somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ মরিয়ম খালার বাগানবাড়ি

২৩ শে অক্টোবর, ২০২১ দুপুর ১২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মিতু আমার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলো । কাল রাতে ওর সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার খানিকটা তর্কাতর্কি হয়েছে। কথার এক পর্যায়ে সে বালিশ নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেছে । ভেবেছিলাম যে কদিন আমার সাথে সে আর কথা বলবে না । কিন্তু দেখলাম আজকে দুপুর না গড়াতেই আবার একই ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে এসেছে । আমি আর নতুন করে এই ব্যাপারটা নিয়ে ঝগড়া করতে চাই না ।

-আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না তুমি ঐ বাড়িতে যেতে চাও না কেন? কি এমন সমস্যা শুনি তোমার?
-আমার ভাল লাগে না । তোমাকে তো আমি যেতে মানা করি নি । চাইলে আমি তোমাকে ঐ বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি !
-হ্যা তোমার খালা, তোমাকে দেখতে চেয়েছে আর আমি গিয়ে হাজির হব ? গিয়ে কি বলবো শুনি ? অপু আসে নি আমি তার সাবস্টিউশন গুডস হিসাবে এসেছি।

আমি বুঝতে পারছিলাম যে মিতু রেগে যাচ্ছে । আমি ওর দিকে একটু এগিয়ে গেলাম । তারপর ওকে জড়িয়ে ধরলাম । আমি জানি আমি যখন মিতুকে জড়িয়ে ধরে থাকি মিতুর রাগ আস্তে আস্তে পড়তে থাকে । এক সময় দেখলাম যে তার রাগ পড়ে গেল । মিতু শান্ত কন্ঠে বলল, বুড়ো একটা মানুষ । যে কোন সময় মারা যাবে । তোমাকে একবার দেখতে চাচ্ছে । যাওয়া উচিৎ না ?

ঝগড়া করলে প্রতি উত্তর দেওয়া যায় কিন্তু এমন নরম সুরে বললে সেই কথা না মেনে উপায় নেই । আমি বললাম, আচ্ছা তোমার যেমন ইচ্ছে । যাবো আর দেখা করে চলে আসবো ! কেমন?
মিতু হাসলো। বলল, তাই হবে!

মিতু খুশি মনে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল । আমি বসে রইলাম নিজের ঘরে । মনের ভেতরে একটা ভয় কাজ করতে থাকলো ! ঐ বাড়িটাকে আমি ছোট বেলা থেকে ভয় পাই । ভয় পাওয়ার পেছনে কারণও আছে । কারণটা মনে হলেই আমার এখনও শরীরটা শিউরে ওঠে ।


মরিয়ম খালা আমার আপন খালা নন । মায়ের দুর সম্পর্কের চাচাতো বোন হোন সম্ভবত । আমি সম্পর্কটা ঠিকমত জানিও না । তবে প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন । আমাদের সব ভাইবোনদের খুব আদর করতেন । বিশেষ করে আমাকে বেশি আদর করতেন । মায়ের কাছে শুনেছিলাম যে তার আমার বসয়ী একটা মেয়ে ছিল । ছোট থাকতেই মেয়েটা নাকি পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলো । এই জন্যই সম্ভবত আমাকে বেশি আদর করতেন !

তিনি আমাদের বাসায় মাঝেমধ্যে আসতেন, আমাকে আদর করতেন । এর ভেতরে কোন সমস্যা ছিল না । সমস্যা দেখা দিল যখন আমরা মরিয়ম খালার বাসায় বেড়াতে গেলাম । তখন ক্লাস ফাইভে কিংবা সিক্সে পড়ি ! গরমের ছুটিতে ঠিক হল আমরা সবাই যাবো মরিয়ম খালার বাসায় । বাড়ি শুদ্ধ মানুষ সেখানে গিয়ে হাজির হলাম । ঠিক হল সপ্তাহ খানেক সবাই সেখানেই থাকবো !

মরিয়ম খালাদের বাড়িটা বিশাল বড় । মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানে । আগে এই বাড়িটা নাকি এক জমিদারের বাগানবাড়ি ছিল । খালুর বাবা এলাকার নাম করা উকিল ছিলেন । তিনিই নাকি সুযোগ বুঝে এটা কিনে নিয়েছিলেন । মেরামত করে নিজের বাগান বাড়ি বানাবেন ঠিক করেছিলেন কিন্তু খালুর বাড়িটা এতোই পছন্দ হয়ে গেল যে সে নিজের জন্য বাড়িটা বাবার কাছ থেকে নিয়ে নিলেন । তারপর এই মুন্সিগঞ্জেই নিজের ব্যবসাপাতি নিয়ে স্থায়ী হয়ে গেলেন ।

আমার নিজেরও বাড়িটা খুব পছন্দ হল । বাড়ির পেছনে বিশাল বাগান । বাগান পেরুলে আবার একটা বড় সান বাঁধানো পুকুর ! মরিয়ম খালা দুই ছেলে । খালিদ আর রনি । পিঠাপিঠি ভাই তারা। আমার বড় ভাইয়ার সমান বয়স । যাই হোক সারা দিন আমরা পুরোবাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতাম । সারা দিন হইচই চলছেই । ছোট রা আছেই বড়রাও মাঝে মধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিতেন । আর খাওয়া দাওয়ার কথা তো বলে শেষ করা যাবে না । প্রথম চার পাঁচদিন কিভাবে চলে গেল আমি টের পেলাম না । আমার কাছে মনে হল এই বাড়ি ছেড়ে আমি আর কোন দিন যাবো না । সারা জীবন এখানেই থাকবো । কিন্তু ছয় নম্বর দিনে এসে আমার সেই ইচ্ছে একেবারে উবে গেল । সন্ধ্যার সময় তখন । খালিদ ভাইয়ারা বাড়ির ভেতরে নেই । তারা বাইরে মাঠে খেলতে গেছে । বড় আপু ঘরের ভেতরে কি যেন করছে । আমি একা একা এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছি বাড়ির ভেতরে । হাটতে হাটতে আমি চলে এসেছি পুকুরটার কাছে । পুকুরের সানবাঁধানো সিড়িতে বসলাম ।

বাড়ির এদিকটা বলতে গেলে সব সময় ফাঁকাই থাকে । মানুষজন থাকে না । কেবলই গাছগাছালি আর পুকুর । একজন মালি আছে পুরো বাগান আর পুকুর দেখাশোনা করার জন্য। তবে সে বিকেল বেলা বাসায় চলে যায় । পুরো এলাকাটা কেমন নির্জন হয়ে আছে । একেবারে শান্ত । আমার হঠাৎ কেমন যেন ভয় করে উঠলো । আমার মনে হল এখানে আর মোটেই থাকা উচিৎ না । একটু আগেই আযান দিয়েছে । আমাদের কাজের বুয়ার মুখে শুনেছি যে আযানের পরের এই সময়টা নাকি ভাল না । এই সময়ে নানান অশরীরী আর ভুতপ্রেত ঘুরে বেড়ায় । আমি উঠে দাড়ালাম । এখান থেকে চলে যাওয়ার একটা তাগাদা অনুভব করলাম । একটা সিড়ি উপড়ে উঠতে যাবো তখনই মনে হল যেন পেছনে পুকুরে পানির নড়ে উঠলো । নড়ে উঠলো বলতে কেউ পুকুরের পানি থেকে উপড়ে উঠে আসতে গেলে যেরকম আওয়াজ হয় ঠিক সেই রকম । আমার অবচেতন মনে বারবার আমাকে বলল আমি যেন কোন ভাবেই পেছন ফিরে না তাকাই, পেছনে তাকালেই আমি ভয়ংকর কিছু দেখতে পাবো । কিন্তু আমার মাথাটা আপনা আপনি ঘুরে গেল । মাথা ঘুরানোর সাথে সাথেই আমার বুকের ভেতরে ঢক করে উঠলো । সেদিন সন্ধ্যা বেলা আমি কি দেখেছিলাম আমি আজও নিশ্চিত করে বলতে পারবো না তবে সেই জিনিস টা দেখে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম । আমার কেবল ভাসা ভাসা এই টুকু মনে আছে যে আমার বয়সী একটা মেয়েকে দেখেছিলাম । চেহাটাটা একেবারে সাদা । মনে হচ্ছিলো যেন অনেক দিন পানির নিচে থেকে তার গায়ের রং একেবারে সাদা হয়ে গছে । আমার দিকে তাকিয়ে সে ফিক করে হেসেছিলো । সাথে সাথে তার মুখ আর চোখ দিয়ে পানি বের হতে শুরু করলো । এই টুকু দেখেই আমার আত্মা উড়ে গিয়েছিলো । আমি চিৎকার করে দৌড় দিয়েছিলাম । বাড়ির উঠানে আসতে আসতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই ।

রাতে আমার জ্ঞান ফিরলে আমি নাকি কউকে ঠিক মত চিনতে পারছিলাম না । তার পরদিনই আমার নিজেদের বাসায় ফিরে আসি । তারপর আবার ভাইয়া আর আপু ঐ বাড়িতে বেড়াতে গেলেও আমি যাই নি অনেক দিন । মরিয়ম খালাও আমাকে নিয়ে যেতে আর জোড়াজুড়ি করেন নি । সম্ভবত আমার ঐ অবস্থা দেখে সে নিজেও খানিকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো । তবে আমার প্রতি তার ভালবাসা কমলো না । আমাদের বাসায় আসলেই সেটা আমি টের পেতাম ।

দ্বিতীয় বারের মত আমার গেলাম যখন মিতুর সাথে আমার বিয়ে হল । মরিয়ন খালা নিজে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন । বললেন যে যেতেই হবে ঐ বাড়িতে । আমি মিতুকে নিয়ে আবারও হাজির হলাম ঐ বাড়িতে । তবে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম যে কোন ভাবেই আমি ঐ পুকুর পাড়ে যাবো না । কিন্তু মিতুর কেন জানি পুকুরপাড়টা খুব বেশি পছন্দ হল । দিনের বেশির ভাগ সময় সে সেখানেই কাটাতে লাগলো ।
পুরো বাড়িতে তখন মানুষ বলতে খালা আর খালু । আর তাদের কিছু চাকর বাকর । খালুর বয়স হয়ে গেছে অনেক বেশি । দুই ছেলেই থাকে কানাডাতে । আমাদের সাথে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয় । তারা খালা খালুকে কতবার করে কানাডাতে নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন কিন্তু খালা খালু নাকি কোন ভাবেই রাজি হন নি । তারা ঐ বাড়ি ছেড়ে কোন ভাবেই যাবেন না ।

আমরা যাওয়াতে বাড়িটা আবারও মানুষে ভরে উঠলো । প্রথম দুদিন মনের ভেতরে ভয় কাজ করলেও আস্তে আস্তে সেটা কাটিয়ে উঠলাম । আমিও মিতুর সাথে পুকুরে পাড়ে সময় কাটাতে থাকলাম । খালার আদর আপ্যায়নে মিতু একেবারে গলে গেল । জানিয়ে দিল যে সময় পেলেও আমরা এখন থেকে এই বাড়িতেই বেড়াতে আসবো । কোন অযুহাত চলবে না ।

এই কদিনে আমার রাতে ঠিকমত ঘুম আসতো না । নতুন জাগয়াতে আমার এমনিতেও ঘুম আসতে চায় না । তা ছাড়া ঐ ভয়টা মনের ভেতরে একটু রয়েই গেছে তাই রাতে ঘুম আসতে আমার একটু সময় লাগতো। মিতু এদিক দিয়ে বেশ ভাগ্যবতী। সে যেখানেই যাক না কেন ঘুমের ব্যাপারে তার খুব একটা সমস্যা নেই। আমি বাড়ির ভেতরে এদিক ওদিক হাটতে থাকি। খালাদের বাসায় চমৎকার একটা লাইব্রেরি আছে। আমি সেখানে গিয়েও বই নাড়াচাড়া করি। তবে আজকে সেটাও ভাল লাগছিল না। কি মনে হল সিড়ি বেয়ে আমি ছাদের দিকে হাটা দিলাম। আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে বেশ। সব কিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বাতাসটাও স্নিগ্ধ আর মোলায়েম মনে হল। মিতুর সাথে কিছু এখানে থাকতে পারলে ভাল লাগতো।

ছাদে কিছু সময় হাটাহাটি করতেই মন টা শান্ত হয়ে এল। মনে হল যে এখন ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেই আমার ঘুম আসবে। সিড়ি ঘরের দিকে পা বাড়াতে তখনই আমার চোখ চলে গেল পুকুরের দিকে। ছাদ থেকে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে পুকুত পাড়টা দেখা যায় পরিস্কার। সেদিকে তাকাতেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো। আমার চোখের ভুল হওয়ার কথা না। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেখানে কেউ দাড়িয়ে রয়েছে। এতো দুর থেকেও আমার সেই ঘোলা চোখ আর পানিতে ভেজা ফ্যাকাসে সাদা চামড়ার মেয়েটিকে চিনতে মোটেই কষ্ট হল না। আমার মনে হল আমার পায়ে যেন শিকল বেঁধে দিয়েছে। আমি নড়তে পারছি না। মেয়েটি একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও তার দিকেই তাকিয়ে আছি।

-কি দেখছো?

আমি চমকে ফিরে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি মিতু দাড়িয়ে আছে। ওকে দেখে জানে পানি এল। আমার কাছে এগিয়ে এসে মিতু বলল, কি ব্যাপার এই রকম লাগছে কেন তোমাকে?

আমি মিতুর সেই কথার জবাব না দিয়ে বললাম, আচ্ছা দেখোতো পুকুর পাড়ে কেউ আছে কি না!
মিতু রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দেখলো কিছু সময় তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যা বিশাল বড় বড় ভুত রয়েছে দাড়িয়ে। তুমি এখনও সেই পুরনো কথা মনে রেখেছো?

আমি হাসলাম। মিতুর উপস্থিতিতে আমার ভয় কেটে গিয়েছে। আমি এবার মিতুর দিকে ভাল করে তাকালাম। বললাম, তুমি এখানে?
মিতু বলল, ঘুম ভেঙ্গে দেখি তুমি পাশে নেই। মনে হল লাইব্রেরিতে আছো সেখানেও না পেয়ে এখানে চলে এলাম। এসে দেখি কাঠ হয়ে দাড়িয়ে আছো।
আমি আবার লজ্জিত ভাবে হাসলাম। তারপর বললাম, তোমার কথাই মনে করছিলাম। ভাবছিলাম তুমি পাশে থাকলে চমৎকার হত।
-ইস ঢং।
-ঢং না। সত্যিই বলছি।

আর কিছু সময় মিতুর সাথেই হাটাহাটি করলাম। তারপর মনে হল এই জ্যোৎস্নায় মিতুর সাথে একটা ছবি তোলা দরকার। একটা চেন ইন দিলেও মন্দ হবে না। ইঞ্জয়িং জ্যোৎস্না উইথ মিতু।
মিতুকে বললাম, তুমি এখানে বস আমি এক দৌড়ে মোবাইলটা নিয়ে আসি। একটা ছবি তোলা যাক। ভয় পেয় না কিন্তু।
মিতু মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল, ইস আমি তোমার মত ভয় পাই না। যাও জলদি যাও।

আমি দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। বিছানার পাশের টি-টেবিলের উপরেই ফোনটা রাখা। আমি ফোন হাতে নিয়ে আবার বের হতে যাবো তখনই আমার চোখ গেল বিছানার উপর। জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো আসছে পরিস্কার। সেই আলোতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে মিতু বাচ্চাদের মত করে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। ঠিক যেমন ভাবে ওকে রেখে গিয়েছিলাম।

আমার বুকের ভেতরটা আবারও কেমন কেঁপে উঠলো। অনুভব করলাম কেউ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে । আমার কেন জানি জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে মোটেই সাহস হল না ।

আমি মিতুর পাশে শুয়ে পড়লাম চুপচাপ। সারাটা রাত আমার এক ফোটা ঘুম এল না। মনে মনে ঠিক করে নিলাম যে এই বাড়িতে আর একটা মুহুর্তও নয় । কাল সকালেই আমাকে চলে যেতে হবে । অফিসের কাজের অযুহাত দেখিয়ে পরদিনই ঐ বাড়ি থেকে চলে আসি ঢাকাতে।

তারপর আর যাওয়া হয় নি। এরপর খালু মারা গিয়েছেন, খালার স্ট্রোক হয়েছে কিন্তু আমি ঐ বাড়িতে একবারও যাই নি আর। কিন্তু এইবার যেতে হল। পরদিনই মিতুকে নিয়ে আবারও হাজির হলাম মরিয়ম খালার বাড়িতে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। খালার দুই ছেলে দেশে ফিরেছে, তাদের আর আমাদের পরিচিত সবাই এসেছে। খালার অবস্থা আসন্ন। আর খুব বেশি সময় নেই।

খালিদ ভাই আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছেন। খালা নাকি আমাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। বাসায় পৌছানোর পরপরই খালিদ ভাই আমাকে সরাসরি তার ঘরে নিয়ে গেলেন। খালা বিছানাতে শুয়ে আছেন। তার আশে পাশে অনেক মানুষ। কিছু পরিচিত আর কিছু অপরিচিত। দেখলাম আস্তে আস্তে ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। ঘরের ভেতরে মিতু আমি আর খালিদ ভাই রয়েছে। খালা আমাকে চোখের ইশারাতে কাছে যেতে বললেন। আমি কাছে গেলাম। বুঝলাম তিনি আরও কাছে যেতে বলছেন। বেশি জোরে কথা বলতে পারছেন না। আমি আমার কানটা খালার আরও কাছে নিয়ে গেলাম। খালা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, খুখু তোরে খুব পছন্দ করতো বাজান, ওরে দেইখা ভয় পাইস না। তুই ছাড়া আর কেউ ওরে দেখোনের নাই। ওরে একটু দেইখা রাখিস। ভয় পাইস না।

আমি অবাক হয়ে খালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বুঝতে বাকি রইলো না খালা আসলে কি বলতে চাইছে। খুখু খালার সেই পানিতে ডুবে যাওয়া মেয়েটির নাম। আমি যে ভয় পেয়েছিলাম এটার কারণ খালা জানতো।


খালা মারা গেলেন দুপুরের দিকে। দাফনের কাজ শেষ করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। সন্ধ্যার আগ দিয়েই বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। কেবল কাছের কজন আত্মীয় রয়ে গেল। রাতের বেলা খালিদ ভাই আমাকে অদ্ভুত একটা তথ্য দিলেন। খালা অন্য সব সম্পত্তি তাদের দুই ভাইয়ের নামে লিখে দিয়ে গেলেও এই বাড়িটা আমার জন্য দিয়ে গেছেন। তার খুব ইচ্ছে আমি যেন এই বাড়িটা নিই। মাঝেমধ্যে এখানে থাকি।
আমি খালিদ ভাইকে বললাম, আমি এই বাড়ি নিয়ে কি করবো? এটা তোমাদের। তোমরাই নিয়ে নাও।
খালিদ ভাই বলল, মায়ের শেষ ইচ্ছেটা রাখ তুই। আমরা কেউই আর দেশে আসবো না। এই জায়গা সম্পত্তি দিয়ে কি করবো বল, নিজেদের যা আছে তাই অনেক। তুই মাঝেমধ্যে এসে একটু দেখে রাখিস।

আমি আর কোন কথা বলতে পারলাম না। ঠিকই বুঝতে পারছিলাম যে খালা কেন এই বাড়িটা আমাকে দিয়ে গেছেন।

পরিশিষ্টঃ

-আব্বু সন্ধ্যা হয়ে গেছে । ঘরে যাবে না?

পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার ছোট মেয়েটা দাড়িয়ে পরেছে । এতো সময় সে পুরো বাড়িটা দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে । সন্ধ্যা বেলা পুকুর থেকে হাত পা পরিস্কার করে বাসার দিকে পা বাড়িয়েছে । আমাকেও সাথে যেতে বলছে । আমি বললাম, তুমি যাও মামনি আমি আসছি !
সে আর দাড়ালো না । বাড়ির দিকে পা বাড়ালো । আমি দাড়িয়ে রইলাম । পুকুর পাড়ে । আজও আমার এখানে দাড়িয়ে থাকতে ভয় করে বেশ । তবুও আমি দাড়িয়ে থাকি । ভয় করলেও আমার দাড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে । সত্যিই যদি খুখু থেকে থাকে সে নিশ্চয়ই জানে যে আমি তার জন্য দাড়িয়ে আছি । ভয় পেলেও দাড়িয়ে আছি ।

ভাগ্যে আমার লেখা ছিল মরিয়ম খালার বাড়িতেই থাকতে হবে । সেটা আমি চাইলেও এড়াতে পারলাম না । অফিস আমাকে নতুন ব্রাঞ্চের দায়িত্ব দিয়ে এই মুঞ্জগঞ্জে পাঠানো হল । ঢাকা থেকে খুব বেশি দুরে নয় বলে আমার আপত্তি কোন ভাবেই টিকলো না । অফিস থেকে বলা হল যে কয়েক বছর আমাকে এখানে থাকতে হবে । কাজ কর্ম গুছিয়ে আনার পরে আবার আমার পোস্টিং ঢাকাতে করা হবে । আমার রাজি না হয়ে উপায় ছিল না ।

শুরুতে ভেবেছিলাম যে এই বাড়িতে থাকবো না কিন্তু মিতুর কারনে সেটাও পারলাম না । তার কথা হচ্ছে নিজেদের এতো বড় থাকতে ভাড়া বাসায় কেন থাকবো ! তারপর থেকেই এখানেই আছি । আমাদের ছোট মেয়ে টুনুর জন্মও এখানেই । এই বাড়িতে আসার পরে আমাদের কারোই কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নি । কিন্তু সব সময়ই কারো উপস্থিতি অনুভব করতে পারি । বারবার কেন জানি মনে কেউ আমাকে দেখছে কোথা থেকে । আমাদের আদৃশ্য আত্মীয়ের মত করে আমাদের সাথে সাথে আছে । মরিয়ম খালা যেমন করে আমাকে খুব আদর করতেন, আমাকে খুব আপন বলে মনে করতেন, আমার কেন জানি মনে হয় সে তার মেয়েও একই ভাবে আমাকে খুব আপন বলে মনে করে। আমার খারাপ কিছু মনে হয় না । এখনও একটু একটু ভয়ের অনুভূতি হলেও আমার এই বাড়ির প্রতি একটা আলাদা মায়া জন্মে গেছে, কেবল বাড়িই সেই অদৃশ্য খুখুর প্রতিও। মরিয়ম খালার কথাটা কানে আমার প্রায়ই বাজে ! ‘খুখু তোরে খুউব পছন্দ করে। ওরে ভয় পাইস না।‘

আমি পুকুরটাকে পেছনে রেখে বাড়ির দিকে হাটা দিলাম । কানে হঠাৎ করেই সেই শব্দটা শুনতে পেলাম । কেউ যেন পানি থেকে উঠে আসছে । আমি চোখ বন্ধ করে খালার কথাটা আবার মনে করার চেষ্টা করলাম, খুখু তোরে খুউব পছন্দ করে। ওরে ভয় পাইস না



গল্পটা গতবছর লেখা হয়েছিলো । করোনা কালে বিপদে পরা মানুষদের সাহায্যের জন্য একটা অনলাইণ ম্যাগাজিন বের করার উদ্যোগ ফ্রেন্ডলিস্টের কয়েকজন । অনেক ভাল ভাল লেখকেরা লেখা জমা দেন । সেখানে আমার এই গল্পটাও জমা পড়েছিলো । এখানে বলে রাখি এই ম্যাগাজিন বিক্রি করে প্রায় দেড় লাখ টাকা উঠেছিল তখন যা সবই সাহায্য হিসাবে দেওয়া হয়েছিলো ।
picture source
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০২১ দুপুর ১২:৩৪
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×