আপনাদের ঈদ গুলো কেমন কাটে এখন ?
একটা সময় ছিল কত আগ্রহ নিয়ে ঈদের জন্য অপেক্ষা করতাম । কত পরিকল্পনা কত জল্পনা কল্পনা । ঈদের দিনের আগে চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে ঈদের দিনের নামাজ পড়তে যাওয়া কত কিছু ছিল ! কিন্তু এখন ঈদের দিন গুলো কেমন যেন একই রকম রয়ে গেছে । বড় হয়ে যাওয়ার সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এই ছোট বেলার নির্মল আনন্দ গুলো থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে ফেলা । এখন ঈদ মানেই হচ্ছে সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠো, গোসল করে ঈদের নামাজ পড়তে যাও তারপর ঈদ শেষ । সারা দিন বাসায় শুয়ে বসে থাকো আর বিকেল হয়ে একটু বাইরে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দাও । আমার গত কয়েক বছর ধরে ঈদ বলতে এই ছিল ।
ছোট বেলায় ঈদের নতুন জামা কাপড় পরে ঈদের নামাজ পড়তে হাজির হতাম । যাওয়ার পথে কত কিছু চোখে পড়তো । ঈদগায়ে যাওয়ার পথে অস্থায়ী ভাবে নানান দোকান পাট বসতো । কিন্তু সমস্যা ছিল যে তখনও হাতে ঈদী এসে পৌছাতো না । তাই চাইলেও কিছু কেনা যেত না ।
আমার ছোট বেলার সব ঈদ করা হত আমার নানা বাড়ি । ওখানেই আমার সব কাজিনটা চলে আসতো । এক সাথে কত গল্প কত আনন্দ তখন আমরা করতাম । আমার কেবল মনে আছে জীবনের একটা ঈদ আমি করেছিলাম আমার দাদা বাড়ি বিক্রম পুরো । সেবার সারা দিন ব্যাপি কেবল বৃষ্টি হচ্ছিলো । সকালে নামাজ পড়ে এসে সেই যে বাসার ভেতরে ঢুকেছিলাম আর বের হই নি । ছোট বেলাতে তেমন ঈদ যেন আমি কল্পনাই করতে পারতাম না । তারপর থেকে আর কোন ঈদে যাওয়া হয় নি দাদা বাড়ি । সব সময় নানা বাড়িতেই ঈদ হত । এরপর তো নানা বাড়ির পাশেই স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করলাম । তখন ভেবেছিলাম এবার থেকে সব ঈদ গুলো বড় চমৎকার হবে । কিন্তু তারপরই হঠাৎ করেই যেন বড় হয়ে গেলাম । খেয়াল করে দেখলাম যে ঈদ আর আগের মত আনন্দময় মনে হচ্ছে না । ঈদের সারা দিন আসলে আমার কোন কিছু করার নেই শুয়ে বসে থাকা ছাড়া !
ছোট বেলায় ঈদের সব থেকে চমৎকার ব্যাপারটা ছিল ঈদের সালামী । আমি প্রথম ঈদে সালামী পেয়েছিলাম ২০ টাকা । এটা আমার মনে আছে । এই পরিমান টাকাটা তখন আমার কাছে বিরাট কিছু । বিশ টাকা দিয়ে কত কিছু করে ফেলা যেত । সেইবারের ঈদটা আমরা করেছিলাম যশোরে । আমাকে ২০ টাকা দেওয়া হয়েছে ঈদের সালামী হিসাবে । কিন্তু আমার বড় ভাই ঈদের সালামী হিসাবে ৫০ টাকা দাবী করে বসলো । নয়তো সে ঈদ করবে না বলে ঘোষনা দিল । এবং ঘোষণা মোতাবেক সে বাড়ির সামনে পুরানো জামা কাপড় পরে মন খারাপ করে বসে রইলো । নতুন জামা সে পরবে না । আমি ২০ টাকা ঈদ নিয়ে, নতুন জামা কাপড় পরে তার আশে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছি, দেখার চেষ্টা করছি সে কী করে ! অবশেষে বাবার মন গলল । তাকে ৫০ টাকাই দেওয়া হল । তারপরই সে নতুন জামা পরলো । আমি সেই ২০ টাকা নিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম । মনে হল যে আমাকেও তো তাহলে ৫০ টাকা দেওয়া উচিৎ তবে সাহস করে সেই কথা বলা হল না ।
আমি মুলত কখনই অন্য মানুষের কাছ থেকে ঈদী আশা করতাম না । ঈদ যা সব ছিল বাবার কাছ থেকেই । স্কুল জীবে সেই ঈদী ৫০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিলো । তারপর যখন ঢাকায় চলে এলাম । টিউশনী শুরু করলাম তারপর থেকে ঈদ চাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । তখন শুরু হল ঈদ দেওয়ার পালা । বাসায় এসে ঈদ দেওয়া হত ভাইয়ের ছেলেকে । সে শুরু থেকেই পেত ৫০০ টাকা । আমি ঈদী পাওয়া শুরু করেছিলাম ২০ টাকা থেকে তার শুরুটা হল ৫০০ টাকা দিয়ে ।
তবে গত বছর একটু ব্যতীক্রম হল । করোনার কারণে ঈদে বাসায় যাওয়া হল না । ঈদ ঢাকাতে করলাম । বিকেল বেলা হাজির হলাম আমার সব স্টুডেন্টদের বাসায় । ঢাকাতে আমার আপন বলতে আমার ছাত্রছাত্রী এবং এদের পরিবারের মানুষ । ঈদে সবার বাসায় দাওয়াত খেলাম । এবং স্টুডেন্টদের ঈদী দিলাম । এবং সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে আন্টি আঙ্কেলরা আমাকেও ঈদী দিল । অনেক বছর পরে ঈদী পেয়ে আমার মনটা ভাল হয়ে গেল খুব । ঈদী পাওয়া সেই টাকা গুলো এখনও আমার কাছে রয়েছে । সেই নোট করে আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি ।
ছোট বেলার আরও একটা মজার কাণ্ড ছিল বোম ফুটানো । অবশ্য আমি দুর থেকে দেখতাম এসব। বোম বাজি ফুটানোতে আমার কাজিন আর বড় ভাই ছিল পারদর্শী । তবে একটা সমস্যা ছিল । আমার ছোট খালা একটু মানসিক ভাবে চ্যালেঞ্জড মানুষ । সে বাজি ফুটানোর আওয়াজে ভয় পেত । এটা নিয়ে আমার বাবা বারবার আমার বড় ভাইকে মানা করতো বাজি না ফুটানোর জন্য । কিন্তু তবুও সে ফুটাতো । এক ঈদের একটা দৃশ্য এখনও আমার চোখে ভাসে । বাজি ফুটানোর পরপরই আমার বাবা ভাইয়াকে বকছে এবং মারার জন্য তার পেছনে দৌড়াচ্ছে । ভাইয়া সামনে সামে দৌড়াচ্ছে । আমি আমাদের বাড়ির গাড়িবারান্দার উপর থেকে সেই দৃশ্য দেখছি । এই দৃশ্যটা আমি কোন দি ভুলবো কিনা কে জানে ।
এখন অবশ্য এসবে আর কারো আগ্রহ নেই । আমার ভাইয়ের ছেলে যখন ছোট ছিল তখন সে একবার তার দাদার কাছে বায়না ধরলো যে বাজি ফুটাবে । সাথে সাথে এক কাটন বাজির বক্স এসে হাজির । আমরা সেইবার বাসার ভেতরেই বাজি ফুটিয়েছিলাম । সময়ের সাথে সাথে ভাইয়ের ছেলেও বাজি ফুটানোর ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে ।
ঈদের নতুন জামা কিনতেই হবে । এমন ছিল ছোট বেলার মনভাব । আর শেষ কবে আমি ঈদে নতুন কিছু কিনেছি সেটা আমার মনেও পড়ে না । এখনকার ঈদ মানে কেবল নামাজ পরা আর বিকেল বেলা পুরানো বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়া । আজকে একটু আগে বাইরে গিয়েছিলাম । স্কুল জীবনের বন্ধুদের সাথে দেখা হল । অবশ্য দুইদিন আগে ইফতার পার্টিতেও তাদের সাথে দেখা হয়েছিল ।
বড় হয়ে গেলে ঈদের আনন্দ বলে আসলে কিছু থাকে না । বড় হওয়ার এই এক সমস্যা !
তা আপনাদের ঈদ কেমন কাটলো ?
সবাইকে ঈদ মোবারক !
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২২ রাত ৯:২৪