জসীম উদ্দীনের মামার বাড়ি নামে একটা কবিতা আছে । যেখানের একটা লাইন আছে ''ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ'' । সত্যি ছোট বেলাতে এমন একটা সময় আমি পার করেছি আমার মামার বাড়ি । মামার বাড়ি বলতে তখন সেটা আসলে নানীর বাড়ি ছিল । এখনও আছে । আমি কখনোই অবশ্য মামা বাড়ি বলি নি । যদিও তখন নানীর বাড়িতে তখন আমার দুই মামা থাকতেন । এখনও মামারাই থাকেন । আমাদের কাছে সেটা সব সময় নানীর বাড়ি।
আমার জন্ম যশোর জেলাতে । যশোর থেকে আমার নানীর বাসা একদম কাছে । পাশের জেলাতে । তাই যে কোন ছুটিছাটা পেলেই আমরা নানীর বাড়িতে দৌড় দিতাম । এমন কী মাঝে মাঝে দুই একদিন স্কুল কামাই করেও নানীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হতাম । ট্রেনে করা যাতায়াত ছিল সহজ । ভাড়াটাও ছিল কম । আমার যতদুর মনে পড়ে তখন ট্রেন ভাড়া ছিল ৪০/৫০ টাকা । আব্বা এসে আমাদের ট্রেনে তুলে দিতেন । নানীর বাড়ি এসে পৌছে যেতাম ।
নানীর বাড়িতে তখন বড় মামা দুই ছেলে মেয়ে সহ থাকতো । বড় মামাতো বোন আমার থেকে একটু বড় হলেও ওর সাথেই আমার ভাব ছিল সব থেকে বেশি । এই মিলটা আমাদের আমার ঢাকাতে আসা পর্যন্ত টিকে ছিল । ওর ছোট ভাই আমার থেকে কয়েক বছরের ছোট হলেও আমাদের সাথেই সব সময় ঘুরতো । নানী বাড়ি গেলে এই তিনজন সব সময় এক সাথে ঘোরাঘুরি চলতো ।
যখনকার কথা বলছি, সেই সময়ে আমার নানীর বাড়ির আশে পাশে আর কোন বাড়িঘর ছিল না । রাস্তার পাশে একটা বড় বাড়ি । বাঁ দিকে অনেকটা গেলে গ্রাম শুরু হয়েছে । পেছনে বড় একটা আম বাগান । আর ডান দিকেও বেশ কিছুটা দুরে জেলার বনবিভাগ তারপর বিজিবি ক্যাম্প ।
গরমের ছুটি হলেও আমরা এক দৌড়ে হাজির হয়ে যেতাম নানী বাড়ি । সেখানেই আমাদের দিন কাটতো । তখন প্রায় সময়েই সন্ধ্যার দিকে ঝড় আসতো । সন্ধ্যার সময় ঝড় এলেই বাড়ির বড় আমাদের ঘরের বাইরে বের হতে দিতে চাইতেন না । বিশেষ করে আমরা আমাদের ছোট মামাকে বেশ ভয় পেতাম । তখনও সে বিয়ে থা করে নি । বাড়ির সব ছেলে মেয়ে গুলো তাকে খুব ভয় পেত । আমরা যে বেড়াতে এসেছি আমরাও পেতাম ।
যখনই ঝড় আসতো তখন সে প্রায়ই দরজার কাছে বসে বসে ঝড় দেখতো । আমরা বের হওয়ার সুযোগ পেতাম না । তবে যেহেতু বিকাল সন্ধ্যার সময় ঝড় আসতো, আর তার যেহেতু তখনও বউ নেই বাসায় তাই সন্ধ্যা হলেই সে সব সময় বাসায় থাকতো না । বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিতো বাইরে । আমরা এই সুযোগে এক ছুটে চলে যেতাম পেছনের আম বাগানে । সেখানে তখন মাটিতে প্রচুর আম পড়ে থাকতো । আমরা গামছা নিয়ে যেতাম । সেই গামছা পেতে আমরা তিনজন কুড়াতে শুরু করতাম । মাঝে মাঝে আমার ছোট খালাও আমাদের সাথে এসে যোগ দিত । হাই স্কুলের পরে অবশ্য আর যশোরে থাকা হয় নি । তখন স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য নানীর বাড়ির ঠিক পাশেই আমাদের একটা নিজেদের বাড়ি হল । সেই সময়ে পুরো ঝড়ের সময়ই আমরা আম কুড়ানো চলতো ।
এখনও সেই আম বাগান রয়েছে তবে এখন আগের সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে । সেখানে নতুন করে আবারও আম বাগান করা হয়েছে । এবং এই আম বাগান আগের মত আর খোলা মেলা নেই । পুরো এলাকাটা ঘিরে দেওয়া হয়েছে । বাইরের কেউ যাতে সেখানে ঢুকতে না পরে সেই জন্য পাহাড়ার ব্যবস্থা করার হয়েছে । আসলে আগে এই আম বাগান নিয়ে একটা মামলা চলছিলো । তাই কেউ এটাকে দখলে নিতে পারে নি । আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিই তখন এক পক্ষ মামলা দিতে যায় । এবং পুরো আম বাগানটা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসে । আমাদের আম কুড়ানোর দিনও শেষ হয়ে যায় ।
হঠাৎ আম কুড়ানোর কথা কেন এল । ঈদের তৃতীয় দিন দুপুর বেলা হঠাৎ করেই ঝড় শুরু হল । মুহুর্তের ভেতরেই সব অন্ধকার হয়ে গিয়ে সেই বাতাস শুরু হতে শুরু হল । সেই সাথে বৃষ্টি । আমি তখন আমার ঘরের দরজা দিয়ে আমাদের বাড়ির পেছনের উঠানের দিকে উদাস মনে তাকিয়ে রয়েছে । আমাদের বাড়ির শেষ সীমানাতে একটা বড় আম গাছ রয়েছে । গত বছর এই গাছে একেবারে আম আসে তবে এইবার প্রচুর আম হয়েছে । ঝড় শুরুর সাথে সাথে দেখলাম গাছ থেকে টুপটাপ করতে করতে আম পড়তে শুরু করলো । আমার কেন জানি খুব ইচ্ছে করলো তখনই নিচে যাই আম গুলো কুড়িয়ে বাসায় নিয়ে আসি । তবে এখানে অবশ্য এতো তাড়াহুড়ার কিছু নেই ।
ছোট বেলা যখন আম কুড়াতে যেতাম তখন এই চেষ্টা থাকতো যে কে কার আগে আম কুড়িয়ে নিতে পারে । এখানে অবশ্য সেই ঝামেলা নেই । এই আম অন্য কেউ নিতে আসবে না । বের হব হবে করেও জানি আর বের হওয়া হল না । দরজা থেকে ঝড় দেখতে শুরু করলাম । ঝড় যখন কিছুটা থেমে গেছে দেখলাম ভাবি ছাতা নিয়ে নিচে গিয়ে আম কুড়াতে শুরু করেছে । দেখতে এক বালতি আম জমে গেল । তখনই আমার ছোট বেলার আম কুড়ানোর কথা মনে হল । সন্ধ্যার অন্ধকারে আমরা যখন পেছনের সেই আম বাগানে আম কুড়াতে যেতাম তখন কী এক উত্তেজনা কাজ করতো আমাদের মনে । একটা আম পাওয়ার সাথে সাথে সে কী আনন্দ । এই আনন্দের আসলে কোন তুলনা নেই ।
এই আমের দিনে আরেকটা ব্যাপার ছিল আম মাখানো । কাঁচা আম কেটে কিংবা ভর্তা করে মাখানো হত । আমরা ছেলে মেয়েরা গোল হয়ে বসে নিজেরাই সেই আম ঝালাই করতাম । সেই আম ঝালাইয়ের স্বাদ আর আর কোথাও কখনো পাওয়া সম্ভব নয় । ঝড়ের আমরা গুলো বাসায় আনার পরে মাকে বললাম যে কয়েকটা আম ঝালাই করে দিতে । কিছু সময়ে তা এসে হাজির হল । কতদিন পরে আম ঝালাই খেলাম মনেও নেই । বছরের এই সময়টা বাসায় আসা হয় না অনেক দিন । তাই ঝড়ে পড়া আমের ঝালাই খাওয়া হয় না । এইবার ভাগ্য গুনে পেয়ে গেলাম ।
আমাদের সেই সময়ের ব্যাপার গুলো এখন আর দেখা যায় না । এখনকার ছেলে মেয়েরা একেবারেই ভিন্ন ভাবে বড় হচ্ছে । বলছি না যে এটা খুব খারাপ । আসলে সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তন আসবে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার ।
ব্লগারদের ব্লগিং টুলস নিয়ে একটা আলাদা পোস্ট দেওয়া ইচ্ছে আছে । সকল ব্লগারদের কাছে অনুরোধ থাকবে তারা যে যে ডিভাইস দিয়ে ব্লগে লেখেন তার একটা ছবি আমাকে পাঠাবেন । কিভাবে পাঠাবেন তার তথ্য এই পোস্টে পাবেন। সকলের কাছে অনুরোধ যে সবাই অংশ গ্রহন করবেন ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১২:৩৮