somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের জীবন থেকে ''হ্যারিকেন'' হারিয়ে গেছে !

১৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১০:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হ্যারিকেন জিনিসটার সাথে বোধকরি আপনারা সবাই পরিচিত । অবশ্য বর্তমান কালের ছেলে মেয়েরা এই জিনিসটা যে কী সেটা নাও জানতে পারে । অথবা জানলেও সেটা কেবল বই পুস্তকেই সীমাবদ্ধ ।

আমাদের বয়সের যারা আছে তদের বোধকরি এই হ্যারিকেনের সাথে সরাসরি দেখা সাক্ষাত হয়েছে । আমাদের ছোটবেলাতে নিত্য দিনের একটা ঘটনা ছিল যে সন্ধ্যার আযান দেওয়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া । সন্ধ্যার আলো নিভে যাওয়ার আগেই আমাদের মায়েদের একটা কাজ ছিল হ্যারিকেনের কাঁচ পরিস্কার করে তাতে তেল আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা । সন্ধ্যায় লোডশেডিংয়ের সাথে সাথে জ্বলে উঠতো এই হ্যারিকেন । আমরা আমাদের স্কুলের যাবতীয় পড়াশোনা করেছি এই হ্যারিকেনের আলোতেই । আমার এখনও এই সব দৃশ্য গুলো পরিস্কার মনে আছে । সন্ধ্যা বেলা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরপরই আমাদের সামনে এসে হাজির হত এই হ্যারিকেন। সেই আলোতে আমি আর আমার বড় ভাই পড়াশোনা করতাম । বাড়িতে দুইটা কী তিনটা হ্যারিকেন ছিল । একটা আমাদের পড়ার জন্য অন্যটা মায়ের কাজের জন্য ।

সেই সময়ে চার্জার লাইট খুব বড় ব্যাপার ছিল । আর দামীও ছিল । আমাদের বাসায় তখন একটা চার্জার লাইট কেনা হয়েছিলো । তবে সেটা থাকতো বাবার কাজের জন্য । মাঝে মাঝে আমাদের সামনে আসতো সেটা । অবশ্য সেই চার্জার লাইট খুব বেশি দিন টেকে নি । আমরা এই হ্যারিকেন দিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে গেছি আজীবন । মাঝে মাঝে অবশ্য মোমবাতি ব্যবহার করতাম । তবে প্রতিদিন মোম কেনার মত বিলাসিতা ছিল না ।

এরপর আমাদের গ্রামে জেনারেটর এল । গ্রামের মোড়ে বড় একটা জেনারেটর বসানো হল । তারপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই জেনারেটরের লাইন দেওয়া হল । এক লাইট, দুই লাইট কিংবা এক ফ্যান দুই এই রকম ভাবে সংযোগ দেওয়া হল । আমাদের বাসাতেও নেওয়া হল সেই সংযোগ । তখন সন্ধ্যার লোডশেডিংয়ের সাথে সাথেই আলো জ্বলে উঠতো । তখন প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই এই লাইণ নেওয়া হয় । ফলে আগের মত সন্ধ্যা হলেও হ্যারিকেনের কাঁচ পরিস্কারের তোড়জোড় কমে এল । হ্যারিকেন যেমন একেবারে অপরিহার্য ব্যাপার ছিল, সেই ব্যাপারটা আর রইলো না । ধীরে ধীরে হ্যারিকেনের অবস্থান ঘরের কোনা থেকে স্টোর রুমে গিয়ে পড়লো ।

তারপরই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি সাধন হল । মানে একেবারেই বিদ্যুৎ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য যাও যেত চলে আসতো জলদিই । ততদিনে হ্যারিকেনের প্রয়োজনীয়তা একেবারেই কমে গেছে । বাসায় তখন মোমবাতি এনে রাখা হত । কারণ বিদ্যুৎ খুব একটা যেত না । জেনারেটরের লাইণও কেটে দেওয়া হল । সেই সাথে নতুন আরেকটা জিনিস এসে হাজির হল । সস্তার চার্জার বাতি । এলইডি লাইট আর মোবাইলের ব্যাটারি দিয়ে বানানো হত এই চার্জার বাতি গুলো । বেশ চমৎকার আলো হয় এবং এক চার্জে অনেক সময় থাকে । প্রথমে পাড়ার মেকানিকেরা এই গুলো বানিয়ে বিক্রি করতো তবে এটা বেশ ভাল জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরে অনেক দোকানেই এই লাইট কিনতে পাওয়া যেতে শুরু করলো । মানুষ কিনতোই বেশ । দামে কম ছিল টিকতো বেশ ভাল । হ্যারিকেনে তেল ভরার একটা ব্যাপার ছিল যেখানে এই লাইট একবার কিনলেই আর খরচ নেই কোন ঝামেলা নেই ।

এখন আবার ফিরে এসেছে লোডশেডিং । কিন্তু হ্যারিকেন আর ফিরে আসে নি । আর আসবে না । তার স্থান দখল করে নিয়েছে চার্জার বাড়ি । বোধকরি আমি অনেক দিনই হ্যারিকেন দেখি নি কারো ঘরে । এই শিল্পের সাথে জড়িতো সকল মানুষ নিশ্চিত ভাবে অন্য পেশাতে চলে গেছে । গ্রামের প্রায় প্রতিটা দোকানে হ্যারিকেনের জন্য আলাদা কাঁচ কিনতে পাওয়া যেত । দুই সাইজের কাঁচ ছিল । কাঁচের জিনিস যেহেতু ভেঙ্গে কিংবা ফেঁটে যেত প্রায় । আমরা তখন দৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে এই কাঁচ কিনে আনতাম । আবার সেফটির জন্য মা একটা কাঁচ কিনে জমা করে রাখতো । আরেকটা জিনিস দরকার ছিল সেটা হচ্ছে হ্যারিকেনের ফিতা । এটাও কিনতে পাওয়া যেত দোকানে । এখন আর কিছুই পাওয়া যায় না । এখন হ্যারিকেন দিয়ে খুজলেও কোন হ্যারিকেন দেখতে পাবেন না কোন দোকানে ।

আমি গ্রামের একেবারে প্রত্যন্ত এলাকাতেও গিয়ে দেখেছি, সেখানেও এখন কেউ হ্যারিকেন ব্যবহার করে না । এমনকি বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আমি হ্যারিকেন দেখিনি । আপনি শেষ কবে দেখেছেন হ্যারিকেনের ব্যবহার ?

এই হ্যারিকেনের সাথে আরও একটা যন্ত্র ছিল । সেটাকে আমরা কুপি বলতাম ।


এই কুপিও ছিল আমাদের বাসায় । তবে এই কুপি বাসার ভেতরে আনা হত না । কারণ কুপি থেকে কালো ধোয়া বের হয়ে সেটা দেয়াল কালো করে দিবে এই মতবাদ প্রচলিত ছিল । তাই কুপিটা কেবল রান্না ঘরে ব্যবহৃত হত । সন্ধ্যা বেলা যদি রান্নার কাজে রান্নাঘরে যেতে হত তাহলে এই কুপি জ্বালানো হত । কুপিটা মূলত সব সময় এই রান্নাঘরেই থাকতো ।

এছাড়া আরেকটা বাতি ছিল । হ্যাজাক বাতি । এই বাতিটা আমি এখনও দেখি মাঝে মাঝে । এই হ্যাজাক বাতি গ্রামের হাট দোকানে বেশি দেখা যেত । এখনও যায় । আমি ঢাকা শহরেই এই বাতি এখনও দেখতে পাই । বাংলামোটরের পাশের একটা রাস্তা, নৌবাহিনীর নতুন একটা সদর দপ্তর আছে, ওটার সামনে একজন চটপটিওয়ালা বসেন । তার দোকানেই এই হ্যাজাক বাতি আছে । আমি রোজার আগেও দেখেছি ।

ফিরে আসি হ্যারিকেনের কথায় । আমি কয়েক বছর আগে আমার এক স্টুডেন্টকে এই হ্যারিকেনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম । ও খানিকটা অবাকই হয়েছিলো যে এমন জিনিসও থাকতে পারে । সে কোন দিন দেখে নি এই জিনিস । আমি তারপর মোবাইল বের করে ছবি দেখালাম । সেখানেও সে দেখে নি ।

যাদের বই পুস্তক পড়ার অভ্যাস আছে তারা হয়তো বই পড়ে এই হ্যারিকেন সম্পর্কে জানতে পারবেন । এখনও অনেকে লেখকের লেখায় বিশেষ করে গ্রামের ভুতের গল্পে এই হ্যারিকেনের ব্যাপারটা চলে আসে । তবে আস্তে আস্তে সেটাও অবশ্য হারিয়ে যাবে । কালের সময়ের আবর্তে এক সময়ে হ্যারিকেন হারিয়ে যাবে । তখন হয়তো কেউ জানতেও পারবে না যে আমাদের সময়ে এই জিনিসটার গুরুত্ব কত ছিল !



pic source 01 02
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১১:৫৭
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×