ঋতুরাজ বসন্ত যেন বাসন্তী সাজে। প্রকৃতি সেই সাজে প্রেমোন্মূখ, মনেতে ফাগুন এলো তখন রঙিন রঙ ছড়িয়ে। অনেকক্ষণ থেকে ভাবছি বসন্ত নিয়ে কিছু লিখতে হবে, হঠাৎ কবিগুরুর একটি গান লোপা দি'র কন্ঠে ভেসে আসলো-
" ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।
আমার আপন হারা প্রাণ
আমার বাধন ছেঁড়া প্রাণ
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।"
কবিগুরু বসন্ত কবিতায় কবিতায় বসন্তের আগমন সম্পর্কে বলেছেন-
"অযুত বৎসর আগে হে বসন্ত,
প্রথম ফাল্গুনে মত্ত কুতূহলী,
প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের
দক্ষিণ-দুয়ার মর্তে এলে চলি। "
বসন্তকে কাছে পেয়ে কবিগুরু তার "আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে" কবিতায় লিখেছেন-
"আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
এই সংগীতমুখরিত গগনে
তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।"
রবীন্দ্রনাথ তার গানে বসন্তের ফুল ও পাখির বর্ণনাও দিয়েছেন-
"আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে, কত পাখি গায়"
বসন্তের বিদায়ে কবিগুরু চুপ করে থাকেন নি প্রশ্ন করেছেন বসন্ত কে -
"কেন রে এতই যাবার ত্বরা–
বসন্ত , তোর হয়েছে কি ভোর গানের ভরা "
কবিগুরু ছাড়া যেমন বসন্ত অসম্পূর্ণ তেমনি প্রেমের কবি নজরুলও বসন্তকে তুলে এনেছেন কবিতা ও গানে । নজরুলের কবিতা "এলো বনান্তে পাগল বসন্ত" এর কথা না বললেই না -
"এলো বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে,
চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।
বাঁশীতে বাজায় সে বিধুর পরজ বসন্তের সুর,
পান্ডু-কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে
রাঙা হল ধূসর দিগন্ত।।"
রবী ঠাকুরের ১৪০০ সাল কবিতার প্রতি উত্তরে নজরুল ১৪০০ সাল নামেই একটি কবিতায় লিখেছিলেন-
'আজি নব বসন্তের প্রভাত বেলায়
গান হয়ে মাতিয়াছ আমাদের যৌবন মেলায়’
একই কবিতায় আরও লিখেছিলেন -
(১)
'সহসা খুলিয়া গেল দ্বার
আজিকার বসন্ত প্রভাতখানি
দাঁড়াল করিয়া নমস্কার’
(২)
‘শতবর্ষ আগেকার
তোমারি বাসন্তিকা দ্যুতি
আজি নব নবীনেরে জানায় আকুতি’
কবি নজরুল শুধু ফুল, ফাগুন আর পাখিদের মধ্যে বসন্ত এনেই ক্ষান্ত হন নি। বসন্তের করুণ বিদায়ও জানিয়েছেন-
'বৈকালী সুরে গাও চৈতালী গান
বসন্ত হয় অবসান
নহ্বতে বাজে সকরুণ মূলতান’
বিরহের কবি নজরুল বসন্তেও বিরহ এনেছেন কবিতার মাঝে-
'অনন্ত বিরহ ব্যথায় ক্ষণিকের
মিলন হেথায়
ফিরে নাহি আসে
যাহা চায় নিমেষের
মধুতর তান।’
বসন্ত বিলাপে কবি আরো বলেছেন-
‘বাঁশিতে বাজায় সে বিধুর
পরজ বসন্তের সুর
পাণ্ডু কপোলে জাগে রঙ নব অনুরাগে
রাঙা হ’ল ধূসর দিগন্ত।’
শুধু কবিতায় থেমে থাকেন নি প্রিয় কবি নজরুল। নজরুলের গানে বসন্ত বার বার উঠে এসেছে -
(১)
‘ফুল রেণু মাখা দক্ষিণা বায়
বাতাস করিছে বন-বালায়’
(২)
‘বসন্ত এলো এলো এলোরে
পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহুরে
মুহু মুহু কুহু কুহু তানে
মাধবী নিকুঞ্জে পুঞ্জে পুঞ্জে
ভ্রমর গুঞ্জে গুঞ্জে গুনগুন গানে’
(৩)
"আসিবে তুমি জানি প্রিয়
আনন্দে বনে বসন্ত এলো
ভুবন হল সরসা, প্রিয়-দরশা, মনোহর।"
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের কাছে বসন্ত বিদ্রোহের প্রতিমূর্তি, প্রেরণাদাত্রী।তার ভাষায়-'এলো খুনমাখা তৃণ নিয়ে খুনেরা ফাগুন’। প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে আমরা বসন্তের মাঝে হারিয়ে যেতে চাই, জীবনকে প্রকৃতির রং, রূপ ও গন্ধে মাতিয়ে নিতে চাই। বসন্ত রং এ পৃথিবীকে ভালোবাসতে চাই, সুন্দর পৃথিবী চাই। সকলকে বসন্তের শুভেচ্ছা জানাই। কবি গুরুর গান দিয়েই বসন্তের কাছে প্রত্যাশা দিয়ে শেষ করলাম--
'রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে--
তোমার আপন রাগে,
তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে
অশ্রুজলের করুণ রাগে॥
রঙ যেন মোর মর্মে লাগে,
আমার সকল কর্মে লাগে,
সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে,
গভীর রাতের জাগায় লাগে॥
যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে,
রক্তে তোমার চরণ-দোলা লাগিয়ে দিয়ে।
আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে,
পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে,
মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,
বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে,
তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও
যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,
কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে॥"