মেয়েটার চোখের মধ্যে টলটলে আস্ত একটা পুকুর উপুড় করে রাখা আছে ।
সত্যিই ,মেয়েটার চোখের মধ্যে টলটলে আস্ত একটা পুকুর উপুড় করে রাখা আছে ।
পুকুরটা তার আঁখি পল্লবে ঢাকা থাকে । কিন্ত অনেকদিন বাদে দেখা হওয়ার পর সে তার বাবা হারানো গল্প বলতেই দেখি টলমল জলে একবারে মাখামাখি । পল্লবের পরতে পরতে জলের ছোঁয়া ।
ওরে বাব্বা । এমন অবস্থা দেখে হাঁটু গেড়ে চোখের নীচে যেই হাত পেতেছি- দাঁড়া, তোর চোখের জলে আমার পাপ সব ধুয়ে নিই।
- - ধ্যাৎ ! বাজে না বকে তোর জোনাক পরীর কাছে গিয়ে হাত পাত ।
খ্যাচ করে খোঁচা দিয়ে কৃত্রিম গাল ফোলায় পুকুরচোখি কন্যা । আরক্তিম গাল আপেলের সুবাস ছড়ায় । উড়না উড়ে যায় বিদিক বাতাসে সাথে নিয়ে যায় মেঘ মালার মত দুরন্ত কেশরাজি । ফের আঁখি পল্লবে ঢাকা পড়ে আয়ত পুকুরখানি ।
হায়রে , রমণী, দয়া করে একটু চুপ করে বস ।
না হয় একটু ডুব সাঁতার হয়ে যাক তোর পুকুরে । কোত্থেকে বেহায়া ফোন বাঁজতেই কনকচাঁপা আঙ্গুলগুলোর মধ্যে মোবাইলখানা আদরে ডুবে যাচ্ছিল । উপরন্ত কান-গাল ঘষাঘষিতে ব্যাস্ত মোবাইল দেখে আফসোস হলেও ওর হেসে গলে যাওয়া দেখে আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছিল । অবশ্য এসব বুঝতে দেয়া যাবেনা । ক্ষতটাকে যতটা পারি বুকের মধ্যে চেপে এক মলিন হাসি হেসে বললাম , কে আন্টি ফোন করেছেন ?
- তোর মাথা !
- তাইলে তো খুশিই হতাম । বল না কে ?
-- তোর দুলাভাই । বুইড়া মিয়া ।
-- মানে !!
মেয়েটা বরাবর খুব কুল টাইপ । পোষাক আশাকেও শালীন আর স্বাভাবিক ।শান্ত মুখশ্রী আর কুল স্বভাব নিয়ে অনার্সের দিনগুলো কিভাবে যে কাটালো আল্লাই মালুম । তার এই চোখ কোথায় লুকিয়ে রেখে এতগুলো দিন কাটালো ! ওকে পছন্দ করলেও সে কথা বলার বা বোঝানোর কোন সুযোগ আমার মেলেনি এক এক্সারসানের ঐ সাতদিন ছাড়া ।
ওটাই মূলতঃ একটু কাছে যাওয়ার আর নিজেদের ভাল লাগা খারাপ লাগা শেয়ারের একটু সুযোগ ছিল মাত্র । কক্সবাজারের ঐ বালুকাবেলার সন্ধ্যা আর রাত্রির মূহুর্তগুলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ।হয়ত ভালবাসি শব্দটা অমন আটপৌরেভাবে ব্যবহার করিনি কিন্ত হ্রদয় দিয়ে ওর ছবিই আমি এঁকেছিলাম সেই রূপালী বালুকাবেলায়।
সম্মুখের বিস্তৃর্ন সমুদ্র জলরাশির সামনে ওর হাত ধরে আমার মনে হয়েছিল আমার চেয়ে সুখী মানুষ এই পৃথিবীতে বোধহয় আর কেউ নেই।আমি জানিনা মানুষ কি সমুদ্রের কাছাকাছি গিয়ে এমন উদার উদাস হয়ে যায় নাকি কাউকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয় !
ওরও কি অমন ছিল ? আমার তো পুরোটাই হ্রদয়বৃত্তিক ছিল । কিন্ত ওর ? জানিনা ।
ও নিরদ্বিধায় আমার কাঁধে মাথা রেখে সমুদ্রের আছড়ে পড়া জলরাশি উপভোগ করেছে ,বলেছে – আমি তোর জন্য অপেক্ষা করতে পারব ।
না হোক অনন্ত কাল কিন্ত অপেক্ষা করতে তো চেয়েছে ।
এরপর ফিরে এসে অনার্স ফাইন্যালের চাপ ।ফটোকপি, নোট দৌড়াদৌড়ি --
তারপর তো মেয়েটা অনার্স ফাইন্যাল দিয়ে একেবারে লাপাত্তা । কোথাও দেখা নেই । ওদিকে আমিও তাকে খুঁজে ফিরেছি কলাভবন,হল, টিএসসি ,শাহবাগ - - নাহ, নেই । কোত্থাও আর খুঁজে পাইনি । পুরোই ট্রেসলেস ।ওর দেখা যতই পাইনা ততই আমার অবস্থা সঙ্গিন ! কেন জানি মনে হয়েছে ওকে আমার খুব খুব দরকার । তারপর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ওর ভর্তি ফর্ম টর্ম দেখে মোবাইল নাম্বার আর স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি । কোথায় হারালো আমার পুকুরচোখি কন্যা- -
মোবাইলে নো কানেকশান ।অতঃপর স্থায়ী ঠিকানায় চিঠি দিয়ে আমার মোবাইল ফোন নাম্বার জানিয়ে জরুরী যোগাযোগের তাগাদা দিয়ে লিখি । তারপরে আবার অনেকদিন কোন খোঁজ নেই ।তার প্রায় চারমাস পরে মহিয়সীর ফোন –
-- হ্যালো , আমি সেতু ।এটা কি - - -?
আমার ধাতস্ত হতে সময় লাগে ।কিছুই বলতে পারিনা ।বলি -হ্যাঁ ।
--আমি ঢাকায় এসেছি ।কাল কলাভবনের নীচে আসব ।বিকাল পাঁচটায় ।
খুট করে কেটে গেল ফোন ।আমি কেটে যাওয়া কোনের দিকে মনে হয় অনন্তকাল তাকিয়ে আছি ।হার্টবিট মনে হয় একসাথে চারটা করে বাড়ি মারছে !
হার্টবিটের ধামাকা কমতেই মনে হল – ঢাকায় আসছে মানে ? কই থাকে ?
জানিনা অনেক কিছুই । সারারাত অস্থির । ঘুম হয়না । পায়চারি করে বেড়াই ।
আকাশপানে নির্নিমেষ চেয়ে থাকি । যেন চোখের সামনে আদিগন্ত জলরাশি । নোনাজলে ঘর্ষনে ঘর্ষনে ফসফরাস জ্বলে তারার মত । মনে হয় আরেকটা আকাশ নেমে এসেছে আমার সামনে ।আমার হাতের মুঠোয় সেতুর হাত ।সেতু কেমন আনমনা প্রেমিকা হয়ে আমার বুকে পড়ে থাকে ।আহ !সেই ক’টা দিন ।
সেই মহেন্দ্রক্ষন এসেই পড়ে । আমার হ্রদ-কম্পন কিছুতেই কমেনা ।
ওর শান্ত চেহারার সামনে শুস্ক হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলাই ।
তারপর ওই শুরু করে । অনার্সের পর বাবার মৃত্যু, বাড়ী থেকে নিজের বিয়ের চাপ সামাল দিতে না পেরে ও একটা এন জিওতে জয়েন করে ঠাকুরগাঁও চলে যায় ।
আত্মীয়র সাথে বিয়ে দেয়ার চাপ সামলাতে না পেরেই তার এই পলায়ন । ওখানেই তার জীবনযাপন আর চারটা মেয়ের সাথে ।
--বুঝলাম তো তোর সব কথা ।তাই বলে আমায় জানাবি না ? আমি কি কেউনা ?
সেতুর পুকুরে রীতিমত বন্যা নামে । নামুক । নামতে দিই ।
ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যা বলে তার মানে এই রকম দাঁড়ায় যে - ও হ্রদয় দিয়ে অনুভব করেছে আমায় কিন্ত পরে ভেবেছে আমি সিরিয়াস ছিলাম কিনা তা তো সে জানেনা । তাছাড়া এ ব্যাপারে আমিও নাকি কিছু বলিনি ।
ও প্রত্যাখানের ভয়ে আর কিছু বলেনি । ওর ভালবাসা নিয়েই ও লুকিয়ে যেতে চেয়েছিল । সেটাও ওর জন্য খুব কষ্টের ছিল ।এই প্রায় একটা বছর প্রতিদিনই সে এই অনলে পুড়ে মরেছে ।কিন্ত কেন জানি ও বিশ্বাস করতো একদিন আমার সাথে দেখা তার হবেই ।তবে তার নাকি ভয় ছিল কিসব জোনাক কন্যা, কদম কন্যাদের গল্প আমি করতাম তাদের কারো সাথে আমায় দেখতে পাবে বলে মনে হত ।আর আমার পাঠানো চিঠিটা সে চারমাস পরে বাড়ি গিয়ে পেয়েছে দুইদিন আগে ।আর পেয়েই ঢাকা এসেছে গতকাল ।ও এমন কিছুর জন্য ই তো অপেক্ষা করেছে এতদিন ।
গতকাল এক ফোঁটা ঘুমুতে পারিনি ।গত তিনদিন সে ঘুমুতেই পারিনি । আসলে সে দীর্ঘদিন ঘুমাতে পারিনি ।
আমার হ্রদয় খানা কেমন কোমল আর সুস্থির হয়ে এল ।
আমি ওর পাশে বসে মাথাখানা আমার কাঁধে রাখলাম ।
ও ফোঁপাতে লাগলো ।
- -এই আমার সার্টটা তো ভিজিয়ে ফেললি ।
কিছু বলেনা । আস্তে আস্তে চুপচাপ হয়ে গেল । একটু পরে দেখি ও সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে আমার কাঁধে মাথা রেখে । কি পরম আস্থায় আর নির্ভরতায় এই ঘুম !
অনেক কষ্টের পর আরাধ্য কিছু পেলে কেমন একটা সস্তি আসে তেমন ।
আমারও দেখি ঘুম পাচ্ছে । পুকুরচোখি কন্যা কে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে আমারও কেমন ঘুম ঘুম পেয়ে যায় । মনে হয় আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । দুজন মানুষ এই জনসমক্ষে মিষ্টি বিকেলে একটা গাছের নীচে ঘুমাচ্ছে এটা একটা দেখার মত ব্যাপার ।
সেদিন আড্ডায় শুভ তার প্রেমের পুকুরচোখি কন্যা র গল্পটা আমাদের এইভাবে বলে গেল ।।