somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নবনীতা

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“নদীর বুকে কষ্ট জমাট বাধে রে?” – অপর্ণাদি চেয়ে থাকেন আমার দিকে। তবে সেই চাওয়ায় উত্তর খোজার কোন প্রত্যাশা নেই। তার চেয়ে থাকা শুধুই একটা স্থবিরতা। আমাদের ছোট্ট চিত্রা নদীর পার ঘেষে ছগীর চাচার নৌকাটা ঢেউয়ের সাথে সুর তুলে এগিয়ে যায়। আমি তাকিয়ে থাকি অপর্ণাদির দিকে। অপর্ণাদি চোখ সরিয়ে মাঝির কাছে জিজ্ঞাসা করে, চাচা নদীর পানি কয় হাত?
ছগীর চাচা হাসে, বলে – অনেক গভীর। যেবার তোমার চাচীরে ভাসায়া নিয়া গেলো সেবার ছিলো সবেচ্চে গভীর। এখন নদী শান্ত হইছে। আর পার ভাঙ্গেনা।
অপর্ণাদি নৌকার এক কোণায় বসে মনের ঝাপি খুলে আকাআকি করে। আমি অনেকক্ষণ বাদে তাকে মিষ্টি হেসে বলি, আচ্ছা তুমি কলেজ পাশ দিলে কি করবে?
যার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছিলো সে তার গালে হাত দিয়ে ভাবে। ভাবছে আর ভাবছে। মিষ্টি করে বলে, জানিনারে। হয়তো নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো। বাতাবি লেবুর বনে ঝুলঝুলি উড়াবো। মনের আকাশে ঘুড়ি চড়বে, আমি তাতে খাবি খাবো।জানিসরে অর্ণ আমার খুব শখ করে কবিতা দিয়ে জাল বোনার। সেই জালে আমি লাল নীল ভালোবাসা ধরবো। মজা না?
আমি জানি অপর্ণাদি আমার জন্য কথাগুলো বলেনি। যার জন্য বলেছে সে এখন নবগঙ্গার ধার ধরে মিছিলের পথে পা বাড়িয়েছে। আমি জয়নাল স্যারের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম সেদিন বেশ মনা বেজার করে। পরের বছর পরীক্ষা, কিচ্ছু পড়া হয়নি তেমন। পুরো একটা বছর হেলায় কাটিয়ে দিয়েছি। সারাদিন অপর্ণাদির বাড়ির পাশের মাঠে দাপিয়েছি, কখনো গল্প কবিতার বইয়ে ডুব দিয়েছি। ১৮টাকা জমা করে রকিব হাসান, আরেকটু জমলে বিভূতি অথবা সমরেশ কিনতে দৌড়ে যেতাম বড় শহরে। তা পড়া হতোনা, আগে অপর্ণাদিকে দিতাম। সে যখন নতুন বইয়ের ঘ্রাণে নাক ডুবিয়ে শ্বাস নিতো, আমি তাকিয়ে থাকতাম। ও জানেনা আমি তাকে বড্ড চাই, ও বোঝেনা আমার বেলা গড়িয়েছে ওকে না বলে ভালোবাসতে।
নৌকা যখন ঘাটে ভেড়াতে চলছে তখন সাহস করে অপর্ণাদিকে বললাম, তোকে যদি একটা চিঠি দিই নিবি?
অপর্ণাদি আমার দিকে তাকালো, তারপর ফিক করে হেসে দিলো। এরপর বললো, এই তোর গোফ গজিয়েছে দেখি। বড় হয়ে যাচ্ছিস, না?
প্রিয় পাঠক, আপাতত এটুকুই অপর্ণার কথা। পরে কোন এক কালে আবার হয়তো সে ভেসে আসবে, উঁকি দিয়ে সবসময়ের মত গলায় ঢেউ তুলে বলবে, মনে রেখেছিস রে?

বয়স যখন ছয় বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, অর্ণ মানে কি বাবা?
বাবা বেশ অনেকক্ষণ মাথা চুলকালো। তারপর বললো শেফালীকে জিজ্ঞাসা করতে হবে তো।আমি কখনো ওকে আজ পর্যন্ত এই কথাটা জিজ্ঞাসাই করে উঠতে পারলাম না।গ্রামে গেলে এবার মনে করিয়ে দিস।
শেফালী আমার ফুপু। উনার সাথে আমার বাবার বাড়ির কারো তেমন একটা যোগাযোগ নেই। ফুপু নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেছিলেন তাই হয়তো তাকে নিয়ে সবার এতো গোস্বা। কি অদ্ভূত। একজন মানুষ যার সাথে শোবে, ঘুমাবে, বাচবে, খাইবে, রাত বিরেতে হুট করে বায়স্কোপের গল্প করবে তাকে পছন্দ করে নিতে পারেনা? কেন তাতে সবার এতো রাগ হতে হবে?
ফুপুর সাথে অবশ্য আমার দেখা হয়নি আর এই জীবনে। আমি মনে মনে একটা মানে দাড় করিয়ে নিয়েছি আমার নামের। আমার নামের অর্থ স্বাধীনতা। যেমন তেমন ভাবার স্বাধীনতা, রাত বিরেতে হারিকেনের আলোয় সত্যজিতের কাকাবাবু পড়া, অথবা কোন একদিন স্কুল পালিয়ে নদীর পারে শুয়ে অপর্ণাদির কথা ভাবা। ও হিন্দু ঘরের মেয়ে, এমনটা ভাবা নাকি আমার ধর্মে পাপ। আমি কখনো ওর গায়ে হিন্দু গন্ধটা পেলাম না। এটা কেমন গন্ধ?অবশ্য মাঝে সাঝে আমি অপর্ণাদির গায়ে জাঁকালো একটা তুলসীর ধোয়াচ্ছন্নতা উপভোগ করি। সেই ঝাজালো গন্ধে আমি চোখের পানি আটকে অপর্ণাদিকে মনে মনে বলি, বুঝতে পারো কিছু? কতটা ভালোবাসলাম বুঝতে পারো?

বয়স যখন সাত একরাতে দেখলাম মায়ের খুব মন খারাপ। একটু পরপর আমার দিকে আর বাবার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। খুব বেশি কিছু বোঝার বয়স আমার তখন হয়ে উঠেনি। রাত তখন আনুমানিক ১১টা বাজে হয়তো। আমি ঘুম থেকে জেগে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে রাখলাম। গুমোট দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা আধাপাকা বাড়ির জং ধরা টিনের ফাক গলে হারিয়ে যাচ্ছে আর আমি মায়ের চোখের জল গুনছি। মা একটু পর বললেন, বাবাকে ভালো করে দেখে নে। আরব দেশ চলে যাবে আর সপ্তাহ পেরোলে। তখন আর কোলে নিয়ে এমন করে কেউ ঘুরবেনা।
আমি কিছু না বুঝেই মায়ের আচল চেপে ধরে কান্না শুরু করলাম। সময় গড়িয়েছে, কত বেলা মায়ের প্রাণহীন চূড়ির শব্দটা আমার হৃদয়টা চীর্ণবিচীর্ণ করেছে। আমি শুধু ভেবেছি বাবারা এমন হয় কেন। আমার বাবা আর ফিরে আসেননি। টাকা পাঠাতেন, ফোনে কথা হলে – “ভালোমত পড়ো, বাবা অনেক কষ্ট করছে জানোতো?” এইটুকুর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকতো। আমি লুকিয়ে ছাপিয়ে বড়দের বই পড়তাম। বিকেলে যখন খেলার সুযোগ হত তখন পাশের পাড়ায় সুমন ভাইদের সাথে একদম চাকরী নেয়া লেফটব্যাকের মত দাঁড়িয়ে দড়াম করে ফুটবলে কিক মারতাম। পড়াশোনাটা ঠিকঠাক ছিলো। মনটা ছিলো দুর্নিবার। আমার জীবনটা অন্তত একঘেয়ে ছিলোনা। আমি আমার মত বাঁচতাম।বেশ বাঁচতাম, শ্বাস নিতাম। গোপালগঞ্জের হাউড়ে বাঊড়ে আমার শতকোটি দুরন্তপনার লালনীল ছাপ ছিলো।

২০০২ সালে মেট্রিক পাশ করে আমি তখন নিজেকে বড় ভাবা শুরু করেছি। সেসময় হঠাৎ একদিন একটা পত্রিকায় আমার লেখা বের হলো। আমি হতভম্ব, বিহবল হয়ে গেলাম। লেখাটা একটা ছোট্ট প্রবন্ধ ছিলো, শিরোনামে “কোথায় এগিয়ে চলছি আমরা”। খালেদা জিয়া তখন ক্ষমতায়। দুর্ণীতি নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য হচ্ছে। আমি ভাবলাম, আসলেও কি আমরা এগোচ্ছি? আমি একটা ছোট্ট লেখা দাড় করালাম নিজের মনে মনে। তাতে কিছু যুক্তি তর্ক মিশিয়ে এই সরকারে আমাদের কোথায় জ্বলছে, কোথায় পুড়ছে আর কোথায় ধামাচাপা দিয়ে মলম লাগানো হচ্ছে তার একটা নকশা একে সোজা ইত্তেফাকে পাঠিয়ে দিলাম। পাঠকের চিঠিতে সেই লেখা ছাপা হবে কে ভেবেছিলো? দৈনিক জনকণ্ঠেও পাঠিয়েছিলাম, তারা ছাপায়নি। লেখা ছাপা হওয়ার পর প্রথম দৌড়ে গিয়েছিলাম অপর্ণাদির কাছে, তাকে দেখালাম। নিজে পড়ে শোনালাম। সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, তুইতো পুরা সঞ্জয়ের মত লিখিস দেখি।ওর লেখা প্রায়দিন পেপারে আসে জানিস?
আমি এমন হিংস্র আঘাত সহ্য করার অবস্থায় ছিলাম না। পেপারটা ছো মেরে কেড়ে নিয়ে বাড়িতে চলে আসলাম। মন খারাপ করে নিজের জরাজীর্ণ কামরায় বসে ভাবছিলাম, সঞ্জয়দাকে কত ভালো লাগতো এককালে। আর এখন নামটা শুনলে কেন যেন খুব রাগ পায়। অথচ সেতো কোন দোষ করেনি। ওরা ভালোবাসতো একজন আরেকজনকে। এটাই সত্য, হয়তো এটাই সুন্দর। আমি মাঝখানে শুধুই একটা পোকা। তবুও আমি ওর কাছে বারবার যেতাম, ওর কথা শুনতাম। মনে মনে বলতাম, তুমি আমাকে জাদু করেছিলে, আমার কাল হয়েছিলো তোমার ভালোবাসায়।তাই বারবার চেয়েও তোমার কথা ফেলতে পারিনা, আমি পারিনা তোমাকে ভুলে একটা নিঃশ্বাস নিতে। আমার কাছে তোমার অনেক দায়, জানো তো অপর্ণা?

ঢাকার ভাড়া বাসাগুলো খুব এলেবেলে হয়। অন্তুকে নিয়ে একটা বাসা ভাড়া করেছিলাম। ভাড়া ছিলো ৩৮০০ টাকা। বাসাটা ছিলো আমার কলেজের একদম পাশে, আরামবাগে।সেসময় হঠাৎ কবিতা লেখার শখ হলো। আমি অনুসরণ করতাম রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। তার মত বড় চুল রাখা শুরু করলাম। রুদ্র দাদার একটা ছবি দেখেছিলাম পত্রিকায়। আমি সেই ছবিতে উনি যেমন করে হাসতো ঠিক তেমন করে হাসতে চাইতাম। উনি হৃদয়ের কবি ছিলেন। আমার ১৭ বছরের অক্ষত হৃদয়ের গল্প কেউ শুনতে না চাইলেও আমি তাকে শুনাতাম। গুনগুন করে তার কবিতার দ্রোহের ঘ্রাণটা শুকে নিতাম, আমি তাকে এবং তার কবিতাকে বিষম ভালোবাসতাম।মা একা একা গ্রামে থাকতো, আমার ভালো লাগতোনা। বাবার খবর নেই বছর দুই হয়ে গেলো। আমরা মধ্যবিত্তও ঠিক ছিলামনা, তার থেকে আরেকটু গরীব। একা একা মা কিভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকবে আমি জানতাম না। কিন্তু মা চাইতেন আমি যেন এক্কেবারে ভালো একটা পড়াশোনা করি।তাই মাতুলবাড়ি থেকে সম্পত্তি ভাগাভাগির পর যা কিছু অংশ পাওয়া গিয়েছিলো মা পুরোটা আমার জন্যই রেখে দিয়েছিলেন। মা কে রেখে আসার দিন খুব কাদলাম। বারবার বললাম, মা আমি থেকে যাই? তুমি পারবানা আমাকে ছাড়া থাকতে। মা নিজেও কাঁদে। আমাকে বলে, বেশ পারবো। তুইও পারবি। এখন বড় হতে হবে। অনেক বড়। এভাবে আর কতদিন বল?কয়েকটা বছর একটু কষ্ট কর।একটুখানি আর।

আমার কষ্ট হয়েছিলো মা কে ছেড়ে আসতে। বুকটা ফেটে গিয়েছিলো অপর্ণাদিকে আর দেখতে পাবোনা ভেবে। যাওয়ার আগে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। মনে তখনও অনেক অভিমান। যাওয়ার পর আমাকে বলে, অর্ণ একটা কাজ করতে পারবি? পারতেই হবে।
আমি হেসে বললাম, কি লাগবে বলো তো?
অপর্ণাদি আমাকে বাড়ির পেছনের গাছগাছড়ার নির্জনতায় হাত ধরে নিয়ে গেলো। ওর আরেক হাতে একটা চিঠি। আমাকে বললো, অর্ণ এই চিঠিটা সঞ্জয়কে দিবি। ওর ঠিকানা আমি চিঠির উপর লিখে দিয়েছি। তুই আমার এই উপকারটা কর? আর এইযে ১২০০ টাকা দিলাম। তুই ১০০ টাকা রেখে দিস। বাকীটা ওকে দিস। ও খুব কষ্টে আছে। টিউশনী করেনা, কোন আয় নেই দুমাস ধরে। পরীক্ষা দেয়নি এবার জানিস? ওর যে কি হয়েছে! তুই কথা দে আমার কাজটা করে দিবি?
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম অবাক হয়ে। আমি খুব আশা করেছিলাম অপর্ণাদি আজ আমাকে একটা মিষ্টি কথা বলবে। যে চোখের জলে আমি সিক্ত ছিলাম, তার স্রোতে একটু ভালোবাসার টান ধরবে। আমি নির্বাক ছিলাম। আমি ও কি যেন সব হাবিজাবি বলছিলো, বুঝতে পারছিলাম না। দড়াম করে ওকে বললাম, আচ্ছা অপর্ণাদি আমি যদি বলে ফেলি তোমাকে ভালোবাসি খুব কি পাপ হবে?
অপর্ণাদির মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। চোখটা শুধু কাল অমাবশ্যাতেও ঝকঝক করছিলো। আমি ওর মাথার সিথির দিকে তাকিয়ে আস্তে করে একটা আঙ্গুল বুলিয়ে দিলাম। ওর চোখে তখন কেমন একটা কৌতুক খেলা করছে। আমি চিঠি আর টাকাটা হাত বাড়িয়ে নিলাম। ১০০ টাকা ফেরত দিয়ে বললাম, বললা না? আমার কি পাপ হবে? তোমার সাথে দেখা হওয়া যতগুলো গল্প সব একটা লালচে কালো মলাটে বাধাই করা ডায়েরীতে লিখে রেখেছি। অন্যায় হয়েছে? তোমাকে আমি চোখ বুজে আঁকতে পারি এবং কথা দিতে পারি এতো যত্ন করে ছোপ ছোপ জলরঙ্গে আর কেউ আঁকতে পারেনি। পাপ হয়েছে?
আমার চিবুকে একটা হাত ছুইয়ে দিয়ে ও বললো, তুই আরো একটু বড় হ। তারপর তোকে অনেক ভালোবাসবো। ভগবানের দিব্যি। আমি তো খেয়ালই করিনি তুই এতো বড় হয়ে গেছিস। বেশ ভালোবাসা প্রেম শিখেছিস না?
আমি নড়ে উঠি, নাকি আমার ভেতরের শান্ত নির্লিপ্ত অথচ কালান্তের অস্থির আত্নাটা নড়ে উঠে টের পাইনা। আস্তে করে সরে পড়তে গেলে অপর্ণাদি হাত ধরে আটকায়। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ভালো থাকবি তো আমাদের রেখে?
আমি চোখের পানি লুকিয়ে বললাম, হয়তো থাকবো। তবে তোমাকে না দেখে খুব ভালো থাকবো। কথা দিচ্ছি তোমাকে একদম মনে রাখবোনা।
অপর্ণাদি হাসছে মিষ্টি করে। আস্তে করে আমার কাছে এগিয়ে আমার ঠোটে আলতো করে একটা চুমু দিলো। আমার জগতটা তখন থেমে গিয়েছিলো। এই প্রথম কোন নারীর তার নারীত্বের আহবান দিয়ে আমাকে ছাপিয়ে দিলো। আমি নশ্বর তা আমি জেনেছিলাম, আমি বরবাদ হতে পারি, ধ্বংশ হয়ে আবার গড়ে উঠতে পারি কিন্তু সেই চুমুর উষ্ণতা জন্ম থেকে জন্মান্তরে আমাকে তাড়া করে ফিরবে। আমি ছুটে পালাবার আগে শুনতে পেলাম যাকে ভালোবাসতে হবে বাকীটা জীবন সে খুব করুণা করে বললো, এত্ত অভিমান?!

অন্তুর সাথে বন্ধুত্বটা বেশ জমজমাট ছিলো। পরিচয় ক্লাস সেভেনে পরার সময়। ওর সাথে সব বলতাম। একসাথে গালির চর্চা করতাম, প্রেমের কবিতা আওড়াতাম, সন্ধ্যে হলে বড় হয়েছি এই ভাব ধরে বাসার নিচের নোংরা দোকানটায় চা খেতে যেতাম। অন্তুর আমাদের বাড়িওয়ালার মেয়েকে আবার খুব পছন্দ। মেয়ে পড়ে ক্লাস নাইনে। নটরডেমের ছাত্র হিসেবে তখন আমাদের বেজায় ভাব। অন্তুর প্রেমের চিঠিতে তাই নাইনপড়ুয়া অবনীর মন গলে গিয়েছিলো।অবনীর সাথে আমার একবার কথা হয়েছিলো। এতো ছাগল টাইপ একটা মেয়ের সাথে কিভাবে অন্তু কোন সম্পর্কে জড়াতে পারলো আমার মাথায় আসেনি। রাতের বেলা দুজন চিচিং বিচিং করে কথা বলতো, আমি পাশের বিছানায় বসে শরৎচন্দ্র অথবা সমরেশ নিয়ে বসে থাকতাম। গল্প-কবিতা ভাবতাম। অন্তু অবনীর আবেগে গদগদ অর্থহীন কথাবার্তায় আমার ভাবনায় ছেদ ধরতোনা। এক ভোরে দেখলাম অন্তুর চোখ লাল। জিজ্ঞাসা করলাম চোখ উঠেছে কিনা? অন্তু কিছু বলেনা। ভাবলেশহীন। আমি ক্লাসে চলে গেলাম। সে ক্লাসেও গেলোনা।

অন্তু দুইদিন ধরে মেসে আসেনা। প্রথমদিন আমি খুব বেশি ঘাবড়ায়নি। মনে হয় অবনীর সাথে ঝগড়া হয়েছে তাই ছাদে বসে আছে হয়তো মন খারাপ করে। পরের দিন যখন ওকে ভোরে দেখলাম না, তখন ওকে ফোন দিলাম। ওর ফোন বন্ধ।আমি ক্লাসে চলে গেলাম নানান ঝামেলা ভাবতে ভাবতে।
সন্ধ্যায় অন্তুর ফোনে পেলাম। ও দেখলাম খুব হাসিখুশী। আমি গজগজ করে বললাম, ফাইযলামী মাড়াস? ফোন কইরা জানাবি না সমস্যা।
অন্তু হাসে। বলে, দোস্ত গ্রামে আসছি। ভাল লাগতেছেনা মসজিদের শহর।
আমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ১০ তারিখ পরীক্ষা শুধু। এর পর যাইতে পারতি। বাসা ভাড়ার টাকা পাইছিস কই?
অন্তু হাসে। হাসতে হাসতে বলে, তোর টিউশনীর টাকা কিছু মাইরা দিছি,আমার কিছু ছিলো। টাকা পরে পাঠায় দিবো। মাইন্ড করিস না।
আমি বিছানায় বসে যতটা সম্ভব রাগ কমিয়ে বললাম, টাকা নিছোস সমস্যা নাই। তোর প্ল্যানটা কি? আর আসবিনা?
অন্তু কিছু বলেনা। আমি উত্তর পেয়ে যাই। ফোন রাখার পর আমি চিন্তায় পড়ে যাই। খুব ছোটকালে স্কুলের এক বন্ধু ছিলো হেলাল নামে। ও ক্লাস ফাইভের পর আর স্কুলে আসতোনা। আমি ওর বাসায় গিয়ে দেখি ও তাঁতের কাজ করছে। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। খুব বুঝেছিলাম এভাবেই কেউ কেউ হঠাৎ ঝরে যায়। অন্তুর সাথে এমন হবে আমি মানতে পারছিলাম না। তাই সেদিন রাতেই টিকেট কেটে আমাদের বাড়িতে না গিয়ে সরাসরি ওর বাড়িতে গেলাম। ও তখন থালা ভর্তি ভাত নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে কিছু হয়নি এমন ভাব ধরে বললো, দোস্ত তোর জন্য ভাত নিয়ে বইসা আছি। তুই আসলে একসাথে খামু ভাবছিলাম। হাত ধুইয়া বইসা যা।
অন্তুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি দুইদিন পর ঢাকায় চলে আসি ওকে নিয়েই। সে সারারাত জেগে কবিতা লেখে আজকাল। আমি কিছু বললে মাথা নেড়ে ভাব ধরে বলে, দোস্ত গরীব মানুষ প্রেম করেনা। কবিতা লেখে।
আমি ওর গায়ে থুতু মেরে আবার হাজারী নাগের রাজত্বে হারিয়ে যাই। তিনদিন পর রসায়নবিজ্ঞান পরীক্ষা। আমার এত ইতং বিতং শুনার সময় নেই। অন্তু কবিতা লেখে, মাঝে মাঝে বই উল্টিয়ে পালটিয়ে দেখে। কিছু কিছু সময় আমি বই রেখে ওর পাশে বসি। সে অবনীর গল্প শুনায়। কিভাবে অবনী আরেক ছেলের সাথে ডেট করতে যেয়ে ধরা খেলো সেই গল্পটা সে নানান রঙ লাগিয়ে আমাকে বলে। আমি প্রতিবার বিরক্ত হই আর ওকে বলি, তুই একটা মগা। ওই মাইয়ারে দেখলেই মনে হয় এইরকম। তুই মফস্বলের ছাগা বুঝিসনাই।
অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, প্রেম আমারে দরিদ্র করেনি, দিয়েছে একরাশ জ্বলজ্বলে মুক্তা।
আমি হতাশ হয়ে ওকে বলি, সেই মুক্তা বেইচা তুই হিরোইন কিনে খা কুত্তা।
অন্তু হাসে। ও অবনীকে ভালোবাসতো কিনা জানিনা। ওই বয়সটা কি আমাদের ভালোবাসার জন্য উপযুক্ত ছিলো। লোকে বলে, বয়স যখন কম থাকে আর প্রথম ভালোবাসাটা আপনাকে ছুয়ে যায় তখন আপনি নিজেই একটা জগত হয়ে যান। সেই জগতে বাস করে নিঃসীম কল্পনা, কাউকে পাওয়ার, ছুয়ে দেয়ার প্রত্যাশা। ওই জগত থেকে এক জীবনে কেউ আর মুক্তি পায়না। অন্তুকে দেখে আমার তাই মনে হতো। ও আটকা পড়ে আছে সেই জগতে। এখান থেকে ওর মুক্তি নেই।

অন্তু এইচএসসি পরীক্ষার সময়ও তার বিচলামী বন্ধ করে নাই। সে তখনও গণিতের আগের দিন ভালোবাসা ও ম্যাথ নামে একটি কবিতা লিখে আমাকে চিৎকার করে পড়ে শুনিয়েছিলো। কবিইতার শেষ লাইন ছিলো, অবনী আমার ক্যালকুলাস হয়ে থাকো, আমি তোমার ক্ষুদ্র বিভাজনে বিলীন হবো।অন্তুর পাছায় একটা লাথি মেরে আমি হাহুতাশ করি। আর কিছুদিন পর এই হারামজাদা আরেকটা প্রেম করবে। আরেক মেয়ের হাত ধরে আইসক্রিম খেতে খেতে ভার্সিটির রাস্তায় হেটে যাবে। আমাকে দেখে বলবে, দোস্ত ৩০০ টাকা ধার দে।একটেল জয় প্যাকেজে ভালো অফার দিছে। দেড় টাকা মিনিটে রাত ১২ টার পর কথা বলা যাবে।

অন্তু এইচএসসিতে সমগ্র বাংলাদেশ থেকে যে দুইজন গোল্ডেন এ+ পেলো তার একজন ছিলো। রেজাল্ট আনতে যাওয়ার দিন সে মনমরা হয়ে আমাকে বলেছিলো, রেজাল্ট জেনে আমাকে বলিস। আজকে বিষণ্ণতার কবিতা লিখবো। দেখ তোরা ফেল মারবি দেখে আকাশে আজ কালো মেঘ ছেয়ে গেছে। একটু পর বৃষ্টি, তারপর শুরু হবে এক পৃথিবীর সৃষ্টি। যা যা, তোরা ব্যর্থতার উপাখ্যানটা নিয়ে আয়।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। হারামীটার পেটে একটা কষে লাথি মারতে ইচ্ছা করছে। আমি শুধু গরগর করে বললাম, ছন্দে ছন্দে দুলিয়া নন্দে আমার সাথে কথা বলবিনা। আর নটরডেমের পোলাপাইন ফেল করেনা। তোর মত দুই একটা গরু করতে পারে।
গরু অন্তু রেজাল্ট জেনে ভাবলেশহীন মুখে বললো, কি লাভ এই অলীক ফলাফলের। জীবনের পরীক্ষায় আমি তো শুধুই একটা দাড়কাক। তোরা হলি অবার্চীন।

অন্তু খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ঢাকায় তার পড়ার ইচ্ছা ছিলোনা। সে মাটির গন্ধে কবিতা খুজতো। তাই নিজেকে হারিয়ে দেয়ার সুযোগ করে আমার জীবন থেকেই হারিয়ে যায়। আমি ঢাকায় পড়ে ছিলাম একা, সব নিস্তব্ধাকে পাশ কাটিয়ে। মাঝে মাঝে রাতে ডিম খাওয়ার সময় ওকে মনে পড়তো। ও খুব ভালো ডিম ভাজতে পারতো। আমাদের মত গরীবের জন্য ডিম একটা আশীর্বাদের নাম। সাথে একটু ডাল হলে আমরা ভাতের প্রতি লোকমায় আলহামদুলিল্লাহ বলতে বাধ্য থাকতাম।
আমি প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম।যাপিত জীবনের ক্লান্তি ছাপিয়ে তখন আমার নতুন এক আগ্রহ জন্মে। আমি খুব লেখালিখি শুরু করলাম। আমার প্রথম লেখা ছিলো আচমকা এক মেয়ের সাথে হঠাৎ ভালোবাসা নিয়ে। প্রতিবার লিখতাম আর অপর্ণার কথা ভাবতাম। সেই চুমুটার উষ্ণতা আমাকে তখনো ছেড়ে যায়নি। আমি আর কারো কাছে উষ্ণতার খোজ করিনি। রাত বিরেতে মাঝে মাঝে হাসফাস করতাম। অনেকদিন ভেবেছি গ্রামে যেয়ে অপর্ণাদির হাত ধরে বলবো, আমাকে একটুও ভালোবাসা যায়না। একবার অধিকার পাওয়া যায়না তোমাকে অপর্ণা বলে ডাকার। বিশ্বাস করো জগতের সব আবেগ দিয়ে তোমার নামটা উচ্চারণ করবো। যতটা ভালোবাসা নিয়ে কেউ কাউকে কিছু না বলেও অপেক্ষায় থাকতে পারে, আমি তার সবটা তোমার জন্য গুনে গুনে জমা রাখবো। আমি চায়ের কাপে তোমার জন্য গুছিয়ে রাখা মুগ্ধতা খুজি, সিগ্রেটের ধোঁয়ায় তোমার প্রতিমা আকি। চায়ের উত্তাপ হারিয়ে যায়, আমার মুগ্ধতা তলানীতে ছড়িয়ে থাকে। অথবা ছাইরঙ্গা ধোঁয়ায় তুমি আকাশে এক বিশাল মুর্তি হয়ে বসে থাকো, আমি তাকে অনুসরণ করি। সারাদিন, সারাটাক্ষণ।
আচমকা একদিন এক মেয়ে আমার কেনা নোকিয়া ১১০০ তে ফোন করলো। একহাত বদলী হওয়া গরীব ফোনটায় প্রথম কোন রমনী ফোন করলো। একটু যে উত্তেজনা কাজ করছিলোনা তা কিন্তু না। আমাকে প্রথম কথাটা বললো, আপনার চুল এমন আউলাঝাউলা থাকে কেন সবসময়?
আমি যতটা সম্ভব ভাব নিয়ে বললাম, অনেক ব্যস্ত থাকি। এত সময় কোথায়?
সে তার পরিচয় আমাকে দিলোনা। নানান হেনতেন আলাপ সেরে ফোন রাখার আগে বললো, আসলে আপনি আমাকে চেনেন। আমার নাম অবনী। অন্তুর বন্ধু ছিলাম।
মেজাজটা অত্যন্ত বিলা হয়ে গেলো। আমি যথাসম্ভব শান্ত হয়ে বললাম, এইটা তো আগে বললেই পারতা। অন্তুর সাথে তো তোমার ভাঙ্গাভাঙ্গি হয়ে গেছে।
অবনী একটু মন খারাপ করে বললো, ভাইয়া আসলে আপনার বন্ধুই বলছে আপনার সাথে একটু দুষ্টুমি করার জন্য। ও আমার পাশেই বসে আছে। কথা বলবেন?
অন্তু আমাকে এরপর ফোন ধরে বললো, দোস্ত বিয়া কইরা ফেলছি। তোর মেসের পাশের কাজী অফিসে খাড়ায় আছি।। আইসা বউ দেইখ্যা যা।
আমি বিমূঢ় হয়ে কি বলবো ভাবছিলাম। আমার বন্ধু বিয়ে করেছে এই অল্প বয়সে হঠাৎ করে। আমি মক্কা খেয়ে বললাম, কি হচ্ছে কিছুই তো বুঝতেছিনা!!
সেদিন রাতে আমাকে কাউরান বাজার থেকে একটা লাল মুরগী কিনে রান্না করতে হয়েছিলো। আমার মেসের রুমমেটকে হাতে পায়ে ধরে আরেক জায়গায় থাকতে বাধ্য করেছিলাম। আর নিজে ছাদে যেয়ে একটা চমৎকার গল্প লিখেছিলাম। গল্পের নাম মন্দাকিনী।এই শব্দের অর্থ জানিনা। তারপরও কেন যেন গল্পটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিলো। গভীর রাতে অন্তু ছাদে এসে আমার পাশে বসে বললো, দোস্ত ক্লান্ত লাগতাছে। তোরে ধন্যবাদ থাকার ব্যবস্থা করছোস বইলা। দুপুরের বাসে আমি যাইতেছিগা। তুই অবনীরে একটু ওর বাসায় নামায় দিস।তুই কি বিরক্ত হইছোস?
অন্তু আমার দিকে ভয় ভয় চোখে তাকায় থাকে।আমি বন্ধুকে একটা ঈদ মোবারক দিয়ে বললাম, দোস্ত খুব একা লাগে। তুই ঢাকায় আইসা পড়।
দিন যায়, অনেকগুলো রাত আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। আমি মানুষ দেখি, তাদের গল্প শুনি। হাতটা বেশ খুলে গিয়েছিলো। নিজের মত করে লিখতে পারতাম। মা কে মাঝে মাঝে ফোন করে গল্প শুনাতাম। মা বলতো, তুইতো বেশ ভালো লিখিস। তাড়াতাড়ি একটা বই ছাপায় ফেল।
আমি মার উপর রাগ করে থাকতাম। এই রাগটা ছিলো অর্থহীন। কিন্তু আমার তো রাগ করার মত কেউ ছিলোনা। শুধু একটা অদ্ভূত, সংজ্ঞাহীন একাকীত্ব নিয়ে ব্যস্ত নগরীতে আমি হাসফাস করতাম। ভাবতাম, মা তুমি নেই কেন?এমনটা ভাবতে ভাবতেই একদিন মাকে দাফন করে আসলাম বাড়ির দক্ষিণের ওই গাছটার পাশে যার কাছে আমার শৈশব জমা রাখা ছিলো। মাকেও তার কাছেই গচ্ছিত রাখলাম। লোকে বলতো গাছটা মরে গেছে। আমার মনে হতো ও বেশ বেঁচে আছে। ও অপেক্ষা করছে একটা কাছের মানুষের জন্য। কখনো বুঝিনি সেই মানুষটা আমার মা হবে। সবাই যখন মা কে রেখে চলে আসছিলো আমার তখন অনেক ভয় লাগছিলো। বিশ্বাস করো মা, তোমাকে একা একা ফেলে আসার সেই ভয়টা আমার আরো হাজার জীবনেও কাটবেনা। আমি মা কে রেখে আসতে চাচ্ছিলাম না। সবাই আমাকে বুঝাচ্ছিলো, আমি বুঝতে পারছিলাম না। মা আমি তোমাকে দেখতে পারিনি, তোমার শেষ নিঃশ্বাসের শব্দটা ছিলো আমার জন্য সবচেয়ে কুৎসিত। আমি বুঝিনি তুমি ভেতরে ভেতরে এতো ক্ষয়ে গেছো। আমি একা ছিলাম মা, তোমাকে ছাড়া আমি বহুদিন একা ছিলাম। আজ থেকে আমি নাহয় মৃত হলাম। আমার এক জীবনের সব অর্থ তুমি নিয়ে হারিয়ে গেছো।একা একা ভালো থাকবে তো?
দুদিন প্রায় না খেয়ে মার জরাজীর্ণ ঘরটাতে শুয়ে বসে ছিলাম। অনেকে জোর করে এটা ওটা খাইয়ে দিতে চেয়েছিলো। আমি বমি করে দিতাম, কিছু খেতে পেতাম না। আমার ভেতরটা বদলে গিয়েছিলো। ২১ বছরের আমার ভেতরে তখন একটা দাড়কাক আশ্রয় নিয়েছিলো। বৃদ্ধ দাড়কাক।এক সকালে অপর্ণাদি এসে আমার পাশে বসলো। আলতো করে মাথায় হাত দিয়ে বললো, শহরে ছিলাম। কাল মাত্র দুপুরে জেনেছি। তোকে দেখতে চলে এলাম। আয় তো আমার হাতটা ধর।
আমি হাতটা ছুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর চোখে জল ছিলো, সাথে একটুখানি করুণা। আস্তে আস্তে বললাম, একটু করুণা করবে অপর্ণাদি?
ও কিছু বললোনা। আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি খেয়াল করলাম, ওর চোয়ালটা যেন কেমন শক্ত হয়ে গিয়েছে। শুকিয়ে গেছে বেশ। আমি আস্তে আস্তে বললাম, কেন এসেছো? আমি বেশ আছি।
অপর্ণাদি আমার জন্য খাবার নিয়ে আসলো। একরকম জোর করে নিজে হাতে খাইয়ে দিলো। আমাকে বললো, জানিস জীবনটা পুরাটাই একটা যুদ্ধ। একসময় ভাবতাম সঞ্জয়ের সাথে যেদিন থেকে একসাথে থাকতে পারবো সেদিন থেকে আমার জন্য পৃথিবীটা একটা স্বর্গ। কিন্তু এমনটা আসলে হয়না। একদম হয়না। আমি এখন প্রায়দিন যুদ্ধ করি। কত না বলা যুদ্ধ। তোকেও শিখতে হবে এসব। বাঁচতে হবে। এজন্যই পৃথিবীতে এসেছিস। না খেয়ে মরে যাওয়ার জন্য না, বুঝেছিস?
আমি অপর্ণাদিকে জড়িয়ে ধরে সেদিন খুব কাঁদলাম,ওকে বারবার বললাম, আমার কেউ নেই আর। আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে না।
আমার কোন গল্প অবশিষ্ট ছিলোনা। ঢাকাতে ফিরে এসেছিলাম গল্পহীন আরেক জীবনে ঠিক দু মাস পর। সব কেমন যেন অন্যরকম লাগছিলো। অন্তু আমাকে নিয়ে এসেছিলো। বেশ কয়েকদিন আমার সাথে থাকলো। ওর অখাদ্য কবিতা, গল্প শোনালো। আমি কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। বারবার জীবনের অর্থ খুজছিলাম। যেই মানুষটা আমার জন্য তার পুরোটা জীবনের সবটুকু দিয়ে গেলো, দিন শেষে তাকে আধপেট খেয়ে এভাবে কষ্ট পেয়ে কেন মরে যেতে হবে? আমার অনেক রাগ পেয়েছিলো, সব কিছুতে ঘেন্না এসেছিলো। আমি উচ্ছন্নে গিয়েছিলাম। রান্না খাওয়া সব বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম। অন্তু রান্না করে দিয়ে যেতো, জোর করে মাঝে মাঝে খেতে হতো ওর জন্য।সব কেমন বিস্বাদ হয়ে গেছে। এর মাঝে একদিন ফ্যাকাল্টির ডীন ফোন করে ডেকে পাঠালেন। আমি ডীনের সামনে যেয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। উনি আমাকে উপর নীচে ভালো মত দেখে বললো, কাপড় ধোও না কয়দিন?
আমি মাথা নীচু করে থাকি। স্যার আবার বলেন একটু পর, সুপারভাইজারের কাছে থিসিস পেপার জমা দেয়ার কথা আগের সপ্তাহে। তুমি দুই মাস তার সাথে যোগাযোগ করো্নাই, থিসিস পেপার তো পরের কথা। সমস্যা কি?
আমি স্যারকে মিনমিন করে বলে, স্যার গ্রামে গিয়েছিলাম। মা মারা গেছে। কাজ করিতে পারিনাই কিছুই।
ডীন স্যার মাথা নাড়ে। পাঁচ মিনিট চুপ করে নিজের কাজ করতে থাকেন। অবশেষে আমাকে বললেন, তোমার নাম আসিফ শাহরিয়ার না? রেজাল্ট তো খারাপ না। পড়াশোনা কি ছেড়ে দিবা?
আমি মাথা নেড়ে বলি, না স্যার।
স্যার এই প্রথম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মানুষ মারা যাবে এইটা সবচেয়ে বড় সত্য। আমরা এই সত্য কথাটা মনে রাখিনা। ভুইলা যাই। বাবা মা কাছের মানুষ, কিন্তু তারাও চলে যাবে একদিন। এইটাইতো সত্য, তাই না? কাজ থামায় রাখলে চলবে?
আমি মাথা নেড়ে স্যারকে সম্মতি দেই। স্যার হাই তুলে বলে, তোমাকে দুই মাস সময় দিলাম। তোমার সুপারভাইজারকে আমি বুঝায় বলবো। কিন্তু তোমার কাজ হলো রবিবার আর বৃহস্পতিবার সপ্তাহে এই দুইদিন আইসা আমার কাছে রিপোর্ট করবা কাজের। তবে তুমি পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাইলে অন্য কথা।
আমি স্যারের রুম থেকে বের হয়ে মেসে চলে এলাম। একটু পর আমার কাছে এক বন্ধু ফোন করলো ভার্সিটি থেকে। বন্ধুর নাম আবিদা। কিছুটা সমাজকর্মী টাইপের ছিলো। কারো কোন সমস্যা হলে সবাই আগে ওকে ফোন দিতো। প্রায়ই সে রাত বিরেতে মানুষকে ফোন দিয়ে পেইন দিয়ে এই সেই করতে বলতো। কেউ রাগ করলে বলতো, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা প্রত্যেকের তরে। আমি কি তাকে এখন কোন উপকার করতে পারবো? আমার মনে হয়না, কারণ আমার নিজেরই আলো দরকার ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে ফোন ধরলে আবিদার উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনতে পারলাম। সে আমাকে প্রথম কথা বললো, তোর রক্ত এবি নেগেটিভ না?
আমি আবছাভাবে বললাম, হ্যা। কার লাগবে?
আবিদা কাঁদতে শুরু করলো, তুই তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে বার্ণ ইউনিটে চলে আয়। নাফিসার অবস্থা খুব খারাপ। ওর দিকে তাকাতে পারছিনা।তুই তাড়াতাড়ি আয়। আর তোর পরিচিত আর কারো এই গ্রুপের রক্ত থাকলে আল্লাহর ওয়াস্তে তাকেও নিয়ে আসিস। ওর অনেক রক্ত লাগবে। তুই আয় তাড়াতাড়ি।
আমি ফোন কেটে দৌড় দিলাম। ফোন করলাম আফসার ভাইকে। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই। আমি জানি উনার আব্বার এবি নেগেটিভ গ্রুপের ব্লাড। ভাইকে অনেকবার ফোনে চেষ্টা করেও পাচ্ছিলাম না।নাফিসার কথা ভেবে আমার কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমি জানিনা কি হয়েছে, কিন্তু নিশ্চয়ই খারাপ কিছু। নাহলে আবিদার মত মেয়ের তো এভাবে ফোনে কান্না করার কথা না। নাফিসা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো। ওর প্রেমিক ছিলো আমাদেরই ব্যাচের মেকানিক্যালের এক ছেলে। দুইজন সারাদিন একসাথে থাকতো। একেবারে ইউনিতে আসার পরদিন থেকে। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম এতো আত্নীয়তা কেমন করে কারও সাথে হয়। আচ্ছা অপর্ণাদি যদি আমাকে ভালোবাসতো তাহলে সেও কি এমন করেই আমার হাত ধরে ঘুরতো? মাঝে মাঝে চুলে হাত দিয়ে ময়লা ঝেড়ে দিতো?
আধ ঘন্টার মধ্যে মেডিকেলে পৌছে গেলাম। আবিদাকে দেখে কাছে এগিয়ে বললাম, এসে পড়ছি। আরেক ভাই আছে, আফসার ভাই। উনিও আসবে। ফোনে পাচ্ছিনা। নাফিসার কি অবস্থা বলতো?
আবিদার চোখ লাল হয়ে ফুলে ছিলো। আমার কথা মনে হয় শুনতে পাচ্ছিলোনা। চোখে ওড়না দিয়ে কাজল পানি মুছছিলো। আমি আবার ওকে বললাম, নাফিসার এখন কি অবস্থা?
আবিদা উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে একটা সপাং করে চড় মেরে দিলো। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলামনা। আশেপাশে দেখলাম আরো কিছু বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে। সবাই তাকিয়ে আছে এখানে সেখানে। সবার একটা কেমন ব্যর্থ চেষ্টা চোখের পানি লুকানোর।
আবিদা আমার কলার চেপে বললো, এতো দেরী করলি কেন? আরেকটু আগে আসতে পারলিনা। নাফিসাটা এভাবে চলে গেলো? নাফিসার দিকে তাকাইতে পারিতেছিনা আমি, অর্ণ। ওর দিকে তাকানো যায়না। এত সুন্দর আমাদের বন্ধুটারে কি করে দিছে?
আমি নাফিসার লাশটা আইসিইউতে যেখানে অবহেলায় পড়ে ছিলো সেখানে এগিয়ে গেলাম। নাফিসার মুখটা কাছে যেয়ে খেয়াল করলাম। কি হলো জানিনা, সেকেন্ডের ব্যবধানে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। জানিনা কি দেখলাম এটা। এত সুন্দর একটা মুখ পুড়ে এমন বিভৎস হয়ে যায় কিভাবে? কাছের মানুষের এমন রূপ সহ্য করা যায়?
কখন জ্ঞান আসলো জানিনা। আমাকে কাঠের একটা বসে থাকার বেঞ্চে শুইয়ে রেখেছিলো রসি। উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বললাম, কিভাবে?
রসি কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছিলোনা। টেনে টেনে বললো, সুজন আর নাফিসা কালকে রাতে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাচ্ছিলো নাফিসার বাসায়। সুজন যাচ্ছিলো ওকে নামিয়ে দিতে। এরপর রাত দুইটায় হঠাৎ সুজন ফোন করে শাহরিয়ার কে। কোনরকমে বলে নাফিসাকে নিয়ে বাস নাকি চলে গেছে। ওকে মেরে রাস্তায় ফেলে দিছে। দুপুরে পুলিশ নাফিসার শরীর এই অবস্থায় পায়। নাফিসাকে অনেক কষ্ট দিয়ে মারছে দোস্ত। সুজন হাসপাতালে ওকে দেখে কাউকে কিছু না বলে বাসায় যেয়ে কিছু একটা খেয়ে ফেলছিলো মনে হয়। এপোলোতে আছে এখন। মনে হয় না বাঁচবে। দোস্ত কি হয়ে গেলো দেখ। মেয়েটা কালকে রাতেও বলতেছিলো আর দুই মাস পর ওদের এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান হবে, সবাইকে টাঙ্গাইল আসতে হবে। আমাদের চমচম খাওয়াবে। দোস্ত কি হয়ে গেলো? আমার চমচম খাওয়া লাগবেনা, ওর সাথে কোনদিন আর দেখা হওয়াও লাগবেনা। ওরে বল ফির‍্যা আসতে। আমার তো বেশি বন্ধু ছিলোনা।
রসি কাঁদছে ফুপিয়ে ফুপিয়ে। আমরাও কাঁদছি সবাই। নাফিসা খুব ভালো একজন মানুষ ছিলো, ওর সাথে তো এমনটা হওয়ার কথা না। একটু পর ওর বাবা মা চলে আসবে হসপিটালে। ওদেরকে কি বলবো আমরা? আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলাম। পুরো বিকাল-সন্ধ্যা, রাত আমি পাগলের মত রাস্তায় ছুটাছুটি করলাম। এমন আচমকা আঘাতের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।

প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর আমরা অনেকে রাস্তায় নেমেছিলাম। থানায় যেয়ে বসে থেকেছি। আমাদের সাথে কোন রাজনৈতিক নেতা ছিলোনা। কারণ তাদের কোন স্বার্থ ছিলোনা। অনেক দিন এমন গেছে আমরা রাস্তায় না খেয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম প্ল্যাকার্ড হাতে। আমরা বিচার চেয়েছিলাম। পুলিশ প্রথম কয়েকদিন অনেক চেষ্টা করলো, কিন্তু আমাদের দেশে এক শূকর মন্ত্রী ছিলো যে পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষ হয়ে প্রায়ই তাবেদারী করতো। তার পরোক্ষ নির্দেশে পুলিশ বেশি দূর আগাতে পারেনি। আমরা এক সময় ঢাকা টাঙ্গাইল রুটে চলাচল করা চলনবিন সার্ভিসের সব বাস আটক করি। নিজেরাই ওদের ডিপোতে যায়ে খানিকটা মারধর, খানিকটা ধমকাধমকি করে যতগুলো ড্রাইভারকে পাই ধরে নিয়ে আসি ক্যাম্পাসে। ওদেরকে আমরা কিছু বলিনা তেমন। ওরা বারবার ভয় দেখাচ্ছিলো মন্ত্রীকে বলে আমাদের ছাত্রগিরি পেছন দিয়ে ঢুকায় দেবে। পুলিশ আসে ওদের ছাড়িয়ে নিতে। এরপর আসে ছাত্রনেতারা। রকিবুল ভাই তখন ছাত্র সংঘটনের সভাপতি। উনি আমাদের কাছে এসে বললেন, তোরা কি শিবির করা শুরু করছিস?
আমি সামনে এসে বললাম, এখনও আপনাদের রাজনীতি করার মত কুত্তা হয়ে যাইনি।
রকিবুল ভাই আমার কলার চেপে থাপড়াথাপড়ি করতে থাকলো।আমি স্থির হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। কিছু বললাম না কারণ আমাদের লক্ষ্য রকিবুলের মত কুকুরছানারা ছিলোনা। আমরা আমাদের প্রিয় বন্ধুর জন্য বিচার চাচ্ছিলাম। অন্য কোন দিকে সংঘর্ষের যাওয়ার মত মানসিকতা আমাদের ছিলোনা। এদের মত ছাত্র নেতারা আসবে, আমাদের ভয় দেখাবে, ঘেউ ঘেউ করবে। কিন্তু আমাদের কাজ আমাদেরই করতে হবে। রকিবুল ভাই আমার আরোও কয়েকটা বন্ধুকে মারধর করে বললো, শূয়োরের বাচ্চারা প্রতিবাদ চোদাস? তোগো বান্ধবী ওর বয়ফ্রেন্ড লইয়া ঘুরতে যায়া মারা খাইছে এই জন্য এখন বাস আটকায় প্রতিবাদ চুদাবী? সবগুলার বিচি কাইটা ল্যাংটা কইরা রাস্তায় ঘুরাবো।
আমাদের এক বন্ধু ছিলো, আলম নাম। গ্রাম থেকে আসা একদম সহজ সরল ছেলে। টিউশনী করে আধাপেট খেয়ে দিন যাপন করা সেই সাধারণ ছেলেটার চোখেও প্রতিবাদের আগুন ছিলো। আমরা কিছু বলার আগে ও কখন যে রকিবু্লকে ইটের একটা খন্ড নিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিলো টের পাইনি। রকিবুলের সাথের পাতিনেতারাও বেশ ভয় পেয়ে গেলো। আমরা সংখ্যায় ওদের থেকে বেশি ছিলাম এবং আমাদের কোন ভয় ছিলোনা। আলমকে কেউ থামাতে পারছিলাম না। ও ক্রমাগত রকিবুলকে মাটিতে ফেলে ইট দিয়ে মাথায় হাতে পায়ে আঘাত করছিলো। একটু পর ইমতিয়াজ আর আবিদা যেয়ে ওকে অনেক কষ্টে আটকায়। ও চিৎকার করে বলছিলো, শূয়োরের বাচ্চারা তোদের কোন মানুষ জন্ম দেয়নাই? যেইখানে সুযোগ পাস সেইখানে তোরা চোদাইতে আসিস ক্ষমতা। শূয়োরের বাচ্চা তোদের মত জানোয়রাগুলার জন্য আজকে দেশটা নষ্ট হইয়া গেছে। তোরা সামনে আরো বড় নেতা হবি, সংসদে যাবি, ওইখানে যায়াও ঘেউঘেউ করবি। আমাদের মত সাধারণ মানুষরা ভয়ে থাকবো, চুপ কইরা মুখ বুইজ্যা থাকবো। তোদেরকে কেউ কিছু বলতে পারবেনা। তোরা যখন সুযোগ পাবি আমাদের লুটপাট করবি, ধর্ষণ করবি। আমরা খালি চুপ কইর‍্যা থাকবো? শূয়োরের বাচ্চা, কথা বল। পুরা দেশটা প্রতিদিন তোরা ধর্ষণ করিস। আর কত তোরা আমাদের অত্যাচার করবি? এতো লোভ, শূয়োরের বাচ্চা তোদের এত লোভ? তোদের জানোয়ার মন্ত্রীর কথা শুইনা মারতে আসছিস? তোর মন্ত্রীর মুখে আমি পেচ্ছাব করি? এই দেখ এমনে পেচ্ছাব করি।
আলম সত্যি সত্যি রকিবুলের মুখে পেচ্ছাব করে দিলো। আমরা কেউ কেউ ক্লান্ত বিধ্বস্ত ছিলাম। কেউ কেউ সহ্য করতে না পেরে রকিবুলের সাথে আসা পাতিনেতাদের ধাওয়া করলো ওরা পালাতে পালাতে বলছিলো, কাজটা ভালো করিসনাই। দেখ কি করি!

আমাদের আটক করা ড্রাইভাররা একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। ওরা বেশ ভয় পেলো।আমি ওদের কাছে যেয়ে কিছু বলার আগেই ওরা আমার পায়ের কাছে এসে পড়ে বললো, স্যার আমাগো যেতে দেন। বিল্লাল ড্রাইভার এই কাজ করছে এক বড়ঘরের পোলার লগে। ওর ঠিকানা আমরা দিয়া দিমু। আমাগোরে মাফ কইর‍্যা দেন।আমরা খাইট্যা খাই, এইসব করিনা। বিল্লাল, জাকির আরো কিছু ড্রাইভার মিল্যা এই কাজ করে।প্রায়দ্দিন করে। আমরা ওরে না করছি, আল্লাহর গজব পড়বো ওগো উপর। ওরা কিছু কইলে পাত্তা দেয়নাই।

বড়ঘরের ছেলের নাম ছিলো রনি শিকদার। ঢাকার বনানীর ২১ নম্বর রোডে এক আলিশান বাড়িতে থাকে। আমরা পুলিশের কাছে সব জানালাম। রবিবারদিন দুপুরে আমি আর আবিদা শাহবাগ থানার ওসি ডাকলে তার কাছে যাই। উনি তখন খাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে বললেন, খাওয়ার সময় এসে পড়ছেন যখন, আপনাদেরও কিছু খেতে হবে।
আবিদা মাথা নেড়ে বলে, আপনি খান। আমরা বাহিরে অপেক্ষা করছি।
ওসি কামরুজ্জামান হেসে বললেন, আমি ঘুষ খাইনা আপা। যেই খাবার খাই হালাল খাই। আসেন চেয়ারে বসেন। একটু পরোটা খান। আজকে রোববার, এইদিন আমি ভাত খাইনা। আমার বাবা ৯১ সালের এক রবিবারে মারা গিয়েছিলেন কোলন ক্যানসারে। মারা যাওয়ার দিন আমারে ডেকে আদর করে কাছে বসায় বললেন, বাবা তোর মা তো ক্যান্সার হওয়ার পর আমারে ভালো কিছু খাইতেই দেয়না। তুই লুকায় দুলাল ব্যাপারীর হোটেল থেকে দুই পিস পরোটা নিয়ে আসবি। খুব আশ হইছে আজকে পরোটা খাবার। আমি পরোটা নিয়ে আসছিলাম বাবার জন্য। কিন্তু বাবা খাওয়ার জন্য বেঁচে ছিলোনা। আব্বা সবসময় ভালো কিছু রান্না হইলে নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়ে দিতেন।আম্মাকে বলতেন, ওরা খাইলেই আমার খাওয়া হয়ে যায়। আমি এরপর থেকে প্রতি রোববার পরোটা খাই। হালাল উপার্জনের পরোটার স্বাদ ভালো হয়। খেয়ে দেখেন।
আমি ওসি সাহেবের বচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। উনার সাথে দুইজন মিলে অর্ধেক করে পরোটা শেয়ার করলাম। খাওয়া শেষে ওসি সাহেব বললেন, পুলিশের চাকরী করি ১৭ বছর হলো। এতো কঠিন সময়ে খুব কম পড়েছি। যেই ছেলের নামে মামলা করেছেন, সে একজন সংসদ সদস্যের ছেলে এটা কি জানেন? বাবা বড় গ্রুপ অফ কোম্পানীর মালিক।
আমি আর আবিদা দুইজন নির্বাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওসি সাহেব বললেন, অনেক জায়গা থেকে ফোন আসতেছে কেসটা ঘুরায় ফেলার জন্য। কেসটা আমার থানার আন্ডারে না। কিন্তু আমি তবুও আপনাদের ডাকছি কেন জানেন?
আমরা নীরবে উনার দিকে তাকিয়ে থাকি। বুঝতে পারছি কিছু একটা বড় সমস্যা হয়েছে। কামরুজ্জামান সাহেব দড়ি চুলকিয়ে বললো, আমার একটা মেয়ে আছে। ১১ বছর বয়স। পুলিশের চাকরী করি, সারাদিন খারাপ মানুষদের আশেপাশে দেখি। আপনারা সাধারণ মানুষজন বিশ্বাস করতে পারবেন না এই দেশের লোক কত খারাপ হয়ে গেছে। প্রায় চিন্তা করি চাকরী ছেড়ে আপনাদের ছাত্রদের মত দেশের বাহিরে চলে যাই। এতো মেধা নাই, তাই পারিনা। বউ প্রায়দিন বলে কানাডার জন্য চেষ্টা করতে। আমার ভায়রা ভাই থাকে ওখানে। আমি আসলেও ভাবি, চলে যাবো। পারিনা। হাত পা বাধা। কিন্তু আপনারা তো পারেন ভেগে যেতে তাই না?
আমি উনাকে বললাম, আমরা কেন ভাগবো? আমাদের এক বন্ধু এমন নৃশংস ভাবে ধর্ষিত হলো, এভাবে ওকে পুড়িয়ে মারা হলো। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন বিচার চেয়েছি বলে এখন পালাতে হবে?
ওসি সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার নাম কি ছোটভাই?
আমি নাম বললে উনি বললেন, অর্ণ ভাই, আমি যেটা বলি ভালোভাবে বুঝেন। আমার দরকার নাই তবুও বিবেকের তাগিদে আপনাদের উপকাত করতে চাচ্ছি। যেই ছাত্রনেতারে আপনারা পিটাইছেন দুইদিন আগে, সে আপনাদের নামে মামলা করছিলো গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার। আমি কিন্তু আপনাদের সাথে কোন ঝুট ঝামেলায় যাইনি। আমাকে যদি বিশ্বাস করেন তাহলে খুব ভালো ভাবে একটা কথা বুঝেন। আমি আপনাদের ভালো চাই। কারণ আপনারা ভালো মানুষ। যেই নাফিসা আহমেদের সাথে এই ঘটনা হয়েছে তার জন্য আমার পূর্ণ সহমর্মিতা। আমি পারলে সবগুলো অপরাধীকে এখানেই পুড়ায় মারতাম ছোটভাই। কিন্তু পারিনা। সরকারী পোশাকে সব করা যায়না। কিন্তু আমি আপনাদের দুইটা ভালো পরামর্শ তো দিতে পারি। আপনাদের নামে কয়েকটা মিথ্যা মামলা করার চিন্তা ভাবনা হচ্ছে উপর থেকে। আমারই এক সহকর্মী এই ব্যাপারে উপরের পর্যায়ের কিছু লোককে সহযোগিতা করেছে। একটা মামলা করা হয়েছে দেশদ্রোহিতার, একটা করা হয়েছে রেইপের। আপনার নাম য়াসিফ শাহরিয়ার অর্ণ না? আপনার নামে রেইপ এবং খুনের মামলা করা হয়েছে। বলা হয়েছে আপনি বাসে আপনার আরো কিছু বন্ধু নিয়ে নাফিসাকে ধর্ষণ করেছেন, পরে উনার প্রেমিক সুজন যেন কিছু বলতে না পারে সেইজন্য উনাকে জোর করে বিষ খাইয়েছেন। ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে বুঝেছেন?

আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। আবিদা খুব রেগে বললাম, আপনি না সৎ মানুষ।সৎ অফিসার। এইসব নিয়মিত দেখেন আর মুখ বুজে হিজলাদের মত অপরাধীদের সাহায্য করেন। লজ্জা হয়না আবার আমাদের হাবিজাবি উপদেশ দিতে?
কামরুজ্জামান সাহেবের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। উনি অনেকক্ষণ পরে মুখ খুলে বললেন, আপা আমার অনেক লজ্জা হয়। এখনো হচ্ছে, প্রতিদিন এমন দুই একবার হয়। চাকরী ছেড়ে দিতে পারি সর্বোচ্চ, এর বেশি কিচ্ছু করার ক্ষমতা নাই। দেশ যারা চালায় তাদের কাছে আমরা এক প্রকার পালিত কুকুর। আমার পকেটে একটা চাকরী হতে অব্যাহতি চাহিয়া আবেদন পত্র আছে। দেখবেন? সাধু ভাষায় লিখেছি। আমার স্ত্রী বাংলায় অনার্স করেছে, সে দুদিন ধরে লিখে দিয়েছে। আমি প্রায়ই নতুন করে ওকে দিয়ে লেখাই। একদিন আল্লাহর নামে জমা দিয়ে দেবো। কিন্তু এতে আপনাদের কোন লাভ হবেনা। আপনাদেরকে যে পরামর্শ দিলাম ভালোর জন্য দিলাম। নাফিসা আপার লাশের ছবি দেখে আমি আর আমার স্ত্রীও চোখের জল ফেলেছি। অসহায় বোধ করেছি। যাই হোক, আপনারা আমাকে বিশ্বাস করলে করেন, না করলে কিছু করার নাই।

আমি আবিদাকে নিয়ে উঠে গেলাম। আমি জানতাম যা শুনলাম সব সত্যি। এই দেশে এখন সত্যি একঝাক শূয়োর বসবাস করে। আমরা কেউ এদের কাছে নিরাপদ না। এরা প্রতিদিন আমাদের আবর্জনার মত দলিত করবে। আমরা চুপ করে ওদের সব অন্যায় সহ্য করবো। কারো কিছু বলার থাকবেনা। আমাদের মত সাধারণ লাল রক্তের মানুষগুলোর এর বাহিরে সত্যিই কিছু করার আর ক্ষমতা নেই। কেউ একজন মুখে দড়ি বেধে পেছন থেকে বারংবার চাবুকের বাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও ভয়ে দৌড়াচ্ছি, শুধু দৌড়াচ্ছি। আমাদের যাত্রার শেষ নেই। আমরা দলিত মথিত আবর্জনায় মুখ লুকিয়ে রাখা পরজীবি।ওরা আমাদের খোদা।

ক্যাম্পাসে যেয়ে কয়েকজন একসাথে বসলাম। আমাদের সাথে আমাদের বিভাগীয় প্রধানও দেখা করতে এসেছেন। উনি কথা বলবেন। স্যার খুব ভালো মানুষ। আন্দোলন শুরুর প্রথম দিন থেকে উনি আমাদের পাশে ছিলেন। আমার সব কথা শুনে উনি মলিন মুখে বললেন, বাবারা আমার আসলে কিছু বলার নাই। আমার চাচা যুদ্ধে যখন যায় আমার বয়স তখন ৭ বছর ছিলো। আজকে ৪৭ বছর পরও আমার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে বলা কথাগুলো মনে আছে। চাচা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, “যদি মারা যাই শরীরে অনেক ব্যথা লাগবে। কিন্তু বুকে একটুও ব্যথা থাকবেনা। দেশটা আমার মায়ের মত বুঝছিস। তোর দাদী যেমন করে কোলে আদর করে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দিতো দেশটাও এমন আদর করে আমাকে এর মাটির উপর চলতে দিয়েছে। মাটি থেকে ধান দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে। আমার মা তো মাত্র চারটা সন্তানকে আদর করে। দেশ মা পুরো জাতিটাকে আদর করে খাওয়ায়। এই মায়ের জন্য মরলে একটু ব্যথা লাগবেনা। তুই ভয় পাইসনা। চাচ্চু ভালো থাকবে”।
স্যারের চোখ ভরা পানি। আমি স্যারকে বলি, স্যার এখন তো দেশকে নিয়ে কেউ ভাবেনা। যেই দিন আপনার চাচার মত মানুষগুলো হারিয়ে গেছে সেইদিন থেকে এই দেশটা প্রতিদিন ধুকে ধুকে মরে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের নিয়ে এতো ব্যস্ত স্যার, কেউ দেশ-মা এই শব্দগুলোকে আর মনে ধরতে পারেনা। এগুলো এখন শুধু কবিতা গানে আছে”।
স্যার চোখ মুছে বলেন, আজকে তোমাদের সাথে ঘটে যাওয়া সব দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধ সেই যে শুরু হয়েছিলো এখনো চলছে। এই যুদ্ধ হয়তো কোনদিন শেষ হবেনা। একটা দেশে যখন ন্যায় বিচার চাইতে গেলে পদে পদে এভাবে নির্যাতিত হতে হয় তখন সেই দেশটা যে মরে যাচ্ছে বোঝা যায়। আমার বলতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তবুও বলছি। তোমরাও একটু স্বার্থপর হও।নিজেকে নিয়ে এখন ভাবো। আমি ভিসির সাথে কথা বলবো, তোমাদের নামে যেন কোন মিথ্যা মামলা না হয় সেইজন্য আমরা কাজ করবো সরকারের সাথে। তোমরা এখন পাশ করে গেছো, নিজেদের পেশায় মনোযোগ দাও। পারলে দেশের বাহিরে চলে যাও। এই দেশে মানুষ আর বাস করবেনা কিছুদিন পর। একটা ভয়ংকর অন্ধকার আস্তে আস্তে সব খেয়ে ফেলছে। যাও ভেগে যাও। এই অন্ধকার তোমাদের খেয়ে ফেলার আগে পালিয়ে যাও।
আমাদের কোন কোন বন্ধু গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কেউ কেউ বললো, “পালায় যাবো। ভেগে যাবো। এরপর সারাজীবন নাফিসার সাথে হওয়া অন্যায়ের একজন অপরাধী হয়ে বেঁচে থাকবো। জ্বী স্যার এইটাই করবো। অন্তত বাঁচতে তো পারবো”।

ক্যাম্পাস থেকে মেসে ফিরে আসলাম। থিসিসের কিছু লেখা বাকি ছিলো। আমি সেডন স্মিথের মাইক্রোইলেকট্রনিসের বইটা খুলে পড়তে বসলাম। ওখান থেকে রেফারেন্স নিতে হবে কিছু। বইয়ের পাতা উল্টাই আর নাফিসার পোড়া বিভৎস মুখটা চোখের সামনে এসে পড়ে।। বইয়ের ৩১৭ নম্বর পাতায় দু নম্বর অনুচ্ছেদের উপরে হঠাৎ করে একটা লেখা চোখে পড়লো। নাফিসা একদিন কামরান স্যারের ক্লাসে আমার পাশে বসেছিলো। তখন বই চেয়ে ওই পাতায় বাংলিশে লিখেছিলো, Chotpoti khabi?class sheshe…

আমি বইয়ের পাতা আর উল্টাতে পারলাম না। অসহায় বোবা আর্তনাদ আমার ভেতরে আঘাত করছে ক্রমাগত। মানুষ হয়ে জন্মানোর লজ্জায় আমি কুকড়ে গেলাম। শুধু নাফিসা কেন যে ২২ মাসের ছোট্ট বাচ্চাটা এখন চট্রগ্রাম মেডিকেলে ধর্ষিত হওয়ার অপরাধে এখন জীবন মৃত্যুর সাথে লড়ছে তার জন্যও আমি অপরাধী। যে ৮ বছরের মেয়েটা সংবাদ সম্মেলনে এসে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে লজ্জায় কারণ তার বাবাকে আজ উপায় না দেখে লোক ডেকে তার মেয়ের ধর্ষনের জন্য বিচার চাইতে হচ্ছে তার জন্যও আমি অপরাধী। দুই বাস ড্রাইভারের মজা করে ব্যস্ত করে প্রতিযোগিতার বাহানায় যেই এতীম যুবকটির হাত কাটা পড়ে এবং ক্ষমতাসীন দলের আরো ক্ষমতাশীল লোকটি বলে, ওই পথচারীরও রাস্তায় চলাচলে ভুল থাকতে পারে – এই সকল কিছুর জন্য আমি অপরাধী, আমি দায়ী। কারণ আমার মত ভীরু কাপুরুষের বাচ্চারা যেদিন নিজেকে মানুষ মনে করা বন্ধ করে দিয়েছিলো সেদিন থেকে হয় তারা শূকরপালে যোগ দিয়েছে অথবা শূকরের খাদ্য হয়েছে। মেরুদন্ড এখন শুধুই একটা মেডিক্যাল টার্ম, এই দেশে এখন একটা মানুষেরও এই দন্ডটা নাই। আমি আজকে সত্যি মানুষ হওয়ার অপরাধে লজ্জিত, মর্মাহত।নাফিসা তুই আমাকে মাফ করে দিস।

মাসখানেক পর ক্যাম্পাসে থিসিস জমা দিয়ে ফিরছিলাম। দেখি আবেদা দাঁড়িয়ে আছে, ওর হাতে একটা পোস্টার। তাতে লেখা, “নাফিসারা কবে বিচার পাবে?”
আমি ওর কাছে যেয়ে দাড়ালে ও হাসে। হেসে বলে, চাকরী পাইনি এখনও। বাসায় এসে প্রায়ই এই সেই লোক ধমক দিয়ে যায়। ফোন আসে নানান অজানা নম্বর থেকে। আমি থামিনাই রে। আমি থামলে দেশ হেরে যাবে। তাই আমি থামিনাই। তোরা যা, চাকরী খোজ।
আমি আবারও লজ্জায় কুকড়ে গেলাম। ওর সাথে একটাও কথা না বলে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা দশ সীটের মাইক্রো এসে ওর সামনে থেমে ওকে তুলে নিতে চাচ্ছে। ও চিৎকার করছে, কেউ এগিয়ে আসছেনা ভয়ে। আমি দৌড়ে গেলাম। আমাকে দেখে গাড়ির সামনের সীটে বসা একজন বললো, ওরেও তোল।পাঁচটারে পাইছি। আর কয়টা বাকী আছে।

জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে তারা আমাকে আর আবিদাকে বড় একটা কাঠ দিয়ে ক্রমাগত মারতে গেলো। আবিদা একসময় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো পায়ের কাছে। আমি কখন পড়ে গিয়েছিলাম আমি জানিনা।

যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন সারা গায়ে প্রচন্ড ব্যথা। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি একটা কাঠের দরজা সামনে। ডানে একটা খাটে গাড়ির সামনে সীটে বসা লোকটা তাস খেলছে আরো কয়েকজনের সাথে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, আমাদের এখানে আনছেন কেন?
তাস খেলা বাদ দিয়ে পরিচিত লোকটা আমার কাছে এসে বসলো। মাথায় হাত রেখে বললো, ভালো আছো বাবু? আমার নাম রনি শিকদার। তোমার বান্ধবীরে চুদছে যে রনি, সেই রনিই হইলাম আমি। আর ওইযে ডানে বইস্যা আছে বিল্লাল আর হারুন। আমরা সবাই তোমার বান্ধবীরে নিয়ে মজা করছি। তবে ফ্রাই করছি আমি। ইচ্ছা কইর‍্যা না। চিৎকার করবার লাগছিলো তাই পুড়ায় দিছি। ভালো হইছে না?
বিল্লাল পিছন থেকে বললো, স্যার এগুলারে কিছু খাইতে দিবেন। দুপুর থেইক্যা আটকান আছে।নিয়া আসমু কিছু?
রনি শিকদার গলার কফ পরিষ্কার করতে করতে বললো, বিরানী নিয়া আয় তিন প্যাকেট।
আশেপাশে তাকিয়ে বললো, তোরা কেউ খাবি?
বিল্লাল আমাদের জন্য বিরানী নিয়ে আসতে গেলে, রনি শিকদার আমাকে তুলে বিছানায় বসিয়ে বললো আমার নামে মামলা করো শুনলাম।আমার বাপে চালায় দেশ, তোদের মত কুত্তা বিলাইরে পালে মুখে অন্ন দেয়। তোরা আমার নামে মামলা দিস কোন সাহসে? আমার বাপের নামে আজে বাজে কথা কস। আমার বাপ কি তোগো বাপের মত দর্জি মেথর? নাটকীর পোলা, মুখ দিয়ে কথা বাহির হয়না ক্যান?
আমি মুখ দিয়ে থুতু বের করে ওর গায়ে ছুড়ে মারি। আমার দুর্বল শরীরে কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বলি, তোর চেহারা আয়নায় দেখ। একটা জারজ শূয়োরকে দেখতে পাবি। আমাকে দেখ, আমি এখনও মানুষ। আমার সাথে তোর তুলনা করিস কোন সাহসে?
রনি শিকদার হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু পর হাসতে হাসতে বলে, এই পিচ্চিগুলা তো দেখি বাংলা সিনেমার মত ডায়ালগ মারে। এত খ্যাত কথা কয় কেমনেরে হারুন? ওগো বাপ কি তোগো মত ড্রাইভার ছিলো।
হারুণ হাসে। আমারে বলে, ছোটভাই বইসা থাকো। নূনু লইয়া যদি বাসায় যাইতে চাও মুখ বন্ধ কইর‍্যা বইস্যা থাকো। তোমার দুই বন্ধুরে মাইরা এমনেই হাসপাতাল চিকিতসা লইতে পাঠায় দিছি।মাগীটারে চুইদা পাশের রুমে রাইখ্যা দিছি। বাইচা ফিরতে চাইলে কথা বইলোনা।
রনি শিকদার ওর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার কোমড়ে লাথি দিলো। আমি ব্যাথায় মাটিতে শুয়ে পড়লাম। তারপর পাশের টেবিলে রাখা গ্লাসে পানি ঢেলে চুমুক দিয়ে বললো, দেখো মাইন্ড কইরোনা। তোমার মত ফকিন্নীর ছেলেপেলের সাথে সময় নষ্ট করার মত সময় আমার নাই। তোমরা আমার নামে মামলা দিছো, আমার বাপের ইজ্জত নষ্ট করছো। তোমাগো বান্ধবী এমন কোন মাগী ছিলোনা যার জন্য আমার পরিবারের ইজ্জত লয়া তোমরা টান মারবা। সহজ কথা বলি, ভালো কইরা বুঝবা। তোমাদের একটু পর ছাইড়্যা দিবো। সুন্দর করে বাসায় যায়া গোছল করবা, এরপর কালকে ভোর সকালে যায়া মামলা ফালায় দিবা অথবা বাতিল করবা। আর এইসব চুদুরবুদুর করবানা। পড়াশোনা করছো, চাকরী করবা। বাল ফালাইবা এইসব মামলা কইরা? আমি ভালো মানুষ, এইজন্য তোমাদের নামে এখনও উলটা মামলা করিনাই। কথা বুঝছো?
আমি মাথা নাড়ি। ক্ষমতাহীন রাস্তায় আবর্জনা খাওয়া কুকুরের মত মাথা নাড়ি। কারণ আমার এখন আবিদাকে নিয়ে, শাহরিয়ারকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। আরো কিছু বন্ধু ছিলো, আমি শুধু দুজনকেই দেখেছি যখন তুলে নিয়ে আসা হয়। আমার ওদেরকে নিয়ে জীবিত বের হয়ে আসতে হবে। এর বাহিরে আর কোন চিন্তা আসছিলোনা।
রনি শিকদার আমার হাত ধরে বলে, শোন মাঝে মাঝে শখ হয় দুষ্টুমি করার। বাসের মধ্যে হঠাৎ করে একটা মাগী যখন বুঝে তার আইজকা খবর আছে তখন যে মজাটা হয় ওইটা তুমি বুঝবানা। চলন্ত বাসে কুমারী কন্যা, এইটা একটা প্যাশন ম্যান। তোমাগো মত ইন্দুরের বাচ্চা এইটা বুঝবানা।
এরপর জানোয়ারটা হারুণের দিকে তাকিয়ে বললো, ছাইড়া দিস সন্ধ্যার পর। মাইয়াটারে আর খাইস না, মইর‍্যা যাবো।
আমি হামাগুড়ি দিয়ে পাশের অন্ধকার ঘরে যাই। ওখানে শাহরিয়ার চুপ করে মাথা গুজে কাঁদছিল। আমি পাশে গেলে ও গুঙ্গিয়ে বলে, দোস্ত আবিদাকে মনে হয় মাইর‍্যা ফেলছে। আমার সামনে ওর সাথে কি করলো। দোস্ত আমি বাঁচতে চাইনা। দোস্ত আমারে পারলে গলা টিপ্যা মাইরা ফেলা। পারবিনা? আমারে মাইর‍্যা ফেলা। আমরা কেন নাফিসার জন্য বিচার চাইলাম। াবিদা দিন নাই রাত নাই একটু বিচার পাওয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড়ায় দাঁড়ায় যুদ্ধ করছে। ওর সাথে কেন এমন হইলো? দোস্ত আমি সহ্য করতে পারতেছিনা। আবিদার চিৎকার আমারে বাঁচতে দিবোনা দোস্ত। তুই আমাকে মাইর‍্যা ফেলা।
একটু পর বিল্লাল বিরানীর প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে। আমাকে দেখে হেসে বলে, স্যারের আজকে একটু মাথা গরম ছিলো। নাইলে এতো পিটাইতোনা। তোমাগো বান্ধবী ভালো আছে?
আমি নির্বাক চাহনীতে তাকিয়ে ছিলাম। শাহরিয়ার আস্তে আস্তে বললো, ভাই ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমাদের যেতে দেন। আল্লাহর কসম আমরা আর কিচ্ছু করবোনা। আমরা কালকেই মামলা তুলে নেবো।
বিল্লাল বিড়বিড় করে বললো, আরেহ ছোটভাই এতো চিন্তার কিছু নেই। মাগীরা এতো সহজে মরেনা। ওরা হইলো বিলাই এর মত। বিলাইরে বাইড়াতে বাইড়াতে লাঠি ভাইঙ্গা যাইবো, কিন্তু বিলাই মরবোনা।
আমি বিল্লালের পায়ে ধরে বললাম, আমাদের ভুল হয়েছে। মাফ চাই। যেতে দেন।
বিল্লাল হেসে আমাকে সরিয়ে দেয়। মুখে সহানুভূতির সুরে বললে, এই এক্ষুনিই ছাইড়া দিমু। দুই প্যাকেট বিরিয়ানী আনছি। খায়া বান্ধবীরে নিইয়া যাওগা। তবে যাওয়ার আগে একটা কাম করতে হইবো।তোমার বান্ধবীরে তোমাগো দুইজনের একসাথে লাগাইতে হইবো। সিনেমায় যেমনে দেখায় এমনে। তারপর ছাড়মু।
শাহরিয়ার চিৎকার করে বিল্লালের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ওর গলা চেপে চিৎকার করে বলে, কুত্তার বাচ্চা, তোর মধ্যে মানুষের আত্না নাই। তুই কি? আমারে বল কুত্তার বাচ্চা তুই কিসের থেকে জন্মাইছোস?
হারুণ পাশের রুম থেকে দৌড়ে এসে বিল্লালকে শাহরিয়ার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। এরপর দুইজন মিলে শাহরিয়ারের গলায় পাড়া দিয়ে আমার চোখের সামনে মেরে ফেলে। এরপর আমাকে মার দেয়ার জন্য আসলে আমি আবিদার কাছে দৌড়িয়ে যাই। ওদেরকে বলি, ভাই আপনারা আমার ভাই। আমাদের এবার যেতে দেন। আল্লাহর দোয়াই লাগে। আপনারা তো ধর্ম মানেন। আমরা বাঁচতে চাই। আমার বন্ধুকে নিয়ে যেতে দেন। প্লীজ।
হারুণ আমাকে আর আবিদাকে আধ ঘন্টা পরে একটা বাসে তুলে। ঢাকার বাহিরের কোন একটা জায়গায় বাসটা ধীরে ধীরে চলা শুরু করে। বিল্লাল গাড়ি চালাচ্ছিলো। আবিদার গায়ে আমি একটা গামছা পেচিয়ে রেখেছি। ও আমার দিকে তাকিয়ে গুঙ্গিয়ে ফিসফিস করে বললো, আমার খুব লজ্জা লাগতেছে রে। মেয়ে হয়ে জন্মাইছি এটার লজ্জা, মানুষ হয়ে দুনিয়ায় বাঁচতে চাইছিলাম এটার লজ্জা।
আমি ওকে চেপে ধরে রাখি। আস্তে আস্তে বলি, আবিদা তোর কিচ্ছু হবেনা। আমি তোকে নিয়ে হাসপাতালে যাবো। তুই ভালো থাকবি, চাকরি করবি। একদিন একটা সংসার করবি। ঠিক আছে?কোন কথা বলিস না আর। চুপ করে থাক।
আবিদার ঠোট অনেকটা চিড়ে গিয়েছিলো। আমাকে ও কি যেন বলছিলো, আমি সব বুঝতে পারছিলাম না। বাস থামিয়ে শুধু আমাকে যখন হারুন গলা ধরে নামিয়ে দিচ্ছিলো তখন আবিদা শেষবার বললো, আমাকে মেরে ফেলতে পারবি?
আমি হারুন আর বিল্লালকে অনেক অনুরোধ করি। কিন্তু ওরা আমার কথা রাখেনা। আবিদাকে নিয়ে বাস টান দিয়ে কই যে চলে গেলো। আমি খোড়া পা নিয়ে অনেক দৌড়ালাম। পারলাম না। আমি আমার চোখের সামনে সবাইকে মেরে ফেলতে দেখলাম। আমি রাস্তায় শুয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ পর কয়েকজন মানুষ আমার কাছে এসে চিৎকার করা শুরু করলো। একজন কাধে তুলে নিলো। কেউ একজন আমার কানের কাছে এসে আরেকজনকে বললো, বাইচ্যা আছে।
আমি বিড়বিড় করে বলছিলাম, আমাকে মেরে ফেলতে পারবেন? কেউ একজন পারবেন?
হাসপাতালে কতদিন পড়ে ছিলাম জানিনা। মাঝে মাঝে পরিচিত কেউ কেউ এসে দেখে যেতো। কেউ কেউ আফসোস করতো। বন্ধুরা কেউ রাতদিন আমার পাশে বসে থাকতো। আমি অপর্ণাদিকে খুজতাম। আমার মনে হত আমার সব সমস্যার সমাধান ওর কাছে। তুমি কোথায় অপর্ণা?
একদিন কামরুজ্জামান সাহেব আসলেন। তখন আমি একটু সুস্থ। কথা বলতে পারছি বেশ। উঠে বসতেও পারি। আমাকে দেখে উনি আফসোস করে বললেন, অর্ণ সাহেব আগেই বলেছিলাম ওরা মানুষ অনেক খারাপ। আপনি আমি চার পয়সার মানুষ। ওরা সরকার চালায়, দেশ চালায়। ওদের বিরুদ্ধে কিছু আপনি বলতে পারবেন না।
আমি হেসে বলি, আমার আর কিছু মনে নেই। ওসব বাদ দিন। আপনি ভালো আছেন?
ওসি সাহেব কিছু বললেন না। আমি উনাকে আবার জিজ্ঞেস করি, আপনার বউ এর রান্না খুব ভালো। আমি একদিন এসে খেয়ে যাবো আবার থানায় যদি কিছু মনে না করেন।
পরেরদিন রনি শিকদার আসলেন। আমাকে দেখে চুকচুক করে বললেন, এইরকম তো হওয়ার কথা ছিলোনা। তোমাদের বলছিলাম ছোট ভাই কোন ঝামেলা না কইর‍্যা চইলা যাইতে। যাই হোক, চিন্তা কইরোনা। তোমারে আমি দরকার হইলে এপোলো, ইউনাইটেড এইসব জায়গায় নিয়ে চিকিৎসা করাবো। বেশি অন্যায় হয়ে গেছে তোমাদের সাথে।
আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আবিদা আমার বন্ধুটা কই? কেউ ওর কোন খোজ দিতে পারছিলোনা।
রনি শিকদার আফসোস করে বললেন, আমি চলি সব জানোয়ারের সাথে, বুঝছো? ওই মাইয়ার কথা ওদের জিগাইলে হাসে। গত পরশু হারুণকে একটা থাপ্পর দিছি। বেয়াদ্দপের বাচ্চা বললো, ওরে নাকি ভাসায় দিছে। আর কিছু বললোনা।শুনো এদের কথা বাদ দাও। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ভালো থাকো। সুস্থ হইলে থানায় যায়া মামলা তুলবা।
তিনদিন পর আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হলো। আমি কারো সাথে একটা কথাও বললাম না। আমার বন্ধু অন্তু ছয়মাস ধরে দেশের বাহিরে মাস্টার্স করতে গিয়েছে। ও মাঝে মাঝে ফোন দেয়। আমি ওকেও কিছু বলিনা। আমার মেসের সীটে অন্য কেউ উঠেছে। তবে মেসের ম্যানেজার আমার অবস্থা দেখে একটা জায়গা ঠিক করে দিলো রাতে ঘুমানোর জন্য।আমার মাথায় তখন প্রতিমুহূর্তে একটাই চিন্তা ঘুরে বেড়ায়, কিভাবে আমার মত একটা ভীতু মানুষ খুব সহজে আত্নহত্যা করতে পারে? জীবনের ভার সহ্য করার ক্ষমতা আমার হারিয়ে গিয়েছিলো।
তবুও আমি বেঁচে ছিলাম। দুদিন পর এক বৃহস্পতিবার সকালে আমি আবিষ্কার করলাম নিজেকে শাহবাগ থানায়। কামরুজ্জামান সাহেব আমাকে দেখে একটু চমকে গেলেন। উনি আশা করেননি আমি উনার সাথে আবার কোনদিন দেখা করতে আসবো।
আমি উনার রুমে বসে বললাম, একটা মামলা করতে চাচ্ছি নেবেন?
কামরুজ্জামান সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, নেবো। কিন্তু আগেও বলেছি ওদের নামে মামলা করে আর লাভ নেই। এটা তো বুঝতে পারছেন তাই না?
আমি মাথা নাড়ি। উনাকে বলি, মামলাটা আমার নামে করবেন। নাফিসা, আবিদা, প্রাঙ্গন, শাহরিয়ার, সুজন - যেই কয়জন মারা গেছে সবগুলার জন্য দোষী আমি।একটা শক্ত মামলা দেবেন।
ওসি সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, আপনার মানসিক অবস্থা বোঝার সামর্থ্য আমার নেই। আপনাকে আমি আজকে আমার বাসায় নিয়ে যাই রাতে? একসাথে ডিনার করবো। এইসব কোর্টকাচারী, মামলার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেন। আমার হাত বাধা, নাহলে আমি অবশ্যই চেষ্টা করতাম আপনার জন্য কিছু করার।
আমি হাসি। কর্কশ ভাঙ্গা গলায় হেসে বলি, আপনি কি নিশ্চিত আপনি এখনো হালাল পরোটা খান? যেই ২২/২৩ বছরের ছেলেমেয়েগুলাকে এভাবে যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলা হলো এর জন্য আমি কেন আপনি নিজেও কি অপরাধী না? আপনার মত মানুষগুলো সৎ আছি এই ভাব নিয়ে বসে থাকে আর অন্যকে বলে নিজেকে বুঝিয়ে প্রবোধ দেয় যে সে তো কোন অপরাধ করেনা। কিন্তু যেই দেশের মানুষ ন্যায় বিচার চাইতে যেয়ে ধর্ষিত হয়, খুন হয় সেই দেশে আপনার মত হাত বাধা লোকগুলার মত বড় অপরাধী আর একটাও নাই।যেদিন আপনার মেয়ে এমন অন্যায়ের শিকার হয়ে আপনার কানে কানে বলবে, তাকে মেরে ফেলা যাবে কিনা তখন ওকে বইলেন আপনার হাত বাধা। এই কাজটাও তো মনে হয় পারবেন না। আসসালামু আলাইকুম।

অন্তু সপ্তাহখানেক আগে আমাকে কিছু টাকা পাঠিয়েছিলো। সেই টাকা দিয়ে এই সেই খাবার কিনে মাঝে মাঝে খাই। দিনে হয়ত একবার খাওয়া হয়। এর বেশি খাওয়ার রুচি হয়না। শরীর দিন দিন আরো ভেঙ্গে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের মধ্যে নিজের গলা নিজে চেপে ধরে বসে থাকি। আমার ভেতরের মানুষটা অনেক আগেই মরে গিয়েছিলো। এই শরীরটা কোনরকমে ঝুলে আছে। আমি একদিন সাহস করে বাজার থেকে ইদুর মারার বিষ কিনে খাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। জানিনা কেন পারলাম না? আমার বুকে কখনো কখনো খুব দ্রোহের ঘ্রাণ হয়। মনে হয় সব শূয়োরগুলাকে মেরে ফেলে আসি। কিন্তু জীবনটা যে সিনেমার মত হয়না। আমি ওদের কিচ্ছু করতে পারবোনা। কিচ্ছু না।আমারও ওসি সাহেবের মত হাত বাধা, শরীর বাধা। তারপর সত্যি সত্যি একদিন থানায় যেয়ে মামলাটা তুলে নেই। এরপর রাস্তায় হাটা শুরু করি। আমার হাটতে হবে। অনেক দূর, দূর, বহু দূর।শহরের কংক্রিটের বস্তি ফেলে, সবুজ মাঠের সোদামাটির গন্ধ হটিয়ে আমাকে হেটে যেতে হবে।এই হাটার কোন শেষ নেই।

এরপর মাস কেটে যায়, বছর পার হয়ে যায়। আমি ভিক্ষুকের মত রাস্তায় ঘুমাই, কেউ দয়া করে কিছু দিলে খাই। একদিন অপর্ণাদিকে আবার মনে পড়ে। পুরোন ঢাকায় ওয়ারীতে যেই ঘুপচি বাসায় ও থাকতো এখনো কি সেখানেই আছে। ওর গন্ধটা কতদিন নাকে স্পর্শ করেনা। ভার্সিটিতে থাকাকালীন যখন খুব মন খারাপ হতো তখন আমি হেটে হেটে ওর বাসায় চলে যেতাম। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, ওর বাসার থেকে কয়েক মাইল দূরে যখন থাকতাম তখন থেকে একটা অপার্থিব বিমর্ষতায় আমি ডুবে যেতাম। বারবার ওর ঠোটের উত্তাপ আমাকে গ্রাস করতো। আমি ওর গায়ে পুজোর সময় ধুপ জড়ানো যে গন্ধটা খেলা করতো সেটা প্রবলভাবে টের পেতাম। আচ্ছা ও কি এখনো আগের মত আছে? সেই কাজলে আঁকা চোখের ছলছলে অব্যক্ততা এখনও কি আমাকে ছুয়ে দিবে হাজার বছর আগে যেমনটা দিতো?

যা আশা করিনি তাই হলো। আমি আবার অপর্ণার সামনে হাজির হয়ে গেলুম। আমার এলমেলো চুল, শতছিন্ন জামা আর হাজারটা চেড়া আত্নাটা যখন ওর সামনে দন্ডায়মান, তখন একটা দমকা বাতাস আমার বুক থেকে বের হয়ে গেলো। অপর্ণা একটু করে কান্না করে দিলো।আমাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো।কি বলবে ও জানেনা। আমিও জানিনা। প্রথম কথাটা আমিই জিজ্ঞাসা করলাম, সঞ্জয়দা কেমন আছে?
ও আমার হাত ধরে কাঁদছিল। বারবার বলছিলো, তোকে কত খুজেছি। তোর কি হয়েছিলো রে?এভাবে হারিয়ে যেতে হয়?
আমি ওকে বললাম, এক গ্লাস পানি দেবে। অনেকদিন সভ্য জলের স্পর্শ পাইনি।
অপর্ণাদি ছুটে গেলো পানি আনতে। পানি খাওয়া হলে ওকে বললাম, তোমার ছেলে মেয়ে হয়নি?
অপর্ণাদি আজ প্রথমবারের মত হেসে বললো, কিভাবে হবে? সঞ্জয়ের সাথে আমার কিছু নেই আর। ঝোকের বশে প্রেম ভেবে ওর হাত ধরে চলে এসেছিলাম এই বাজে শহরে। ও ব্যস্ত ছিলো ওর আন্দোলন রাজনীতি এইসব নিয়ে।আমাকে দেয়ার সময় ছিলোনা। আমি ছিলাম শুধু মাঝে মাঝে ওর একাকীত্বে সঙ্গী দেয়ার একটা উপকরণ। জানিস আমাকে আর চিঠিও লিখতোনা ও এখানে চলে আসার পর। অথচ ওর জন্য আমি মা বাবার সাথে কত ঝগড়া করে পালিয়ে এসেছিলাম। এখনোও বাবা আমাকে দেখলে ঠিকমত কথা বলেনা।
আমি সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার তাহলে চলে কেমন করে?
ছোট্ট একটা চাকরী করি। বাসাটা বদলাইনি, জানি তাহলে তুই খুজে পাবিনা।ভালো করেছিনা? – অপর্ণা চকচকে চোখে কথাগুলো বললো।ওর সাথে শেষবার দেখা হয়েছিলো প্রায় তিনবছর আগে।ওর মনে আছে আমি ওকে কি প্রবলভাবে ভালোবাসতাৎ! কি অদ্ভুত একটা বাধন ছিলো যা আমি এতো বছরে একটুও শিথিল করতে পারিনি। পারিনি কাউকে আর সেভাবে ভালোবাসতে। আমার নিঃশ্বাসে ছিলো ও, আমার সত্ত্বায় ছিলো শুধুই ও।তারপর আমি ঘুমিয়ে গেলাম। দুই সিটের সোফায় পা ভাজ করে ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘন্টাখানেক পর ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখলাম অপর্ণাদি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ পুরোপুরি মেলে ধরলে ও জিজ্ঞেস করলো, তুই আমাকে সত্যি ভালোবাসতি?
আমি উঠে বসলাম। ওকে বললাম, বাদ দাও। কিছু খেতে দেবে?
অপর্ণাদি উঠে চলে গেলো খাবার আনতে। আমি খাবার খেয়ে ওর বাসা থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। যাওয়ার আগে ওকে বললাম, ভালো থাকবে তো?
ও ছলছল চোখে বললো, জানিনা রে। আবার কবে আসবি?
আমি মাথা নেড়ে হাসিমুখে বললাম, জানিনা।
দরজা ঠেলে বের হয়ে গেলাম।রাস্তায় নেমে একটা ধাক্কা খেলাম। এতো আলোকিত কেন চারদিক। গন্ধটাও এতো অপরিচিত। আমি ছুটে গেলা আবার অপর্ণার বাসায়। ওর দরজার বাহির থেকে কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম।সিটিকিনি লাগায়নি। আমি ঠেলে ভেতরে ঢুকে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, তোমার সাহস হলো কিভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করার তোমাকে ভালোবাসতাম কিনা?কিভাবে সাহস হলো?দিনের পর দিন যখন তোমার সাথে চিত্রার পার দিয়ে নৌকোতে ঘুরতাম দেখনি তোমাকে কেমন তৃষ্ণা নিয়ে দেখতাম? যখন প্রায় রাতে তোমার বাসার জানালার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতাম, লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখতাম তখন বোঝোনি?কিছুই কি কখনো বোঝোনি? অন্তত একবার কি অনুভব করোনি যখন তোমাকে আমি মানিকের গল্প শুনিয়ে বারবার বোঝাতে চাইতাম সব চাওয়ার কথা বলা যায়না। না বলতে বলতে একসময় ভালোবাসাটা যে কি ভয়ংকর তীব্র হয়ে উঠে তা কি জানোনা? অপর্ণা আমার দিকে তাকাও। তুমি আমাকে এতো তুচ্ছ করেছিলে কেন?
অপর্ণা সোফায় বসে পড়লো। ও কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি তোকে কখনও চাইতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ঠিক বুঝতাম, জানতাম। যেই চোখে তুই আমার দিকে তাকিয়ে থাকতি তার জবাব দেয়ার সামর্থ্য আমার ছিলোনা। ভাবতাম, অন্য কাউকে ভালোবাসি। তোকে অনেক অবজ্ঞা করেছি, না?
আমি রেগে বললাম, হ্যা তুমি করেছো। যখন দেখলে, জানলে তখন একটাবার আমাকে তাড়ায় দিতে। নাহলে একবার বলতে আমি তোমার কাছে কতটা ক্ষুদ্র। তুমি আমাকে, আমার চাওয়াকে প্রতিটামুহূর্তে প্রশ্রয় দিয়েছো। আমি তোমাকে একটুও কম চাইনি কারো থেকে।আমি এখনও এতো কিছুর পরও বেঁচে আছি শুধু এই জন্য। কারণ তোমাকে যে মানুষটা ভালোবেসেছিলো সে আমাকে মরতে দিচ্ছেনা। আমি মরতে চাই। এজন্যই তোমার কাছে এসেছিলাম। তুমি এতোই অধম যে আমাকে আবার মনে করিয়ে দিলে যে আমি মানুষ। আমি এখনও মানুষ।অপর্নাদি কেন এমন হলো বলবে?
অপর্ণাদি উঠে দাঁড়িয়ে আমার গালে হাত দিয়ে বললেন, আমি ক্ষমা চাবোনা তোর কাছে। সেই অধিকারটাও হয়তো আমার নেই। শুধু একটা কথা বলি শোন, যেদিন থেকে আমার মোহটা কেটেছে সেদিন থেকে প্রতিদিন আমি তোকে খুজেছি। প্রতিটাদিন।আমি তোর জন্য অপেক্ষা করেছি।মাঝে মাঝে ভেঙ্গে পড়তাম, ভাবতাম তুই আর আসবিনা।
আমি অপর্ণার কপালে একটা চুমো খেয়ে বললাম, আমি তোমাকে মাঝে মাঝে একটা নামে ডাকতাম মনে আছে?
অপর্ণা মাথা নেড়ে বললো, আছে... নবনীতা।

নবনীতাকে আমি কিছু বলার আর সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে যাই। যতই কর্কশ হোক রোদটা, শহরটা হোকনা আরো শ্বাপদসংকুল আমি হেটে যাবো। আমার মানুষ হিসেবে আরো অনেকদিন বেঁচে থাকতে হবে।
ওসি কামরুজ্জামানের অফিসে আমি আবার এক রোববার গেলাম পরোটা খেতে। আমাকে উনি দুই পিস পরোটা দিয়ে বললেন, শরীর এখন সুস্থ?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, জ্বী। তবে মনটা অসুস্থ। আমি নাফিসাকে নিয়ে করা মামলাটা আবার চালু করতে চাচ্ছি। কি করতে হবে বলুন?
ওসি সাহেব মাথা ঝাকালেন। আমাকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলেন আপনার সাথে পাশের হোটেলে চা খেতে খেতে গল্প করি।চা বানায় এক বয়স্ক মহিলা। এতো ভালো চা আপনি এর আগে খাননি। মহিলার নাম জয়নাব। আমার মায়ের নামে নাম। আসুন।
আমি চা হাতে নিয়ে আবার ওসি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখন বলুন আমার কি করতে হবে।
ওসি সাহেব পিরিচে চা ঢেলে চুমুক দিয়ে খেতে খেতে বললেন, নাফিসার জন্য মামলা করে কিছু হবেনা। থানায় আসার আগেই এই সব উচুতলার লোকদের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আমার কিছুই করার ক্ষমতা থাকবেনা।
আমি হেসে বললাম, আপনার কখনও কিছু করার ক্ষমতা থাকেনা। আমার আছে। আমি ওদের বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ করবো, সেটা যার সাথেই হোক। মরলে মরলাম।যা খুশি ওরা করুক আমার সাথে।
ওসি সাহেব চা শেষ করে আরেকটা চায়ের অর্ডার করলেন। আমাকে বললেন, কিছুদিন আগে আমার মেয়ের সাথে গল্প করছিলাম। ও আমাকে বললো, ওর ক্লাসের একটা ছেলে নাকি ওকে খুব বিরক্ত করে। আমি বললাম, টীচারের কাছে বিচার দিতে। ও বললো, ছেলেটা নাকি টীচারের সন্তান। কিচ্ছু হবেনা বললে। এইজন্য ও বুদ্ধি করেছে ও নিজেই ছেলেটাকে একটা শিক্ষা দেবে। আমার মেয়ে এতো দুষ্টু, সে সত্যি সত্যি আমার রিভলবারটা চুরি করে নিয়ে একদিন স্কুলে যেয়ে ছেলেটাকে এমন ভয় দেখিয়েছে যে ছেলে আর স্কুলে আসেনি এক সপ্তাহ। এই গল্প থেকে আমি শিক্ষা পেয়েছি কি জানেন? যখন ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলো নিজেরাই নষ্ট হয়ে যায় তখন যা করার আপনার নিজেরই করতে হবে। তবে এজন্য অস্ত্রের মত একটা ব্যাকআপ দরকার। আপনার ব্যাকআপ কি জানেন?
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, ভেতরে একটা আগুন জ্বলছে। আমি ভাবতাম এটা ভয়। এখন বুঝতে পারি এটা সাহস। এতোদিন এটা ছিলোনা। এখন আছে।
কামরুজ্জামান সাহেব মুচকি হেসে বললেন, এইতো বুঝে গেছেন। আসেন আরেক কাপ চা খান। সাথে দুইটা টোস্ট বিস্কিটও খান। ভালো লাগবে।
সেদিন বিদায় নেয়ার আগে কামরুজ্জামান সাহেব একটা চমৎকার কথা বললেন, “অর্ণ ভাই মনে রাখবেন আপনি যখন জানোয়ারের সাথে যুদ্ধ করবেন তখন নিজেকে ওর মতই একটা জানোয়ারের বেশে পাল্টাতে হবে। মানুষ হয়ে জানোয়ারের সাথে আপনি লড়তে পারবেন না”।
রনি শিকদার মাঝে মাঝে শান্তিনগরের Sports Castle এ বিলিয়ার্ড খেলতে আসেন। শুক্রবার রাতেও এসেছিলেন। সাথে কয়েকজন বন্ধু বান্ধব ছিলো। গতকালকে পত্রিকায় নাফিসা খুনের ঘটনা নিয়ে তাকে জড়িয়ে খুব আজেবাজে কথাবার্তা লেখা হয়েছে। এরপর থেকে সে বাসায় যাচ্ছেনা তার বাবার ভয়ে। তার বাবা শাহজাহান শিকদার সবসময় তাকে বলেছে, সে যা ইচ্ছা করতে পারে কিন্তু পেপার পত্রিকায় যেন এসব নিয়ে কোন লেখা না আসে এটা খেয়াল রাখতে হবে। রনি শিকদার বিল্লাল আর হারুনকে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে পাঠিয়েছে। তার মাথায় ঢুকছেনা ওই মুরগীর বাচ্চাগুলো এতো কিছুর পরও কিভাবে মিডিয়ার কাছে তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছে। এতে সে যতটা না রাগ করেছে তার থেকে বেশি উদাসীন হয়েছে।আজকাল সে সবকিছুতেই উদাসীন হয়ে পড়ে। জীবনটা কেমন বিচ্ছিন্ন বিষাদে ঢাকা। কিছুই তার ভালো লাগেনা।
রাত্রি ১২টা বাজে। ওসি কামরুজ্জামান বিলিয়ার্ড সেন্টারে ঢুকলো। রনি শিকদারকে সালাম দিয়ে কাছে এসে কানে কানে বললো, স্যার আমি শাহবাগ থানার ওসি। আপনার নামে অর্ণ নামে এক ছেলে মামলা করতে চায়। এই ব্যাপারে একটু বাতচিত করতে চাচ্ছিলাম।
রনি তার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওসি সাহেবের সাথে বিলিয়ার্ড সেন্টারের বাহিরে এসে দাড়ালো। সে মুখ দিয়ে হিসহিস করে বললো, ওই শূয়োরের পয়দারে বাঁচায় রাখছিলাম। আমার খুনাখুনি পছন্দ না। বেজন্মাটার এতো সাহস কোথা থেকে আসলো বুঝতেছিনা।
কামরুজ্জামান আফসোস করে বললো, বাঁচায় রাখা ঠিক হয়নাই স্যার। ছেলেরে আমি পুরান ঢাকায় একটা বাড়িতে আটকে রেখেছি। ওরে কিছু টাকা পয়সা দিলে মনে হয় আর উত্তুবুত্তু করবেনা। সব জায়গায় তো খুনাখুনি দিয়ে কাজ হয়না, আপনি কি বলেন? এর মধ্যে মিডিয়ায় অনেক কিছু এসে পড়ছে। ওর সাথে বাজে কিছু হলে আপনি আরো বাজে ভাবে ফাসবেন। আপনার বাবার তো একটা মান ইজ্জত আছে তাই না। চলেন আমার সাথে। ওর সাথে একটা মিটিং করায় দেই।
রনি পকেটে তার পারসোনাল রিভলবারটা গুজে পুলিশের গাড়িতে উঠে বসলো।কনস্টেবল রমজান সেদিন গাড়ি চালাচ্ছিলো। ওসিকে গাড়িতে উঠতে দেখে বললো, স্যার রাতে অনেক বৃষ্টি হবে। নিউমার্কেটের একটা হোটেলে এখন একটা খিচূড়ি খাওন যায়না।
কামরুজ্জামান, রমজানের দিকে তাকিয়ে বললো, খিচূড়ি তোর পাছায় ভইরা দিবো বাইঞ্চোত। আমরা যাচ্ছি জরুরী কাজে, তর খিচুড়ি এখন ভরতে হবে। ঘুষ খাইতে খাইতে তোদের হুশ জ্ঞান জিরো হয়ে গেছে। কমপ্লিট জিরো।

রমজান মন খারাপ করে গাড়ি চালানো শুরু করে। গাড়ি পুরনো ঢাকার দিকে রওনা হলেও সেখানে যায়না। খুব নির্জন একটা রাস্তায় ঠিক আমার থেকে ৫০ মিটার দূরে গাড়ি থামানো হলে রনি শিকদার কামরুজ্জামানের দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে বলে, এখানে তো আসার কথা ছিলোনা।
ওসি সাহেব রনির গলা ধরে গাড়ি থেকে নামায়। আমি কাছে এলে আমাকে হেসে বলেন, এর দিকে একবার তাকায় দেখেন। সারাজীবন মানুষকে ভয় দেখায় আসছে। আজকে যখন নিজের টাইম আসছে পুরাই বিলাইয়ের বাচ্চা।
আমি রনির কাছে এসে বলি, রনি ভাই ভালো আছেন?
রনি শিকদার ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে কুই কুই করে বললো, ভাই কত টাকা লাগবে?
ও আর কিছু বলার আগে আমি ওর গলায়, বুকে পিঠে এলোপাথারী ছুরি চালাতে লাগলাম।আমার তখন খুব চিৎকার করতে ইচ্ছা করছিলো। নিজের ভেতর একটা জন্তু জেগে উঠেছিলো। যখন মনে হলো জানোয়ারটা মরে গেছে আমি রাস্তায় বসে পড়লাম নির্জীব হয়ে। খুব শান্তি লাগছে। বৃষ্টি তখন ঝমঝমিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে। রাত দুইটার দিকে এমন জমকালো বৃষ্টি আগে কখনো দেখিনি।পুলিশের গাড়ির হেডলাইটের আলোতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রনির রক্তের রংটা আর লাল নেই। কেমন কালচে নীল যেন। এদের রক্ত লাল হয়না।
কামরুজ্জামান সাহেব আমাকে একটু পর গাড়িতে উঠিয়ে বললেন, সারাজীবন সৎ থাকার চেষ্টা করে আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু আজকে এমন একটা অসৎ কাজ করে এর থেকে বেশি আনন্দ পাচ্ছি। কেমন যেন সিনেমার দুধর্ষ পুলিশের মত নিজেকে মনে হচ্ছে।আপনি কি ভয় পেয়েছেন খুন করতে?
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, নাহ! ওর মত একটা পিচাশ মারতে ঘিন্না হয় ভয় হয়না।

বিল্লাল আর হারুন, রনি শিকদার খুন হওয়ার মাস তিনেক পর আবার বাস চালানো শুরু করে। মাঝে মাঝে তারা অসহায় চোখে বাসে থাকা মেয়েদের দিকে তাকায়। কিন্তু রনি এখন নেই। তাই হঠাৎ করে ওরাও কেমন যেন ভীতু হয়ে গেছে।এপ্রিলের ১১ তারিখ এভাবেই একদিন ঢাকার সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে ওরা রাত আটটায় রওনা দিলো বাস নিয়ে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে। পেসেঞ্জার উঠেছে মাত্র ১০ জন। সামনে যাত্রাবাড়ি থেকে আরো কিছু লোক তোলা যাবে। হারুন আজকে কন্ডাকটার হয়েছে। বাস চলা শুরু করলে সে খেয়াল করে তিন নম্বর সারিতে একটা ১৬-১৭ বছরের মেয়ে বসে আছে। হারুন মুখ দিয়ে হিসহিস আওয়াজ শুরু করলো। একটু পর বিল্লালকে যেয়ে বললো, ভাই আজকে গাড়িতে একটা মাল উঠছে।
বিল্লাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আজকে কিছু করা যাইবোনা।কয়েকদিন যাক। পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক। সবুর করতে হইবো।
হারুন মন খারাপ করে চলে আসে। গাড়ি যাত্রাবাড়ি বাস ডিপোর কাছাকাছি পৌছালে তিনজন পুলিশ গাড়িতে উঠে পড়ে। হারুন তাদের কাছে যেয়ে বলে, স্যার গাড়ি টাঙ্গাইল যাইবো। আপনেগো কই নামামু?
কামরুজ্জামান হারুনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, আমরাও টাঙ্গাইল যাবো। চুপ কইর‍্যা চালাও। ভাড়া নেয়ার সময় এসে পড়ো।আর সামনে শনির আখড়া আসলে ওইখানে গাড়ি থামাবে, তারপর সব যাত্রী নামিয়ে দেবে।
হারুন একটু ভয় পায়। সে জিজ্ঞাসা করে, ক্যান?
কনস্টেবল রমজান হারুনের কান বরাবর একটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন, প্রশ্ন কইরোনা বেশি। স্যারের আজকে মনটা ভালো নাই।

শনির আখড়া আসলে হারুণ প্যাসেঞ্জার সবাইকে নেমে যাওয়ার জন্য বলে। প্যাসেঞ্জাররা পুলিশ দেখে ভয়ে কোন প্রতিবাদ না করেই নেমে যায়।হারুন খেয়াল করে বাসের পেছনে একজন তখনও বসে আছে। কাছে এসে পেছনের মানুষটাকে হারুন জিজ্ঞাসা করে, নামেন না ক্যান? সবাইরে নামতে কইলাম না?
আমি হেসে হারুণকে বললাম, কিরে বাইঞ্চোত ভালো আছিস। বাসে মেয়ে মানুষ পাইলে অনেক মজা করো না তোমরা। আজকে চলন্ত বাসে তোমাদের নিয়ে খুব মজা হবে। আসো, কাছে এসে বসো। বীচি কেটে দিলে কেমন মজা হয় আজকে বুঝবা।
রাত্রি তিনটার দিকে ঢাকা টাঙ্গাইল রুটে একটা অগ্নিদগ্ধ বাস এতীমের মত দাঁড়িয়ে ছিলো। সেখানে ভোর হওয়ার আগেই একটু একটু করে মানুষের ভীড় জমে যায়। সকালে পত্রিকায় আসে, বাসটিতে অজানা কারনে আগুন ধরে গিয়েছিলো। ভেতরে দুটো লাশ পাওয়া যায়। লাশগুলো এতোটাই পুড়ে গিয়েছিলো যে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় নাই।

মাসখানেক পর আমি অপর্ণার বাসায় যাই আবারও। ভোর তখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। চারদিকে কুয়াশায় ঢাকা। রাস্তায় কারো সহজে দেখা মিলছেনা। কেউ কেউ লেপ মুড়ি দিয়ে তখনও ফিনিক্স পাখির স্বপ্নডানায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউবা আবার জানালাটা খুলে দিয়ে আলো আধারের মরীচিকায় নিজেকে সপে দিচ্ছে। আমি তখন আমার ছোট্ট গ্রামের কাচা রাস্তায় হেটে যাচ্ছি। বর্মন কাকা এমন সকালে গলির মোড়ে বিশাল পাতিলে মাঠা নিয়ে বসে থাকতেন। আমাকে দেখে বলতেন, আইজ ভালো বেচা হবে মাঠা। মেয়েটার জন্য সন্দেশ কিনে নিয়ে যাবো।
অপর্ণাদির বাসায় যেয়ে দরজা ঠক ঠক করলাম। ও যেন দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে দেখে খুশি হয়ে বললো, এই দেখ। আজকে মনে হচ্ছে তুই আবার মানুষ হয়ে উঠছিস। তোর চোখটা ঠিক আগের মত ঝকঝক করছে। নাস্তা করেছিস?
আমি অপর্ণার হাত ধরে বললাম, চলো আবার চিত্রা নদীর কাছে ফিরে যাই। বাবুবাজারের কাচা ধরে হেটে হেটে তোমাকে বাড়িতে পৌছিয়ে দেবো। এই শহরটা আমাদের না। কখনও আমাদের ছিলোনা।
অপর্না মোহ ভরা নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তারপর?

আমি ওর গালে হাত রেখে বললাম, নবনীতা আমি তোমাকে একটা কবিতা শোনাবো। শান্ত স্থির জলে একাকী ভেসে থাকা শান্ত পদ্মের মত। শুনবে?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১১:০৬
৯টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×