করোনার কারণে ঘুরাঘুরি বাদ বলা চলে একেবারে । শেষ ঘুরতে গিয়েছিলাম সেই ফেব্রুয়ারিতে । আর ঢাকা থেকে বের হওয়া বলতে কেবল ঈদে গিয়েছিলাম গ্রামে । তাছাড়া পুরোটা সময় ঢাকাতেই বসে থাকতে হয়েছে । গ্রাম থেকে আসার পর থেকেই কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিলো । তবে শারীরিক কিছু কারণে যেতে ইচ্ছে করছিলো না কোথায় । বান্ধুপি যখন বলল যে চল যাই রাঙ্গামাটি, প্রথমে মানাই করে দিলাম । বললাম যে যাবো না । শরীর ভাল না । পেট খারাপ ! তবে কোথাও যাওয়ার লোভ আর সামলানো যায় নি । পরে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলাম ।
গত বৃহস্পতিবার রাতে আমরা রওয়ানা দিলাম রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে । এখানে বলে রাখি ফেসবুকে এখন বেশ কিছু সুপরিচিত ট্যুর গ্রুপ আছে যারা নিয়মিত এই রকম ট্যুরের আয়োজন করে থাকে । এই রকম একটা গ্রুপের সাথে প্রায় তিন বছর ধরে যুক্ত রয়েছি আমি । ঘুরাঘুরি তাদের সাথেই হয়ে থাকে । ছাত্র জীবনে যত ট্যুর দিয়েছি সব গুলোর আয়োজক থাকতাম আমি সহ কয়েকজন । টিকেট কেনা থেকে শুরু করে যাত্রার যাবতীয় ঝামেলা আমরা সামাল দিতাম । তাই এটার ঝামেলা কতখানি সেটা জানি । এখন এই কাজটাই এই গ্রুপ গুলো করে । আমরা কেবল টাকা দিই বাদ বাকি সব কিছুর দায়িত্ব তাদের । ঝামেলা বিহীন ভাবে ঘুরে আসি ।
যাই হোক গল্প শুরু করা যাক । সকালে পৌছিয়ে গেলাম কাপ্তাই । বান্দরবানে আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি তবে রাঙ্গামাটিতে এই প্রথম । কাপ্তাইয়ে নেমে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নিলাম । এখানে একটা কথা বলে রাখি যে কাপ্তাইয়ে আসলে ফ্রেশ হওয়ার জন্য খুব একটা ভাল ব্যবস্থা নেই । একটা পাবলিক টয়লেট দেখতে পেলাম যেটা খুব একটা যুতসই ছিল না । হোটেলেও টয়লেট জাতীয় কিছু ছিল না । বান্দরবানের অবশ্য এই ঝামেলা নেই । সেখানে বেশ ভাল পরিস্কার ব্যবস্থা আছে প্রতিটি হোটেলের সাথেই ।
নাস্তা করে আমরা ট্রলারে চেপে বলসাম । সেখান থেকে ঘন্টা দুয়েকের ট্রলার যাত্রা করে হাজির হলাম বিলাইছড়ি উপজেলাতে । মূলত এটাই আমাদের বেজ পয়েন্ট । সেখানে আমাদের জন্য আগে থেকেই রিসোর্ট বুকিং দেওয়া ছিল । এখানে ব্যবস্থা বেশ ভাল । ফ্রেশ হয়ে নিলাম এখান থেকেই । নাস্তা খাওয়াই ছিল তাই আর খাওয়ার দরকার ছিল না খুব একটা ।
শুক্রবার আমাদের দুইটা ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার কথা । ঝর্ণা দুইটার নাম হচ্ছে 'ন কাটা' আর 'মুপ্পাছড়া' । দুইটা ঝর্ণাই একই জাগয়াতে । বলা যায় যে দুটো আসলে একই ঝর্ণা । একটা উপরে আরেকটা নিচে । উৎস একই স্থান । আমরা আবার ট্রলারে রওয়ানা দিয়ে দিলাম ।
যাওয়ার পথের দৃশ্য ।
মোটামুটি ঘন্টা দেড়েক জার্নি করে পৌছালাম আসল জায়গায় । এরপর পায়ে হাটা পথে । আমরা সবাই হাটা শুরু করলাম। বান্দরবানে যে কঠিন পথ আমি পাড়ি দিয়েছি তার তুলনাতে এই পাহাড়ে ওঠানামাটা আসলে একেবারে দুধভাত বলা যায় ! তবে যারা প্রথমবার তাদের জন্য একটু কষ্টেরই হবে ।
আমরা প্রথমে পৌছালাম ন কাটা ছড়িতে । ছবিতে আসলে এই সৌন্দর্য্য কোন ভাবেই বোঝা যাবে না । দেখতে হবে সরাসরি । তাহলেই আসল সৌন্দর্য্য বোঝা যাবে । তবুও দিলাম কয়েকটা ছবি ।
ন কাটা ছড়ি
ন কাটা থেকে আমার গন্তব্য এবার মুপ্পাছড়ার দিকে । যাওয়ার পথে আরও একটা ঝর্না পড়লো !
এই যাত্রা পথে বেশ মজা হয়েছিলো । আমাদের গ্রুপের এক অংশ আগেই রওয়ানা দিয়েছিল । আমরা ইচ্ছে করেই পেছনে ছিলাম। হাটা দিলাম কিছু সময় পরে । তবে যে বাঁকে যাওয়ার কথা ছিল সেদিকে না গিয়ে অন্য দিকে হাটা দিলাম । পথ ভুল হল । আবার ফিরে এসে অন্য আরেক দিকে যাওয়া শুরু করলাম । কিছুদুর গিয়ে সেটাও দেখলাম ভুল । এরপর তিনবারের বার সঠিক পথটা খুজে পেলাম । এই পথটা একেবারেই পাথুরে ছিল । ঝর্ণার ঝিরি পথ দিয়েই আমরা গিয়ে হাজির হলাম মুপ্পাছড়াতে । তবে এটাতে পানির পরিমান একটু কম ছিল । যদিও আমার কাছে এটাও দেখতে চমৎকার লাগছিলো । ছবিতে মনে হবে যে একদম পানি কম কিন্তু বাস্তবে সেখানে হাজির থাকলে ঝর্ণাটার সৌন্দর্য আরও ভাল ভাবে উপভোগ করা যাবে !
ছবি দেখে অনেকে হতাশ হতে পারেন তবে বিশ্বাস করুন যে বাস্তবে এটা অনেক বেশি সুন্দর !
তারপর ফেরার পালা । একই পথে ধরে আবারও আমরা ফিরে এলাম । একই ভাবে ট্রলারে করে হাজির হলাম আবারও বিলাইছড়ির সেই রিসোর্টে । তখন প্রায় চারটা বেজে গেছে । গোসল সেরে খাওয়া দাওয়া করতে করতে সাড়ে ৫টা বেজে গেল । সন্ধ্যার পরে আমরা বাজার ঘুরে দেখলাম । বিলাইছড়িতে বলতে গেলে সব কিছু রয়েছে । উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটা দেখতে বেশ সুন্দর । থানাটা আরও বেশি সুন্দর । একেবারে বিশাল বিল্ডিং ।
পরদিন খুব ভোরে আমরা রওয়ানা দিলাম । আজকে আমাদের গন্তব্য হচ্ছে ধুপপানি ঝর্ণা । মূলত এটাই হচ্ছে ট্যুরের আসল গন্তব্য । ছয়টার আগে আর্মি অনুমতি দেয় না যেতে । ক্যাম্পেই অপেক্ষা করতে হল কিছু সময় । ছয়টা বাজলো তারপর আমাদের যাত্রা শুরু হল । স্রোতের বিপরীতে আমাদের ট্রলার চলছিলো । তাই যেতে সময় লাগছিলো বেশ খানিকটা । সাড়ে নয়টার সময় দ্বিতীয় আর্মি ক্যাম্পে আমরা এন্ট্রি করলাম । তারপর আরও মিনিট বিশেষ ।
ট্রলারে যাওয়ার পথে ।
এরপর ঘাটে ট্রলার থামলো । আমাদের আবারও যাত্রা শুরু । মূলত ঘাট থেকে ধর্ণাতে যেতে আড়াই থেকে তিন ঘন্টার মত সময় লাগে ! ঘাট থেকে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত এক ঘন্টার সমতল ভূমির হাটা এবং সেখান থেকে পাহাড়ে ওঠা আরও দেড় থেকে দুই ঘন্টার পথ । কিন্তু আমাদের এই সমতল ভূমিতে হাটাটা বেশ ঝামেলার হয়ে গিয়েছিলো । গতদিন রাতে বৃষ্টি হয়েছিলো । তাই পথ ছিল কাদায় পরিপূর্ন । যে সে কাদা না, ভয়ংকর কাদা । এই পথ টুকু আসলেই খুব বিরক্তিকর ছিল । আমি দুইবার আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম । একবার তো একেবারে কাদার ভেতরে । সারা শরীর কাদায় মাখামাখি !
তবে পাহাড়ে ওঠার পর থেকে অবশ্য আর কাদা ছিল না । এই যাওয়ার পথটা পরিশ্রমের ছিল কিন্তু সেই সাথে উপভোগের । পাহাড়ে আমার হাটতে সব সময় ভাল লাগে । মাঝে কিছুটা পথ ছিল ঝিরির মধ্য দিয়ে । সেটাও চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা ।
এই যে রাস্তা নেমে গেছে নিচে !
ঐ দেখা যায় একটা পাড়াতে যাওয়ার পথে ।
এরপরে আমরা পৌছালাম ধুপপানি ধর্ণাতে । সত্যি বলতে কি জাদিপাই ঝর্ণার পরে এতো চমৎকার একটা ঝর্ণা দেখতে পেলাম । এই সৌন্দর্য্য আসলে কোন ভাবেই ভাষার প্রকাশ করা সম্ভব না । এমন কি এটা ছবিতেও দেখে বোঝা সম্ভব না । যারা সেখানে গিয়ে নিজ চোখে দেখেছে কেবল তারা বুঝতে পারবে । পানির যে কী তীব্র একটা শক্তি এই ঝর্ণার সামনে গেলে সেটা বুঝা যাবে আরও ভাল করে ।
ধুপপানি ঝর্ণা
অনেকটা সময় এখানে কাটিয়ে আবারও আমরা ফেরার পথ ধরলাম ! ঘাটে ফিরে এসে আগে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম । যাওয়ার সময়ই বলে গিয়েছিলাম খাবারের কথা । উপজাতিরা এখানে আমাদের জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছিলো । ট্রলারে বসে খাওয়া শেষ করলাম । তারপর আবারও সেই ট্রলার জার্নি !
ফেরার পথে ।
এখানে পানি কিছুটা শান্ত ।
ঐ যে আমাদের ফিরে যাওয়ার পথে ।
রিসোর্টে পৌছাতে পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে গেল । আমরা আবার ফ্রেশ হয়ে রওয়ানা দিলাম বিলাইছড়ির উদ্দেশ্যে । সন্ধ্যা সাতটার আগে আবার আর্মি ক্যাম্পে এন্টি করতে হবে । নয়তো আবার ওরা যেতে দিবে না !
এই ছবিটা রিসোর্টের ব্যালকোনি থেকে তোলা । দুরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে । কী অদ্ভুত এক মায়াময় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিলো ।
সাড়ে আটটার দিকে আমরা আবার কাপ্তাই এসে পৌছালাম । একই হোটেলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে সাড়ে নয়টার বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম । ঝর্ণা ভ্রমনের শেষ এখানেই । আবার হয়তো সামনে অন্য কোথাও যাওয়া হবে । কবে যাওয়া হবে কে জানে ! ততদিন আবারও এই সিমেন্টের জঙ্গলে পড়ে থাকতে হবে ....
সব গুলো ছবি আমার কমদামী মোবাইলে তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০২১ সকাল ১০:২৯