বাসা থেকে বের হয়েই গেইটের সামনে এসে দেখি অনেক খালি রিক্সাওয়ালা তীর্থের কাকের মত দাঁড়িয়ে আছে, সবার দৃষ্টি আমার উপর, চোখগুলো চক চক করছে। তাদের এ দৃষ্টির ভাষা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে নগর জীবনে যারা প্রায়ই চলাফেরার জন্য এই রিক্সার উপর নির্ভরশীল। জোয়ান আর তাগড়া দেখে (যেন দ্রুত টানতে পারে) এক রিক্সা'য়ালাকে বললাম,
- মালিবাগ রেলগেট যাবা?
- যামু, ২০ টাকা!
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মূল ভাড়া দশ টাকা। বললাম, - তোমারটায় যামু না!
- মামা ১৫ টাকা দিয়েন, আসেন। আমি হাঁটা শুরু করলাম আরও যারা আছে ওদের দিকে। এবার সে বলে, ঠিকাছে মামা ১২ টাকা দেন। আমি বলি ১০ টাকা দিমু। সে রাজি হয়ে যায়। বলল, উঠেন!
রিক্সা চলা শুরুর পর বলে,
- তারপরও ক্ষ্যাপ ছাড়ুম না।
- ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা কইলে ক্ষ্যাপ মারবা কেমনে? (আমি বলি।)
মুখে বিশাল একটা হাসি দিয়া সে টানা শুরু করে।
কিছুক্ষণ পর সে বলে, মামা আজকে কি বার?
- বৃহস্পতিবার।
-হুমম, তারমানে কালকা শুক্র, পরশু শনিবার, এরপরদিন রবি?
-হ!
-আজকে কত তারিখ?
- ২৯ তারিখ।
- তারমানে রবিবার ১ তারিখ? (এটা বলেই সে হাসা শুরু করে।)
- হ্যাঁ। রবিবার ১ তারিখ, এইটা নিয়া এত খুশি কেন? কিছু হইবো নাকি? (আমার কাছে কেন জানি তাকে ইন্টারেস্টিং মনে হয়, এজন্য গেজানো শুরু করি।)
- ১ তারিখ বাসা ভাড়া দিতে হইবো মামা! (এই বলে সে আবারো হাসা শুরু করে, মনে হয় যেন বাসা ভাড়া দেওয়া খুব মজার কাজ!!!)
- বাসা ভাড়া দেওয়া কি খুব মজার কাজ? ভাড়ার কথা বইলাই তুমি যেইভাবে হাসতাছো...! (সে প্রাণ খুলে হেসে যায়!)
- বাসা কই তোমার?
-রামপুরা।
-ভাড়া কত দাও?
- ৩০০০ টাকা!
ভাড়া শুনে আমি একটু অবাক হই!
- কি বল, কয়জন থাকো তোমরা, ভাড়া এত বেশি কেন?
- ২ জন মামা!
- তুমি আর মামী থাকো, নাকি??? (লজ্জা মাখানো হাসিতে সে সম্মতি জানায়)! :#>
- বাসায় কি গ্যাস, কারেন্ট, পানি সব আছে?
- হ মামা, সবই আছে, এজন্যইতো ভাড়া বেশী।
- হুমম... তাহলে ঠিক আছে।
এবার সে তার নিজের কিছু কাহিনী বলে যায়,
- আগে তো মামা নিজের গাড়ি (রিক্সা) ছিল, সব ভাড়া দিতাম, আমি চালাইতাম না। সবগুলা চুরি হয়ে গেছে। এজন্যই নিজে চালাই এখন। (তার মুখে হাসি লেগেই আছে, এত বড় শোক সংবাদ জানানোর পরও তার মুখে কোন বিষাদের চিন্হ পেলাম না।)
- এখন চালাইতেছ এইটা কার গাড়ি?
- গ্যারেজের, অন্য লোকের।
- জমা কত দাও সারাদিন চালাইলে?
- ৮০ টাকা।
- হুমম, ডেইলি ক্ষ্যাপ মারো কত?
- এই মনে করেন ২০০ বা ৩০০ টাকা। কখনও এর চেয়ে সামান্য বেশীও হয়।
- তাহলে তো ২ জনের চইলা যায়!
- হ, চইলা যায়। তয় এখন মাসের শেষতো, লোকজন বেড়ায় কম, রিক্সায় উঠতে চায় না। সবাই বাসে উঠার চেষ্টা করে। মতিঝিলে সব রিক্সা খালি পইরা আছে। এইজন্যই এইদিকে চইলা আইলাম।
- হুমম। গ্রাম থেকেও তো অনেক লোক এখন শহরে আসতাছে, কাজের জন্য। সবাই তো রিক্সাই চালায়।
- হ!
- তোমার বাড়ি কই?
- শেরপুর।
- হুমম... আমি অবশ্য ময়মনসিংহের ফুলপুর পর্যন্ত বেশ কয়েকবার গেছিলাম। এরপরই তো শেরপুর। (সে সম্মতি জানায়)। শেরপুরে তো সব আবাদী জমি, মাইলের পর মাইল ফসলের ক্ষ্যাত। ঐখানে কাজ করতে পারো না? ঢাকায় থাকো কেন?
- ঐ কাম করতে ভাল লাগে না। রিক্সা চালায় মজা। তবে শেরপুর শহরে চালাইলেও ভাল ইনকাম করা যায়। ডেইলি ২০০ টাকা আসে।
- বাহ, তাহলে ঢাকায় পইড়া আছ কেন? ঐখানে তো খরচ আরও কম। চইলা যাও সেখানে!
- বউয়ে যাইতে চায় না। কয়, বাড়িতে থাকমু বুড়া বয়সে, এখন গিয়া কি করমু?
- বাহ! তোমার বউয়ের তো দেখি অনেক শখ! চাকরি বাকরি কিছু করে, নাকি বাসাই পইড়া থাকে সারাদিন?
- না মামা, বাসায়ই থাকে, কিছূ করে না।
- তাহলে কাজে লাগায় দাও, গার্মেন্টসএ অথবা রান্না বান্না কিছু পারলে কারও ঘরেও কাজ করতে পারে, ঝামেলা কম।
- হ, সেইটা তো বলছি, কিন্তু হের এক কথা, "বিয়া করছি আরামে বইসা বইসা খাওনের জন্য, চাকরি করুম কেন??"
- খাইছে! মামীরে তো দেখি বেশ আরামেই রাখছো।
- হ! বিয়ার আগে এইসব কইলে তো এত তাড়াতাড়ি করতাম না। আরও পরে করতাম।
- হুমম.... নিজেই পছন্দ করছো, না? পিরিতের বিয়া?
সে লাজুক হাসি দিয়া বলে - হ!
পৌঁছার পর ভাড়া দেওয়ার সময় শেষ কথা বলি,
- তো, পছন্দ করলা কেন মামীরে, বেশী সুন্দর নাকি?
- মাশাল্লাহ, ভালই! :!>
ঝকঝকে দাঁতে বিশার একটা হাসি দেয় সে। একেবারে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি যাকে বলে। ঠোটের দুই প্রান্ত তার দু'কানের লতি স্পর্শ করেছে যেন...!
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




