গতদিন বাইরে এতো ঠান্ডা ছিল যে সাইকেল নিয়ে বের হওয়ার সাহস করি নি । গনপরিবহনে যাতায়াত করেছি । কিছুটা পথ বাসে কিছুটা রিক্সায় আবার কিছুটা হেটে । আমার রাস্তায় এই হাটলে সব থেকে বড় যে সমস্যাটা হয় সেটা হচ্ছে সামনে যে খাবার চোখে পড়ে সেই জিনিসই আমার খেতে ইচ্ছে করে । ঝালমুড়ি থেকে শুরু করে পুড়ি, চপ ছোলা যা সামনে আসে সব কিছু । এটা আমার সেই ছোট বেলার অভ্যাস । সাইকেল হলে বারবার থেমে খাওয়াটা একটু ঝামেলার । সাইকেল চালানোর শুরুর পর থেকে তাই স্ট্রিট ফুড খাওয়া কমে গেছে অনেক । যাই হোক কাল যা সামনে এসেছে মোটামুটি সবই পেটের ভেতরে চালান দিয়েছি । একেবারে শেষে ফেরার পথে চোখ পড়লো পিঠার দোকানের দিকে । একটু আগেই ঝালমুড়ি খেয়েছি । তারপর মনে হল একটা খেলে কোন সমস্যা হবে না । বাসায় যেতে এখনও কম করে হলেও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে । এতো সময় পেট খালি থাকবে নাকি !
দাড়িয়ে গেলাম পিঠা খেতে । তখনই চোখ গেল লোকটার দিকে । আমার থেকে কয়েক বছর বড়ই হবে । পরনে বাসায় পরা ট্রাউজার আর চাদর । বুঝতে কষ্ট হল না যে লোকটার বাসা আসে পাশেই । সে একটা হটপট নিয়ে এসেছে । গরম গরম পিঠা বানাচ্ছে আর সেই হটপটে ঢোকানো হচ্ছে । হিসাব করে দেখলাম কম করেই ১২/১৫টা ভাপা ও চিতই পিঠা সে নিলো। নিশ্চিত ভাবেই আজকে তাদের বাসায় পিঠা উৎসব হবে ।
যখন ছোট ছিলাম তখন শীতকালটা আমাদের কাছে বিশেষ পছন্দের ছিল এই পিঠা উৎসবের কারণে । বিশেষ করে ধুপি পিঠা কিংবা ভাপা পিঠা বানানোর দিন যেন পুরো বাড়িতে একটা আলাদা উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হত । কারণ ভাপা পিঠা বানানো একটা হ্যাপার কাজ ছিল । প্রথমেই চাল গুড়ো করতে হত । গ্রামে তখন ছিল ঢেকির প্রচলন । আমাদের বাসার পাশেই একজনের ঢেকি ছিল । প্রায়ই দিনই আমরা সেই ঢেকির আওয়াজ শুনতে পেতাম । চাল কুটে নিয়ে আসার পরে সেগুলো ছাদে কিংবা উঠনে রোদে দেওয়া হত । আমাদের বাচ্চাদের মাঝে মাঝে সেই চাল পাহারাও দিতে হত । চাল তৈরি হয়ে গেলে এরপর আসতো ঢাকনা কাঁটার ব্যাপার । আপনারা জানেন যে ভাপা পিঠার জন্য পানির ভাপ নিয়ে হাড়ির উপরে একটা ঢাকনা রাখতে হয় এবং সেই ঢাকনাতে ছিদ্র করতে হয় । বেশির ভাগ সময়ই সেই ঢাকনার একটা মাথা কেটে ফেলা হত । এই একটা কাঁটা ঢাকনা দিয়েই আশে পাশে সবাই ভাপা পিঠা বানাতো । আমরা ছোট রা সেই কাটা অংশ টুকু নিয়ে খেলা করতাম । তারপর সেই ঢাকনা হাড়ির উপরে বসিয়ে আলাদা ভাবে আটা দিয়ে আটকিয়ে দেওয়া হত যাতে করে কেবল একটা নির্দিষ্ট অংশ দিয়েই ভাপ বের হয় । অন্য দিক দিয়ে গরম ভাপ যদি বের হয় তাহলে পিঠা ভাল হবে না । মাঝে মাঝে সেই সংযোগ খুলে যেত তখন আবারও সেগুলো বন্ধ করতে হত ।
এরপর যখন সন্ধ্যা বেলা পিঠা বানানো হত ততখন আমরা ছোটরা রান্নাঘরে চুলার আশে পাশে ভিড় করতাম । আমার মনে আছে আমার জন্য আলাদা ভাবে গুড় দিয়ে পিঠা বানানো হত । আমি কেবল পিঠার গুড় দেওয়া অংশ গুলো খেয়ে বাকি টুকু খেতাম না । তাই পুরো অংশ টুকুই গুড় দেওয়া হত । এভাবে একের পর এক পিঠা বানানো হত তারপর সেগুলো সবাইকে সরবারহ করা হত । পুরো সময়টা একটা উৎসব মূখর পরিবেশ বিরাজ করতো !
কিন্তু এখন শহর অঞ্চলে এই ব্যাপারটা কল্পনাই করা যায় । এখানে পরিবেশ পরিস্থিতি কিংবা উপায়ও সম্ভবত নেই । অবশ্য এমনটা হবে সেটাই স্বাভাবিক । আর এখন প্রতিটি এলাকাতেই পিঠা ঘর থাকে। সেখান থেকেই মানুষ নানান ধরনের পিঠা খেতে পারে । আমি যেখানে থাকি সেখানেই প্রায় সাত আটটা দোকান বসে নিয়মিত । এতো কম কষ্টে যখন কাজ হচ্ছে তখন মানুষ কেন কষ্ট করবে । তবে গ্রামের দিেকও কিন্তু মানুষ এখন আর এতো পরিশ্রম করে না । আরও সহজ হয়ে গেছে সব কিছু ।
বছর দুয়েক আগে শীতের কথা । গ্রামে গিয়েছি । একদিন মা বলল যে আজকে ভাপা পিঠা বানানো হবে । কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখলাম যে কোন তৎপরতা নেই । না চাল কুটা না ঢাকনা কাটা কিংবা অন্য কোন কাজ নেই । অথচ সন্ধ্যার একটু পরে ঠিক ঠিক আমার ঘরে পিঠা এসে হাজির হল । ভাবী একা হাতেই সব পিঠা বানিয়ে ফেলেছে । আগে পিঠা বানাতে কত ঝামেলা করতে হত এখন সেই সবের কিছুই করতে হয় না । যেমন পিঠার জন্য আটা আর ঢেকিতে ভাঙ্গতে হয় না । সেটা পাওয়া যায় কিনতে । আর এখন রাইস কুকারে খুব সহজেই পিঠা বানানো যায় । পাঁকা রান্না ঘরে রাইস কুকারের ভেতরেই পিঠা তৈরি হয়ে যাচ্ছে ।
বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে কত সহজ করে দিয়েছে অথচ আবার কত কিছু কেড়েও নিয়েছে । আমার ভাইয়ের ছেলে কোন দিন আমার মত পিঠা বানানোর ব্যাপারটা দেখে নি । সে ছোট থেকেই দেখেছে যে তার মা চট করে রাইস কুকারে পিঠা বানিয়ে তাকে দিচ্ছে । সে কোন দিন আমাদের মত সেই সকাল থেকে পিঠা খাওয়ার আয়োজনটা দেখতেই পাবে না । আমরা যে আনন্দের ভেতরে বড় হয়েছি সেটা হয়তো কোন দিন উপলব্ধি করতে পারবে না ।
pic source