somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা কিংবদন্তীঃ কুড়িটিলার কালোপাথর

১২ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পৃথিবীর নানান প্রান্তে নানা রকম লেজেন্ড বা কিংবদন্তী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । শত শত কিংবা হাজার বছর ধরে লোকের মুখে মুখে বেঁচে আছে এই সব কিংবদন্তী । লেজেন্ড কিংবা কিংবদন্তী ঐ সমস্ত এলাকার নিজেস্ব সংস্কৃতির সাথে যুক্ত, সংস্কৃতির অংশ। আজকে আমাদের দেশের সিলেট জেলার একেবারে শেষে অবস্থিত দিনারপুর পরগনার একটা কিংবদন্তীর কথা বলছি । এই এলাকার পূর্বপাড়ায় রয়েছে একটা সুউচ্চ পাহাড় । এই পাহাড়ের দক্ষিণে রয়েছে আরও একটু সুউচ্চ টিলা । এই টিলার নাম মীরটিলা । এর আশে পাশে আরও অনেক উচু নিচু টিলা অবস্থিত । সব থেকে উচু টিলার নাম হচ্ছে কুড়িটিলা । এই টিলাতে অবস্থিত একটা বড় কালো পাথর নিয়ে আজকের কিংবদন্তী । শত শত বছর ধরে এই কারো পাথরের গল্প ছড়িয়ে রয়েছে এলাকার মানুষের মুখে মুখে । এই পাথরের রয়েছে রহস্যময় কিংবদন্তী ।

এই পরগনার অন্যতম সমৃদ্ধ বাজারের নাম হচ্ছে ইমামবাজার । এই ইমামবাজার তখন খুবই কর্মব্যস্ত বাজার ছিল । এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল জিনিস পত্র কেনাবেঁচা হত প্রতিদিন । সেই সাথে বড় মাছের বাজার । জেলেরা মাছ ধরে এনে এই বাজারে বিক্রি করতো । এইখানেই মাছ কাটা হত । এই মাছ কাটার পরিত্যাক্ত অংশ টুকু বাজার থেকে একটু দুরে ফেলে দেওয়া হত । এই পরিত্যাক্ত মাছের অংশ গুলো প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় একজন সৌম্য চেহারার সাদা পোশাক পরা বৃদ্ধ দরবেশ কুড়িয়ে নিয়ে যেত । এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা অন্য কারো চোখে না পড়লেও, চোখে পড়ে এলাকার প্রসিদ্ধ সামসু ডাকাতের । অবাক হয়ে সামসু ডাকাত খেয়াল করলো যে এই বৃদ্ধ দরবেশ প্রতিদিন মাছ কাটার ফেলে দেওয়া অংশ গুলো সংগ্রহ করে নিয়ে পাহাড়ের দিকে হেটে যেতেন । একদিন কৌতুহল নিয়ে সে বৃদ্ধ লোকটার পিছু নিল ।

দরবেশের পিছু আসতে আসতে সামসু ডাকাত এসে হাজির হল কুড়িটিলার কাছে । সেখানে একটা বড় কালো পাথর আছে । তার সামনে দাড়াতেই সামসু ডাকাত এক আশ্চর্য ঘটনা দেখলো । সে দেখলো কালো পাথরটা যেন অদৃশ্য ইশারা পেয়ে সরে দাড়ালো এবং তার পেছন থেকে একটা আলোকিত সুরঙ্গ পথ বের হয়ে এসেছে । তারপর দরবেশ সেই পথেই প্রবেশ করলো । এবং পাথরটা খোলা অবস্থায় রেখে দিল । যেন সামসুকে ভেতরে আসার আমন্ত্রন জানাচ্ছে বৃদ্ধ দরবেশ ।

এতো সময় আড়াল থেকেই সব কিছু দেখছিলো সামসু ডাকাত । কিন্তু দরবেশ ভেতরে চলে যাওয়ার পরে এবং পথটা খোলা রেখে যাওয়ার কারণে সামসু ডাকাত বেশ ভয় পেল । সে বুঝতে পারলো যে তাকে ঠিকই লক্ষ্য করেছে দরবেশ । এবং তাকে ভেতরে ঢোকার জন্যই আমন্ত্রন জানিয়েছে । ঢুকবে কি ঢুকবে না এটা নিয়ে কিছু সময় দোটানায় ছিল সে । পরে কৌতুহলের কাছে ভয় পরাজিত হল । ভেতরে প্রবেশ করলো সে । কিন্তু ভেতরে ঢুকে আরেকবার অবাক হয়ে গেল ।

সামসু ডাকাত দেখতে পেল সুরঙ্গের ভেতরে রীতিমত বিশাল রাজপ্রাসাদ । চারিদিকে অপুরূপ সৌন্দর্য । ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত সোনাদানা আর মনিমুক্তা । সুন্দর ঘ্রাণে সুরোভিত চারিদিক । একটু দুরেই বসে আছে সাতজনের একটা সুসজ্জিত দল । এবং এই দলের একজন হচ্ছে সেই বৃদ্ধ দরবেশ । সবার পরনেই বৃদ্ধের মত সাদা পোশাক । সবাই খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে । সামনে থালা পেতে রাখা । বৃদ্ধ সাথে করে আনা সেই ব্যাগ থেকে খাবার প্লেটে সাজাতে শুরু করলো । সামসু আরেকবার অবাক হয়ে গেল । কারণ এই ব্যাগে করে বৃদ্ধ দরবেশ নিয়ে এসেছিলো মাছের উচ্ছিষ্ট অংশ অথচ তিনি ব্যাগ থেকে বের করছেন সুস্বাদু সব খাবার ।

খাবার গুলো সাজানো হল আটটি প্লেটে । প্লেটের সংখ্যা আট দেখে দরবেশের একজন সঙ্গী বলল যে তারা তো সাত জন তাহলে প্লেট আটটা কেন । তখন বৃদ্ধ দরবেশ স্মিত হেসে বলল, আজকে আমাদের সাথে একজন অতিথি রয়েছে । তারপর সামসুর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে তাদের সাথে যোগদানের আমন্ত্রন জানালো ।
সামসু ততক্ষণে বুঝে গেছে যে বৃদ্ধের কাছ থেকে কোন ভয়ের কারণ নেই । সে আড়াল থেকে বের হয়ে এল এবং তাদের সাথে খাবারে অংশ নিলো । জীবনে এতো সুস্বাদু খাবার সামসু খায় নি এর আগে । খাওয়া শেষ করে গভীর রাতে সামসুকে আবার দরবেশ বৃদ্ধ গুহার মুখে পৌছিয়ে গেল এবং তাকে সতর্ক করে দিল যে এই গুহার কথা যেন সে কোন দিন কারো কাছে না বলে । যদি বলে তাহলে সে মারা পরবে ।

বাসায় পৌছে সামসুর মাঝে এক বিশাল পরিবর্তন এল ।সে ডাকাতি ছেড়ে দিলো । নামাজ কালাম শুরু করলো । এলাকার লোকজন আগে সামসু ডাকাতের নাম শুনে ভয়ে কাঁপতো । তাই তার ভেতরে এই পরিবর্তন সবার মনেই কৌতুহলের জন্ম দিলো । সবাই তাকে চেপে ধরলো আসল কারণ জানার জন্য । অনেক চাপাচাপির পরে সামসু ঐ দিকের ঘটনা সব খুলে বলল । এবং সত্যি সত্যি পরের তিন দিনের জ্বরে সামসু মারা গেল ।

কুলিটিলার আশে পাশে বাসিন্দরা লোভে পরে সেই সুরঙ্গের খোজ করতে লাগলো । কিন্তু সেই কালো বড় পাথর ছাড়া তারা আর কিছু পেল না । একজন সেই পাথরে কুড়াল দিয়ে আঘাত করলে পরে সেও তিনদিনের ভেতরে মারা যায় ! তারপর থেকে লোকজন এই পা থরকে ভয় পাওয়া শুরু করে । নানান রকম গল্প প্রচলিত হতে থাকে । সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রায় নয়শ বছর আগে এই পাথরের দৈর্ঘ্য ছিল সাত ফুট প্রস্থ ছিল পাঁচ ফুট । কিন্তু বর্তমানে এর দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট এবং প্রস্থ ১১ ফুট । তবে এই পরিমাপ নিয়ে নানান রকম বিদ্রান্ত ছড়িয়ে রয়েছে । কোথাও বর্তমান পরিপাপটা বলা হয়েছে ১২ বাই ৯ ফুট আবার কোথাও বলা হয়েছে ৫৫ বাই ৩৩ ফুটের কথাও উল্লেখ রয়েছে । গল্পের আরেকটা ভার্শনে বলা আছে যে ৭ জন দরবেশ নয়, দরবেশ ছিল ২১ জন। সেখানে সামসু ডাকাতের বদলে গ্রামের হেতিম আলীর কথা বলা হয়েছে । তবে মুল গল্প সেই একই রকম !

এলাকা বাসীর মুখে মুখে এই গল্প বছরের পর বছর প্রচলিত হয়ে আসছে । এলাকার মানুষ এই গল্প স্রেফ কুসংস্কার বলেই বিশ্বাস করে । তারপরেও এই রহস্যময় কালোপাথর দেখতে অনেক মানুষ আসে নিয়মিত । কালের বিরবর্তনে বন পাহাড় উজার হয়ে গেলেও এই পাথরটা রয়ে গেছে আর রয়ে গেছে সেই প্রচলিত কিংবদন্তী ।



তথ্যসুত্র
বাংলা কিংবদন্তী - আসাদুজ্জামান জুয়েল
কুড়িটিলায় রহস্যময় কালোপাথর
টিলার ওপর রহস্যেঘেরা কালো পাথর - বাংলা ট্রিবিউন
ইনসাইড আর্টিকেল ‘কালো পাথর’
রহস্যঘেরা কালো পাথর - এম এ আহমদ আজাদ, নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ)

ছবি উৎস
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১:২৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×