সামনের দিকে হেঁটে চলেছি বেশ অনেকটা সময় ধরে। সকাল হবার অপেক্ষা করতে করতে রাতটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হচ্ছে। ভোরের দেখা পাওয়াটা একেবারেই অসম্ভব মনে হচ্ছে এই বর্তমানে দাড়িয়ে।
প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। গরমের এই রাতেও শীত যেন জেঁকে বসেছে আমার জন্যে। এদিকটাতে কোন মানুষজন তো দূরে থাক একটা কুকুরকেও দেখা যাচ্ছে না। মানুষজন..... হাহ, তাহলে ঐগুলি কি ছিল? কোন পশুও তো এভাবে আক্রমণ করে রাস্তায় ছেড়ে দেয় না। হয় ভক্ষণ করে নয়তো ছিঁড়ে ছুড়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তবে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে ঐ গুলিরও মানুষের মত হাত-পা, নাক-মুখ, মাথা সব আছে। শুধু মনুষ্যত্বের বোধটা ওদের ভেতরে নেই।
আজকে অফিস করে একটু লেট হয়ে গিয়েছিল। সাথে গতমাসের বেতনের টাকাটা ছিল। সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল আমার জন্যে। রহমত মিয়ার কিছু বাকি টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। পথে রিকশা থাকলেও পয়সার মায়া করে তাতে চড়া হয়নি। পয়সার মায়া....হাহ, কত শত প্রয়োজন, ইচ্ছে আর স্বপ্ন। কিন্তু সামর্থ্য সেই অর্ধেক হাতের মত। না এগুতে পারে না পারে পিছাতে। অথচ স্বপ্নেরা হাতছানি দিতে ভুল করে না। ঈদে এবার মা'কে কিছু বেশি টাকা পাঠানোর ইচ্ছে ছিল। সে বোধয় আর হল না.....
গলির ঐ মোড় পেরুলেই মেসে যাবার রাস্তাটা পড়ে। উল্টো দিক দিয়ে গেলে আরও বেশ কিছু পথ হাটতে হয়। শর্টকাট নিলাম তাই গলিটা ধরেই। ব্যাস, আর যাই কোথায়। গলির মাঝামাঝি পৌছতেই পেছন থেকে ডাক দিল "ভাইজান দাঁড়ান" বলে। ব্যাপারটা তখনই বুঝে গিয়েছিলাম। নাহ, ঝেড়ে দৌড় দেই নি। দিয়ে লাভ হবে না। কারণ ততক্ষণে সামনে থেকেও ৩টা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছিল। আমি মুখ ঘুরে দাঁড়ালাম। লোকটা ঠাণ্ডা ভাবে বলতে শুরু করলো-
- ভাই, সাথে যা আছে সব দিয়ে দেন। অযথা গ্যাঞ্জাম আমার ভালো লাগে না।
- ভাই, তেমন কিছুই নেই। মানিব্যাগ আর মোবাইলটা আছে। নিয়ে নিতে পারেন।
- মানিব্যাগে এখন আর কেউ টাকা রাখে না। পকেটের খামটা বের করেন। ঐটা দিয়ে চুপচাপ হাইট্টা চইলা যান।
- ভাই, আমার কাছে কোন খাম-টাম নেই। আপনারা ভুল করছেন।
- দেখেন ভাই, ভুল আমরা করতেছি না। ভুল করতেছেন আপনে। হুদাই গ্যাঞ্জাম লাগাইতেছেন। আমি ভালো করে বলতেছি আপনার কাছে সেইটা ভালো লাগতেছে না। পরে কিন্তু পস্তাইবেন।
- ভাই আপনার ভুল হচ্ছে...
- ঐ! সাইজে ল তো। ব্যাটা ইতরামি শুরু করছে।
এরপর হুট করেই বেল্টের একটু উপরে এটা পোঁচ বুঝতে পারলাম। তীব্র জ্বলুনি শুরু হল সাথে সাথেই। অজান্তেই হাত দুটি চলে গেলো সেখানে। চোখ পানিতে ছল ছল করছে। কিন্তু আশ্চর্য নিজের উপরেই, মুখে কোন শব্দ করতে পারছি না বলে। ওরা নিজেরাই পকেট ঘেঁটে খামটা বের করে নিলো। তারপর বলল-
- শুধু শুধুই পোঁচটা খাইলেন। আগে দিয়া দিলে কি আর পোঁচটা খাইতে হইত?
বলা শেষ হবার আগেই পেছন থেকে অন্যজন-
- কাউরে কিছু কইতে যাইয়ো না, নাইলে পরের পোঁচটা আর সাইডে দিমু না। একেবারেই পুরোটা নামাইয়্যা দিমু। ঐ চল।
এই বলেই পেছন থেকে আরেকটা লাথি দিয়ে রাস্তার উপর ফেলে চলতে শুরু করল। আমি উঠে কিছুক্ষণ ওরা যেদিকে গিয়েছে সেদিকে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গলি পেরুতে পেরুতেই হারিয়ে ফেললাম ওদের। কেউ নেই এদিকে।
হসপিটালের দিকে যাওয়া যায়। কিন্তু গেলেই বলবে পুলিশ কেস। আর পুলিশ আসলেই হাজার রকমের প্রশ্ন। অপরিচিত এই ঢাকা এই কয়েক বছরেও পরিচয় দেবার মত কোন পরিচিতি তৈরি করতে পারেনি। তাই একাই এই রাস্তা ধরে হাঁটছি। সকাল হলে কোন একটা ডিসপেনসারিতে কিছু টাকা দিয়ে একটা সেলাই নিতে পারলেই এ যাত্রায় মুক্তি।
কিন্তু ঐ সকালটার দেখা পাবো বলে তো মনে হচ্ছে না.......
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৪ সকাল ১১:২৫