somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেভাবে আমার মৃত্যু হলো

১০ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাদা ফতুয়া পরা লোকটা যখন আমাকে তার দোকানের রডটা দিয়ে পেট বরাবর বাড়ি দিল মূলত তারপর থেকেই আমি চিৎকার করা ছেড়ে দেই। আপনারা হয়ত ভাবছেন আমি চিৎকার করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম । ব্যাপারটা আসলে তা্ নয় আমি ইচ্ছা করেই চুপ মেরে গিয়েছিলাম। কি হবে আর চিৎকার করে? কেউ তো আমার কথা বিশ্বাস করছেনা। বরং প্রচন্ড ক্রোধ আর ঘৃণা নিয়ে আমাকে পিটিয়েই যাচ্ছিল। আমি যতই বলছিলাম আমি চোর না, আমি চাকরি করি, আমি একটা জুতা ফ্যাক্টরির স্টাফ ওরা ততই আরো ক্ষেপে উঠছিল। কি আশ্চয!
একজন বলল আইডি কার্ড দেখা্ । আমি আইডি কার্ড দেখাতে পারলাম না। কি করে দেখাব মারের শুরুতেই তো একজন আমার পকেট থেকে মানিব্যাগ নিয়ে নিল্ ।
দুটো উঠতি বয়সের ছেলে ছিল। ওরা পরনের প্যান্ট থেকে বেল্ট খুলে আমাকে পেটাতে লাগল। এদের একজনের বয়স এবং চেহারা হুবুহু আমার বড় ছেলেটার মত।
আমি খুব অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম্ । ছেলেটা একবারো আমার চোখের দিকে তাকায়নি। আমার চোখের দিকে তাকানোটা তার জন্য জরুরী ছিলনা। তার জন্য জরুরী ছিল সমস্ত ক্রোধ নিয়ে একজন সন্দেহভাজন চোর বা ডাকাতকে পেটানো। সমাজকে কলুষমুক্ত করতে হবে।
একজন বলছিল আমি নাকি শফিক মেম্বারের মোটর সাইকেল চুরি করেছি। আমি জীবনেও কোনদিন এই এলাকায় আসিনি। কিন্তু এই কথাটাও কাউকে বোঝাতে পারলাম না। আমার অপরাধ কি তাও বুঝতে পারছিলাম না।
ভোর বেলা সকালটাকে অদ্ভূত সুন্দর লাগছিল। আগেরদিন সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি, কি কারণে যেন। এখন আর মনে পড়ছেনা। মাঝে মাঝেই আমার এমন হত। আমি ঘুমাতে পারতামনা। আমি ভোরবেলা ভাবলাম একটু হাটি। সকালের সূর্য ওঠার আগ মূহুর্তটা সব সময়ই অসাধারণ মনে হয় আমার কাছে। আমি হাঁটতে শুরু করলাম।হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা পার হয়ে গ্রামে ঢুকে পড়লাম। গ্রামটা সুন্দর ছিল। গ্রামের জমির মাঝ বরাবর আলপথ ধরে আমি হাঁটছিলাম। একটু করে অন্ধকার সরে আসছিল। হালকা ঠান্ডা বাতাস শরীরকে জুড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা এত সুন্দর! সব রাতে আসলে ঘুম না আসলেই ভাল। এ
রকম সময় একদল লোক দৌড়ে আসল ‘ডাকাত ডাকাত‘ বলে। তারা গ্রাম থেকে দৌড়ে এস জমির আলপথে উঠলো। মানুষগুলির চিৎকার শুনে আমার মনে হলো কি জানি কি? হঠাৎ আলের পাশে পা পিছলে আমি পড়ে গেলাম। দেখলাম মানুষ গুলি আমার দিকে দৌড়ে আসছে।
আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি। আমার ভাগ্যে ছিল গনপিটুনিতে মৃত্যু। আমার তাই হয়েছে।ভাগ্যে যদি মদীনা শরীফে মৃত্যু লেখা থাকত তবে তাই হত। কড়িকান্দি গ্রামের ধান ক্ষেতের পাশে বড়পুকুর পাড়ে আমার মৃত্যু হতনা।
আমাকে মারতে মারতে যখন সবাই ক্লান্ত তখন ফজরের আজান হলো। ফজরের আজানটা সব সময় সুমধুর হয়্। আসসালাতু খাইরুম মিনান নউম।এই লাইনটা মুয়াযযিন যখন পাঠ করে তখন চোখে পানি আসে। আসলেই তো ঘুম হতে নামাজ উত্তম। অথচ কত ভোর ঘুমের ঘোরে কাটিয়েছি। নামাজ পড়া হয়নি। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার আর কিছুক্ষণ পর মৃত্যু হবে। নামাজ না পড়ার হিসাব আমাকে দিতে হবে।
ফজরের আজানের উছিলায় তারা কিছুক্ষণ বিরতি নিল। আমাকে বেধে রাখা হলো একটা গাছের সাথে । একটা অল্প বয়সী মেয়ে আমাকে জানালা দিয়ে দেখছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম মেয়েটি কষ্ট পাচ্ছিল। পাওয়ারই কথা। মেয়েরা একটু নরম স্বভাবের হয়। আমার পরনের প্যান্ট মারের চোটে ছিড়ে গিয়েছিল। বাম চোখটা ফুলে গিয়েছিল বিশ্রীভাবে। ঠোঁটের কোনা থেতলে গিয়ে রক্ত পড়ছিল। আমাকে আসলে বিকট দেখাচ্ছিল।
আমার স্ত্রীর কথা মনে পড়ছিল। নীলফামারী জেলার বাসরডাঙ্গি গ্রামে আমার স্ত্রী থাকে। এক পুত্র আর এক কণ্যা নিয়ে। ওদের কথা মনে পড়ছিল। আমার স্ত্রী খুব মায়াবতী একজন মহিলা। কারো দুঃখ কষ্ট সইতে পারেনা। একবার আমাদের গ্রামেও চোর ধরা পড়েছিল। আমার স্ত্রী চোর পেটানো সহ্য করতে পারবেনা বলে ঘর থেকে বের হয়নি। আমাকেও বের হতে দেয়নি। আমি তবু বের হয়েছিলাম। বের হয়েছিলাম চোর পেটানো বন্ধ করতে। বিষয়টা আমারো ভাল লাগেনা।
এখন অবশ্য বিষয়টা আমার ভাল লাগা না লাগার মধ্যে নেই। এই গ্রামের লোকজন ধরেই নিয়েছে আমি ডাকাত। অথবা চোর। আমার কথা বলার শক্তি বা ইচ্ছে এখন আর নেই। আমি অপেক্ষায় আছি। নামাজের পর হয়ত সবার মন ঘুরে যাবে। জানালা দিয়ে দেখলাম মেয়েটা তাকিয়ে আছে। আমাকে ইশারা করে বলছিল পালিয়ে যেতে। আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার শক্তি আমার ছিলনা।
আমার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। ফজরের নামাজের পর আমার উপর নতুন করে অত্যাচার শুরু হলো। ওদের ভাষায় অবশ্য এটা অত্যাচার না।

ওরা সমাজকে কলুষমুক্ত করছে আমাকে পিটিয়ে। ওরা যে ভুল করতে পারে সেটা ওদের মাথায় ছিলনা। অবশ্য সমস্ত মানবজাতিরই এই সমস্যা। সবাই মনে করে তারা ঠিক। অন্যরা ঠিক নেই।

দ্বিতীয় দফা পিটুনি শুরু হলো। এবারের ধরনগুলি আগের থেকে ভিন্নতর। কে কত সৃজনশীল উপায়ে আমাকে শাস্তি দেবে সেই প্রতিযোগিতা চলল। একজন আমার অন্ডকোষ চেপে ধরল। হঠাৎ একজন দৌড়ে গেল তার বাড়ির দিকে । আধঘন্টা পর ফিরে এল একগামলা গরম পানি নিয়ে। আমার উপর ঢেলে দেওয়া হলো সেই পানি। আমি ছটফট করতে করতে কখন যেন শ্বাস টানলাম। আমার শ্বাস নালিতে পনি ঢুকে গেল আমি কাশিও দিতে পারছিলামনা।
এরপর থেকেই আসলে আমি বুঝে গেলাম আমি মরে যাচ্ছি। মারা যাওয়ার সেই মূহুর্তটায় আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল।সারা রাতের ঘুম আমার চোখে এসে পড়লেঅ এক লহমায়। সমস্ত চরাচর ঝাপসা হয়ে আসছিল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমার চোখের সামনে ঝাপসা এক গ্রাম। সদ্য সকালের আলো ফুটেছে। পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু হালকা ক্ষীণ শব্দ । যেন অনেকদুর থেকে ভেসে আসছে। ঝাপসা চোখে দেখছিলাম একটি ছেলে আর একটি মেয়ে সকালে আমপারা আর রেহেল বুকে জড়িয়ে মক্তবের দিকে যাচ্ছে। ওরা দুজন অবিকল আমার ছেলে এবং মেয়েটার মত। হঠাৎ আমার মনে হল আমি কি তবে বাসরকান্দি গ্রামেই আছি?
গাছের নিচে বাধা থাকা অবস্থাতেই আমার মৃত্যু হলো। আমার মৃত্যুর পর একজন বলল “মনে হয় মইরা গেছে“।
আমার মৃতদেহ নিয়ে কি করবে সেটা নিয়ে বাদানুবাদ হচ্ছিল। একজন বলল পুলিশে খবর দিতে। আরেকজন বলল “আগে চেয়ারম্যান সাবেরে খবর দাও“।
সেই তরুনী মেয়েটি জানালার ধারে বসে কাঁদছিল। আমি আমার মৃত খোলা চোখে মেয়েটিকে দেখছিলাম। আমার চোখের পলক পড়ছিলনা। মৃত লোকদের চোখের পলক পড়ার কথাও না। মেয়েটি একসময় জানালা থেকে সরে গেল।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল মেয়েটি কি কাঁদছিল?
১৪টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×