বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে ! সেই কখন থেকে এক টানা ! তাকিয়ে থাকলে কেবল তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে । ফারিয়া সব কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে কেবল কাঁচের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে ! বারবার মনে হচ্ছে ইস এখন যদি ইফতেখার সাথে থাকতো, তাহলে ওর হাত ধরে বৃষ্টিতে ভেজা যেত !
এমন একটা বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ফারিয়া কতদিন ধরে অপেক্ষায় আছে !
একবার কি ফোন দিবে ইফতেখার কে ?
ফারিয়া নিজের কাছে যেন প্রশ্নটা জানতে চাইলো ।
নাহ ! থাক !
ও এখন লেকচারে ব্যস্ত ! ক্লাস নিচ্ছে মনে হয় ! এই সময় ফোন দিলে বিরক্ত হবে !
ফারিয়া আবারও বৃষ্টি দিকে মনযোগ দিলো ! এখনও বৃষ্টি এক ভাবেই পড়ছে ! কাঁচের জানালা দিয়ে দুরের ভেজা রাস্তা দেখা যাচ্ছে । রাস্তা প্রায় ফাঁকা । তবুও একটু পরপর ভুসভাস করে ছুটে চলছে গাড়ি । পথে দু একটা রিক্সাও দেখা যাচ্ছে পলিথিন পেঁচিয়ে ছুটে চলছে !
আজকে কি থামবে না বৃষ্টি ?
এমন সময় কেবিনের দরজার নক পড়লো ! তাকিয়ে দেখে সুমন দাড়িয়ে রয়েছে !
-ব্যস্ত ?
-নাহ !
-ক্যান্টিনে যাবেন ? এক কাপ চা কি খাওয়া যায় আমার সাথে ?
সুমনে কন্ঠে সব সময়ই কেমন একটা অন্য রকম অনুরোধের আভাস পায় ফারিয়া ! এমন ভাবে সুমন অনুরোধ করে যেন খুব বড় কিছু সে চেয়ে বসেছে ।
ফারিয়া বলল
-হ্যা ! কেন না ! এমন বৃষ্টিতে কার কাজ করতে মন চায় বলুন ?
সুমন একটু হাসলো !
চায়ের কাপ সামনে নিয়ে দুজন বসলো ক্যান্টিনের একবারে কোনার দিকটাতে । বৃষ্টি বলে ওদের অফিসের অনেকেই ক্যান্টিনে এসে আড্ডা মারছে ! সুমনদের ক্যান্টিন টা একেবার ছাদের উপর ! পুরো ছাদ টার এক পাশে খোলা অন্যপাশে এই ক্যান্টিন ! যারা সিগারেট খায় তারা খোলা ছাদে গিয়ে সিগারেট খায় ! ছাদে কয়েকটা ছাউনিও লাগানো আছে সবার জন্য ! সুমনকে একভাবে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখে ফারিয়া বলল
-আপনার বৃষ্টি অনেক পছন্দ ?
-বলতে পারেন । যখন আগে গ্রামে থাকতাম তখন প্রত্যেক বৃষ্টির দিন ভিজতামই ভিজতাম !
-এখন ?
-এখনও সুযোগ পেলে ভিজি ! আজকেও ভিজতে ইচ্ছে করছে খুব !
তারপর একটু নিরবতা দিয়ে সুমন বলল
-আপনার সাথে বৃষ্টি ভেজার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের !
এই কথা টা বলেই সুমন ফারিয়ার দিকে তাকালো ! ফারিয়ার বুক টা হঠাৎ করে কেমন করে উঠলো ।
ছেলেটা এমন করে কেন তাকায় ?
সব কিছু জানার পরেও কেন ছেলেটা এমন করে তাকায় ?
চাকরীর প্রথম দিক থেকেই ফারিয়া ব্যাপার টা কিছু একটা আঁচ ঠিকই করতে পেরেছিল ! মেয়েদের এমন একটা ক্ষমতা থাকেই । তবে খুব বেশি পাত্তা দেয় নি কোন দিন ! কলিগ এবং পাশাপাশি কাজ করার জন্য আসে পাশে প্রায়ই সুমনের সাথে কথা হত ! একদিন হঠাৎ করেই সুমন ওকে প্রোপোজ করে বসলো ! তবে ঠিক যেমন টা প্রোপোজ হয় ঠিক তেমন নয় ! সুমন কেবল নিজের ভাল লাগার কথা টাই ওকে বলেছিল !
ফারিয়া কেবল বলেছিল
-দেখুন আমার এক জনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ! বছর খানের ভিতরেই তার সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে !
-না না ! আমি কেবল আমার মনের কথাটা বলেছি ! আর কিছু না ! আমি জানি আপনার মনের মানুষ আছে ! তাতে কি হয়েছে বলুন ? আপনাকে পছন্দ করি এটা নিশ্চই কোন অপরাধ নয় ?
-তা ঠিক !
সুমন সেদিন হেসেছিল কেবল ! অদ্ভুদ সুন্দর হাসি !
সুমনের সাথে তারপর থেকেই যোগাযোগ বেড়ে যায় ! সুমন সব সময় স্বভাবিক আচরন করতো কিন্তু ফারিয়া সব সময় সুমনের চোখে একটা লুকানো কষ্ট লুকানো দেখতো !
ওকে না পাওয়ার কষ্ট ?
প্রথম প্রথম ফারিয়া ঠিক বুঝতে পারে নি ! কিন্তু দিন যাওয়ার সাথে সাথে বুঝতে শিখলো সুমনের চোখের লুকানো কষ্টের ভাষা ! ছেলেটার জন্য খানিকটা মায়াই লাগতো ! কিন্তু সুমন সব সময় স্বভাবিক থাকতো ! কোন দিন অন্য রকম কিছুই বলে নি কিংবা করে নি যা ফারিয়াকে বিব্রত করে !
আজ তাহলে হঠাৎ এমন কথা কেন বলল ?
ফারিয়া খানিকটা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো সুমনের দিকে !
সুমন খনিকটা অস্বস্তি নিয়ে বলল
-আসলে আমার জীবনে দুইটা ইচ্ছা আছে খুব বেশি ! অনেক দিনের ইচ্ছা আপনার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো ! পূরন করা কি সম্ভব ? যদি সম্ভব না হয় তাহলে অবশ্য কোন অভিযোগ নেই !
ফারিয়ার একবার মনে হল কঠিন করে কিছু বলে কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল ছেলেটা তো খুব বেশি অন্যায় কোন আবদার করে নি !
কি করবে ?
ভিজবে ?
ভিজতে পারে ! ওর নিজেরও খুব ভিজতে ইচ্ছে করছে !
ফারিয়া হঠাৎ বলল
-আচ্ছা চলুন !
সুমন অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বলল
-সত্যি ?
-হুম ! আমার সেই সকাল থেকে ভিজতে ইচ্ছে করছে ! চলুন !
ওরা যখন বৃষ্টিতে নেমে পড়লো অনেকে অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু দুজনে মনের সুখে ভিজতে লাগলো ! ওদের দেখা দেখি আরও কয়েকজন নেমে পড়লো ! বৃষ্টিতে ভেজার সারাটা সময় সুমন কেবল ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল অদ্ভুড চোখ !
সেই চোখে অদ্ভুদ একটা আনন্দ !
তারপর একটা সময় ফারিয়ার বিয়ের দিন ঘনিয়ে এল ! সুমন কে কিাভাবে বিয়ের কথাটা বলবে ফারিয়ে ঠিক বুঝতে পারছিল না ! খানিকটা অস্থির লাগছিল ওর । কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন সুমন অফিস থেকে গায়েব হয়ে গেল ! খোজ নিয়ে জানা গেল কাউকে কিছু না বলে বসের কাছে নাকি ও রিজাইন দিয়ে কোথায় চলে গেছে । কোথায় গেছে কেউ জানে না !
একদিক দিয়ে ফারিয়া একটু স্বস্তিই পেল মনে মনে ! ছেলেটা নিজ হাতে ওর বিয়ের কথাটা কিংবা বিয়ের কার্ড টা দিতে হবে না এই ভেবে ছিল ওর শান্তি টা লাগছিল !
তিন বছর পরের কথা !
বিকেল প্রায় শেষ ! সূর্য ডুবিডুবি করছে !
ফারিয়া কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে হাটছে আনমনে ! ওর মেজাজ টা একটু বিক্ষিপ্ত ! আজকে এখানে ও ইফতেখারের সাথে এসেছে অথচ ওর নাকি কি একটা সেমিনার আছে আজকে সময় দিতে পারবে না ! ফারিয়াকে এখন একা একা সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে হচ্ছে !
যতই ও আসে পাশের জুটিদের কে দেখছে ততই ওর মেজাজ টা গরম হচ্ছে ! এখন মনে হচ্ছে এখানে আসাটা ঠিক হয় নি । হোটেলে বসে থাকলেই ভাল হত !
বসার জন্য ফারিয়া একটা জায়গা খুজতে লাগলো ! সী বেঞ্চ গুলো সব ভর্তি ! হাটতে হাটতে বেশ দুরেই চলে এসেছে !
ঐ যে ফাঁকা একটা সী বেঞ্চ পাওয়া গেছে ! বসতে যাবে ঠিক তখনই ও সুমন কে দেখতে পেল ! ঠিক ওর সামনে দাড়িয়ে আছে !
ঠিক আগের মত চোখে চেয়ে আছে !
এই তিন বছরে ফারিয়া সুমনকে একটা বারের জন্যও দেখতে পায় নি । ঠিক কোথায় ও চলে গিয়েছিল ওর পরিচিত রাও ঠিক বলতে পারে নি ! ফারিয়া বিয়ের পরেও কদিন ওর খোজ খবর নিতে চেষ্টা করেছিল !
আজকে এখানে এভাবে দেখবে ভাবে নি !
-আপনি এখানে ?
-আমি এখানেই থাকি !
-তাই ? কোথায় ?
-এখানে একটা হোটেলে জব করি !
-তাই নাকি ? আপনার কত খোজ করেছি আপনি জানেন ? একেবারে গায়েব হয়ে গেলেন কেন ?
সুমন কিছুটা সময় ওর ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি জানেন কারন টা কি !
ফারিয়া চুপ করে গেল হঠাৎ কথা না পেয়ে ! সুমন বলল
-আসলে সেদিনের সেই মিষ্টি অভিজ্ঞতাটা আমার জন্য অনেক বড় কিছু ছিল ! তবে
-তবে ?
-আসলে আজকে আরেক টা চাওয়া পুরনের লোভে আবার আপনার কাছে আসলাম আবার !
-মানে কি ?
-আপনি গত তিন বছরে মোটা পাঁচবার এখানে এসেছেন, তাই না ?
ফারিয়া অবাক হয়ে বলল
-আপনি কিভাবে জানলেন ?
-আপনি আমার খোজ না পেলেও আমি ঠিকই আপনার খোজ খবর রাখি ! যাই হোক ! আজকে মনে হয় সেই সুযোগ টা এসেছে !
-কি সুযোগ ?
-আপনাকে সেদিন বলেছিলাম মনে আছে ?আমার দুইটা ইচ্ছা কথা যার একটা সেদিন পূরন হয়ে গেছে !
-অন্য টা কি ? আমার সাথে সমুদ্রের পাড়ে হাটা !
সুমন কেবল মাথা নাড়লো ! বলল
-সূর্য ডোবা দেখা ! আপনার হাত ধরে ! তবে হাত ধরতে হবে না ! কেবল আমার পাশাপাশি হাটলেই চলবে !
-যদি রাজি না হই ?
-আমার কিছুই করার নেই ! আমি কেবল অনুরোধ করতে পারি ! অধিকার খাটানোর কোন অধিকার আমার নেই !
-বিয়ে করেন নি ?
-কি মনে হয় ?
-করবেন না ?
কথা বলতে বলতে ফারিয়া হাটা শুরু করলো ! সুমনও ঠিক তার পাশে পাশে হাটতে লাগলো ! ফারিয়া অনেক দিন পর সুমনে চোখে আবারও সেই আনন্দ দেখতে পেল ! আশ্চার্য ছেলেটি এখনও ওকে ভালবাসে ! ঠিক আগের মতই !
এখনও মাঝে ফারিয়ার মনে একটা প্রশ্ন প্রায়ই ঘুরপাক খায় ! সেদিন যদি সুমনের ভালবাসায় সাড়া দিতো আজকে কি ওর জীবন টা অন্য রকম হত ?
ইফতেখার এমনিতে ভাল তবে ওর কাজ নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকে । ফারিয়ার দিকে তাকানোর তার সময় কোথায় ? অন্য দিকে একটা ছেলে যে জানে ফারিয়া কোন দিন তার হবে না তবুও তাকে ভালবাসে ! আসলেই আশ্চর্য মানুষের জীবন !
-কি হল জবাব দিলেন না ?
-জানি না ! কখনও ভাবি অন্য কাউকে বিয়ে করবো !
ফারিয়া আবারও সেই কষ্ট টা যেন দেখতে পেল সুমনের চোখ । সেই পুরানো কষ্ট !
কষ্ট গুলো বদলায় না । একই রকম রয়ে যায় ! একই রকম ভাবে পীড়া দেয় মানুষ কে !