
কদিন আগে আমাদের দেশের উপর দিয়ে একটা ঘুর্নিঝড় বয়ে গেল । আমরা আগে থেকেই সেই ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে গেছি । এমন কি ঝড় কোন দিক দিয়ে যেতে পারে তার একটা ম্যাপও আমরা জেনেছি আগেই । ভূমিকম্পটা বাদ দিয়ে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার আগেই এখন মানুষ জেনে যায় কোন দিক দিয়ে কোন বিপদ আসছে । আচ্ছা যেভাবে আমরা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার আগেই সেটার ব্যাপারে খবর পেয়ে যাচ্ছি যদি মহামারি শুরুর আগেই এমন একটা বিপদ সংকেত আমরা জানতে পারতাম তাহলে ব্যাপারটা কেমন হত? কলেরা মহামারি শুরুর আগেই এমন একটা বিপদ সংকেত আবিস্কারের চেষ্টা চলছে অনেক দিন থেকেই ।
প্রাচীন কাল থেকেই কলেরা রোগটা আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে । হয়তো কখনই এই রোগটা আমাদের ছেড়ে কোনদিন যাবে না । প্রাচীন কালে এই রোগটাকে মানুষ চিনতো অপদেবতার অভিশাপ হিসাবে । ভারতবর্ষের প্রাচীন পুথি কিংব পান্ডুলিপি পড়ে জানা যায় যে আড়াই হাজার বছর আগে মুনি ঋষিরা মানুষজনকে অভিষাপ দিয়ে ভয়ংকর একটা অবস্থা খারাপ করে দিতেন । এই রকম এক ভয়ংকর অভিশাপের কথা ঊল্লেখ আছে গুজরাটের এক মন্দিরের দেয়ালে । এই ভয়ংকর অভিশাপ যার উপরে পরে তার আর রক্ষা নেই । রক্ত শূন্য হয়ে যায় কিছু সময়ের ভেতরেই । কোটরের ভেতরে চোখ ঢুকে যায় । শরীরটা শুকিয়ে যায় । আমাদের লোক সাহিত্যে এই ভয়ংকর অভিশাপটা পরিচিত অপদেবী হিসাবে । মুসলমানরা এটা বলে ওলাবিবি আর হিন্দুরা বলে ওলাইচন্ডী । আমি নিশ্চিত ওলাবিবি আপনি আপনার দাদী নানীদের কাছ থেকে গল্প শুনেছেন । কিংবা ওলাবিবির গল্প পড়েছেন বইতে । আমি অনেক গুলো ভুতের গল্প পড়েছি এই ওলাবিবি কে নি । আদতে এই ওলাবিবি হচ্ছে আমার পরিচিত কলেরা রোগ । কথিত আছে একবার ওলাবিবি যে গ্রামে ঢুকতো, সেই গ্রাম পুরো সাফ করে দিতো । এমন অবস্থা হত যে লাশ কবর দেওয়ার জন্য মানুষ খুজে পাওয়া যেত না ।বই পুস্তবে এমন গল্প আমরা অনেকেই পড়েছি ।
আগে এক সময়ে মনে করা হত যে দুর্গন্ধময় বাতাস থেকে কলেরা ছড়ায় । এই কারণে ঘিঞ্জি কিংবা স্যাতস্যাতে এলাকায় যাদের বাস তাদের কলেরায় আক্রমন বেশি করবে এমনটাই ধারণা করা হত আগে । কিন্তু যখন একবার কলেরা আক্রমন করতো তখন কিবা ঘিঞ্জি আর কিবা পরিস্কার এলাকার মানুষ, সব মরে সাফ হয়ে যেত । সর্ব প্রথম ব্রিটিশ চিকিৎসক ও অ্যানাসথেটিস্ট ডা. জন স্নো-ই নিশ্চিতভাবে ধরতে পেরেছিলেন কলেরা কোন দুর্ঘন্ধময় বাতাস থেকে ছড়ায় না । এটি ছড়ায় জীবাণু সংক্রমিত পানির মাধ্যমে । পানি হচ্ছে আসল মাধ্যম । কলেরা কিভাবে ছড়ায় সেটা কিভাবে আবিস্কার হল সেটা এই বিবিসির আর্টিকেল থেকে পড়ে নিতে পারেন ।
কলেরার কারণ, টিকা, প্রতিশেষক আবিস্কারের পরে এই রোগের প্রকোপ কমে গেছে । আগে যেমন একবার কলেরা দেখা দিলে গ্রামের পর গ্রাম সাফ হয়ে যেত এখন কিন্তু এমনটা হয় না । কিন্তু তার মানে এও নয় যে কলেরা একেবারে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । কলেরা সম্ভবত এমন একটা রোগ যেই রোগটা আমাদের ছেড়ে কোন দিন হয়তো যাবে না । এর পেছনের কারণ হচ্ছে কলেরার জীবানুর আদি নিবাস হচ্ছে পানি । বলা যায় যে, যে যে স্থানে পানি থাকবে প্রায় সব স্থানেই থাকবে এই কলেরার জীবানু থাকবে কলেরার রোগ । আমরা যেহেতু পানি ঘেষা জীব । আদি কাল থেকে যেমন পানির উৎসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো নগর গ্রাম সভ্যতা, সেই রীতি কিন্তু এখনও রয়েছে । সেই হিসাবে এই কলেরার জীবানুর পাশেই আমাদের বসবাস সব সময় । প্রকৃতি থেকে এই রোগ কোন দিন নিশ্চিহ্ন হবে না।
আবার অনেক রোগ আছে যে যার টিকা একবার আপনি দিলে সেই রোগ আর আপনার হওয়ার সম্ভবনা নেই । গুটিবসন্তের টিকা যদি আপনি একবার দেন তাহলে এই রোগ আর আপনার হবে না । তার মানে হচ্ছে যদি যদি প্রকৃতিতে এই রোগের জীবানু কোন ভাবে থেকে গেলেও এই জীবানু আপনার দেহে ঢুকলেও কাজ হবে না । কিন্তু কলেরার ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটে অন্য রকম । কলেরার টিকা দিলে আপনি সারা জীবন এই রোগ থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা পাবেন না । যে টিকা আবিস্কৃত হয়েছে সেই টিকা মানুষকে দুই থেকে তিন বছর নিরাপত্তা দেয় । তারপর আবার তাকে টিকা নিতে হবে । এই যে বারবার টিকা নেওয়াও একটা কঠিন ব্যাপারে । আর একটা দেশের জনসংখ্যা যখন অনেক, তখন সবাইকে এই টিকা দেওয়াটা সরকারের পক্ষে অনেক কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার ।
এখানেই আসে কলেরার বিপদ সংকেতের ব্যাপারটা । অর্থ্যাৎ যদি আমরা বুঝতে পারি যে কোথায় কলেরার মহামারী হতে যাচ্ছে তাহলে কেবল মাত্র সেই স্থানটা টিকার আওয়ায় আনা গেলে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রানহানীর পরিমান অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।
কলেরার জীবানুর নিবাস যেহেতু পানিতে, পানি কিংবা পানিতে থাকা কোন প্রাণী বা উদ্ভিতের সাথে এর একটা সম্পর্ক থাকাটা একেবারে অসম্ভব না । এটাই প্রথমে বিজ্ঞানীরা খেয়াল করলেন । তারা দেখলেন যে বঙ্গোপসাগরের পানিতে যখন শ্যাওলার পরিমান বাড়ে, তার কিছুদিন পরেই কলেরার একটা ধাক্কা আসে । এর পেছনের ব্যাখ্যা কী সেটা নিয়ে এখনও সঠিক কারণ খুজে পাওয়া যায় নি তবে কিছু একটা সংযোগ আছে সেটা নিশ্চিত হওয়া গেছে ।
কিন্তু সমুদ্রে তো শ্যাওলার পরিমান মাপাটা সহজ ব্যাপার নয় । তখন স্যাটেলাইটের ব্যবহার করে রিমোর্ট সেন্সিং করে মাপা হল সমুদ্রে সালোকসংশ্লেষণের পরিমান । শ্যাওলা যেহেতু সমুদ্রে সালোকসংশ্লেষন ঘটায় তাই সালোকসংশ্লেষনের পরিমান বাড়লে শ্যাওলার পরিমান বাড়বে এটা খুব সহজেই বের করা সম্ভব । হিসাব করে দেখা গেল যে সমুদ্রে যখন সর্বোচ্চ পরিমান শ্যাওলা জমে ঠিক তারপঈ কলকাতায় কলেরার একটা ধাক্কা আসে । কিন্তু চাঁদপুরে কলেরার ধাক্কাটা আসে তারও মাস খানেক পরে । কারণ হিসাবে বলা হল যে কলকাতা যেহেতু সমুদ্রের একেবারে পাশেই তাই এই ধাক্কাটা জলদি আসে অন্য দিকে চাঁদপুর একটু ভেতরে হওয়ায় ধাক্কা আসতে একটু সময় লাগে । এটা থেকে একটা সংকেত বানানো সম্ভব যে কখন কলেরার আক্রমন হতে পারে দেশে ।
আরেকদল বিজ্ঞানী কেবল শ্যাওলার পরিমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেন না । তারা শ্যাওলার সাথে সাথে আরেকটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করলেন । সমুদ্রের পানি থেকে স্থলভাগের দুরত্ব কত দুর এবং সেই পানি স্থল ভাবে পৌছাতে কত সময় লাগে এটা নিয়েও তারা হিসাব করে দেখলেন । তারা দেখলেন যে যখন নদীর পানিতে স্রোত থাকে শ্যাওলা তথা এই কলেরা সমুদ্র থেকে নদীতে যেতে সময় লাগে বেশি আবার যখন স্রোত কম থাকে তখন সহজে চলে যেতে পারে, মানে কম সময়ে চলে আসতে পারে । এই নদীর স্রোত নির্ভর করে হিমালয়ের পাদদেশের বাতাসের তাপমাত্রার উপরে । পাদদেশে তারমাত্রার পরিমান পরিবর্তন হলে এদিকে নদীর স্রোতে পরিবর্তন আসে । সেই হিসাবে এই হিমালয়ের পাদদেশের বাতাসের তাপমাত্রার পরিমান করে সেটার সাথে স্রোতের পরিমান বের করা সম্ভব । আবারও স্যাটেলাইট ব্যবহার করেই এই তাপমাত্রা বের করা সম্ভব। এটা একটা ফ্যাক্টর যুক্ত হয় এই কলেরা মহামারী সংকেত বের করার । এই দ্বিতীয় সংকেত বের করার জন্য প্রিন্স আব্দুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর ওয়াটার জিতেছেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড. শরীফুল ইসলাম, ড. রিটা কলওয়েল ও তার দল ।
তো কী দেখা গেল? এখন যেমন আমরা আগে থেকেই জানতে পারছি যে কখন ঠিক কোন কোন স্থানে সাইক্লোন এসে আঘাত দিবে, ঠিক একই ভাবেই কোথায় কলেরার হামলা করবেন মহামারী আকারে সেই ব্যাপারটাও জানা সম্ভব হচ্ছে । এই বিপদ সংকেত যদিও এখনও শতভাগ নিশ্চিত নয় তবে মোটামুটি একটা হিসাবে আনা গেছে । সামনে হয়তো আরও নিঁখুত ভাবে জানা সম্ভব হবে !
ওলাবিবির উপাখ্যান পড়তে পারেন
ওলাবিবি
তথ্যসুত্র
বই - ''এটাই সায়েন্স'' বাংলাদেশের অজানা কিছু গবেষণার গল্প
লেখক হাসান উজ জামান শ্যামল ।
এই বইতে আরও কিছু মজার গল্প আছে । সেগুলো লিখবো সামনে আশা করি ।
pic source
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



