
আমাদের দেশে সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনা যে একেবারে নেই তা কিন্তু না কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের মত আমাদের দেশের সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনা গুলোকে এতো রোমান্টিসাইজ করা হয় না। এই কারণেই আমাদের দেশী সিরিয়াল কিলিংয়ের কোন প্রচার নেই। নেটফ্লিক্সের কল্যানে পাশের দেশ ইন্ডিয়াতে বেশ কয়েকটা সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনাকে মিডিয়াতে নিয়ে আনা হয়েছে সম্প্রতি বছর গুলোতে । সামনেও আনা হবে । হয়তো আমাদের দেশের সিরিয়াল কিলারদের নিয়েও এমন কোন সিরিজ বানানো হবে করা কোন এক সময়ে । যাই হোক আজকে কথা বলা যাক ইতিহাসের যে সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে সব থেকে বেশি জল্পনা কল্পনা করা হয়েছে তাকে নিয়ে । শিরোনাম দেখেই তার নাম বুঝে গিয়েছেন আশা করি ।
উনিশ শতকের মাঝমাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে অবৈধ ভাবে প্রচুর অধিবাসী প্রবেশ করতে শুরু করে । এদের ভেতরে অধিকাংশই ছিল আইরিশ । ১৮৮০ সালের পরে ইউরোপের রাশিয়া রোমানিয়া এবং পোল্যান্ড থেকেও ইহুদীরা লন্ডন শহরে এসে জড় হতে শুরু করে ভাগ্যের সন্ধানে। এবং এরা লন্ডন শহরে বিশেষ করে ইস্ট লন্ডনে নিজেদের আস্তানা গেড়ে বসতে শুরু করে । ফলে যা হওয়ার তাই হয় । লন্ডনের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে প্রবল ভাবে। হিসাব মত খুব অল্প সময়ের ভেতরে কাজের পরিমান কমতে থাকে, মানুষের জীবন যাত্রার মান কমতে থাকে আর বাড়তে থাকে অপরাধ । এবং সেই সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে পতিতাবৃত্তি । উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে ১৮৮৮ সালে কেবল হোয়াইট চ্যাপেলের লোকসংখ্যা আশি হাজার বৃদ্ধি পায় এবং এখানে ৬২টি পতিতালয়ে বারোশর বেশি পতিতা কাজ করতো । ঠিক এই সময়ে দৃশ্যপটে হাজির ইতিহাসের সব থেকে বিখ্যাত সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্যা রিপার ।
জ্যাক দ্য রিপার প্রথম খুনটা করে ১৮৮৮ সালের ৩১শে আগস্ট । ভিক্টিমের নাম মেরি এন নিকোলাস । মেরিএনই জ্যাক দ্য রিপারের হাতে প্রথম খুন হওয়ার নারী ।

মেরির লাশটি খুজে পাওয়া যায় ৩১শে আগস্ট রাত তিনটা চল্লিশ মিনিটে । তার লাশ আবিস্কার হওয়ার ঘন্টা খানেক আগেও মেরিএনকে জীবিত দেখা গিয়েছিলো । সেই হিসাবে তার খুনের সময় রাত আড়াইটা থেকে সাড়ে তিনটা ধরে নেওয়া যায় । মেরির গলায় দুটো তীক্ষ্ণ আঘাত করা হয়েছে খুব ধারালো কোন ছুরি দিয়ে । সার্জারির কাজে এই রকম ছুরি ব্যবহার করা হয়ে । এছাড়া তার তলপেতের একটা নির্দিষ্ট অংশ নিখুত ভাবে কেটে নেওয়া হয়েছে ।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে ৮ই সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় খুন করে জ্যাক দ্য রিপার । মোটামুটি একই সময় লাশটি আবিস্কার করা হয় । মেয়েটির নাম এনি চ্যাপম্যান ।

এনিকেও ঠিক একই ভাবে খুন করা হয়েছে । গলাতে খুন ধারানো ছরি দুইবার পোঁচ দেওয়া হয়েছে এবং তলপেটের পুরো ফেড়ে ফেলা হয়েছে । এছাড়া এনির জড়ায়ুও কেটে নিয়েছিলো খুনী ।
এরপর একই ভাবে জ্যা দ্য রিপার এলিজাবেথ স্ট্রাইড, ক্যাথারিন এডোজ এবং মেরি জেন কেলিকে খুন করে । এর ভেতরে এলোজাবেথ এবং ক্যাথরিনকে একই দিনে শহরের দুই প্রান্তে খুন করা হয় (৩০ সেপ্টেম্বর) এবং মেরিজেন কেলিকে খুন করা হয় ৯ নভেম্বর ।
এই পাঁচটি খুনকে কোন সন্দেহ ছাড়াই জ্যাক দ্য রিপারের কীর্তি হিসাবে মেনে নেওয়া হয় । এই পাঁচটি খুনকে বলা হয় ক্যানোনিকাল ফাইভ। অনেকেই মনে করেন যে এরপরে জ্যাক দ্য রিপার থেমে যায় । তবে এরপরেও আরো ছয়টি খুনকে জ্যাক দ্য রিপারের খুনের সাথে যুক্ত করে অনেকে । তবে এগুলোর ব্যাপারে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন কারণ হচ্ছে উপরের এই ৫টি খুন যতখানি নিখুঁত ভাবে করা হয়েছে, যেভাবে খুন গুলো করা হয়েছে পরের খুন গুলো ততখানি নিখুঁত ভাবে করা হয় নি । খুনের ধরণেও ছিল তারতাম্য ।
তবে এই খুনের পরে জ্যাক দ্য রিপার একেবারে থেমে যায় । তার আর কোন হদিস পাওয়া যায় নি । যেমন হঠাৎ করেই জ্যাক দ্য রিপারের আবির্ভাব হয়েছিলো ঠিক একই ভাবে হঠাৎ করে তা থেমে যায় পুরোপুরি । তবে মানুষের মন থেকে কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই ভয় দুর হয় নি । তখন শহরে কোন নারী খুনের ঘটনা ঘটলেই ধরেই নেওয়া হত যে জ্যাক দ্য রিপারের কাজ ।
এই হত্যা গুলোর চলাকালেই পুলিশ আদা জল খেয়ে খুনিকে ধরতে মাঠে নামে । প্রচুর মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় । তিনশও বেশি মানুষের উপর বিশেষ ভাবে তদন্ত করা হয় ৮০ জনকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয় কিন্তু আসল মানুষকে ধরা যায় না । এমন কি রিপারকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সিটি পুলিশের পক্ষ থেকে ৫০০ পাউন্ড পুরুস্কারও ঘোষণা করা হয় । সেই সময়ে ৫০০ পাউন্ডের পরিমানটা আপনারা বুঝতেই পারছেন । এছাড়া হোয়াইটচ্যাপেলে ভলন্টিয়ার কমিউনিটি গড়ে ওঠে গুনীকে ধরতে এবং রাতে পাহাড়া দেওয়ার জন্য ।
এই খুনীর নাম আসলে জ্যাক দ্য রিপার কেন হল ?
জ্যাক দ্য রিপারের নাম যে কেবল এই একটা ছিল তাও কিন্তু না । তাকে প্রথমে বলা হত হোয়াইট চ্যাপেলের খুনি কিংবা কসাই। আরো নাম দেওয়া হয়েছিলো লেদার এপ্রোন । তবে জ্যাক দ্যা রিচার নামটাই টিকে গেছে সব থেকে বেশি । খুন শুরু হওয়ার পরে পুলিশ এবং নিউজ এজেন্সির কাছে অনেক চিঠি আসতে শুরু করে । এমন একটা চিঠি এসে হাজির হয় যেখানে চিঠির শেষে নাম সই করা ছিল ''জ্যাক দ্য রিপার'' নামে। পুলিশ প্রথমে এটাকে মোটেই গুরুত্বদেয় নি । ভেবেছিলো এটা হয়তো কোন গুজব হবে । কিন্তু পরে যখন একই নাম সই নিয়ে আরেকটা চিঠি এসে হাজির হয় প্রথম চিঠির রেফারেন্সসহ তখন পুলিশের একটা ধারণা হতে শুরু করে যে এটা আসল খুনি কর্তৃক পাঠানো হলেও হতে পারে । তখন আরো তথ্যের আশায় পুলিশ এই চিঠি প্রকাশ করে এবং এই নামটাই সব থেকে বেশি প্রচার ও জনপ্রিয়তা পায় । এছাড়া খুনি যেহেতু তার ভিক্টিকদের একেবারে চিরে ফেলতো মানে দেহ রিপ করে হত্যা করতো এই রিপার নামটা বেশি যুতসই মনে হয়েছে অনেকের কাছে ।
কে ছিল এই খুনী?
নানান সময়ে নানান মত দিয়েছে অনেকে । বিশেষ করে যখন খুন গুলো সংগঠিত হচ্ছিলো সেই সময়ে পুলিশের কাছে অসংখ্য চিঠি আসতে শুরু করে এই খুনির ব্যাপারে । কেউ কেউ খুনির ব্যাপারে কেবল নিজেদের মতামত দিতে শুরু করে আবার কেউ কেউ বলতে থাকে সে খুনিকে দেখেছে ।
পুলিশ খুন গুলো পর্যবেক্ষণ করে ধারণা করে এমন একজন খুন গুলো করেছে যার মানুষের দেহের উপর বিশেষ জ্ঞান রয়েছে এবং ছুরি চালনায় রয়েছে দক্ষতা । সে একজন সার্জন হতে পারে এমন ধারণা করা হয় । এছাড়া সে হোয়াইটচ্যাপেলের স্থানীয় বাসিন্দা হবে কারণ সকল ওলিগলি সে চেনে খুব ভাল করে । খুন করেই হাওয়া হয়ে যেতে পারে । এছাড়া আরেকটা বিশেষ ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে জ্যাক দ্য রিপার কখনই সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া খুন করে নি ।
পুলিশ বিভাগের জনপ্রিয় মতবাদ হল জ্যাক দ্য রিপার হচ্ছে জর্জ চ্যাপম্যান। এই চ্যাপম্যান ছিল একজন আইরিশ অধিবাসী এবং এই খুন গুলো হওয়ার সময় সে নাপিতের কাজ করতো । যখন খুন গুলো বন্ধ হয়ে যায় তখন সে আমেরিকা চলে গিয়েছিলো । অবশ্য কয়েক বছর পরে আবার ফিরে এসেছিলো লন্ডনে । তখন সে আরও তিনজন মহিলাকে বিষপানে হত্যা করে । এবং সেই তিন খুনের কারণে তার ফাঁসি হয় ।
আরেকটা থিউরী হচ্ছে এই জ্যাক দ্য রিপার ছিল প্রিন্স আলবার্ট । কোন এক পতিতার কাছ থেকে সে সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হোন এবং এরপরেই সব পতিতাকে খুন করতে শুরু করেন । প্রিন্স আলবার্টকে নিয়ে আরও একটা থিউরি আছে । সেটা হচ্ছে প্রিন্স এক নিম্ন গোত্রের মেয়েকে বিয়ে করেন এবং যারা যারা এই বিয়ের খবর জানতেন তাদের সবাইকে সে হত্যা করে ।
এছাড়া আরও থিউরী হচ্ছে জনৈক ডাক্তার স্ট্যানলিই হচ্ছে জ্যাক দ্য রিপার । কারণ হিসাবে বলা হয় যে ডাক্তারের ছেলে পতিতার কাছ থেকে সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হোন এবং তার প্রতিশোধ নিতে সে এই হত্যা গুলো করা শুরু করে ।
এছাড়া আরও এক থিউরী হচ্ছে এই জ্যাক দ্য রিপারকে আসলে রাশিয়া থেকে পাঠানো হয়েছে লন্ডন পুলিশ নাকানী চুবানী খাওয়ানোর জন্য ।
তবে নিশ্চিত করে আসলে কেউ বলতে পারে নি কে ছিল এই জ্যাক দ্য রিপার আর ঠিক কী কারণে সে এই খুন গুলো করেছিলো । এই এতো গুলো বছর পরেও কিন্তু মানুষের মনে এই রহস্যের প্রতি আগ্রহ কমে নি । সম্প্রতি সময়ে ২০১৪ সালে লন্ডনে বসবাস কারী রাসেল এডওয়ার্ডস নামে একজন একটি বই লেখেন । বইটির নাম ‘নেমিং জ্যাক দ্য রিপার' ৷ এই বইতে সে দাবী করে যে জ্যাক দ্য রিপার ছিল পোল্যান্ড থেকে আসা এক ইহুদি নাম অ্যাডাম কসমিনস্কি৷। এবং সেই সময়ে পুলিশের সন্দেহভাজনের তালিকাতে তার নাম ছিল । মূলত ক্যাথেরিন এডোজের পাশে পড়ে থাকা রক্তাক্ত শাল নিলাম থেকে সংগ্রহ করে রাসেল। তারপর ডিএনএ এনালাইসিস করে অ্যাডাম কসমিনস্কির সাথে সংযোগ স্থাপন করেন ।
এই জ্যাক দ্যা রিপারকে নিয়ে যত গবেষণা জল্পনা কল্পনা হয়েছে সম্ভবত অন্য কোন সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে এতো আলোচনা হয় নি । এই সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক বই । লেখা হয়েছে গল্প আর সেই সাথে বানানো হয়েছে মুভিও । আমার পছন্দের একটা টিভি সিরিজের একটা পর্ব ছিল এই জ্যাক দ্যা রিচারকে নিয়ে ।
যে আর্টিকেল গুলো পড়েছি এবং সাহায্য নিয়েছি এই লেখা লিখতে।
Jack the Ripper
জ্যাক দ্যা রিপারঃ রহস্যময় বিখ্যাত সিরিয়াল কিলার
জ্যাক দ্য রিপারঃ কুখ্যাত এক সিরিয়াল কিলার
জ্যাক দ্যা রিপার
১২৬ বছরের ধোঁয়াশা কাটিয়ে পরিচয় ফাঁস জ্যাক দ্য রিপারের
জ্যাক দ্যা রিপার – লন্ডনের রহস্যময় বর্বর এক খুনি
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২৩ দুপুর ১২:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




