হ্যারিকেন জিনিসটার সাথে বোধকরি আপনারা সবাই পরিচিত । অবশ্য বর্তমান কালের ছেলে মেয়েরা এই জিনিসটা যে কী সেটা নাও জানতে পারে । অথবা জানলেও সেটা কেবল বই পুস্তকেই সীমাবদ্ধ ।
আমাদের বয়সের যারা আছে তদের বোধকরি এই হ্যারিকেনের সাথে সরাসরি দেখা সাক্ষাত হয়েছে । আমাদের ছোটবেলাতে নিত্য দিনের একটা ঘটনা ছিল যে সন্ধ্যার আযান দেওয়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া । সন্ধ্যার আলো নিভে যাওয়ার আগেই আমাদের মায়েদের একটা কাজ ছিল হ্যারিকেনের কাঁচ পরিস্কার করে তাতে তেল আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা । সন্ধ্যায় লোডশেডিংয়ের সাথে সাথে জ্বলে উঠতো এই হ্যারিকেন । আমরা আমাদের স্কুলের যাবতীয় পড়াশোনা করেছি এই হ্যারিকেনের আলোতেই । আমার এখনও এই সব দৃশ্য গুলো পরিস্কার মনে আছে । সন্ধ্যা বেলা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরপরই আমাদের সামনে এসে হাজির হত এই হ্যারিকেন। সেই আলোতে আমি আর আমার বড় ভাই পড়াশোনা করতাম । বাড়িতে দুইটা কী তিনটা হ্যারিকেন ছিল । একটা আমাদের পড়ার জন্য অন্যটা মায়ের কাজের জন্য ।
সেই সময়ে চার্জার লাইট খুব বড় ব্যাপার ছিল । আর দামীও ছিল । আমাদের বাসায় তখন একটা চার্জার লাইট কেনা হয়েছিলো । তবে সেটা থাকতো বাবার কাজের জন্য । মাঝে মাঝে আমাদের সামনে আসতো সেটা । অবশ্য সেই চার্জার লাইট খুব বেশি দিন টেকে নি । আমরা এই হ্যারিকেন দিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে গেছি আজীবন । মাঝে মাঝে অবশ্য মোমবাতি ব্যবহার করতাম । তবে প্রতিদিন মোম কেনার মত বিলাসিতা ছিল না ।
এরপর আমাদের গ্রামে জেনারেটর এল । গ্রামের মোড়ে বড় একটা জেনারেটর বসানো হল । তারপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই জেনারেটরের লাইন দেওয়া হল । এক লাইট, দুই লাইট কিংবা এক ফ্যান দুই এই রকম ভাবে সংযোগ দেওয়া হল । আমাদের বাসাতেও নেওয়া হল সেই সংযোগ । তখন সন্ধ্যার লোডশেডিংয়ের সাথে সাথেই আলো জ্বলে উঠতো । তখন প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই এই লাইণ নেওয়া হয় । ফলে আগের মত সন্ধ্যা হলেও হ্যারিকেনের কাঁচ পরিস্কারের তোড়জোড় কমে এল । হ্যারিকেন যেমন একেবারে অপরিহার্য ব্যাপার ছিল, সেই ব্যাপারটা আর রইলো না । ধীরে ধীরে হ্যারিকেনের অবস্থান ঘরের কোনা থেকে স্টোর রুমে গিয়ে পড়লো ।
তারপরই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি সাধন হল । মানে একেবারেই বিদ্যুৎ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য যাও যেত চলে আসতো জলদিই । ততদিনে হ্যারিকেনের প্রয়োজনীয়তা একেবারেই কমে গেছে । বাসায় তখন মোমবাতি এনে রাখা হত । কারণ বিদ্যুৎ খুব একটা যেত না । জেনারেটরের লাইণও কেটে দেওয়া হল । সেই সাথে নতুন আরেকটা জিনিস এসে হাজির হল । সস্তার চার্জার বাতি । এলইডি লাইট আর মোবাইলের ব্যাটারি দিয়ে বানানো হত এই চার্জার বাতি গুলো । বেশ চমৎকার আলো হয় এবং এক চার্জে অনেক সময় থাকে । প্রথমে পাড়ার মেকানিকেরা এই গুলো বানিয়ে বিক্রি করতো তবে এটা বেশ ভাল জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরে অনেক দোকানেই এই লাইট কিনতে পাওয়া যেতে শুরু করলো । মানুষ কিনতোই বেশ । দামে কম ছিল টিকতো বেশ ভাল । হ্যারিকেনে তেল ভরার একটা ব্যাপার ছিল যেখানে এই লাইট একবার কিনলেই আর খরচ নেই কোন ঝামেলা নেই ।
এখন আবার ফিরে এসেছে লোডশেডিং । কিন্তু হ্যারিকেন আর ফিরে আসে নি । আর আসবে না । তার স্থান দখল করে নিয়েছে চার্জার বাড়ি । বোধকরি আমি অনেক দিনই হ্যারিকেন দেখি নি কারো ঘরে । এই শিল্পের সাথে জড়িতো সকল মানুষ নিশ্চিত ভাবে অন্য পেশাতে চলে গেছে । গ্রামের প্রায় প্রতিটা দোকানে হ্যারিকেনের জন্য আলাদা কাঁচ কিনতে পাওয়া যেত । দুই সাইজের কাঁচ ছিল । কাঁচের জিনিস যেহেতু ভেঙ্গে কিংবা ফেঁটে যেত প্রায় । আমরা তখন দৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে এই কাঁচ কিনে আনতাম । আবার সেফটির জন্য মা একটা কাঁচ কিনে জমা করে রাখতো । আরেকটা জিনিস দরকার ছিল সেটা হচ্ছে হ্যারিকেনের ফিতা । এটাও কিনতে পাওয়া যেত দোকানে । এখন আর কিছুই পাওয়া যায় না । এখন হ্যারিকেন দিয়ে খুজলেও কোন হ্যারিকেন দেখতে পাবেন না কোন দোকানে ।
আমি গ্রামের একেবারে প্রত্যন্ত এলাকাতেও গিয়ে দেখেছি, সেখানেও এখন কেউ হ্যারিকেন ব্যবহার করে না । এমনকি বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আমি হ্যারিকেন দেখিনি । আপনি শেষ কবে দেখেছেন হ্যারিকেনের ব্যবহার ?
এই হ্যারিকেনের সাথে আরও একটা যন্ত্র ছিল । সেটাকে আমরা কুপি বলতাম ।
এই কুপিও ছিল আমাদের বাসায় । তবে এই কুপি বাসার ভেতরে আনা হত না । কারণ কুপি থেকে কালো ধোয়া বের হয়ে সেটা দেয়াল কালো করে দিবে এই মতবাদ প্রচলিত ছিল । তাই কুপিটা কেবল রান্না ঘরে ব্যবহৃত হত । সন্ধ্যা বেলা যদি রান্নার কাজে রান্নাঘরে যেতে হত তাহলে এই কুপি জ্বালানো হত । কুপিটা মূলত সব সময় এই রান্নাঘরেই থাকতো ।
এছাড়া আরেকটা বাতি ছিল । হ্যাজাক বাতি । এই বাতিটা আমি এখনও দেখি মাঝে মাঝে । এই হ্যাজাক বাতি গ্রামের হাট দোকানে বেশি দেখা যেত । এখনও যায় । আমি ঢাকা শহরেই এই বাতি এখনও দেখতে পাই । বাংলামোটরের পাশের একটা রাস্তা, নৌবাহিনীর নতুন একটা সদর দপ্তর আছে, ওটার সামনে একজন চটপটিওয়ালা বসেন । তার দোকানেই এই হ্যাজাক বাতি আছে । আমি রোজার আগেও দেখেছি ।
ফিরে আসি হ্যারিকেনের কথায় । আমি কয়েক বছর আগে আমার এক স্টুডেন্টকে এই হ্যারিকেনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম । ও খানিকটা অবাকই হয়েছিলো যে এমন জিনিসও থাকতে পারে । সে কোন দিন দেখে নি এই জিনিস । আমি তারপর মোবাইল বের করে ছবি দেখালাম । সেখানেও সে দেখে নি ।
যাদের বই পুস্তক পড়ার অভ্যাস আছে তারা হয়তো বই পড়ে এই হ্যারিকেন সম্পর্কে জানতে পারবেন । এখনও অনেকে লেখকের লেখায় বিশেষ করে গ্রামের ভুতের গল্পে এই হ্যারিকেনের ব্যাপারটা চলে আসে । তবে আস্তে আস্তে সেটাও অবশ্য হারিয়ে যাবে । কালের সময়ের আবর্তে এক সময়ে হ্যারিকেন হারিয়ে যাবে । তখন হয়তো কেউ জানতেও পারবে না যে আমাদের সময়ে এই জিনিসটার গুরুত্ব কত ছিল !
pic source 01 02
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১১:৫৭