রাতের বেলা লং ড্রাইভে যাওয়া তৃষার অন্যতম পছন্দের একটা কাজ । যদিও আমি রাতে ঘুমাতে বেশি পছন্দ করি কিন্তু সংসারে সুখ শান্তি বজায় রাখতে হলে বউয়ের কথা শুনতে হয় ! বউকে খুশি রাখতে হয় । তাই মাসে অন্তত একটা কি দুইটা দিন রাতে তৃষাকে নিয়ে বের হতে হয়। অবশ্য সময় যে খারাপ যে সেটা আমি মোটেও বলবো না । আজকেও সময় খারাপ যাচ্ছিলো না । আজকে আমরা এসেছিলাম মুন্সিগঞ্জের রাস্তায় । এদিক দিয়া মাঝে মধ্যে আমি আমার গ্রামের বাড়ি যাই । মাওয়া রাস্তা দিয়ে ডান দিকে গেলেই রাতের বেলা গাড়ি ঘোড়া চলে না বললেই চলে । একেবারে ফাঁকা পাওয়া যায় ।
এই লংড্রাইভে যাওয়ার আরও একটা চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে এই রাস্তায় তৃষার গলায় গান শুনতে পাওয়া যায় । এটা আমার জন্য খুবই আকর্ষনীয় একটা ব্যাপার । তাই সব কিছু বাদ দিয়ে আমি গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাই ওর সাথে । রাস্তাটা আরও একটু বেশি নির্জন হতেই তৃষা গান ধরলো । বাংলা গানের ভেতরে ও রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া আর কিছু শোনে না । রবীন্দ্র সংগীতই ধরলো ও । আমি আপন মনে সেটা শুনতে থাকলাম । চারিদিকে রাতের নিস্তব্ধতা । গাড়ি চলছে আপন মনে গতিতে সেই সাথে তৃষার গান ।
হঠাৎ করেই তৃষা গান থামিয়ে দিল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই ওটা কে ?
আমি কোন কিছু না বুঝেই ব্রেক করলাম । গাড়িটা আমি খুব বেশি জোড়ে চালাচ্ছিলাম না । তাই গাড়ি থামতে খুব বেশি ঝামেলা হল না ।
আমি এতোই মনযোগ দিয়ে গান শুনছিলাম যে ডান বায়ে খুব ভাল করে তাকাই নি । আর সামনে থেকে কোন গাড়ি আসলে তো হেড লাইট দেখবো তাই খুব একটা ভাল করে লক্ষ্যও করি নি । কিন্তু লক্ষ্য করলাম তৃষার কথা শুনে । তাকিয়ে দেখি আমাদের গাড়ি থেকে আরও হাত বিশেক দুরে একটা মেয়ে দাড়িয়ে রয়েছে । হাতে ছোট একটা ব্যাগ । পরনে মলিন পোশাক । হেড লাইটের আলোতে মেয়েটাকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। মেয়েটা আস্তে আস্তে হাটতে হাটতে আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে এল । এসে থামলো তৃষার জানালার পাশে ।
গড়িতে সময় দেখলাম প্রায়ই দুইটা বাজে । এতো রাতে এই মেয়ে এখানে কি করছে !
আমার মনের ভেতরে কু ডেকে উঠলো ! যদিও এই রাস্তা নিরাপদ । এখানে ডাকাতি হয় না ।
তাহলে কি অন্য কিছু ?
নাহ ! তৃষার সামনে এই কথা বলা যাবে না মোটেও । শুনলে সে আমাকে চিবিয়ে খাবে । বলবে যে আমি সারা দিন গল্প লিখি বলেই মাথার ভেতরে এই সব আজগুবী চিন্তা ভাবনা কাজ করে ।
তৃষা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে কি সামনে একটু নামিয়ে দিবেন?
মেয়েটার শব্দের উচ্চারণ একেবারে পরিস্কার । স্পষ্টই বুঝতে পারছি যে মেয়েটা ভাল ঘরের । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এতো রাতের বেলা মেয়েটা এই নির্জন রাস্তায় কি করছে ?
তৃষা বলল, তুমি এতো রাতের বেলা এখানে কি করছো ?
মেয়েটা একটু নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বাসা থেকে রাগ করে বের হয়ে গিয়েছিলাম । কিন্তু এখানে এসে ভয় লাগছে । বাসায় যে ফেরৎ যাবে সেই সাহস পাচ্ছি না । যখন রাগ ছিল অন্য কিছু চিন্তা করি নি । কিন্তু এখন রাগ পড়ে গেছে ।
তৃষা একটু দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বলল, এমন কেউ কাজ কেউ করে ! বোকা মেয়ে ! সামনেই তোমার বাড়ি ?
-জি ! শিকদার বাড়ি নামে একটা বাড়ি আছে ।
আমার সাথে সাথেই বাড়িটার কথা মনে পড়লো । যতবার গ্রামের বাড়ি গিয়েছি এই বাড়িটা আমার চোখে পড়েছে । তৃষা বলল, ঠিক আছে উঠে পড় ।
যদিও আমার মনের ভেতরে কেমন যেন একটা অস্বস্থি লাগছিলো । তবে তৃষা যখন বলেছে তখন আমার আর কিছু বলার থাকতে পারে না । মেয়েটা গাড়িতে উঠলে আবারও গাড়ি চালিয়ে দিলাম ।
তৃষাকে দেখলাম এবার মেয়েটার সাথে কথা বলতে । তবে একটা ব্যাপার ঠিকই লক্ষ্য করলাম যে মেয়েটা কেমন যেন গুম মেরে রয়েছে । কোন কথা বলছে না । তৃষা বার কয়েক চেষ্টা করলো কিন্তু মেয়েটা হু হা ছাড়া আর কোন কথাই বললো না । তৃষা এক সময় হাল ছেড়ে দিলো । তারপর আবারও সামনের দিকে তাকালো । ওর মুখ দেখে মনে হল খানিকটা বিরক্ত হয়েছে মেয়েটার উপরে । আমার মনের ভেতরে সেই অস্বস্তিটা রয়েই গেল । কিছুতেই যাচ্ছে না যেন । মনে হচ্ছে কিছু একটা যেন ঠিক হচ্ছে না ।
শিকদার বাড়িটা আসতে খুব বেশি সময় লাগলো না । মিনিট দশের ভেতরেই বাড়িটার সামনে এসে হাজির হলাম ।
গাড়িটা থামালাম বাড়িটার সামনে । তৃষা ঘুড়ে মেয়েটার দিকে তাকাবেই তখনই একটা ধাক্কার মত খেল । আমি ওর চেহারা দেখে পেছনে ফিরে তাকালম । দেখলাম যে গাড়ির পেছনের সিটে কেউ নেই । দুজন দুজনার দিকে তাকালাম । একে অন্যকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছি যেন । বুঝানোর চেষ্টা করছি যে মেয়েটা হয়তো মেনে গেছে । কিন্তু দুজনেই জানি গাড়িটা মাত্রই থেমেছে এবং গাড়ির দরজা খোলার আওয়াজ হয় নি । আমরা কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । কিছু সময় গেটের সামনেই বসে রইলাম গাড়ির ভেতরে । তারপর তৃষা বলল, বাড়ির ভেতরে যাবে ?
-গিয়ে ? কি বলবো ওদের ?
-না মানে মেয়েটা তো ভেতরে চলেও যেতে পারে !
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । তৃষাকে খানিকটা লজ্জিত মনে হচ্ছে । সম্ভবত মেয়েটাকে গাড়ির ভেতরে নেওয়ার কারণে নিজেকে অপরাধী ভাবছে । আমি বললাম, চল চলে যাই । এই সব ঝামেলা আর দরকার নেই ।
তৃষা বলল, চল ।
আমি গাড়িটা ঘোরাতেই যাবো দেখলাম গেটটা খুজে এক দারোয়ান গোছের লোক বের হয়ে এল । আমাদের গাড়ির দিকেই এগিয়ে এল । এইবার একেবারে কিছু না বলে চলে যাওয়াটা কেমন দেখায় ! আমি জানালার কাঁচ নামিয়ে লোকটাকে বলল, চাচা এই বাড়িতে কে থাকে ?
লোকটা আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে কিছু সময় আমাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, আপনেরা কি ভয় পাইছেন ? কাউরে দেখছেন !
আমি আর তৃষা আবারও একে অন্যের দিকে তাকালাম । তারপর দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে এলাম । চাচা মিয়া আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনেরা আফামনিরে দেখছেন । তাই না ?
তৃষা বলল, দশ এগারো বছরের একটা মেয়ে !
-জে ! সেই ই । আপনেগো এই বাড়িতে নিয়া আইছে । প্রায়ই কাউরে না কাউরে নিয়া আহে ! তয় কারো ক্ষতি করে না ।
তৃষা বলল, মানে আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না ।
-আসলে এই বাড়িত এক কালে তারা থাকতো । সাহেব, তার বউ আর তাগো তাগো মাইয়া । আমি তখনও দারোয়ান আছিলাম । একদিন আফা মনি রাগ কইরা বাড়িত তন চইলা গেল রাইতের বেলা । ফেরৎ আসে নাই । রাস্তায় এক্সসিডিং কইরা মারা গেছিলো । তারপর থেকেই মাঝে রাইতে কোন গাড়ির দেখা পাইলে সেই গাড়ির লুকজনরে কয় এইখানে নিয়া আসতে । অনেক গাড়ি আইসা থামতো ।
আমি আর তৃষা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম । তৃষার চোখে একটু ভয় দেখতে পেলাম । ভয় তো পাওয়াই স্বাভাবিক । এতো সময় আমাদের পেছনের সিটে একটা মরা মেয়ে বসে ছিল । আমাদের দুজনের চোখের ভুল হতে পারে না । হ্যালুসিনেশন তো হতেই পারে না । আমরা যখন আবারও গাড়িতে উঠতে যাবো দারোয়ান লোকটা বলল, ভাইজান, ভয় পাইয়েন না । আফা মনি কাউরে ক্ষতি করে না !
কথাটা কেন বলল সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরেই । গাড়ি নিয়ে আবার ঢাকার দিকে রওয়ানা দিতেও মেয়েটিকে আবারও দেখতে পেলাম । রাস্তার ধারে নিরবে দাড়িয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে । আমার বুকের ভেতরে কেমন দুরু দুরু করে উঠলো । তৃষা কেমন শক্ত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে । মেয়েটাকে ক্রস করে একটু সামনে আসার মাইল খানেক পরে আবারও দেখতে পেলাম একই ভাবে দাড়িয়ে আছে এবং আমাদের দিকে একই ভাবে তাকিয়ে আছে ।
মাওয়া আসা পর্যন্ত মেয়েটাকে আমরা প্রায় প্রতি এক মাইল পরপরই মেয়েটাকে দেখতে পেলাম । প্রতিবার দেখি আর আমাদের বুকের ভেতরে কেমন যেন কেঁপে উঠে । দুইজনেই একই সাথে দেখেছি তার চোখের ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না ! এর মাঝে একটা গাড়িও দেখি নি । তবে মাওয়া আসার পর অনেক গাড়ির দেখা পেলাম । বুকের ভেতর থেকে যেন একটা বড় পাথর নেমে গেল ।
মাওয়ার ঘাটে নেমে বেশ কিছু সময় আমি তৃষা একে অন্যের হাত ধরে দাড়িয়ে রইলাম । একে অন্যকে খানিকটা সাহস দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম । এই রকম ভয় যেন আর পাই নি আমরা কেউ !
-----
ভ্যানিসিং হিচহাইকারের লেজেন্ডটা কম করেও হলেও একশ বছরের পুরানো । এটা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার একটা আরবান লেজেন্ড ! শুনশান রাস্তায় একটা মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় । ড্রাইভারের কাছে সে লিফট চায় । এবং এমন একটা ঠিকানা বলে যে যা ড্রাইভার মানা করতে পারে না । অনেকটা সামনেই যাবে সে যে রাস্তায় গাড়িটি যাচ্ছে । সঠিক ঠিকানায় আসার পর দেখা যায় মেয়েটা আর নেই । গায়েব হয়ে গেছে । এই অদ্ভুত ছোট মেয়েটির কথা প্রথম পত্রিকাতে উঠে আসে এক দম্পত্তির মাধ্যমে । তারা হানিমুনে যাচ্ছিলো । এমনই এক নির্জন রাস্তায় মেয়েটিকে দেখতে পায় । মেয়েটিকে তার লিফট দেয় । গাড়িতে ওঠার পর মেয়েটার সাথে স্ত্রীটি কথা বলার চেস্টা করলেও ছোট মেয়েটি কোন কথাই বলে নি । নির্দিষ্ট ঠিকানাতে আসার পর মেয়েটির দিকে ঘুরতেই দেখা গেল মেয়েটি আর নেই । সেই বাড়িতে কড়া নেড়ে জানা গেল এমন কোন মেয়ে সেখানে থাকে না । পরে আবার যখন ঐ দম্পত্তি রাস্তায় বের হয় তখন কিছু সময় পরপরই মেয়েটাকে দেখতে পায় রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকতে ।
এটাই মূলত ভ্যানিশিং হিচহাইকারের গল্প । এই আরবান লেজেন্ড থেকেই এই গল্পের উৎপত্তি !
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ১:০৯