স্কুলে পড়ার সময় বাবার সাথে মাঝে মাঝে বইমেলায় যাওয়া হয়েছে। তখন আমি বই দেখতাম, বাবা নিজের পছন্দে বই কিনে দিত। বেশির ভাগ জীবনী বা নামি দামি উপন্যাস; উদ্দেশ্য চরিত্র গঠন। ২০০২ সালের বইমেলাটা আমার জন্য অন্যরকম ছিল। সেবার বইমেলায় গিয়েছিলাম প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে। বইমেলাটাকে খুব আপন মনে হচ্ছিল সেদিন। এরপর সব কটি বছর বইমেলা আমার বিভাগের পাশেই হত। অনেকেই ঘটা করে বইমেলায় যায় আর আমি হাটতে হাটতে একটু একটু করে প্রতিদিনই বইমেলায় ঘুরে আসতাম। যেমন ঘোরাঘুরি করা হয় নিজের বাসায় এই রুম সেই রুমে। বই কেনা হয় প্রতিবারই্ তবে ছাত্র জীবনে পকেটের হিসেব রাখাটা জরুরি ছিল। অপেক্ষায় রইতাম কবে চাকরিতে ঢুকব আর ইচ্ছা মত বই কিনব। এবার এল সেই সুযোগ, তবে এখন সময় সীমিত। অতিব্যস্ততায় বই মেলায় মাত্র একবার অল্প সময়ের জন্য যাওয়া হয়েছে। তবে এবারের ফেব্রুয়ারির আমেজ গত বছর গুলোর থেকে আলাদা। প্রথমেই একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা কয়েক বন্ধু মিলে গেলাম বই মেলায়। অল্প ঘুরে মেলার বাইরে রাস্তার আইল্যান্ডে বসে বাদাম খাচ্ছিলাম। তখন এক মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি একটা পোস্টার নিয়ে এলেন। লোকটা অনুমতি নিয়ে কথা বলা শুরু করল। সে বলে, তারা ভাষা শহীদদের ছবি সম্বলিত একটা পোস্টার বার করেছে। এটা আলাদা এই দিক দিয়ে যে তাদের পোস্টারে সালাম ভাইয়ের (!) ছবি আছে। সালাম ভাইয়ের কোন ছবি নাকি আগে পাওয়া যায়নি। ঐ লোকের কম্পানি নাকি সালাম ভাইয়ের দুইভাইয়ের ছবি জোগার করে সালাম ভাইয়ের সম্ভাব্য ছবি তৈরি করেছে কম্পিউটারে। দাম মাত্র বিশ টাকা, বিশ টাকা, বিশ টাকা। আমরা বললাম না নিব না। লোকটা একটু অনুরোধ করে চলে গেল। আমরাও বাদাম চিবাতে মন দিলাম। হঠাৎ আমরা থমকে গেলাম, আরে সালাম ভাই মানে? এমন ভাবে বলছিল যেন, এলাকার পোলা সালাম ভাইয়ের ছবি। তার উচ্চারণে কোন শ্রদ্ধা ছিল না। সে বলতে পারত, শহীদ সালামের ছবি। লোকটারে একটা থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা হল। খুজলাম কিন্তু শত মানুষের ভীড়ে আর হদিস পাওয়া গেল না। ব্যবসা করার জন্য মানুষ কত ধান্ধাই না করে থাকে। নিজেরা এই ব্যাপারে কথা বলতে বলতে ফিরে এলাম।
টিভি তেমন একটা দেখি না এখন। তাই খবর বা বিজ্ঞাপনও দেখা হয় না। খবররের কাগজের বিজ্ঞাপনগুলো অনেক আগে থেকেই এড়িয়ে চলি। দুই তিনদিন আগে এক বান্ধবির বিয়েতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠির সাথে দেখা। সে বলে, ২১ তারিখের র্যা লিতে যোগ দিতে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিসের র্যা লি? সে বলে বাহান্নর একুশে ফ্রেব্রুয়ারির আন্দোলনের বিখ্যাত আমতলায় গ্রামীন প্রথমালো ত্রিশ মিনিটের র্যা লি আয়োজন করছে। আরো কিছু চেতনা সম্বলিত বাক্য সহপাঠির মুখে শুনলাম। একটু অবাক হয়েও আবার বাস্তবে ফিরে এলাম। অবাক এই জন্য যে, এই সহপাঠির মুখে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ শব্দগুলো একটু বেমানান। শিবিরের ছেলেদের সাথে উঠাবসা, আলোচনায় বাঙালির বিভিন্ন অর্জনকে কটাক্ষ করা এই ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে বুঝতে পারে ক্ষমতায় লীগ আসবে। অতি নিপুনতায় আওয়ামী পন্থি শিক্ষক ও এক ছাত্রদল হতে আগত ছাত্রলীগ সহপাঠির ল্যাঞ্জা ধরে এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়। অতএব, তার মুখে এসব এখন শুনতেই হবে। যাইহোক, ফিরে এসে খবরটা ভাল ভাবে শুনলাম। গ্রামীন ফোন, প্রথমালো ইত্যাদি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপনের পণ্য হিসেবে এবার ভাষা আন্দোলনকে বেছে নিয়েছে। ভাবতে ভালই লাগে বাঙ্গালির ব্যবসায়িক দৃষ্টি দিন দিন উন্নত হচ্ছে। আর যাই হোক এই বুদ্ধি নিশ্চয়ই কোন না কোন বাঙ্গালি মার্কেটিং কর্মকর্তার মাথা থেকেই এসেছে। তবে ভাবতে দুঃখ লাগে তাদের সহযোগী হলেন তিনজন ভাষা সৈনিক। জানি না ভাষার প্রতি কি আবেদন তারা এই নাটকে খুজে পেলেন। কত কিছুই না দেখলাম আমাদের পথ পদর্শকদের কাছ থেকে। জীবন সায়াহ্নে সারা জীবনের কর্মকান্ডের উপর কর্পোরেটের ধুলা ছড়ানো কতটা জরুরি ছিল তা তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন। তবে, এই একটি ঘটনার দায়ভার তাদের ঘাড়ে চাপানো উচিত হবে না। আমরা হয়ত জানি না, কিন্তু পেছনে আছে নিশ্চয়ই কোন না কোন মীর জাফরের প্যাচ। গ্রামীন, প্রথমালোর সেই দালালরা হয়ত ভাষা সৈনিকদের অজান্তেই তাদের চেতনা বিক্রি করে দিয়েছে। হতাশা থেকে যে যায় যে, আমাদের গর্বের মানুষগুলো এখনও মীর জাফরদের চিনতে শিখল না। মুজিব-জিয়া বলি আর মতিন-রফিক-বাচ্চু বলি কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিল না। আরো কত কিছু দেখব জানি না। হয়ত এবার আসবে, “রক্তাক্ত নয় মাস”। শ্লোগান হবে, “চেতনা দেখান গ্রামীন ফোনে কথা বলুন নয় মাস”।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:৩৪