somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ জঙ্গলের শেষ বাড়িটা

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যখন জ্ঞান ফিরলো তাকিয়ে দেখি, তাহিরা আমার উপর ঝুকে রয়েছে । ওর কপালের কিছুটা কেটে গিয়েছে । তবে সেখান থেকে রক্ত পড়ছে না । বড় বড় চোখ নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আমার দিকে । বোঝার চেষ্টা করছে আমার কিছু হয়েছে কি না । আমি চোখে খানিকটা ঝাপসা দেখছি । মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে । কেন এমন করছে !
আমি তাহিরার দিক থেকে চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম । মাটির উপর আমি শুয়ে আছি । মাটির উপরে শুয়ে কেন আছি এমন প্রশ্ন মনে আসলো । আর সাথে সাথেই আমার কিছু একটা মনে পড়লো । আমাদের গাড়ি দুর্ঘটনাতে পড়েছিল । তাহিরা গাড়িটা চালাচ্ছিলো । হঠাৎ করেই সব কিছু ঘটে গেল । দুর্ঘটনা এমন হঠাৎ করেই ঘরে !

আমার গাড়ি সাধারনত আমি নিজেই চালাই । তবে তাহিরার গাড়ি চালানোর বেশ শখ । সময় সুযোগ পেলে সে সেটা করতে ছাড়ে না । গাড়ি ও ভালই চালায় । ওর কেবল একটাই সমস্য । গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে পেলে ও মনে করে ও প্লেনের পাইলট হয়ে গেছে । গাড়ি যেন উড়ে চলে তখন ।
আজকেও তাহিরা তেমন করেই গাড়িটা চালাচ্ছিলো । শহর ছেড়ে আমরা বেশ দুরে চলে এসেছিলাম । অন্য গাড়ি একেবারেই চোখ পড়ছিলো না। এক সময়ে একদমই কোন গাড়ি চোখ পড়লো না । কেবল দুই ধারে গাছের সারি । তার মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেছে রাস্তা । এমন রাস্তাই তাহিরা সব সময় পছন্দ করে গাড়ি চালানোর জন্য । এক্সস্লেরেটরে চাপ দিতেই থাকলো আর গাড়ির গতি বাড়তে লাগলো হুহু করে । বেশ দক্ষ হাতেই তাহিরা গাড়ি চালাচ্ছিলো । আমার প্রথম প্রথম একটু ভয় করলেও এক সময়ে মনে হল রাস্তা এখন একদম ফাঁকা । কারো সাথে ধাক্কা মেরে দেওয়ার সম্ভবনা কম । আর তাহিরা বেশ ভাল গাড়ি চালায় । সুতরাং সমস্যা নেই ।

কিন্তু কপালে হয়তো অন্য কিছু ছিল । আমি যেই না একটু নিশ্চিন্ত হয়েছি ঠিক তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটলো । ফাঁকা রাস্তার সামনেই হঠাৎ করেই একটা গরু জাতীয় প্রাণী এসে হাজির হল । তাহিরা সেটাকে পাশ কাটাতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি । গাড়িটা রাস্তা ছেড়ে গাছপালার ভেতরে ঢুকে গেল । গাড়ির গতি এতোই ছিল যে তাহিরা কিছুতেই সেটা নিয়ন্ত্রন করতে পারছিলো না । ব্রেক চাপ দিচ্ছিলো কিন্তু যেটা মনে হল ব্রেকটা সম্ভবত কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে । আমি তখনই লক্ষ্য করলাম গাড়িটা নিচের দিকে নামছে । গাছগাছালির ভেতরেই নিচে নামতে ঝড়ের বেগে ! তাহিরার চেষ্টা করেই যাচ্ছে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না । কয়েকবার ঝাকি গেল । আমার মাথাটা সামনে ঠুকে গেল তারপরই লক্ষ্য করলাম তাহিরা গাড়ির গেটলক খুলে দিয়েছে । একটা ধাক্কা অনুভব করলাম । তারপরই আমি ছিটকে পড়লাম গাড়ি থেকে । চোখ বন্ধ হওয়ার কিছু সময় আগে কেবল একটা পতনের আওয়াজ পেলাম !

আমি তাহিরার দিকে তাকিয়ে দেখি ও দিব্যি সুস্থ্য রয়েছে । ওকে বললাম, তুমি ঠিক আছো ?
কিছু বলল না ও । কেবল মাথা ঝাকালো ! তারপর আমাকে উঠতে সাহায্য করলো । আমি উঠে দাড়াতে গিয়ে অনুভব করলাম যে আমার আসলে তেমন কোন ব্যাথাই অনুভব হচ্ছে না । যেভাবে আমি গাড়ি থেকে পড়েছিলাম মনে হয়েছিলো যেন হাত পা ভেঙ্গে যাবে অথচ কিছুই হয় নি । তাহিরার দিকে তাকিয়ে বলল, কিছুই তো হয় নি দেখছি ।
তাহিরা একটু হাসলো । তারপর বলল, সত্যিই?
-হ্যা । সত্যিই কিছুই হয় নি । একটু কেটে ছিলে গেছে এই যা ।
-যাক ভাল । তবে তোমার গাড়িটা ...

লাইণটা শেষ করলো না ও । মুখে একটা অপরাধীর ভাব ফুটে তুলেছে । আমি বললাম, বাদ দাও । তোমার আর কি দোষ! সামনে ঐ গরুর বাচ্চা গরুটা না চলে আসলে এমন টা কি হত?
-তাহিরা বলল, কিন্তু তবুও । দোষ আমার খানিকটা আছে । এতো জোড়ে গাড়ি ছোটানো উচিৎ হয় নি আমার ।
-যাক এখন আর এসব ভেবে লাভ নেই । গাড়ির ইন্সুরেন্স করা আছে । খুব একটা সমস্যা হবে না আশা করি ।
তাহিরা বলল, গাড়ির অবস্থা দেখতে চাও?

সে চোখের ইশারাতে দেখালো গাড়িটা কোন দিকে আছে । আমি সেদিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলাম । ভাঙ্গা চুড়া গাড়ির অবস্থা দেখতে মন চাইলো না । তাহিরার দিকে তাকিয়ে বললাম, থাকুক । আর দেখতে চাই না ।
তাহিরা যেন হাসলো । তারপর বলল, চল সামনে যাওয়া যাক । সন্ধ্যা হয়ে আসছে । আমরা কতদুর এসেছি খেয়াল আছে ? আমি আশে পাশে তাকাতে শুরু করলাম । সত্যিই কত দুর এসেছে সেটা চিনতে পারলাম না । জায়গাটা আমাদের অপরিচিত । কতদুর এসেছিলাম আমি নিজেই বলতে পারছি না । আর এখন খানিকটা সন্ধ্যা হয়ে আসছে । অন্ধকার নামছে দ্রুতই ।

আমি আর তাহিরা বেড়াড়ে এসেছিলাম । জায়গাটার নাম ড়ুপালসি । ছিমছাপ ছোট শহর । শহরটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ যায় । প্রাকৃতিক পরিবেশ ছাড়া আর আলাদা ভাবে কিছুই দেখার নেই । অবশ্য আমাদের অন্য কিছু চাওয়ার ছিল না । আমরা ছিমছাম ফার্স্ট ক্লাস কটেজ ভাড়া নিলাম । মোট তিন দিন থাকার প্লান । প্রথম দিন বের হয়েছিলো আসে পাশটা ঘুরে দেখার জন্য । ফাঁকা রাস্তা পেয়ে তাহিরা যখন গাড়ির গতি বাড়ালো তখনই বিপত্তিটা বাঁধলো ।
আমি পকেটে হাত দিলাম । আমার মোবাইলটা পেলাম না । তাহিরার দিকে তাকিয়ে বললাম, মোবাইল?
তাহিরা বলল, আমার টা তো গাড়ির ভেতরেই রয়ে গেছে । তোমারটাও সম্ভবত !
-এখন ?
-এখন কিছু করার নেই । চল রাস্তায় গিয়ে দাড়াই । গাড়ি পেলে তাদের কাছে লিফট নেওয়া যাবে । অন্তত একটা ফোন তো পাওয়া যাবে!

আমি তাতে সম্মতি দিলাম !
তাহিরা বলল, চল ঐদিকে যাওয়া যাক ! ঐদিকেই সম্ভবত রাস্তাটা !
আমি এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম । বেশ বড় বড় গাছ পালা । একদমই অপরিচিত মনে হচ্ছে । অবশ্য এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু অবাক হলাম এই ভেবে যে গাড়িটা যখন রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের রাস্তায় নেমে এসেছে তখন তো খুব বেশি দুরে আসে নি । বড় জোড় মিনিট খানেক গাড়িতে ছিলাম আমি । সেই হিসাবে খুব বেশি দুরে তো আমার আসার কথা না । এখান থেকেই তো রাস্তাটা দেখতে পাওয়া কথা । কিন্তু আমার চারিপাশ দেখে মনে হচ্ছে যেন আমি গভীর কোন জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করেছি । এমন তো হওয়ার কথা না !

তাহিরা বলল, আসো, ঐ দিকে যাই ।
-তুমি নিশ্চিত?
-ঐ দিকেই তো জঙ্গল একটু ফাঁকা মনে হচ্ছে ।
আমি অবশ্য চারিপাশের কোন দিকেই কোন পার্থক্য খুজে পেলাম না ! আমার কাছে সবই একই মনে হতে লাগলো ! তবুও তাহিরার কাছে যেহেতু ফাঁকা মনে হয়েছে সেহেতু ঐদিকেই যাওয়া যাক আপাতত ! সেই পথেই পা বাড়ালাম !

আমি আমাদের গাড়ির চাকার দাগ খুজতে থাকলাম । কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম যে গাড়ির কোন দাগই নেই । এমন তো হওয়ার কথা না । নাকি আলো কমে আসছে বলে আমি দেখতে পাচ্ছি না ব্যাপারটা । ততক্ষনে তাহিরা হাটতে শুরু করেছে । আমি ওর পেছন পেছন হাটতে শুরু করেছি । তখনই আমার মনে হল খুব দুর থেকে কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে ! এবং কন্ঠটা আমার তাহিরাই মনে হল ! কিন্তু তাহিরা আমার একদম সামনে । ও যদি আমাকে ডাকতো, তাহলে এই ভাবে শোনাতো না মোটেই !

-তাহিরা !
আমার ডাকে তাহিরা পেছন ফিরে তাকালো । আমি বললাম, তুমি কি আমাকে ডাকলে ?
-কই নাতো !
-না মানে মনে হল কেউ মনে হচ্ছে আমার নাম ধরে ডাকছে !
তাহিরার চেহারাটা কেমন যেন মুহুর্তেই বদলে গেল । এবং সাথে সাথেই সেটা আবার আগের স্থানে ফিরে এল । সে আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে বলল, আরে তোমার শকটা এখনও কাটে নি বুঝতে পারছি । এই জন্য এমন উল্টাপাল্টা শুনছো । আসো তো আমার সাথে !

তাহিরা এবার আমাকে খানিকটা জোর করেই যেন সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো । এই ব্যাপারটাও আমার কাছে কেমন যেন অদ্ভুত লাগলো । তাহিরা কিংবা আমি দুজনের কেউ এই এলাকাতে এর আগে এসেছি বলে আমার মনে পড়ে না । অন্তত এই জঙ্গলে যে দুজনের কেউ ই আসে নি সেটা আমি শতভাগ নিশ্চিত । কিন্তু তাহিরা এমন ভাবে সামনে এগুচ্ছে, তাতে দেখে মনে হচ্ছে যে ও যেন এই জঙ্গলটা বেশ ভাল ভাবেই চেনে ! সেই ভাবেই সে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে । আমি খানিকটা দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে ওর সাথে সাথে এগিয়ে যাচ্ছি । এবং আমার মনে হচ্ছে যে আমরা যেন আরও গভীর জঙ্গলের ভেতরেই এগিয়ে চলেছি । আমি কয়েকবার কথাটা বলতে গেলাম তাহিরাকে । কিন্তু তাহিরা কথাটা উড়িয়ে দিল । ঠিক তখনই আমি আবারও ডাকটা শুনলাম । কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে । তবে বেশ ক্ষীণ কন্ঠে সেটা আমার কানে আসছে । এবং কন্ঠটা তাহিরার সেটা আমার কোন সন্দেহ নেই ।
কী হচ্ছে এসব ?

আমি এবার তাহিরাকে কিছু বলতে যাবো তখনই বাড়িটা দেখতে পেলাম । জঙ্গলটা খানিকটা ফাঁকা হয়ে এসেছিলো । সেই ফাঁকেই আমি বাড়িটা দেখতে পেলাম । ততক্ষণে বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে । ঐ বাড়িতে আলো জ্বলছে ।
তাহিরা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছো ! বাড়ি । চল চল জলদি চল !

তাহিরা এবার আমার পা ছেড়ে দিয়ে যেন দৌড়েই এগিয়ে গেল সেদিকে । আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম । এভাবে কারো বাসায় গিয়ে হাজির হওয়াটা মোটেও ভাল কাজ হবে কি ! অবশ্য বিপদে পড়েছি । এই সময়ে আর কী ই বা করার আছে ।
আমি বাড়িটার সামনে গিয়ে থেমে গেলাম । কাঠের তৈরি বাড়ি । বাড়িটা চার কোনাই । সামনে একটা বারান্দা । ঘরের ভেতরে কোন আলো জ্বলছে না । তবে বাড়ির ঠিক সামনে একটা লাইট জ্বলছে । আমি কোন ইলেক্ট্রিক লাইণ দেখতে পেলাম না আশে পাশে । এমন কি জেনারেটরের আওয়াজও আসছে না । এই সমস্ত জঙ্গলের বাড়ি গুলো স্বাধারনত জেনারেটর দ্বারাই আলোকিত হয় ।
আরেকটা অস্বাভাবিক ব্যাপার চোখ পড়লো সেটা হচ্ছে বাড়িটা দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে বাড়িটা এখনই ভেঙ্গে পড়বে । খুব বেশি পুরানো মনে হচ্ছে । আলোটা না জ্বললে আমার মনে হতো বাড়িটা অনেক দিন আগেই পরিত্যাক্ত । এছাড়াও বাড়িটার থেকে একটা অশুভ ভাইব আসছে । আমার কেন জানি মনে পুরো বাড়িটা জুড়েই কোন অশুভ কিছুর দিকে ইঙ্গিত করছে । এমনটা মনে হওয়ার পেছনে আসলে কি কারণ থাকতে পারে সেটা আমার জানা নেই । কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে আছে ! বারবার মনে হচ্ছে যেন এই বাড়ির ভেতরে ঢোকা ঠিক হবে না ।


আমি আর তাহিরা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে রয়েছি । ভেতরে ঢুকতে এখনও আমার ইচ্ছে করছে না । আবার চলে যেতেও পারছি না ।
আমি তাহিরার দিকে তাকিয়ে বললাম, এই বাড়িতে নক করতে ইচ্ছে করছে না ।
-কেন ?
-জানি না । কেবল ভাল লাগছে না ।
-আরে বাবা কী করবা আর !
-তবুও! এই বাড়িতে ঢুকবো না । চল !
-আরে বাবা দাড়াও ! একটু দাড়াও !

তাহিরা এমনিতে বেশ জেদি মেয়ে । তবে আমি কিছু জোর দিয়ে বললে সেটা সে শোনে । আমার সাথে কখনই জেদ দেখায় না সে ! কিন্তু আজকে এমন কেন করছে ! আমি ওকে কিছু বলতে যাবো তখনই বাড়ির দরজা খুলে একজন মাঝ বয়সী লোক বের হয়ে এসেছে । পরনে প্রিস্টদের মত কালো পোশাক । তবে গলাতে প্রিস্টদের মত সাদা কলার পরে নি ।

লোকটা বলল, আপনারা কারা ? এই সময়ে এখানে ?
আমার কিছু বলার আগেই তাহিরা বলল, আসলে আমরা একটু বিপদে পরেছি !
লোকটা আমার দিকে বলল, তা তো বুঝতেই পারছি । বিপদে না পড়লে আসলে কেউ এই দিকে আসে না ।

এই বলে লোকটা কেমন শব্দ করে হাসলো । এমন একটা কথা যেন খুব হাসির কিছু বলেছে সে । দেখলাম তাহিরাও সেই হাসিতে যোগ দিয়েছে । কিন্তু আমি মোটেও হাসির কিছু পেলাম না । তবে মুখে একটু জোর করে হাসি নিয়ে এলাম । তারপর বললাম, আসলে আমাদের গাড়িটা .....
লোকটা বলল, এই রাস্তায় এতো জোরে গাড়ি চালাতে নেই । জঙ্গলের ধারে ফাঁকা রাস্তায় প্রায় কোন না কোন জন্তু চলে আসে । গাড়ির সামনে পড়ে যায় । তখনই দুর্ঘটনা ঘটে !
আমার মনে এবার একটু খটকা লাগলো । কারণ আমাদের গাড়ি কিভাবে দুর্ঘটনাতে পড়েছে সেটা এই লোকের কোন ভাবেই জানার কথা না । এই লোকটা কিভাবে এই কথা জানলো । আমার কেন জানি আমার মবের ভেতরের কুডাক টা আবারও ডেকে উঠলো ।

লোকটা বলল, আপনারা ভেতরে এসে বসুন !
তাহিরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি বললাম, আসলে আমরা বাসায় যাবো । রাস্তাটা কোন দিকে যদি বলে দিতেন তাহলে খুবই উপকার হত ! কিংবা আপনার কাছে কি ফোন আছে ? আমাদের ফোন গুলো গাড়িতে !
লোকটা বলল, এই রাতের বেলা যাবেন ? এর থেকে রাত টা এখানে থেকে যান ! সকালে যাবেন !
তাহিরা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যা । আমিও তাই বলছিলাম । উনি যখন বলছেন । রাতটা এখানেই থাকি । সকালে যাওয়া যাবে !

আমি এবার তাহিরার দিকে ভাল করে তাকালাম ! ব্যাপারটা আমার কাছে একটু অবাক লাগলো । কারণ তাহিরার একটা দিক আমি খুব ভাল করেই জানি সেটা হচ্ছে থাকার ব্যাপারে সে অনেক খুঁতখুঁতে । যে কোন স্থানেই সে থাকতে পারে না । বেড়াতে গেলেও নিজে আগে সেই কটেজ কিংবা হোটেল রুম নিজে চেক করবে । বিশেষ করে ওয়াশ রুম যদি তার পছন্দ না হয় তাহলে সেখানে মোটেই থাকবে না । আর এই তাহিরা একদম কিছু না দেখেই বলছে এখানে রাত কাটাতে ! আমি সরু চোখে তাকালাম তাহিরার দিকে । তখনই আমার পার্থক্যটা ধরা পরলো ।

তাহিরার চোখ !
তাহিরার চোখ ঘন কালো । এই এই তাহিরার চোখ তো অনেকটা বিড়াল চোখী । আমার চোখ বাড়ির সামনে দাড়ালো ঐ লোকটার দিকে গেল । এবং আমি আরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে ঐ লোকটার চোখ আর তাহিরার চোখের ভেতরে আশ্চর্য রকমের মিল ! আমার মনে হল এই বাড়ি থেকে আমাকে এখন দুরে যেতে হবে না । যে কোন ভাবেই এদের থেকে দুরে যেতে হবে । এই বাড়ির ভেতরে ঢোকা যাবে না কোন ভাবেই ।

কয়েকটা মুহুর্ত কেউ কোন কথা বললাম না । কেবল একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম । আমি মনে মনে ভাবছি কোন দিকে আমি দৌড় দিব । ঠিক তখনই আমার নাম ধরে কেউ ডাক দিল । এবার অনেকটা কাছে । এবং কন্ঠটা তাহিরার এই ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই । আমি এক পা পিছনে নিলাম ।

সাথে সাথেই লোকটা তাহিরাকে উদ্দেশ্য চিৎকারে বলে উঠলো, ওকে ধর । ও যেন পালিয়ে যেতে পারে না ! দেহের সাথে এখনও ওর বন্ডটা মজবুত হয়ে আছে !

আমার চোখের পলকে তাহিরা আমার কাছে চলে এল । আমার এক হাত ধরলো । তাহিরার ধরার ধরন দেখেই আমার মনে হল যে কি পরিমান শক্তি দিয়ে যে আমার হাত ধরেছে । এতো শক্তি তাহিরার শরীরে থাকার কথা না । দেখতে দেখতে লোকটাও আমার অন্য হাত ধরে ফেলল । আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম কেবল । কিন্তু বুঝতে পারলাম কোন লাভ নেই । এদের দুজনের কাছ থেকে আমি নিজে কোন দিন মুক্তি পাবো না ! তবুও আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম ।

তাহিরা বলল, অপু তুমি জোর করো না । পারবে না । কেবল ঐ ঘরে ঢুকলেই হবে ! আর কিছু না । ঐ ঘরে ঢোকার পরেই শান্তি !
-মানে কি বলছো তুমি!
-বিলিভ মি ! এই জগতে কিছু নেই । ঐ ঘর তোমাকে মুক্তি দিবে !

এই বলে দুজনে আমাকে অনেকটা টেনে হিড়চেই নিয়ে যেতে লাগলো বাড়িটার দিকে । আমি আরও ভীতু চোখে বাড়িটার দিকে তাকালাম । আমার কাছে মনে হল এই বাড়িটা আমাকে এখনই গিলে খাবে । আমি নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু খুব একটা কাজ হল না । আস্তে আস্তে ওরা আমাকে বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো । বাড়ির সিড়ির কাছে যেতেই হঠাৎ ওরা দুজন থেমে গেল । আমি অনুভব করলাম যে ওরা আমাকে সামনে নিয়ে যেতে পারছে না । আটকে গেছে । আমি নিজেও অনুভব করতে পারলাম ব্যাপারটা ! আমাকে কেউ যেন টানছে পেছন থেকে !

লোকটা তাহিরার দিকে তাকিয়ে বলল, শক্তি লাগাও । ওর দেহ ওকে টানছে !

আমার দেহ ! আমাকে টানছে !
মানে কি ! এরা কি বলছে ?

তখনও টান অনুভূত করলাম আমি । দেখলাম আমার সাথে সাথে ওরা দুজনও চলে আসছে । শেষ শক্তি দিয়ে আমার হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না । আমার আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে দুরে সরে যেতে লাগলাম ! একটা সময় দুজনই আমার হাত ছেড়ে দিল । তাররপই আমি হেচকা টান অনুভব করলাম ! বন জঙ্গল অন্ধকার পার হয়ে আমাকে কেউ টানছে । এতো শক্তি সেই টানে যে আমি নিজের চোখ মেলে রাখতে পারলাম না । জ্ঞান হারালাম !

দ্বিতীয় বার যখন চোখ খুললাম তখন তাকিয়ে দেখি তাহিরা আমার উপর ঝুঁকে আছে । ওর মুখ কপালের অনেক টা অংশ কেটে গেছে । তাজা রক্তের ছড়াছড়ি ! ঘন কালো চোখ দিয়ে পানি পরছে । ওর চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম যে এই তাহিরা আমার তাহিরা ! আমার চোখ মেলে তাকাতেই তাহিরা কান্না সুরে বলল, থ্যাঙ্ক গড ! আই থট আই লস্ট ইউ !

আমি কিছু সময় কিছু বুঝতে পারলাম না । আমি আবার এখানে কিভাবে কিভাবে এলাম সেটাও মাথায় এল না ! একটু উঠতে গেলাম । কিন্তু তীব্র একটা ব্যাথা অনুভব করলাম । তাহিরা বলল, উঠো না ! সম্ভবত ঘারের হাড় ভেঙ্গেছে । একটা হাতও ভেঙ্গেছে ! এভাবে শুয়ে থাকো । আমি ফোন দিয়েছি । এম্বুলেন্স আসছে । ও মাই গড ! আমি ভেবেছিলাম তুমি ....
-আমি কি?
-বেশ কিছুটা সময় তুমি নিঃশ্বাস নিচ্ছিলে না ! আমি ভাবলাম .....

বলতে বলতে তাহিরা আবার কেঁদে ফেলল ! তার একটু পরেই আমি এম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনতে পেলাম !


পরিশিষ্ট


আমার পুরোপুরি ঠিক হয়ে প্রায় মাস দুয়েক লেগেছিল । এ সময়টা আম পুরোপুরি খাটে শুয়ে ছিলাম । তাহিরার বেশ কেটে কুটে গেলেও বড় রকমের ক্ষতি হয় নি । সে সপ্তাহখানের ভেতরেই ঠিক হয়ে গেল । যদিও পুরো দুইমাস সে আমার দেখা শুনা করেই কাটিয়ে দিল ! আমি এই দুইমাস কেবল ঐ বাড়িটার কথা ভেবেই কারিয়ে দিলাম । কি ছিল ঐ বাড়িটা !
আমার সাথে ঐ ঘটনা ঘটার মানে কি ! অনেক ভেবে কেবল একটা ব্যাখ্যাই আমি দাড় করিয়েছি মনে মনে ! তাহিরা বলেছিলো যে আমি কিছু সময়ের জন্য নিঃশ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম । তখন সম্ভবত কিছু সময়ের জন্য আমার আত্মা আমার দেহ থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো । সেটাটে সংগ্রহ করতে এসেছিলো তাহিরার রূপ ধরে । আর ঐ ঘরটা ছিল আমার গন্তব্য । আত্মারা সম্ভবত ঐখানেই যায় । একবার ঐ ঘরে প্রবেশ করলে আমি আর আমার নিজের দেহের কাছে পৌছাতে পারতাম না । তাই ঐ দুজন আমাকে ঐ ঘরে ঢোকাতে ব্যস্ত ছিল । আর আমার দেহ থেকে তখনও আত্মার পুরোপুরি মুক্তি হয় নি বলেই হয়তো তাহিরার যখন আমার দেহের কাছে আমার নাম ধরে ডাকছিলো তখন আমি সেটা শুনতে পাচ্ছিলাম !

এই ব্যাখ্যার কোন ভিত্তি নেই । এটা আমি ভাল করেই জানি নি। কিন্তু আমার কাছে এর থেকে ভাল ব্যাখ্যা নেই । আর আমার ব্যাখ্যার দরকারও নেই খুব একটা । আমি আর তাহিরা বেঁচে আছি এটাই সব থেকে বড় কথা । বেঁচে থাকার আনন্দই সব থেকে বড় আনন্দ !
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ১:০৮
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×