somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুমন ও তার বাবার গল্প

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুমন তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে । স্পষ্টই বুঝতেই পারছে তার বাবা বেশ উত্তজিত ! আনন্দ মাখা উত্তেজনা ! এই ছোট্ট বয়সেও বাবার আনন্দ দেখে সুমনের ভাল লাগছে !
-দেখো দেখো ! স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নেই !
সুমনের বয়স মাত্র সাত বছর ! এরই ভিতর সে স্বাধীনতা কথাটার মানে বেশ ভাল ভাবেই বুঝে গেছে !
স্বাধীন দেশ মানে নিজেদের একটা দেশ ! কারো অধীন না ! একেবারে নিজেদের আপন একটা মাতৃভূমি !

সুমনের বাবা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আবার বললেন
-আর কেউ বাধা দিতে পারবে না । ২৪ ঘন্টার ভিতরে আমরা স্বাধীন হয়ে যাবো !
অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভেতরে দারুণ এক তোলপাড় হচ্ছে ! কিছুতেই তিনি নিজের এই উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না ! অবশ্য খুব একটা চাইছেনও না ! কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে যে মুক্ত হতে যাচ্ছে দেশ। অনেক রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে মুক্ত হতে যাচ্ছে দেশ !


-আপনি এখনও দাড়িয়ে ?
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী পেছন ঘুরে দেখলেন তার স্ত্রী তাহমিনা !
-আরে তুমিও এসো ! দেখে যাও সোনার ছেলেরা কি করে ফেলেছে ! দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে !
স্বামীর উত্তেজনা দেখে তাহমিনার বেশ ভাল লাগলো ! খুশি হলে মানুষটা কেমন বাচ্চাদের মত আনন্দ প্রকাশ করে ! দেখতে ভাল লাগে !
তাহমিনা বলল
-সারাদিন বারান্দায় দাড়ালে চলবে ? এবার খওয়ার সময় হয়েছে ! টেবিলে ভাত দেওয়া হয়েছে !
-আমি তো গোসল করি নি এখনও !
-আচ্ছা ! আগে গোছল করে নিন ! আপনার গোসলের পানি ও কাপড়চোপড় সব প্রস্তুত।
তারপর সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল
-যাও সুমন ঘরে যাও ! বাবা এখন গোসলে যাবে !



দরজা খুলেই লুত্‍ফুল হায়দার চৌধুরী একটু অবাক হলেন ! একটু ভয়ও পেলেন মনে মনে । কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলেন না ! যথা সম্ভব গম্ভীর গলায় বললেন
-কাকে চাই ?
তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই নাক পর্যন্ত কাপড় দিয়ে ঢাকা কতগুলো লোক হাতের রাইফেল উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। লুত্‍ফুল হায়দার চৌধুরীর মনের ভয়টা আরো খানিকটা বেড়ে গেলে ! বারবার একটা প্রশ্নই মনে জাগছিল এরা কারা ?
এরা কি চায় ?
হঠাৎ তাদের ভিতর একজন বলে উঠলো
-স্যার কি বাসায় আছেন ?
যা ভয় করছিলেন শেষে তাই হল ! কদিন থেকে লুত্‍ফুল হায়দার চৌধুরীর বড় ভাই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তার এই শান্তিবাগের বাসায় এসে উঠেছে স্ত্রী পুত্র নিয়ে !
এই লোক গুলো তাহলে বড় ভাইকে খুজতেছে !
কেন ?
উনি তো কোন দোষ করেন নাই !
লুত্‍ফুল হায়দার চৌধুরী বললেন
-কেন ? ওনাকে কেন দরকার ?
আগের জনই বলল
-আমাদের কমান্ডার গাড়িতে বসে আছেন। উনি স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলবেন !
লুতফর হায়দার একবার ভাবলেন বলেন যে তার বড় ভাই বাসায় নেই ! কিন্তু সেই কথা বলতে পারলেন না !

হইচই শুনে তার বড় ভাই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বেরিয়ে এসেছেন !
সে নিজেই লোক গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল
-আমাকে কি দরকার ?

তখনই লোক গুলোর ভিতর থেকে আরেকজন এগিয়ে এসে বলল
-স্যার আমি মুঈনুদ্দীন ! আপনার ছাত্র ! আপনি একটু আমাদের সাথে আসবেন দয়াকরে !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী গম্ভীর গলায় বলল
-কেন ? আমাকে কি দরকার ?
মুইনুদ্দীন আবার বলল
-আমাদের কমান্ডার আপনার সাথে একটু কথা বলবেন ! একটু দরকার ছিল ! আপনি কোন চিন্তা করবেন না ! আমি নিজে আপনাকে আবার এখানে রেখে যাবো !
ততক্ষনে বাড়ির সবার বারান্দার বাড়ির সামনে চলে এসেছে ! তাহমিনা সহ বাড়ীর সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে !

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বললেন
-আচ্ছা চল !
আরপর তাহমিনার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি এখুনি আসছি ! চিন্তা কর না ! আমি তো কোন দোষ করি নি ! আমার কিছু হবে না !

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বন্দুক ধারীদের সাথে বের হতে যাচ্ছিলেন তখন তাহমিনা তাদের সামনে এসে দাড়ালো । তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল
-আমার স্বামীকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? উনি এখনো গোসল করেননি, ভাত খাননি।
মঈনুদ্দীন আবার বলল
-ভাবী আপনি চিন্তা করবেন না । স্যারকে আমি কিছু হতে দিবো না !


মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বাইরে রাস্তায় দাঁড়ানো কাদামাখা মাইক্রোবাসটায় গিয়ে উঠলেন। এগিয়ে গেলেন তাহমিনা ও লুত্‍ফুল হায়দার।
বাসের কাছে গিয়ে তাহমিনা বলল
-উনাকে যেখানে নিয়ে যাবেন, আমরাও সেখানে যাব।
রাইফেলধারী লোকগুলো তা শুনে খানিকটা বিরক্ত হল ! মুঈনুদ্দীন বলল
-তার আর দরকার নেই। উনি এখনই চলে আসবেন।
আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে চলে গেল তারা।


মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী মনে তখন চিন্তার ঝড় চলছে ! মাইক্রোবাসটা চলছে কোনদিকে ঠিক তিনি বুঝতে পারছেন না ! এদিক ওদিক তাকাতে যাবেন তখন লোকগুলোর একজন তার চোখ বেধে দিল !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ইশারায় তাকে কোন কথা বলতে মানা করলো ! চোখ বাঁধা অবস্থায় কেবল তার প্রিয় পুত্র সুমন আর তাহমিনার কথা মনে হচ্ছিল ! মনে হচ্ছিল এ জীবনে হয় তো কোন দিন তাদের কে দেখতে পাবেন না !


মাইক্রোবাস কতক্ষন চলার পরে একটা জায়গায় এসে থামলো ! মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে হাত ধরে নামানো হল বাস থেকে ! তারপর তাকে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল বড় একটা ঘরের ভিতর !


মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী যখন চোখ খুলে দেওয়া হল তখন তাকে একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে ! তিনি চারিপাশে তাকিয়ে দেখেন সেই বিশাল বদ্ধ ঘরে তার আর কিছু পরিচিত লোকজন রয়েছে ! তাদের ভিতর অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীসহ সমমনা আরও অনেকে । যাঁদের প্রত্যেকের গায়েই পড়েছিল নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। ছেঁড়া জামাকাপড় রক্তে মাখামাখি, এমনকি উপড়ে ফেলা হয়েছিল কারও কারও চোখ !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কিছুই বুঝতে পারছিলেন না ! তবে একটা ব্যাপার ঠিকই আঁচ করতে পারছিলেন !

এভাবে কতটা সময় পার হয়েছে কেউ বলতে পারছিলেন না । একটা সময় লোহার রড হাতে অন্ধকার ঘরটাতে কিছু যুবক প্রবেশ করলো । প্রথমে তারা মুনীর চৌধুরীর মুখোমুখি হল । বলল
-ছাত্রদের তো অনেক কিছু শিখিয়েছেন। আজ আমরা আপনাকে কিছু শিক্ষা দেব। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনি কয়টা বই লিখেছেন?
মুনীর চৌধুরী দুদিকে মাথা নেড়ে বলেলেন তিনি লেখেননি।
তারপর লোক গুলো মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কাছেও একই প্রশ্ন করলো !
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বলেলেন
-হ্যাঁ, আমি লিখেছি।
এ কথা শুনেই লোকগুলোর ভিতরে একজন লোহার রড দিয়ে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী মাথায় জোরে একটা আঘাত করলেন !
প্রতম আঘাত খেয়েই তিনি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লো ! গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করলো !
তারপর আবার এল আঘাত ! মাথা বরাবরই ! দুই আঘাতেই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর চেতনা লোপ পেল ! কিন্তু আঘাত থামলো না ! প্রচন্ড আক্রসে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর উপরে আঘাত চলতেই থাকলো !!


>>>>
(তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, গুনিজন)

৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×