somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রামাদান ডায়রিঃ সেহরীর ডাক ও সহুর নাইট

০৯ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রমজানের একেবারে শুরুর স্মৃতি থেকে আমার মনে আছে রমজান এলেই রাতের বেলা মাইকে মোয়াজ্জিন সাহেব ডাকাডাকি শুরু করে দেন । আমাদের গ্রামে এই কাজটা করা শুরু হত মোটামুটি রাত তিনটার সময় থেকে চলতো একেবারে আযান পর্যন্ত । কেবল যে তিনি উঠার জন্য আমাদের ডাকতেন সেটাই না, নানান ধরনের গজল চালু করে দিতেন । কত হাজিস কিংবা কোরআন তেলোয়াত চলত। এই কাজে তাকে সাহায্য করতো মাদ্রাসার নানান ছাত্ররা । তবে আমাদের এটা নিয়ে খুব বেশি আপত্তি ছিল না । কারণ মসজিদ ছিল বাসা থেকে অনেকটাই দুরে । মাইকের এই আওয়াজ আমার কর্ণকুঠরে খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করতো না। বাড়ির কাছে হলে অবশ্য আপত্তি করতে পারতাম ।

তবে ঢাকায় যখন প্রথমবার এলাম তখন আবিস্কার করলাম যে আমাদের গ্রামের মসজিদের মত মাইকে এতো প্রবল ভাবে ডাকাডাকি করা হত না । অন্য্ এলাকাতে কী করা হত আমার জানা নেই তবে আমার বাসার আশে পাশের মাইকে এমনটা করা হত না । রাত তিনটার দিকে একবার ডাক দেওয়া হত তারপর সেহরীর সময়ের শেষ হওয়ার মিনিট দশেক আগে একবার ওয়ার্নিং দেওয়া হত এবং সময় শেষের একটা ডাক । ব্যাস এমনই হত সেহরির ডাকাডাকি । এখনও যেহেতু একই হাউজিং এলাকাতে আছি তাই এখনও সেই একই নিয়ম ফলো করা হয় ।
তবে একটা ব্যাপার আমি সব থেকে বেশি অবাক হয়েছিলো সেটা হচ্ছে রাত তিনটা হতেই একদল ছেলে হাউজিংয়ের প্রতি রাস্তায় চিৎকার করে করে মানুষজনকে ডাকতে শুরু করে । কোন মাইক নয় খালি গলাতে চিৎকার করে ডাকছে ।
জাগো জাগোরে মুসলমান
জাগো জাগোরে মুসলমান

সুরে সুরে চিৎকার করে হাউজিংয়ের প্রতিটা গলিতে তারা দল বেঁধে ডেকে চলতো । আওয়াজ শুনে বোঝা যায় এদের বয়স খুব বেশিও না । এই ব্যাপারটা আমার কাছে একেবারেই নতুন ছিল । আমাদের গ্রামে আসলে এই রকম ডাক কোন দিন হয় নি, আমার তখন এই ছেলে গুলোর জন্য মনের ভেতরে আলাদা একটা শ্রদ্ধা জমা হল । মনে হল যে মানুষকে রোজা রাখানোর জন্য এই ছেলে গুলো কেমন চিৎকার করে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলছে । নিজেদের আরাম আয়েশকে বিশর্জন দিয়ে ধর্মের কারণে কাজ করে যাচ্ছে ! ধর্মের প্রতি এতো টান এদের । ব্যাপারটা ভাবতেই মনটা ভাল হয়ে গেল ।

কিন্তু এই ভাল কাজ ধর্মের কাজের পেছনে যে আরও একটা উদ্দেশ্য্ সেটা বুঝতে আমার একটু সময় লেগেছিলো । প্রথমবার অবশ্য টের পাই নি কারণ প্রথমবার আমি অনেক আগেই বাড়িতে চলে গিয়েছিলো । পরের বার যখন ঢাকাতে থাকতে এসেছিলাম তখন ব্যাপারটা আমার কাছে ধরা পরে । রমজানে যথারীতি ডাকাডাকি শুরু হল । এবং বিশ রমজান পার হতেই একদিন একটা রোগামত ছেলে আমাদের মেসবাড়ির দরজায় কড়া নাড়লো । আমিই দরজাটা খুলে দিলাম । আমার দিকে তাকিয়ে সে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল । সেটা ছিল একটা রশিদ । আমি ঠিক বুঝলাম না । এমাউন্টটা অবশ্য এখন মনে নেই সম্ভবত একশটাকা ছিল । বললাম, কীসের এটা ?
সে বলল, আমরা ভোরবেলা ডাকি ।
আমি তখনও ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারলাম না । বললাম, মানে?
ছেলেটার চোখে এবার একটা অধৈর্য্যের আভা । সে বলল, আমরা সেহরির জন্য ভোরে ডাকি । এটা তারই বিল !

আমার চোখ কপালে উঠলো । সত্যি বলতে আমি তখন ঢাকার পরিবেশের সাথে খাপ খাইতে নিতে পারি নি । কেউ যে ভোরে ডাকাডাকির জন্য মানুষের কাছ থেকে টাকা দাবি করতে পারে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল ।
বিস্ময়ের ব্যাপারটা সামলে নিয়ে আমি বললাম, এখন তো কেউ বাসায় নেই । সবাই আসুক তারপর আলোচনা করে দেওয়া যাবে ।
-আপনি দিয়ে দেন ।
-না আমি এভাবে টাকা দিতে পারবো না ।

ছেলেটা চলে গেল বটে । পরদিন সে আবার এল । এবং এবার আমি যদিও বাসায় ছিলাম আরও কয়েকজন ছিল বাসায় । সেই ছেলে একই ভাবে বিল দাবী করলে আমাদের মেসের অন্য একজন সেটা দিতে অস্বীকৃতি জানায় । বলে কোন দুঃখে টাকা দেবে । তাদের কে কি কেউ এই দায়িত্ব দিয়েছে নাকি!
তখন আমি সেই ছেলের মারমুখী ভাব দেখতে পেলাম । তার আচরণ আর কথা বার্তা শুনে মনে হল যে টাকা দিতেই হবে । নয়তো সে দেখে নেবে এমন একটা ভাব ।

পরিবেশ খানিকটা উত্তপ্ত করে সে চলে গেল । যাওয়ার আগে বলে গেল সে আবার আসবে ।

আমার তখনও ব্যাপার হজম হচ্ছিলো না । অথচ আমি এদের কতই না ভালো ভেবেছিলাম । মেসবাড়ির একবড় ভাই জানালো যে এরা মূলত পাড়ার বখাটে আর নেশাখোর । টাকা আয়ের একটা মাধ্যম হিসাবে এটা এই সেহরিতে ডাকটাকে ব্যবহার করে । আর কিছু না ।

তারপর প্রতিবছরই এদের উৎপাত চলতে থাকে । এখন ঐ ছেলেগুলোর প্রতি কোন শ্রদ্ধা জন্মে না । বরং বিরক্তি জমে । তবে আশার কথা যে আমি তখন একটি হিন্দু পরিবারের সাথে সাবলেট থাকি । তাই ডাকাডাকির বিল সেই বাড়িতে আসতো না ।

২.
ঢাকাতে আসার পরে আরও একটা নতুন ব্যাপারের সাথে পরিচিত হয় সেটা হচ্ছে সেহরী নাইট বা সেহরী পার্টি । সত্যি বলতে কী এমন একটা জিনিস যে আসলেই হতে পারে সেটা আমার ধারণার বাইরেই ছিল । ইফতার পার্টি আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ছিল । তবে সেহরিতেও যে পার্টি হতে পারে সেটা জানা ছিল না । তবে এই ধারণা কিন্তু আমি যখন ঢাকাতে এসে হাজির হই তখনও অতোটা ছিল । এটা মূলত চালু হয়েছিলো দেশে ফেসবুকের প্রসার চালুর হওয়ার পরে ।

ঢাকাতে অনেক হোটেলই সারা রাত চালু থাকে । যখন দেশের মানুষ সবাই ফেসবুক ব্যবহার করতে শুরু করে তখনই প্রায়ই দেখতাম যে রাতের বেলা তারা ওমুক হোটেলে চেকইণ দিচ্ছে । খাওয়ার ছবি পোস্ট দিচ্ছে । এবং এর পরে বড় বড় রেস্টুরেন্টের ফেসবুক পেইজেও খেয়াল করলাম যে তারা এই রাতের বেলা সেহরির আয়োজনের ব্যাপার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন ।
একবার দেখলাম দেশের একজন বিখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়ার হোটেল আর রাজ্জাকে সেহরি খাওয়ার ছবি পোস্ট করছেন তার পেইজে । আল রাজ্জাক আমাদের ক্যাম্পাসের যাওয়ার পথেই পড়তো । আমরা মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম । তাই সেটা পরিচিত ছিল খুব । তার সাথে আরেকজন পরিচিত মুখ ছিল ।

তার পরের বছর থেকে একেবারে ডাল ভাত হয়ে গেল এই সেহরি নাইটের ব্যাপারটা । প্রায় প্রতিটা হোটেল রেস্টুরেন্ট সেহরি নাইটের আয়োজন করতে শুরু করলো । ফেসবুক ভরে গেল নাইটের ছবিতে । তাদের দেখাদেখি আরও মানুষ গিয়ে হাজির হল নাইটে । প্রথমে কেবল পশ লোকজন মানে যাদের নিজেস্ব গাড়িঘোরা আছে তারাই এসব নাইটে গিয়ে হাজির হত । কিন্তু এক সময়ে সবাই যাওয়া শুরু করলো । করোনার আগের বছর পর্যন্ত এই নাইট চলল খুব জোড়ে সরে। প্রথম প্রথম কেবল বন্ধু বান্ধব নিয়ে এই সব নাইট উজ্জাপন করা হত আস্তে আস্তে পরিবারের সবাই এখন এই নাইটে গিয়ে হাজির হটে শুরু করলো । এখনও অবশ্য আছে । এখনও এই নাইট চলছে । তবে এখন কেন জানি আগের থেকে কম দেখছি ছবি । কিংবা আমারই চোখে কম পড়ে । এখন এটার নাম সেহরি নাইট থেকে সহুর বা সাহুর নাইট হয়েছে সম্ভবত । এমন কিছুটা শব্দের বিরর্তন হয়েছে । তবে আমি এখনও পর্যন্ত এই সেহরি নাইট কিংবা সেহরি পার্টিতে যেতে পারি নি । আদৌও পারবো কিনা জানি না ।
সামুর ব্লগারদের নিয়ে একটা সাহুর নাইট করা যায় কিনা ভেবে দেখা দরকার ! ;)


সংযুক্তিঃ এখন তিনটা ১৩ বাজে । পুলাপাইনের ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ৩:১৪
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে কোনটি মত এবং কোনটি মতভেদ?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৬:৫৪




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে। তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কতভাগ ব্লগার মহা-ডাকাত তারেককে সরকারে দেখতে চায়?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:১২



জিয়া মিথ্যা হ্যাঁ/না ভোটে সামরিক এডমিনিষ্ট্রেটর থেকে আইয়ুবের নতো দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলো, ৫% ভোটকে মিথ্যুকেরা ৯৮% বলেছিলো ; আওয়ামী লীগ বাধা দিতে পারেনি। জিয়ার মৃত্যুর পর, বেগম জিয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাষ্ট্র যখন হত্যার দর্শক

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:১৯

রাষ্ট্র যখন হত্যার দর্শক
দায়হীন সরকারের শাসনে বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে?


দিপু চন্দ্র দাস মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন—
“আমি নবীকে নিয়ে কিছু বলিনি, আমাকে মারবেন না।”
রাষ্ট্র তখন কোথায় ছিল?

আগুনে পুড়তে পুড়তে ছোট্ট আয়েশা চিৎকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=একটি ডায়াটের গল্প, যেভাবে ওজন কমিয়েছিলাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৮


১৬ ডিসেম্বরের খাবার ছিল। উপরের চায়ের ছবিতে ফেসবুকের দুই গ্রুপে দুটো পুরস্কার পেয়েছি প্রতিযোগিতায় আলহামদুলিল্লাহ।

মোবাইলে পোস্ট, ভুল ত্রুটি থাকিতে পারে, মার্জনীয় দৃষ্টিতে রাখবেন।

জব করি বাংলাদেশ ব্যাংকে। সারাদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

'আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান'

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৯



১। মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।
আমাদের মহাত্মা গান্ধীর কর্মকান্ড লুথার খুবই পছন্দ করতেন। ১৯৫৫ সালে লুথার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসোফি ডিগ্রি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×