হাসপাতাল আমার কাছে কখনও কোন ভাল লাগার জায়গা না । আমার মত মনে হয় অনেকেই এই স্থানটাকে পছন্দ করেন না । তবে আমার কেন জানি একটু বেশিই অশান্তি লাগে এই জায়গাতে যেতে । এমন কি কাছের কোন মানুষও যদি অসুস্থ হয় তারপরেও আমি পারতপক্ষে হাসপাতালের করিডোর মাড়াই না । সব সময় দুরে দুরে চলি ।
হাসপাতালে না যাওয়ার পেছনে একটা কারণ বোধ হয় এইটা যে আমার মনে হয় আমি এই হাসপাতালে গিয়ে কী করবো? আমার তো এখানে আসলে আর কিছুই করার নেই । শুধু শুধু সেখানে গিয়ে আমার কাজটা কী !
এটা যদিও একটা কারণ, তবে প্রধান কারণটা আসলে অন্য । হাসপাতাল আসলে এমন একটা স্থান সেখানে মানুষ নিজের সব থেকে অসহায় অবস্থাটা প্রকাশ করে । মানুষের এই অসহায়, হেরে যাওয়ার চেহারা আমার মোটেও দেখতে ইচ্ছে করে না । তাদেরকে আমি চিরায়িত ভাবে যেভাবে দেখে এসেছি সেই রূপেই দেখতে পছন্দ করি । ব্যাপারটা কিন্তু এমন না যে কেবল হাসপাতলে যে ভর্তি সেই মানুষটাই অসহায় হয়ে পড়ে, তাকে ঘিরে আরও অনেক গুলো মানুষের চেহারাতে এই অসহায়ত্বের ভাব ফুটে উঠে।
এই প্রথম ব্যাপারটা আমি খেয়াল করি স্কুলে পড়া সময়ে । আমার মায়ের পেটে একটা ছোট পাথর হয়েছে । সেটা কেটে বাদ দিতে হবে । খুবই ছোট অপারেশন । যথারীতি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল । অপারেশনের আগের দিন আমরা সবাই গিয়েছি । একটু পরেই আম্মুকে ওটিতে প্রবেশ করানো হবে । এমন সময়ে আমি আমার আব্বাকে কাঁদতে দেখলাম ।
ব্যাপারটা আমাকে এতো তীব্র ভাবে ধাক্কা দিল সেটা আমি বলে বোঝাতে পারবো না । আমি সারাজীবন আমার আব্বাকে শক্ত মানুষ হিসাবে দেখে এসেছি । তাকে সব সময় জমের মত ভয় পেয়ে এসেছি। শক্ত হাতে সে সব সময় সব কিছু সামলেছেন অথচ সেদিন তার চেহারায় কী একটা অসহায় ভাব ছিল সেটা আমি হয়তো কোন দিন ভুলতে পারবো না ! তারপর থেকে আমি সব সময় হাসপাতাল থেকে দুরে থাকার চেষ্টা করতাম !
কোভিটের সময় আমার আব্বাকে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হল । তখন তার অবস্থা গুরুতর । অবস্থা এমনই যে তাকে ঢাকা নিয়ে আসতে হল । আমি খুব করে চাচ্ছিলাম আবার বাবার সেই অসহায়ের চেহারাটা যেন আমি আর না দেখি ! কিন্তু ঢাকায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই । সেই চেহারাটা আবারও আামকে দেখতে হল । কী শক্ত সমর্থক আমার বাবা ছিলেন । সে কিনা কেমন শান্ত আর নির্জিব হয়ে গেছেন । ঐ কোভিটের সময়ে আমি প্রায় দশদিন ছিলাম হাসপাতালে । আমাদের সাথে আরও কত গুলো মানুষ ছিল । কেউ গরীব, কেউ ধনী । সবাই এক সাথে অথচ সবার চেহারাতেই সেই অসহায়ত্ব ভাব !
আমার স্টুডেন্ট নেহাল । সেই ছোট বেলা থেকে ওকে পড়িয়ে এসেছি । ক্লাস নাইনে ওঠার পর ওর ক্যান্সার ধরা পরলো । প্রায় তিন মাস সিঙ্গাপুর চিকিৎসা করার পরে দেশে ফিরে এল । ওখানকার ডাক্তারেরা তাদের অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন । শেষ কটা দিন দেশে নিয়ে যেতে বললেন । দেশের আসার পরে আমি যাবো না যাবো না করেও দেখতে গেলাম ওকে । এখন মনে হয় না যাওয়াটাই সম্ভবত ভাল ছিল । কারণ ছোট বেলা থেকে ওর যে সুন্দর নিষ্পাপ চেহারাটা আমি দেখে এসেছি সেটাই আমার মনে থাকতো তাহলে । শেষ সময়ে ওর চেহারাটা আমি মোটেই মনে করতে চায় নি । ক্যান্সার ওর চেহারাকে কী করে ফেলেছিল ! আমি চাইলেও সেই চেহারা ভুলে যেতে পারি না !
গত সপ্তাহে আমার সব কাছের বন্ধুটির মা হার্ট এটাক করেছে । প্রতিদিন আমি স্কোয়ারের সামনে দিয়েই আসি । ভেবেছিলাম হাসপাতালে যাবো না দেখতে । তবুও আজকে গিয়ে হাজির হলাম । পুরানো সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে এল আমার ! আস্তে আস্তে সেই সব স্মৃতি গুলো ফিরে এল !
আমি মানুষজনকে তাদের চিরায়িত চেহারাতে দেখতে ভালোবাসি ! তাদের অসহাত্ব আমাকেও কেমন অসহায় করে তোলে ! আমার মনে শান্তি লাগে না । মনের ভেতর থেকে সেই চেহারাটা আমি দুর করতে পারি না ।
জগতের সব মানুষ গুলো ভাল থাকুক !
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৮:৫৮