পৃথিবীর নানান প্রান্তে নানা রকম লেজেন্ড বা কিংবদন্তী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । শত শত কিংবা হাজার বছর ধরে লোকের মুখে মুখে বেঁচে আছে এই সব কিংবদন্তী । লেজেন্ড কিংবা কিংবদন্তী ঐ সমস্ত এলাকার নিজেস্ব সংস্কৃতির সাথে যুক্ত, সংস্কৃতির অংশ। আজকে আমাদের দেশের সিলেট জেলার একেবারে শেষে অবস্থিত দিনারপুর পরগনার একটা কিংবদন্তীর কথা বলছি । এই এলাকার পূর্বপাড়ায় রয়েছে একটা সুউচ্চ পাহাড় । এই পাহাড়ের দক্ষিণে রয়েছে আরও একটু সুউচ্চ টিলা । এই টিলার নাম মীরটিলা । এর আশে পাশে আরও অনেক উচু নিচু টিলা অবস্থিত । সব থেকে উচু টিলার নাম হচ্ছে কুড়িটিলা । এই টিলাতে অবস্থিত একটা বড় কালো পাথর নিয়ে আজকের কিংবদন্তী । শত শত বছর ধরে এই কারো পাথরের গল্প ছড়িয়ে রয়েছে এলাকার মানুষের মুখে মুখে । এই পাথরের রয়েছে রহস্যময় কিংবদন্তী ।
এই পরগনার অন্যতম সমৃদ্ধ বাজারের নাম হচ্ছে ইমামবাজার । এই ইমামবাজার তখন খুবই কর্মব্যস্ত বাজার ছিল । এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল জিনিস পত্র কেনাবেঁচা হত প্রতিদিন । সেই সাথে বড় মাছের বাজার । জেলেরা মাছ ধরে এনে এই বাজারে বিক্রি করতো । এইখানেই মাছ কাটা হত । এই মাছ কাটার পরিত্যাক্ত অংশ টুকু বাজার থেকে একটু দুরে ফেলে দেওয়া হত । এই পরিত্যাক্ত মাছের অংশ গুলো প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় একজন সৌম্য চেহারার সাদা পোশাক পরা বৃদ্ধ দরবেশ কুড়িয়ে নিয়ে যেত । এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা অন্য কারো চোখে না পড়লেও, চোখে পড়ে এলাকার প্রসিদ্ধ সামসু ডাকাতের । অবাক হয়ে সামসু ডাকাত খেয়াল করলো যে এই বৃদ্ধ দরবেশ প্রতিদিন মাছ কাটার ফেলে দেওয়া অংশ গুলো সংগ্রহ করে নিয়ে পাহাড়ের দিকে হেটে যেতেন । একদিন কৌতুহল নিয়ে সে বৃদ্ধ লোকটার পিছু নিল ।
দরবেশের পিছু আসতে আসতে সামসু ডাকাত এসে হাজির হল কুড়িটিলার কাছে । সেখানে একটা বড় কালো পাথর আছে । তার সামনে দাড়াতেই সামসু ডাকাত এক আশ্চর্য ঘটনা দেখলো । সে দেখলো কালো পাথরটা যেন অদৃশ্য ইশারা পেয়ে সরে দাড়ালো এবং তার পেছন থেকে একটা আলোকিত সুরঙ্গ পথ বের হয়ে এসেছে । তারপর দরবেশ সেই পথেই প্রবেশ করলো । এবং পাথরটা খোলা অবস্থায় রেখে দিল । যেন সামসুকে ভেতরে আসার আমন্ত্রন জানাচ্ছে বৃদ্ধ দরবেশ ।
এতো সময় আড়াল থেকেই সব কিছু দেখছিলো সামসু ডাকাত । কিন্তু দরবেশ ভেতরে চলে যাওয়ার পরে এবং পথটা খোলা রেখে যাওয়ার কারণে সামসু ডাকাত বেশ ভয় পেল । সে বুঝতে পারলো যে তাকে ঠিকই লক্ষ্য করেছে দরবেশ । এবং তাকে ভেতরে ঢোকার জন্যই আমন্ত্রন জানিয়েছে । ঢুকবে কি ঢুকবে না এটা নিয়ে কিছু সময় দোটানায় ছিল সে । পরে কৌতুহলের কাছে ভয় পরাজিত হল । ভেতরে প্রবেশ করলো সে । কিন্তু ভেতরে ঢুকে আরেকবার অবাক হয়ে গেল ।
সামসু ডাকাত দেখতে পেল সুরঙ্গের ভেতরে রীতিমত বিশাল রাজপ্রাসাদ । চারিদিকে অপুরূপ সৌন্দর্য । ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত সোনাদানা আর মনিমুক্তা । সুন্দর ঘ্রাণে সুরোভিত চারিদিক । একটু দুরেই বসে আছে সাতজনের একটা সুসজ্জিত দল । এবং এই দলের একজন হচ্ছে সেই বৃদ্ধ দরবেশ । সবার পরনেই বৃদ্ধের মত সাদা পোশাক । সবাই খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে । সামনে থালা পেতে রাখা । বৃদ্ধ সাথে করে আনা সেই ব্যাগ থেকে খাবার প্লেটে সাজাতে শুরু করলো । সামসু আরেকবার অবাক হয়ে গেল । কারণ এই ব্যাগে করে বৃদ্ধ দরবেশ নিয়ে এসেছিলো মাছের উচ্ছিষ্ট অংশ অথচ তিনি ব্যাগ থেকে বের করছেন সুস্বাদু সব খাবার ।
খাবার গুলো সাজানো হল আটটি প্লেটে । প্লেটের সংখ্যা আট দেখে দরবেশের একজন সঙ্গী বলল যে তারা তো সাত জন তাহলে প্লেট আটটা কেন । তখন বৃদ্ধ দরবেশ স্মিত হেসে বলল, আজকে আমাদের সাথে একজন অতিথি রয়েছে । তারপর সামসুর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে তাদের সাথে যোগদানের আমন্ত্রন জানালো ।
সামসু ততক্ষণে বুঝে গেছে যে বৃদ্ধের কাছ থেকে কোন ভয়ের কারণ নেই । সে আড়াল থেকে বের হয়ে এল এবং তাদের সাথে খাবারে অংশ নিলো । জীবনে এতো সুস্বাদু খাবার সামসু খায় নি এর আগে । খাওয়া শেষ করে গভীর রাতে সামসুকে আবার দরবেশ বৃদ্ধ গুহার মুখে পৌছিয়ে গেল এবং তাকে সতর্ক করে দিল যে এই গুহার কথা যেন সে কোন দিন কারো কাছে না বলে । যদি বলে তাহলে সে মারা পরবে ।
বাসায় পৌছে সামসুর মাঝে এক বিশাল পরিবর্তন এল ।সে ডাকাতি ছেড়ে দিলো । নামাজ কালাম শুরু করলো । এলাকার লোকজন আগে সামসু ডাকাতের নাম শুনে ভয়ে কাঁপতো । তাই তার ভেতরে এই পরিবর্তন সবার মনেই কৌতুহলের জন্ম দিলো । সবাই তাকে চেপে ধরলো আসল কারণ জানার জন্য । অনেক চাপাচাপির পরে সামসু ঐ দিকের ঘটনা সব খুলে বলল । এবং সত্যি সত্যি পরের তিন দিনের জ্বরে সামসু মারা গেল ।
কুলিটিলার আশে পাশে বাসিন্দরা লোভে পরে সেই সুরঙ্গের খোজ করতে লাগলো । কিন্তু সেই কালো বড় পাথর ছাড়া তারা আর কিছু পেল না । একজন সেই পাথরে কুড়াল দিয়ে আঘাত করলে পরে সেও তিনদিনের ভেতরে মারা যায় ! তারপর থেকে লোকজন এই পা থরকে ভয় পাওয়া শুরু করে । নানান রকম গল্প প্রচলিত হতে থাকে । সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রায় নয়শ বছর আগে এই পাথরের দৈর্ঘ্য ছিল সাত ফুট প্রস্থ ছিল পাঁচ ফুট । কিন্তু বর্তমানে এর দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট এবং প্রস্থ ১১ ফুট । তবে এই পরিমাপ নিয়ে নানান রকম বিদ্রান্ত ছড়িয়ে রয়েছে । কোথাও বর্তমান পরিপাপটা বলা হয়েছে ১২ বাই ৯ ফুট আবার কোথাও বলা হয়েছে ৫৫ বাই ৩৩ ফুটের কথাও উল্লেখ রয়েছে । গল্পের আরেকটা ভার্শনে বলা আছে যে ৭ জন দরবেশ নয়, দরবেশ ছিল ২১ জন। সেখানে সামসু ডাকাতের বদলে গ্রামের হেতিম আলীর কথা বলা হয়েছে । তবে মুল গল্প সেই একই রকম !
এলাকা বাসীর মুখে মুখে এই গল্প বছরের পর বছর প্রচলিত হয়ে আসছে । এলাকার মানুষ এই গল্প স্রেফ কুসংস্কার বলেই বিশ্বাস করে । তারপরেও এই রহস্যময় কালোপাথর দেখতে অনেক মানুষ আসে নিয়মিত । কালের বিরবর্তনে বন পাহাড় উজার হয়ে গেলেও এই পাথরটা রয়ে গেছে আর রয়ে গেছে সেই প্রচলিত কিংবদন্তী ।
তথ্যসুত্র
বাংলা কিংবদন্তী - আসাদুজ্জামান জুয়েল
কুড়িটিলায় রহস্যময় কালোপাথর
টিলার ওপর রহস্যেঘেরা কালো পাথর - বাংলা ট্রিবিউন
ইনসাইড আর্টিকেল ‘কালো পাথর’
রহস্যঘেরা কালো পাথর - এম এ আহমদ আজাদ, নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ)
ছবি উৎস