somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রেমিক নজরুলের সাতকাহন ~ফজিলতুন্নেসা পর্ব-৩~

০২ রা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নার্গিস পর্ব || প্রমীলা পর্ব-১|| প্রমীলা পর্ব-২ ||
প্রমীলা পর্ব-৩ || ফজিলতুন্নেসা পর্ব-১ ||
ফজিলতুন্নেসা পর্ব-২


ফজিলতুন্নেসার হৃদয় জয় করতে ব্যর্থ নজরুল কলকাতা ফিরে আসেন কলকাতায় তার কৃষ্ণনগরের বাসায়, যেখানে তার পরিবার থাকত। পৌছে নজরুল কাজী মোতাহার হোসেনকে মোট ৭টি এবং ফজিলাতুন্নসাকে একটি চিঠি পাঠান। এই ৮ টি চিঠি ১৯২৮ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মাঝে লেখা । চিঠিগুলো কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত ছিল পরে এগুলো সংগ্রহ করে সৈয়দ আলী আশরাফ তার ‘নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়’ গ্রন্থে সংকলন করেন।


প্রথম চিঠিটি ১৯২৮ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতা ফিরবার পথে স্টীমারে বসে লেখা। এই চিঠি কবি ফজিলতুন্নেসাকেও দেখাবার অনুরোধ করেন। নজরুলের চিঠি গুলো মূলত কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে ফজিলতুন্নেসার কাছেই লেখা ছিল। শেষ পর্যন্ত নজরুলের একটি চিঠির উত্তর দেন ফজিলতুন্নেসা। এই চিঠিতে ফজিলতুন্নেসা নজরুলকে আর চিঠি না লিখবার অনুরোধ করেন। উত্তরে নজরুল কাজী মোতাহার হোসেনকে জানান, তিনি আর চিঠি লিখবেন না। কিন্তু সেই কথা রাখা নজরুলের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তিনি ফজিলতুন্নেসাকে তারপরও চিঠি লিখে গেছেন।


ফজিলতুন্নেসা ‘সাওগাত’-এর জন্য একটি গল্প লিখেছিলেন –‘শুধু দু’দিনের দেখা’। সম্পাদক সেটা নজরুলকে দেখতে দেন। নজরুল সেখানে কিছু পরিবর্তন করার অনুমতি ও তার ‘সঞ্চিতা’-ফজিলতুন্নেসাকে উৎসর্গ করবার অনুমতি চেয়ে চিঠি লেখেন। ফজিলতুন্নেসা সেগুলোরও কোন উত্তর কখনই দেননি, বরং তিনি সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন সাহেবক চিঠি লিখে অনুরোধ করেন, ‘আমার গল্পটি যেমন আছে তেমনই ছাপালে সুখী হব’। এই ঘটনায় কবি আঘাত পান এবং ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন। এই আঘাত পেয়েও কবির ফজিলতুন্নেসাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না। তিনি কাজী মোতাহার হোসেনকে উল্লেখ করে আরো তিনটি চিঠি লিখেন।


ফজিলতুন্নেসার প্রতি নজরুলের অনুরাগের কোন খবর অন্যরা জানত না, শুধু কাজী মোতাহার হোসেন ছাড়া। নজরুলের কাছে কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে যেই চিঠি গুলো আসত তা তিনি পড়েই ফেলে দিতেন, অন্যদিকে কাজী মোতাহার হোসেন ব্যাপারটি এমন ভাবে গোপন রাখেন যেন প্রমীলা বা তার পরিবার এই সম্পর্কে জানতে না পারেন। নজরুলের ফজিলতুন্নেসার প্রতি মনোভাবের সামান্য আঁচ পান সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন। এই ব্যাপারে নাসিরউদ্দীন লেখেন,

“একদিন গভীর রাতে সওগাত অফিসে বস ঢাকায় মিস্‌ ফজিলাতুন্নেসার কাছে একখানা পত্র লিখবার সময় আমার কাছে তিনি ধরা পড়ে যান। তিনি জানালেন, ‘ও কিছু নয়, ফজিলতুন্নেসা আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন অনেক দিন আগে, তারই একটা উত্তর দিলাম’। চিঠির কতক অংশ আমি দেখেছিলাম। বললাম, ‘এত বড় চিঠি, আর তাতে এই উচ্ছ্বাসঃ এত সাধারণ চিঠি নয়’। কবি বললেন, আমি এমনি করেই লিখি, যান শোন গে, রাত প্রায় একটা বাজে। আমিও শুয়ে পড়ি। তিনি এমনি করে চিঠি লেখেন বলাতে আমি এ বিষয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলাম না বা এতে কোন গুরুত্ব দিলাম না”।

১৯২৮ সালেই ফজিলতুন্নেসা উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেত যান। তার আগে তিনি কিছুদিন কলকাতায় সওগাতের বাড়িতে নাসিরউদ্দীন সাহেবের পরিবারের সাথেই থাকেন। সেখানে নজরুলের উপস্থিতি নিত্য নৈমত্ত্বিক ব্যাপার ছিল। নাসিরউদ্দীন সাহেব লেখেন,

“আমি, ফজিলতুন্নেসা ও নজরুল একই ঘরে বসে কথা বার্তা বলেছি, কিন্তু নজরুল ও ফজিলতুন্নেসা একত সংযত ভাবে কথা বলতেন যে, তাদের মধ্যে পূর্বে ঘটিত এতসব ঘটনার আদৌ কোন আভাষ পাওয়া যেত না। ফজিলতুন্নেসা বাইরে কোথাও গেলে প্রায়ই আমাকে সঙ্গে নিতেন, কিন্তু নজরুলের সাথে কখনো বেড়াতে বের হননি। মনে হত, তাদের মধ্যে সাধারন পরিচয়ের অতিরিক্ত আর কোন সম্পর্ক ছিল না”।
ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলক্ষে ‘সওগাত’ কার্যালয়ে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গণ্যমান্য অতিথিবর্গ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগন এতে উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত না থেকে কবি ভেতরের ঘরে চুপ করে বসে থাকেন। অনুষ্ঠানের শেষে সভাস্থলে এসে তিনি ফজিলতুন্নেসার উদ্দেশ্যে নিচের গানটি পরিবেশন করেন,

‘জাগিলে পারুল কিগো ‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে,
উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে।।
চলিলে সাগর ঘু’রে
অলকার মায়ার পুরে,
ফোটে ফুল নিত্য যেথায়
জীবনের ফুল্ল-শাখে।।
আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা,
জাগিছে বন্দিনীরা, টুট ঐ বন্ধ কারা।
থেকো না স্বর্গে ভুলে,
এ পারের মর্ত্য কূলে,
ভিড়ায়ো সোনার তরী
আবার এই নদীর বাঁকে।।




একই উপলক্ষে কবিতার ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতাও রচনা করেন। বর্ষা বিদায় কবিতা সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেন,
‘তার বিখ্যাত প্রেমের কবিতাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। কিন্তু কবিতাটি এমন নৈব্যক্তিকভাবে লেখা যে অধিকাংশ পাঠকের পক্ষে এর ব্যঙ্গারথ কিংবা রূপকের রহস্য ভেদ করা কঠিন। তার শুধু দেখবেন প্রকৃতি কিভাবে বর্ষা ঋতু থেকে শীত ঋতুতে রূপ পরিবর্তন করছে। অথবা অন্য ভাবে বলা যায় যে, তিনি তার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে চেতনাশ্রিত কল্পনায় এমন ভাবে জারিত করে নিয়েছিলেন যা থেকে তিনি মুক্তার মত এমন কতকগুলো কবিতা রচনা করেন যা তার অনুভূতিকে বিনয় চারিত্র্য দান করেছে’।

বিলেতে গিয়ে ফজিলতুন্নেসা তার জীবনসঙ্গীও নির্বাচন করেন এবং দেশে ফেরার পর তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বিয়ের খবর শুনে নজরুল নিচের গানটি রচনা করেন।

বাদল বায়ে মোর
নিভিয়া গেছে বাতি।
তোমার ঘরে আজ
উৎসবের রাতি।।
তোমার আছে হাসি,
আমার আঁখি-জল
তোমার আছে চাঁদ,
আমার মেঘ-দল,
তোমার আছে ঘর,
ঝড় আমার সাথী।।


শুন্য করি’ মোর
মনের বন ভূমি
সেজেছ সেই ফুলে
রানীর সাজে তুমি।
নব বাসর ঘরে
যাও সে সাজ প’রে,
ঘুমাতে দাও মোরে
কাঁটার শেজ্‌ পাতি।



ফজিলতুন্নেসা পর্বের এখানেই ইতি। এ সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন,

‘ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়। সমান্তরাল আর একটি স্তবকে লক্ষ্য করা যায় কবিত তার আকাঙ্খিত প্রেমকে সুন্দরতর আর এক জগতে খুঁজে ফিরেছেন যেখানে প্রেমে কোন নৈরাশ্য নেই, কোন বেদনা নেই। প্রেমের জন্য নারীর কাছ থেকে তিনি চেয়েছিলেন পূর্ণ আত্মসমর্পন কিন্তু কোথাও তিনি তা পান নি। ফলে ধীরে ধীরে তিনি খোদা ফ্রেমের দিকে ঝুঁকে পড়লেন’। পার্থিব প্রেমকে বিদায় দিয়ে নজরুল লেখেন,

পরজনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও।।
এ জনমে যাহা বলা হ’ল না,
আমি বলিব না, তুমিও বলো না।
জানাইলে প্রেম করিও ছলনা,
যদি আসি ফিরে, বেদনা দিও।।


হেথায় নিমেষে স্বপন ফুরায়
রাতের কুসুম প্রাতে ঝরে যায়,
ভালো না বাসিতে হৃদয় শুকায়,
বিষ-জ্বালা-ভরা হেথা অমিয়।।


হেথা হিয়া উঠে বিরহে আকুলি,
মিলনে হারাই দু’দিনেতে ভুলি,
হৃদয়ে যথায় প্রেম না শুকায়-

সেই অমরায় মোরে স্মরিও।



সূত্র:

১। নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম, ড. আবুল আজাদ

২। স্মৃতিকথা প্রবন্ধ সংকলন, কাজী মোতাহার হোসেন। 'আমার বন্ধু নজরুল ও তার গান'।


শেষ পর্বের জন্য ক্লিক করুন






পোস্টের সাথে সম্পর্কহীন মন্তব্য এখানে করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৩৯
১৯টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×