সময় উনি বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “তোরে না আমি ভাই ভাবতাম?”
কাফি ভাইয়ের বন্ধুকে ফারুক ভাই ভুলবশত হত্যা করেছিলেন। একটা ছোট্ট ভুল বুঝাবুঝি, দরকার ছিলোনা এসবের। তাহরীর স্কয়ারে তখন আরব বসন্তের ডাক, আমি ফারুক ভাইকে মিছিলে নিয়ে খুব মন খারাপ নিয়ে হত্যা করি। কেউ খেয়াল করেনি, সবাই তখন বিদ্রোহে ব্যস্ত। আমার তখন টাকা দরকার। অনেক টাকা।
জেলে থাকার সময় আমার মা কে পুলিশ লাথি মেরেছিলো আমাকে দেখতে চাওয়ার অপরাধে। মা হাসপাতালে ছিলো অনেকদিন। এরপর আর জীবিত ফেরত আসেনি। আমি জেলে বসে কাঁদতাম আর ফারুক ভাই আমাকে শুধু একটা কথাই বুঝাতো, “এই দুনিয়ায় কেউ তোমার না। টাকা আর ক্ষমতাটাই শুধু তোমার। এই দুইটা থাকলে তোমার সব আছে”।
আমি যখন প্রতিটা খুন করি মনে হয় আমার মত ক্ষমতাবান আর কেউ নেই। মনে হয় আমি ওই মানুষটার জীবনের মালিক ছিলাম। আমাকে অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। And I am going to fucking use it. আমি প্রথম খুন করেছিলাম যখন আমার বয়স ছিলো মাত্র ১৫। আমার বাবা মারা যাবার পর মাকে খারাপ মহিলা হতে হয়েছিলো। কিছু করার ছিলোনা, কেউ আমাদের খেতে দিতোনা। মায়ের কাছে এক লোক মাঝে মাঝে আসতো, আমাকে খুব আদর করতো। একদিন লোকটি কেন যেন রেগে মাকে অনেক মেরেছিলো। আমার ভালো লাগেনি। এরপর দিন যখন লোকটা স্যরি বলতে আবার আসে তখন আমি লোকটার মদের গ্লাসে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। বিষ পেয়েছিলাম মার ড্রয়ার থেকে। মা খুব হতাশ হয়ে গেলে কখনো কখনো ওই বোতলটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে খুব সুখ পেতেন। চিৎকার করে বলতেন, “এইটা আমার জীবন। আমি এইটার মালিক। যখন ইচ্ছা শেষ করে দিতে পারি”।
যাইহোক ওই লোকটার লাশ সরাতে খুব কষ্ট হয়েছিলো মায়ের। আমাকে অনেক মেরেছিলো। বলেছিলো আমি যেন আর কখনো এই রাস্তায় না হাটি। আহা, মা যদি জানতো এখন আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর কয়েকজন খুনীদের একজন। মা, আমি নায়ক হতে চেয়েছিলাম তোমার জন্য পৃথিবীর জন্য। কিন্তু আমি আজ অনেক ঘৃণিত, শূকরের থেকেও অধম একজন মানুষ। তবে আমি নিজেকে এখনো মানুষ ভাবি। আমার কাছে আমি একজন নায়ক, তোমাদের কাছে হয়তো আমি প্রতিনায়ক। তাতে আমার কোন যায় আসেনা। আমি তোমাদের ব্যাপারে কোন বিচার রাখিনা, তোমরা আমার ব্যাপারে বিচার করার কে?
ভোর চারটায় আমি মিথিলাকে নিয়ে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে পৌছে যাই। মিথিলা হঠাৎ আমার হাত ধরে বলে, “এক গ্লাস পানি খাবো। আর ক্ষুধাও লেগেছে অনেক। আমরা কি কোথাও নামতে পারি”।
সূর্য উঠতে তখনও প্রায় ১ ঘন্টা বাকি। এই অন্ধকারে কোথায় কি পাওয়া যাবে বুঝতে পারছিনা। আমি রাস্তার একধারে গাড়িটা থামিয়ে মিথিলাকে বললাম, “ব্যাক সিটে কিছু খাবার আছে। সামান্য স্যান্ডউইচ আর সালাদ। আশা করি তোমার হয়ে যাবে। ঠিক আছে?”
মিথিলা মাথা নেড়ে বললো, “আপনি খাবেন না?”
আহা, এমন করে কতদিন কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করেনা। শেষবার মনে হয় মা বলেছিলো আমাকে যখন জেলে ছিলাম। হাত ধরে বলেছিলো, “বাজান ঠিকমত খাস তো?”
আমি মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “খাবো। তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
মিথিলা স্যান্ডউইচের প্যাকেট খুলতে খুলতে বললো, “বলুন”।
আমি কিছুক্ষণ ভেবে তারপর ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কাফি সাহেবকে চেনো?”
মিথিলা খাওয়া থামিয়ে দিলো। আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বললো, “তার কথা কেন?আপনিই তার কথা বললেন কেন?”
আমি ওর চোখে আতংক দেখলাম। মিথিলার হাত থেকে স্যান্ডুইচ পড়ে গেলো। আমার মনে হয়না ওকে জিজ্ঞাসা করা ঠিক হয়েছে। কৌতুহল খুব খারাপ জিনিস, আমি ভুল করেছি। এখন হয়তো ওকে আহত করতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা আগে বোঝা দরকার। সমস্যা একটাই আমি মিথ্যা বলিনা। ওকে ভুলভাল বোঝাতে পারবোনা।
মিথিলা কাঁপা কাঁপা হাতে আমার বুকে হাত দিয়ে বললো, “আপনি কি ওনার কাছে আমাকে নিয়ে যাবেন? আমি আপনার পায়ে পড়ি এই কাজ করবেন না। লোকটা অনেক খারাপ, আমাকে মেরে ফেলবে।আমি আপনার নাম জানিনা, আপনাকে আজকের আগে চিনতাম না। তাও একটু মানবিকতার দাবী জানাই”।
মিথিলা গোঁ গোঁ করতে থাকে ভয়ে। আমি মিথিলাকে ধরে বলি, “আমার উপায় নেই। তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। আমাকে খুব বড় অংকের একটা টাকা দেয়া হয়েছে। আমি জানিনা উনি তোমার জন্য এতো টাকা কেন খরচ করলেন”।
মিথিলা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “উনি আমাদের মত মেয়েদের ব্যবহার করে মেরে ফেলেন। খুব বাজে ভাবে মারেন। আমি ছয় মাস আগে উনার সাথে ছিলাম দুবাইতে। আমাকে প্রতিদিন মারতো, খুব মারতো। আমি অনেক কষ্টে পালিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশে। আমার পায়ের একটা আঙ্গুল কাটা জানেন”।
আমি আধা লিটার পানি এক ঢোকে শেষ করে মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “দুঃখিত মিথিলা। আমার কিছু করার নেই। তুমি আর কিছু খাবে? আমার কাছে কিছু তার্কিশ ডিলাইট আছে। একেবারে তুর্কি থেকেই কেনা”।
মিথিলা রোবটের মত গাড়িতে উঠে বসে।বিড়বিড় করে বলতে থাকে, “নিজে আমাকে ভাড়া নিতে পারবেনা। তাই আপনাকে পাঠিয়েছে তাই না? আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম”।
আমি আবার গাড়ি থামাই। মিথিলার হাত ধরি। ওকে বলি, “পৃথিবী অনেক খারাপ জায়গা। খুব খারাপ”।
মিথিলা জ্বলজ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার গালে হাত দিয়ে বলে, “তোমার নাম কি?”
আমি ওর থেকে চোখ সরাতে পারিনা। ওকে এতো সুন্দর লাগছে কেন? এমনটা অনেকদিন কাউকে লাগেনি।আস্তে আস্তে বলি, “ইন্তিহাব। নামটা সুন্দর না?”
মিথিলা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “অনেক সুন্দর। ইন্তিহাব তুমি আমাকে হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছো, জানো তো? তুমি জেনেও এমনটা করছো। আমার মনে অনেক অভিমান হচ্ছে। কিন্তু তোমার উপর রাগ হচ্ছেনা। তুমি যেমন জানো এই পৃথিবী অনেক খারাপ। আমিও জানি। তুমি যেমন ধর্ষিত হয়েছো পৃথিবীর মানুষ দ্বারা, আমিও অগণিতবার হয়েছি। কিন্তু আমি এখনও মানুষ হতে চাই, খুব চাই একজন আমাকে খুব ভালোবেসে বলুক চলো আমার সাথে।একবার শুধু বলুক, চলো আমার সাথে”।
মিথিলা কাঁদতে থাকে। আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। খুব খুব যন্ত্রণা। আমি সস্তা ধরনের মানুষ, সস্তা মেয়েদের সাথে ভালোবাসা করে বেড়িয়েছি। মুনার মত এমন করে গালে হাত দিয়ে কেউ ভালোবাসা, মায়া, যন্ত্রণা নিয়ে কথা বলেনি। কেউ না। মাথা ঠিক রাখতে হবে। আইনুল কাফির কাজ আমি নিয়মিত করি। উনাকে ধোঁকা দেয়া যাবেনা। আমি জানি সে পশুর থেকে জঘণ্য। আমি জানি মিথিলাকে কি অমানবিকভাবে খুন করা হবে।কাফি ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে এভাবে কেন মেয়েদের হত্যা করে।
কাফি ভাই আমার উপর খুব রেগে গিয়েছিলো। বলেছিলো, “আমার ভালো লাগে। তোমার কোন সমস্যা? মাথা মাঝে মাঝে কাজ করেনা জানো তো। আমার বোনের লাশটার কথা মনে পড়ে যায়। যেই মেয়েকে ভালো লাগেনা তাকে ঠিক ওইভাবে মেরে ফেলি। আমার বোন বাঁচতে পারেনি, ওরা কেন বাঁচবে? প্রত্যেকটা নষ্ট মেয়েকে ঠিক এভাবেই মারবো।ঠিক ১৯টা পোচ দেবো সারা শরীরে। আমার কাছে সব বেশ্যা। ওরা কেন বাঁচবে? ওয়াই? ওয়াই?”
মিথিলা আমার গালে তখনও হাত দিয়ে আছে। আমার বিরক্ত লাগছিলো। এসব ভাব ভালোবাসা আমার জন্য না। মুনা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমার মেয়েদের স্পর্শ ঘিন্না লাগে। আমি চেষ্টা করেছি কাউকে ভালোবাসতে। কিন্তু পারিনা। ভেতরে একটা জানোয়ার বাস করে। যখন কেউ ভালোবাসা দেখাতে চায়, জানোয়ারটা তখন অস্থির হয়ে যায়। আমি মিথিলাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করি। ও সরেনা। খুব আস্তে করে ওর গাল আমার গালের সাথে লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো, “তুমি যেখানে ইচ্ছা আমাকে নিয়ে চলো। শুধু একবার বলো, চলো আমার সাথে। নরকেও যাবো। আমার শরীর টাকা দিয়ে কেনা যায়। মন না। বিশ্বাস করো,আমি এতোটা সস্তা না”।
আমি মিথিলাকে সরিয়ে দিলাম। গাড়িটা ফোর্থ গিয়ারে নিয়ে টান দিলাম। আমার সাতটার মধ্যে ধানমন্ডি পৌছাতে হবে। আমার জন্য এই ভালোবাসা না। এই ভালোবাসাগুলো শুধু সাদা সাদা মানুষের জন্য। কিন্তু কি দুঃখ,আমি সাদা মানুষ দেখতে পাইনা। সবার ভেতরটা এতো কুৎসিত অন্ধকার। আমার অবশ্য অন্ধকার ভালো লাগে। মানুষগুলোর অন্ধকারে হাত দিয়ে, স্পর্শ করে আমি ওদেরকে চিনতে পারি। তখন মনে হয়, আমার মাঝে এখনও আলো আছে। আছে, অবশ্যই আছে। অর্থ কি, আমি কি এখনও ভালো মানুষ হতে চাই? মাথা কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মিথিলা, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
আমি কিছু বলার আগেই মিথিলা গাড়ি থেকে নেমে গেলো।ওকে গেটের ভেতর ঢোকার আগে হাত ধরে থামালাম। কি বলবো জানিনা। কিছু বলা উচিত কিনা তাও জানিনা।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “আমার খুব ভালো মানুষ হতে ইচ্ছা করতো একসময়।চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি।এখন আমার ভেতরটা নোংরা হয়ে গেছে। তোমাকে খুব বলতে ইচ্ছা করেছিলো যা তুমি শুনতে চেয়েছিলে। কিন্তু আমি পারিনা”।
মিথিলা আমার হাত ওর বুকের মাঝখানে নিয়ে বললো, “তোমাকে মাত্র চিনি কিছু ঘন্টা আগে। কিন্তু আমি জানি তুমি অন্যরকম। কেন জানো? কারণ তোমার ভেতরটা একটুও নোংরা না। তুমি অনেক রেগে আছো, তোমার মাঝে অনেক ঘৃণা লুকিয়ে আছে। এই ঘৃণাগুলো তো তোমার না ইন্তিহাব। এগুলা ওই মানুষগুলোর যারা তোমার সাথে অন্যায় করেছে। তুমি সেগুলো যেই মুহূর্তে ফেলে দেবে, যেদিন তোমার সেই শক্তিটা হবে সেদিন থেকে তুমি আমার নায়ক। আমি হয়তো আজকের পর আর সূর্য দেখবোনা। কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি যতবার আমাকে ভাববে, মনের ভেতর উঁকি দিয়ে আমাকে দেখবে আমি ততবার সূর্যস্নান করবো। তুমি শুধু তোমার রাগগুলো ফেলে দাও। আমি তোমার থেকে কম অন্ধকার দেখিনি। কিন্তু আমি মাঝে মাঝে জানো আলো দেখতে পাই। যখন সেই আলো ছুঁয়ে দেই, মনে হয় আমি পবিত্র হয়ে গেছি। এই পৃথিবীতে যতদিন একটা শিশু হাসিমুখ নিয়ে বেঁচে থাকবে ততদিন আলো থাকবেই”।
আমি হাত সরিয়ে নেই। আমার কিছু ভালো লাগছেনা। মিথিলাকে একটা কাগজে আমার মোবাইল নম্বর লিখে দিয়ে বলে “এটা আমার ব্যক্তিগত নম্বর। যদি তুমি বেঁচে থাকো আমাকে ফোন করো। আইনুল কাফি খুব ভয়ংকর মানুষ। ওর সাথে আমি প্রতারণা করতে পারবোনা। আমার আরো কিছুদিন বেঁচে থাকা দরকার। আমি যাই মিথিলা। তোমাকে শুভকামনা”।
আমি আমার বনানীর হোটেলে ফিরে যেয়ে দুই বোতল রেড ওয়াইন অর্ডার করি। আজকে সারাদিন সারারাত আমি নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবো। আমার সারা শৈশব কৈশোরের যে ভয়ংকর কষ্টগুলো আছে সব ভুলে যাবো। মা প্রায় দিন রাতে এই সেই লোকের সাথে থাকতো। প্রায় দিন খুব মার খেতো। কতবার কত বাসা থেকে আমাদের অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। আমার মা সারাজীবন আমার জন্য নিজেকে বিক্রি করেছে, মনুষত্ব্য বিক্রি করেছে। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি। আমার বাবার গলাকাটা লাশের স্মৃতি আমি এখনও ভুলতে পারিনা। আমার চাচা আর দুই চাচাতো ভাই জমির লোভে আমার ভালোমানুষ বাবাটাকে ঘর থেকে বের করে আমার চোখের সামনে জবাই করে। আমাকে আমার চাচা কাছে এসে বলেছিলো, “জমি লাগবো আর? ফকিন্নীর পোলা”।
আমি আমার বাবার গ্রামের প্রায় সব জমি কিনে নিয়েছি। কিন্তু আমি আমার চাচা, চাচাতো ভাইদের কিচ্ছু তেমন করিনি। টাকা ছাড়া আমি খুন করিনা। ভালো লাগেনা, প্যাশন আসেনা। চাচার জিহবা কেটে দিয়েছিলাম শুধু। বলেছিলাম, “আর কখনো রাতের বেলা ঘুমের মাঝে এসে চিৎকার করবেন না ফকিন্নীর পোলা বলে।আমার যন্ত্রণা হয়”।
মিথিলা মেয়েটার উপর বিরক্ত লাগছে। আমার ভেতরে কিছু একটা সমস্যা করেছে ও। আমি যখন চাকরী না পেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম, মেসে রাতের বেলা চুরি করে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম বাড়িওয়ালার ভয়ে তখন মনে হতো খুব খারাপ হয়ে যাই। বাঁচার জন্য আমার মানুষ নামের মুখোশটা খুলে অমানুষ হতে হবে। মুনা তখন মিথিলার মত এমন সুন্দর সুন্দর কথা বলতো। আমি মুনার কোলে শুয়ে থাকতাম, মুনা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো আর ভালবাসার গল্প শুনাতো। আমি ভাব করতাম কিছুই শুনছিনা, কিন্তু ওর প্রত্যেকটা কথা খুব বুকে আঘাত করতো।
আমি বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম দরকার। অনেক অনেক ঘুম। চোখ যখন লেগে আসলো, তখন একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। আমার পাশে মুনা দাঁড়িয়ে।ও আমার দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে বলছিলো, “আমাকে মনে পড়েনা তাইনা?”
আমি কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। সারাদিন কিছু শুয়োরের কালো রক্ত, তাদের অন্ধকার জগত দেখতে দেখতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম আলোর জগতটা কেমন?
মুনা ফিসফিস করে আমাকে বলে, “ওইদিকে দেখো?”
আমি ওর হাত যেখানে নির্দেশ করে সেখানে তাকাই। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলি। দেখি ওর স্বামি ওকে চাপাতি দিয়ে কোপ দিচ্ছে। মুনা চিৎকার করে বলে, “আমি মরে যাচ্ছি ইন্তিহাব। ইন্তিহাব, ও আমাকে মেরে ফেলছে। তোমার কি হবে আমি ছাড়া? আমাকে নিয়ে যাবে? একবার বলো, চলো আমার সাথে”।
আমি কাঁদতে থাকি। ওর কাছে যেতে চাই কিন্তু কিছু একটা আমার গলা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে। আমি হাত জোড় করে বলি, “ওকে বাঁচতে দিন। আমার ওকে খুব দরকার। আমার জানোয়ারের মত বাঁচতে ইচ্ছা করেনা। ওকে যেতে দিন”।
আমার গলার উপর চাপটা আরো বাড়তে থাকে। ঠিক তখনি ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। উঠে বসে দেখি নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। বালিশে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। কতক্ষণ বসে ছিলাম জানিনা হঠাৎ একটা ফোন আসলো। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি এগারোটা বাজে। মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে খুব বিরক্ত লাগলো। কাফি ভাইয়ের এইসময় ফোন দেয়ার কারণ কি জানিনা। ফোন ধরে ওপাশে মিথিলার কন্ঠ শুনলাম। ওর কন্ঠ শুনে মনে হলো একটু আগে খুব কেঁদেছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, “ইন্তিহাব আমি তোমাকে ফোন করেছি শুধু এটুকু বলতে আমি ভালো আছি। আমার যাই হোক নিজের মনে কষ্ট রেখোনা। তোমার ভেতরে আমি একজন ভালো মানুষ দেখি। সেই ভালো মানুষটা জায়গা খুঁজছে, বের হতে চায়। তুমি তাকে আটকে রেখোনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি ইন্তিহাব। একজন মানুষ একজন মানুষকে যতটুকু ভালোবাসতে পারে ঠিক ততটুকু”।
আমি কাফি ভাইয়ের গলা শুনতে পাই। উনি ইউরোপিয়ান লিগের খেলা দেখছেন। আজকে রাশিয়া আর ইতালীর খেলা হচ্ছে। কাফি ভাই ইতালীর বিশাল সাপোর্টার। আমি মিথিলাকে বলি ফোনটা কাফি ভাইকে দিতে। কাফি ভাই ফোন ধরে সালাম দিলো। আমি কাফি ভাইকে বললাম, “ভালো আছেন?”
কাফি ভাই হেসে বললো, “ইন্তিহাব ঘটনা কি বলো তো? এই মেয়েটাকে তুমি কি আগে থেকে চিনতে”।
আমি একটু ভেবে তারপর বললাম, “কাফি ভাই আপনার একাউন্টে আমি তিনলাখ টাকা কিছুক্ষণের মধ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছি যেটা এই মেয়েটাকে নিয়ে আসার জন্য দিয়েছিলেন। মেয়েটাকে আমার দরকার ছিলো।আমি আপনার বাসায় এসে ওকে নিয়ে যাচ্ছি, কিছু মনে নেবেন না”।
কাফি ভাই চুপ করে একটু পর বললো, “আমি জানিনা তুমি কি বলছো। কিন্তু মেয়েটাকে আমি তোমাকে দেবোনা”।
দুইজন ফোনের দুইপাশে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে থাকি। আমিই প্রথম নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, “কাফি ভাই আমি উত্তরার কাছেই আছি যেখানে আপনার বাবা থাকেন। উনাকে হত্যা করতে চাচ্ছিনা। পঙ্গু মানুষ খুন করতে ভালো লাগেনা।আপনি মেয়েটাকে ছেড়ে দেন। আমি কাউকে অনুরোধ করিনা, আপনাকে করলাম”।
কাফি ভাই হেসে বললেন, “তুমি এই কাজ করবেনা। আমার বাবা প্রতি রমজানে তোমাকে আদর করে বুটের হালুয়া খাওয়ান। তোমাকে নিজের ছেলের মত দেখেন।এমন একজনের ক্ষতি করবে?”
আমি ফোন রেখে দিলাম। আমার হাতে সময় কম। মিথিলাকে বাঁচানো দরকার।আমি উত্তরা ৬নং সেক্টরে চুলে গেলাম। আমি জানি কাফি ভাই সেখানে অনেক মানুষ পাঠিয়ে রেখেছে। আমাকে খুব সাবধানে কাজ সারতে হবে।আমি রোকনকে ফোন দিলাম। রোকন আমার সাথে মাঝে মাঝে কাজ করে। ছেলেটা খুব ভালো রিভলবার চালায়। ওকে উত্তরায় আসতে বলে আমি আমার গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম। রোকনের সাথে দেখা হলো ঠিক রাত সাড়ে বারোটায়। রাস্তা একদম শুনশান, একটা মানুষও কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। আমাকে দেখে রোকন আমার পা বরাবর গুলি চালালো।ওর নিশানা মিস হয়না। কিন্তু এবার হলো। পায়ের কিছু মাংশ অবশ্য ছড়ে গিয়েছিলো। সেটা সমস্যা না। আমি দৌড়িয়ে সিগারেট বিক্রি করে এমন একটা ছোট্ট দোকানের পিছনে দাঁড়িয়ে রোকনের কাছে আসার জন্য অপেক্ষা করি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন ওর পায়ের শব্দ পেলাম কাছে আসার, তখন শরীরের সব শক্তি জড়ো করে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। আকস্মিক ধাক্কায় ও রাস্তায় পরে যায়। আমি ওর গলায় পা দিয়ে বলি, “কত টাকা অফার করেছে কাফি ভাই?”
রোকন ফ্যাস ফ্যাস করে বললো, “বলছে যা চাই তাই দেবে আর আপনাকে না মারতে।ভাই একটু গলার উপর থেকে পা সরান। খুব ব্যাথা লাগতাছে। সাত বছর আপনার সাথে কাজ করছি”।
রোকনের মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। আমি খুব জোরে পাড়া দিয়ে ছিলাম তো, তাই হয়তো। ওর মাথায় হাত দিয়ে আমি গলাটা ঘুরিয়ে দিলাম। রাস্তায় লাশটা ফেলে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। সমস্যা হয়েছে ওর গুলির শব্দে হয়তো কাফি ভাইয়ের পাঠানো লোকগুলো আমার আশেপাশে ঘুরছে। সময় নেই। তাই আমি গাড়িতে উঠে বসে আবদুল্লাহপুরের দিকে চলে গেলাম। আমার এখন ভাবা দরকার। আমার গাড়িতে তখন প্রচুর এক্সপ্লোসিভ আর অস্ত্র। প্রিয় রিভলবার রসি আমার হাতে। গাড়ি রেখে আমি আমার সাথে কিছু অস্ত্র নিয়ে উত্তরায় ফেরত আসলাম। কাফি ভাইয়ের কিছু লোক দেখলাম ফ্ল্যাটের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। চার পাঁচজন হবে। আমি দুইজনকে ঠিক করে পরপর গুলি ছুড়লাম। আমি জানি এতে অন্যরা ভয় পেয়ে পাগলের মত এখানে সেখানে দৌড়াবে। ভয় মানুষের বিশাল একটা দুর্বলতা। আমি সেটাকে প্রায়ই কাজে লাগাই। ফ্ল্যাটের দিকে এগোতে এগোতে আমি বাকিদেরও গুলি করি। আমার নিশানা ভালো এবং আমি দ্রুত গুলি ছুড়তে পারি।সারা উত্তরাবাসী তখন হয়তো জেগে উঠেছে। এমন ভয়ংকর তান্ডবের অভিজ্ঞতা আগে তাদের হয়নি।
কাফি ভাইয়ের বাবাকে গাড়িতে বসিয়ে আমি তার বাসায় সরাসরি চলে যাই। কাফি ভাইয়ের বাবা অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করে,“আমারে কই নিয়ে যাচ্ছো?”
আমি উনাকে বলি, “চাচা কাফি ভাই একটা ভুল করতে যাচ্ছে। উনি যেন ভুলটা না করেন তাই আপনাকে সাথে নিচ্ছি। আপনি উনাকে বুঝাবেন, ঠিক আছে?”
কাফি ভাই কলিংবেল টিপলে নিজেই দরজা খুলে দেয়। ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি আরো কয়েকজন লোক বসে আছে। সবার হাতে অস্ত্র।আমি তার সাথে করমর্দন করে বলি, “স্যরি। এমনটা হওয়ার কথা ছিলোনা। মিথিলাকে আমার দরকার। নিয়ে যেতে হবে।আপনার বাবা নিচে গাড়িতে। আমি কিছু করিনি। কিন্তু আপনি ঝামেলা করলে কিছু একটা করতে হবে।গাড়িতে এক্সপ্লোসিভ আছে। অনেক কিছু হতে পারে। আমার শুধু একটা শিস বাজাতে হবে”।
কাফি ভাই হেসে বললো, “আমি তোমার সাহসের তারিফ করছি। আমি আইনুল কাফি, আমাকে সাদা চামড়া কালো চামড়া হলুদ চামড়া সবাই ভয় পায় এবং আদর করে ডাকে Beast of Arm, তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে এমন নির্ভীক হয়ে কথা বলছো আমি আবেগে আপ্লুত হচ্ছি।যাই হোক, মিথিলা নামে আমার কাছে কেউ নেই। যেই মেয়েটাকে তুমি আমার কাছে পৌছে দিয়ে গেছো ওর নাম হাইসা। ওর চোখগুলো দেখেছো? কেমন অসহায় মায়া মায়া তাই না? আমার ওকে ভালো লাগে। দেহ বিক্রি করা বেশ্যা, তবুও ভালো লাগে। কষ্ট দিতে চাইনা তাই নিজে যেয়ে ঝামেলা করিনি। তোমাকে পাঠিয়েছি। কিন্তু তুমি এ কি করলে ইন্তিহাব? এসবে তুমি আমার বাবাকে জড়ালে কেন? আমার এই বাড়িটায় আমি কখনও খুন খারাবি করিনা। আজকে করতে হবে ভাবতেই খারাপ লাগছে। দেশে আসি দুইদিন একটু শান্তিতে বাবার সাথে থাকবো, বাঙ্গাল মেয়ের গন্ধ নিবো। তুমি কি করলা রে ভাই!”
আমি মাথা নেড়ে বলি, “আমার কোন কিছুতে খুব একটা যায় আসেনা। যেই মেয়েটাকে এনে দিয়ে গিয়েছিলাম তাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমাকে ম্যানিপুলেট করবেন না”।
কাফি ভাই তার মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলেন, “ঠিক আছে”। এরপর চোখের ইশারায় তার পাশের লোকগুলোকে কিছু বললে আমি আমার রিভলবার বের করে কাফি ভাইয়ের কপালের উপর ধরি। আস্তে আস্তে বলি, “কোন খুন চাইনা। রক্ত দেখতে ভালো লাগছেনা কাফি ভাই। ওকে দিয়ে দিন, আমি চলে যাই। এরপর আপনাকে আমি চিনিনা, আপনি আমাকে চেনেন না”।
কাফি ভাইয়ের চোখ লাল হয়ে আছে। আমার দিকে চুক চুক করে বললো, “তোমার মাথা নষ্ট হয়েছে আমি বুঝেছিলাম। তুমি হয়তো ভুলে গেছো আমি মৃত্যু খুব একটা ভয় পাইনা।গুলি করতে চাইলে করো, কোন সমস্যা নাই”।
কাফি ভাই হাসতে থাকে, আমার কপালের পাশ দিয়ে ঘাম বের হয়। আমি জানি যদি আমি কাফিকে খুন করি তাহলে তার সাথে লোকরা আমাকে মেরে ফেলবে। সেটা সমস্যা না, কিন্তু মিথিলাকে মেরে ফেলবে এটা ভাবতে ভালো লাগছেনা।
কাফি ভাই আবার বললো, “মেয়েটাকে আমি একটু আহত করেছি। তোমাকে মেরে এরপর আজকে সারারাত ওকে নিয়ে ফুর্তি করবো। তোমার একটা ভুল হয়েছে মেয়েটাকে নিয়ে, তুমি হয়তো সেটা বুঝতে পারছোনা।কি চমৎকারভাবে তোমাকে ব্যবহার করা হলো, তুমি বুঝলাই না। এখন হিজড়ার মত দাড়িয়ে না থেকে হয় আমাকে গুলি করো, নাহলে নিজে মরো। আমার সময়ের অভাব”।
আমি দুই সেকেন্ড ভাবলাম। সময়টা খুব জঘণ্য, আশেপাশের যে ছয়জন লোক আছে তাদেরকে আমার খুব সহজ হবেনা মারা। এরা সবাই খুবই অভিজ্ঞ।অস্ত্র চালাতে পারদর্শী। কিন্তু আমাকে কিছু একটা করতে হবে। আমি কাফি ভাইয়ের থেকে পিস্তল সরিয়ে উনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পাশের লোকগুলোর দিকে ছুটে গেলাম। পরের পাঁচ মিনিট প্রচন্ড গোলাগুলিতে ঘরে আগুন ধরে গেলো প্রায়। আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধটা আজ করলাম মিথিলার জন্য। কিন্তু ও কে, কেন ওর জন্য এমন করলাম আমি জানিনা।কাফি ভাইয়ের পায়ে একটা গুলি করেছিলাম, উনি খুব কোঁকাচ্ছে। আমি উনার ব্যক্তিগত হোয়াইন হাউসের বিশাল টেবিলের নিচে শুয়ে আছি। আমার হাতে কাঁধের কাছে দুটো, দুই পায়েই তিন-চারটা গুলি লেগেছে। মনে হচ্ছে যেন আমি মরে যাচ্ছি। কিন্তু আমার মিথিলার সাথে কথা বলতে হবে। ওঠার মত অবস্থা নেই।কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের নিচ থেকে বের হই। এই রুমে এখন শুধু আমি আর কাফি ভাই জীবন নিয়ে আছি। কাফি ভাই আমার দিকে তাকিয়ে গুঙ্গিয়ে বললো, “তুমি আমাকে মেরে ফেলো সমস্যা নাই। কিন্তু আমার বাবার যেন কিছু না...”
উনি কথা শেষ করার আগে আমি উনার কপাল বরাবর একটা গুলি করলাম। এত ভ্যাজরভ্যাজর শুনতে ভালো লাগেনা। উনার বাবাকে আমি কিছু করবোনা।আমার অযথা রক্ত ভালো লাগছেনা আর। এখন মিথিলা যেমনটা বলেছিলো তেমন একটা মানুষ হতে ইচ্ছা করছে। আমি আস্তে আস্তে কাফি ভাইয়ের রুমের দিকে এগোতে থাকি। যেয়ে দেখি মিথিলা বসে আছে চুপ করে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “সব শেষ?”
আমি বিছানার কাঠামোতে হেলান দিয়ে বসে বলি, “সব শেষ”।
মিথিলা আমার কাছে হেঁটে এসে বলে, “তোমাকে ব্যবহার করেছি এটা ঠিক না। আমার তোমাকে দরকার ছিলো কাফির থেকে বাঁচার জন্য। আমার নাম মিথিলা না, হাইসাও না। যেটা সেটা বলতে চাচ্ছিনা। তোমাদের মত জন্তু জানোয়ারের মুখে আমার নামটা মানায় না”।
আমি ওর দিকে ক্লান্ত হয়ে তাকিয়ে বললাম, “তুমি কি খুব আহত?”
মিথিলা ওর চুল আচড়াতে আচড়াতে বললো, “নাহ, সামান্য শারীরিক অত্যাচারে আমার সমস্যা হয়না। ওই লোকটা মানুষ না পশু। দুবাইতে যখন ও আমাকে কিনে নিয়ে যায়, তিনদিন ওর সাথে থাকতে হয়েছিলো। আমি প্রতিদিন ভাবতাম আত্নহত্যা করবো। পারিনি। ও আমাকে ভয় দেখাতো, কিন্তু মারতোনা। ভয় দেখিয়ে অত্যাচার করতো। ওর চোখে একটা পিচাশ দেখতাম আমি। খুব ভয় পেতাম। আমার খুব ভাগ্য ভালো আমি পালাতে পেরেছিলাম। সব ফেলে আমি দেশে চলে আসি। কিন্তু আমি জানতাম এই পিচাশ আমাকে আবার খুঁজে বের করবে। তোমাকে ধন্যবাদ ইন্তিহাব।তোমাকে তো শয়তান নিজেই এতোদিন ব্যবহার করে আসছে, আজ নাহয় আমি একটু উপকার নিলাম। আশা করি তোমার খুব একটা যায় আসেনা”।
আমি মিথিলার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। চোখজুড়ে আলস্য। প্রায় ভোর হতে যাচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে উঠে বসি। ও সরে যেতে চাইলে জোর করে ওর হাত ধরি। ওকে বলি, “আমার যায় আসেনা। কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো? চলো আমার সাথে...”
মিথিলা হাত সরিয়ে নেয়। ওর চোখে পানি। আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “এতো কিছুর পরও তুমি আমাকে একথা বললে?”
আমি কষ্ট করে হেসে ওকে বলি, “আমরা এই গ্রহে সবাই ধান্দাবাজ। তুমি আমার সাথে ধান্দা করেছো। কাফি তোমার আমার দুজনের সাথে ধান্দা করেছে। আমার এসব আর ভালো লাগছেনা। আজকে আমি তোমাকে না নিজেকে মুক্তি দিতে এসেছিলাম। একদা একজনকে খুব ভালোবাসতাম। ভাবতাম মানুষটা হারিয়ে গেছে। আজকে হঠাৎ করে মনের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখি ভালোবাসাটা একটুও কমেনি। আমার ভেতরের পশুটা শুধু অনুভূতিটাকে আড়াল করে রেখেছিলো। আমার কোন যায় আসেনা তুমি কে? আমার কোন যায় আসেনা তুমি কি করেছো। তুমি চেয়েছিলে কেউ একজন তোমার হাত ধরুক কোন উদ্দেশ্য ছাড়া। আমি তোমার হাত ধরেছি। তুমি আমাকে জানোয়ার ভাবলে ভাবো। কিন্তু আজ আমি তোমার কাছে শুধুই একজন মানুষ”।
মিথিলা আমার পাশে বসে বলে, “কিন্তু আমার তোমাদেরকে মানুষ মনে হয়না। তোমরা রক্ত নিয়ে খেলো। টাকার জন্য সব পারো। আমি তোমাকে আমার ব্যাপারে যে গল্প বলেছিলাম সেখানে একটা ব্যাপার বলা হয়নি। যেই ছেলেটাকে ভালোবাসতাম সে আমাকে সেদিন ছেড়ে দিয়ে যায়নি। নিজের মজা নেয়া শেষ হলে সে আমাকে দৌলতদিয়ায় নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিলো। আমার বয়সটা ছিলো মাত্র ১৫। কিছুদিন পর আমার একটা মেয়ে হয়। মেয়েটার বয়স যখন ছয় তখন ওকে আমারই এক কাস্টোমার জোর করে নিয়ে যায়। আমি আমার মেয়েটাকে বাঁচাতে পারেনি। আমি তোমাদের মত কুত্তা বিলাইয়ের থেকে নিজের সবচেয়ে আদরের বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি। আমি সবকিছু থেকে পালিয়ে যখন দুবাইতে চলে যাই তখন ভদ্রলোকের মুখোশ পরা মানুষগুলো কেউ আমাকে বাঁচতে দেয়নি। আমি দেখতে ভালো, তাই তোমাদের মত নর্দমার কীটরা আমাকে যখন ইচ্ছা নিয়ে খেলেছো। পাশবিক আনন্দ করেছো। জানো তবু এখনও আমার বাঁচার ইচ্ছা আছে। তোমাদের মত শূয়োরদের প্রতি আমার ভালোবাসা হয়না। আমার তোমাদের জাতটাকে দেখলেই ঘৃণা হয়। অনেক ঘৃনা হয়”।
আমি মিথিলার হাত ধরে বলি, “ছোটকালে একটা সিনেমা দেখেছিলাম সুপারম্যানকে নিয়ে। মা কে বলতাম মা একদিন আমি ওর মত নায়ক হবো দেখো। মানুষ আমাকে ভালোবাসবে।ভালোবাসার সাথে মনে করবে।কি হয়ে গেলাম দেখো তো? তোমার ভাষায় অমানুষ জানোয়ার তাই না? তুমি সঠিক। একদম সঠিক। হঠাৎ করে বোকার মত নিজেকে তোমাদের মত মানুষ ভাবা শুরু করেছিলাম। ভুল, একদম ভুল”।
মেয়েটা চলে যায়, কিচ্ছু না বলে। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বুকের পাশ দিয়ে একটা গুলি চলে গিয়েছে। এতো যন্ত্রণা কখনো হয়নি। আজকে বোধহয় একটু মানুষ হতে যেয়ে এই হাল হয়েছে।জঘণ্য ব্যাপার স্যাপার। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। শালার মানুষ, আর মানুষের জীবন। সারাজীবন অভিনয় করে ভালো মানুষ সেজে নিজের সাথে নিজে চোর পুলিশ খেলে বাঁচার নাম যদি জীবন হয়, I fuck on that।
আর সহ্য করতে পারছিলাম না। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেলাম।ভেতরের কেমন একটা শূণ্যতা আমাকে কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে খাচ্ছিলো। যখন প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম মুনাকে। ও আমার পাশে বসে আমার মাথাটা ওর কোলে নিয়ে রেখেছে। আমাকে বললো, “খুব লোভ হচ্ছে ভালোবাসার। আমাকে ভালোবাসবা? আমার শরীরটাকে না। আমার তোমাকে না বলা কথাকে, তোমাকে নিয়ে ভাবনাগুলোকে, আমার স্বপ্নগুলোকে। বাসবা প্লিজ? কেউ বাসেনি। সবাই অভিনয় করে শরীর চেয়েছে। আমার ভেতরটা কেমন করে এখনও যেন বেঁচে আছে। চলে যাওয়ার আগে তাই হঠাৎ তোমার চোখগুলোর কথা মনে হচ্ছিলো।যতবার আমি তোমার দিকে তাকিয়েছি মনে হয়েছে ভেতরে একটা মানুষ থাকে। কিন্তু সে ভয় পায়।আমি তোমাকে রেখে যেতে পারছিনা। ইন্তিহাব আমি খুব স্যরি তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য।তোমার জন্য হঠাৎ খুব মায়া হচ্ছিলো। কারণ হয়তো আমার নামটাই যে মায়া,আমার সত্যি নাম এটা”।
আমি মায়ার হাত ধরি। ঠিকমত চোখ খুলে দেখি মুনা নয়, ও আসলেও মায়া। ও ফিরে এসেছে। ইশ সারাজীবন এভাবে ওর কোলে শুয়ে থাকতে পারতাম! নিজেকে আবার সেই ছোট্টকালের ছেলেটার মত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে মা আমাকে আদর করে তার দেয়া নামে ডাকছে, “অর্ক। আয় বাবা খেতে আয়”।
আমি এক হাতে মায়াকে ছুঁয়ে থাকি, আরেকটা হাত মা কে ধরার জন্য বাড়িয়ে দেই। আমার সময় কম, চারদিক কেমন ঘোলা হয়ে যাচ্ছে...
************
প্রিয় একটা লেখা। প্রায় এক বছর ধরে লিখেছি যতদূর মনে পড়ে। ইন্তিহাব মির্জা এই লেখায় একজন অমানুষ হিসেবেই প্রতীয়মান হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কিভাবে যেন সেও একজনকে ভালোবেসে ফেললো। এমনটা কথা ছিলোনা। এইটাই আমার মত কাবজাব যারা লেখে তাদের সমস্যা। খুব খারাপ মানুষটাকেও একটা প্রেম করায় দেয়। দুঃখিত- নিজের কাছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৪:১৫
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×