অতীতের সময়ে জন্মদিন পালন ব্যাপারটা আমাদের মত মধ্যবিত্তদের কাছে খুব বেশি বিলাসিতার ব্যাপার ছিল । একই ক্যাটাগরিতে পড়তো বিবাহবার্ষিকীর ব্যাপারটাও । এগুলো তখন ছিল কেবল এলিটদের ব্যাপার । আর যারা একটু সৌখিক ক্যাটাগরির ভেতরে তারা হয়তো পালন করতো তবে সেসব খুব একটা বাইরে আসতো না । এখন তো এই রকম ভাবে সোস্যাল মিডিয়া ছিল না । আমরা কেবলই এসব জানতে পারতাম যদি কখনও এই রকম অনুষ্ঠানে দাওয়াত পড়তো ।
ছোট বেলা থেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারেই বড় হয়েছি । বিলাসিতা কোন কালেই আমাদের ছিল না । হ্যা, অভাবও আমি দেখি নি কখনো । একবার ঠিক হল আমার বড় ভাইয়ের জন্মদিন পালন করা হবে । আমার ভাজিতার জন্মের আগ পর্যন্ত এটাই ছিল আমাদের বাড়িতে পালন করা একমাত্র জন্মদিনের উৎসব । আমরা তখন থাকি যশোরের ঝুমঝুমপুরে। আমি যেহেতু তখন বেশ ছোট । স্কুলে তখনও ভর্তি হইনি । বড় ভাইয়ের জন্মদিন পালন হচ্ছে আমারটা হচ্ছে না এটা দেখে আমার মন খারাপ হবে দেখে একই সাথে দুইটা কেক কিনে আনা হল । বাবা তখন ফুড কন্ট্রাক্টর কোম্পানিতে চাকরি করে । বাইরে থেকে দেখলে আমাদের পরিবারটাকে বেশ সুখী পরিবারই মনে হত । ভেতর থেকেও তেমনই ছিল । তখন জীবন এতো জটিল ছিল না । আমরা ছোট দুই ভাই । কোন জটিলতা নেই । বাড়তি ঝামেলাও নেই । একটা বাড়তি অনুষ্ঠান পালন করাই যায় ।
বাবার তখন যশোরে বেশ চেনা শোনা কাজের কারণে । বেশ বড় করেই অনুষ্ঠান পালন করা হল । কত লোকজন এসে হাজির হল পরিবার সহ । সেই সাথে এল উপহার । কত রকমের যে উপহার এসে হাজির হল তার কোন ঠিক নেই । আমার কেবল ভাসা ভাসা সব কিছু মনে আছে । বাসার এলবামে তখনও অনেক ছবি এখনও আছে । নানার বাড়ি থেকে আমার ছোট মামা বড় মামার ছেলে মেয়েরাও এসেছিলো সেবার । সব মিলিয়ে চমৎকার একটা পারিবার আয়োজন ।
আমি তখন আশা করেছিলাম যে আমার ভাইয়ের জন্মদিনে যেহেতু অনুষ্ঠান হয়েছে আমার জন্মদিন যখন আসবে তখন আমারটাও পালন করা হবে । বাবা মা তখন আমাকে এই আশ্বাস দিয়েও ছিল । তবে বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও সেই অনুষ্ঠান আর পালন হয় নি । প্রতিবার জন্মদিন এলে তাই কেন জন্মদিন পালন হল আমার এটা নিয়ে আমার মন খারাপই থাকতো । একটা সময়ে অবশ্য আমি বুঝে গেলাম যে সেটা আর হবে না । তাই মন খারাপের ব্যাপারটা সয়ে গেল ।
এরপর জেলা পরিবর্তন হল স্কুল পরিবর্তন হল । তারপর জীবনে প্রথম প্রেমিকা । তখন পড়ি ক্লাস টেনে । সকালে পড়তে যাই ইংরেজি স্যারের কাছে । মূলত এখানেই আমার এবং আমার প্রথম প্রেমিকার দেখা হত । ও একটু আগে আগে আসতো । স্যার পড়াতে ঢুকতেন নির্দিষ্ট সময়ে । আমরা এই সময়ে যা টুকটাক গল্প করতাম । জন্মদিনের দিন সে একটু আগে আগেই আসতে বলল । এই গল্পটা সম্ভবত আগেও করেছি আমি । যাইহোক অল্প করে বলি আরেকবার । আমি আগে আগে গিয়ে হাজির হলাম । সেই এসে হাজির । জীবনে সেইবারই আমি প্রথম ফুল পেলাম কারো কাছ থেকে । সাথে জমা হয়েছিলো আরো এক গাছি উপহার । এটা নিয়ে আর বাড়তি কিছু একাহনে লিখলাম না । এই পোস্টে গিয়ে পড়ে আসতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের জন্মদিনের স্মৃতি গুলোও বেশ চমৎকার ছিল । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পুরো ক্লাসের ভেতরে দশ বারো জনের একটা গ্রুপ তৈরি হয়ে যায় আমাদের । এদের সাথেই আমাদের মেলামেশা ছিল সব থেকে বেশি । একসাথে ক্লাসের সময় ছাড়াও বাইরে একসাথে আড্ডা দেওয়া, ঢাকার বাইরে একসাথে ট্যুর এসব হত । আর চলতো জন্মদিনের এক সাথে ভুড়িভোজ ।
মূলত নিয়মটা ছিল যে যার জন্মদিন আসবে সে গ্রুপের সবাইকে খাওয়াবে । আমাদের ভাষায় এটাকে বলে ট্রিট দেওয়া । এবং বাকি সবাই চাঁদা তুলে সেই বন্ধুকে কোন উপহার কিনে দিবে । আমাদের মাঝে আমাদের সিআর ছিল । সে থাকতো নিজের বাড়িতে । আমরা অন্যেরা এই জন্মদিনের ট্রিট বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে দিলেও সে এই খাওয়াটা দিতো নিজের বাসায় । এই খাওয়াটা হত সব থেকে চমৎকার । নির্দিষ্ট দিনে যদি ক্লাস থাকতো তাহলে আমরা ক্লাসের পড়ে সবাই একসাথে হাজির হতাম তার বাসায় । ছুটির দিন হলে সকাল সকাল হাজির হয়ে যেতাম । দুপুরের আগেই । খাওয়ার আগে আর পরে চলতো কত গল্প । তবে বেশির ভাগ সময়েই আমাদের ট্রিট হত রেস্টুরেন্টে । আমরা বেশি খেয়েছি পুরান ঢাকার নান্নার বিরিয়ানীতে । তখন আমাদের কারো কাছেই টাকা পয়সা ছিল না । নান্নাতে প্রতি প্লেট বিরিয়ানী তখন ১২০/১৩০ টাকায় পাওয়া যেত । অনেক বেশি পরিমান থাকতো সেখানে ।
এখানে একটা মজার ব্যাপার ঘটতো প্রায় প্রতিবার । আমাদের গ্রুপে তিনজন হিন্দু ধর্মের বন্ধু ছিল । যাদের ভেতরে দুইজনের কোন নিয়ম নীতি ছিল না আমাদের খাওয়ার ব্যাপারে । তবে একজন বেশ নিয়মের ভেতরে ছিল । যার ভেতরে একটা ছিল যে মাংস খাওয়া যাবে না । সে কোন প্রকার মাংস খেত না । তবে আমাদের সাথে প্রতিবার ঠিক ঠিক গিয়ে হাজির হত । এবং তারপর পাশের কোন হোটেল থেকে সে মাছ আর ভাত কিনে নিয়ে আসতো এবং একই সাথে খাওয়া দাওয়া চলতো । খাওয়াটা মূখ্য ছিল না, ছিল এক সাথে বসা এক সাথে আড্ডা দেওয়া । ধর্ম কোন দিন আমাদের বেড়িয়ার হয়ে দাড়ায় নি । পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আমরা এভাবেই কাটিয়েছি ।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরে অবশ্য সবাই নানান দিকে চলে গেছে । এখন সেই গ্রুপের তিন চার জন কেবল ঢাকার ভেতরে । তাও সবাই নিজের কাছে ব্যস্ত । এটা অবশ্য কারো দোষ না । তবে এখনও আমরা এক সাথে বসি মাঝে মাঝে । নান্নার বিরিয়ানীতে আর বসা হয় না ।
এখন অবশ্য কেবল নিজেদের জন্মদিনের পালন হয় না । এখন বন্ধু বান্ধবীদের ছেলে মেয়েদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে হয় । আগেই বলেছি তখন আমাদের মত মধ্যবিত্ত পারিবারের মাঝে এসব অনুষ্ঠান পালনের চল ছিল না খুব একটা । তবে এখন এটা চালু হয়েছে খুব বেশি পরিমানে । বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ার কল্যানে এসব অনুষ্ঠানের আবেদন বেড়েছে অনেক বেশি ।
আবার নিজের বাড়ির কথায় ফিরে যাই । বলেছিলাম আমাদের বাসায় সেই একবারই জন্মদিন পালন করা হয়েছিলো । এরপর আর জন্মদিন পালন করা হয় নি । বেশি ভাগ সময়ে বাড়ির কারো মনেই থাকতো না যে জন্মদিনের কথা । নিজেদের কাজের কর্মেই তারা ব্যস্ত থাকতো । তবে ভাইয়ের বিয়ে এবং আমার ভাতিজার জন্মের পরে অবশ্য এই ব্যাপার মনে রাখা হয় । কারণটা হচ্ছে আমার জন্মদিন আর আমার ভাতিজার জন্মদিন খুব কাছাকাছি । মাত্র দুইজনের পার্থক্য । পালন না করা হলেও বাসা থেকে ফোন আসে । জন্মদিনের কথা বলে বলা হয় আজকে যেত ভাল কিছু খেয়ে নিই আমি । আমার পছন্দের কোন খাবার । ডাক্তারের পরামর্শের কারণে আমি আমার অনেক পছন্দের খাবার খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি অনেক দিন । এই দিনে মা বলে যে এক দিন খা । একদিন খেলে আসলে কিছু হবে না ।
যা বলছিলাম । জন্মদিন আমাদের পালন হয় নি আর। তবে আমার ভাজিতার হল । সেইবার তার প্রথম জন্মদিন ।
বিশাল এক কেক নিয়ে আসা হল । পুরো বাড়ি সাজানো হল জন্মদিনের কারণে । আমি তখন ঢাকাতে । আমাকে একপ্রকার জোর করেই বাসায় নিয়ে যাওয়া হল ।
আমার সব কিছু মনে নেই ঠিক মত । তবে কয়েকটা কথা মনে আছে । তখনও বিদ্যুৎ যেত সন্ধ্যার দিকে । বাসায় জেনারেটরের লাইণ ছিল তবে সেটা কেবল একটা ঘরের জন্য । লোক ডেকে পুরো বাসায় সংযোগ নেওয়া হল একদিনের জন্য । বিকেল থেকেই মানুষজন আসা শুরু করলো । সন্ধ্যায় যখন অনুষ্ঠান শুরু হবে ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল । চিন্তা ছিল না কারণ জেনারেটর চালু হবে। কিন্তু যখন জেনারেটর চালু হল তখন পুরো বাড়ির লোড সেটা নিতে পারলো না । যে তার ছিল সেটা পুড়ে গেল । পুরো বাড়ি অন্ধকার ।
জেনারেটর লাইণ নেওয়া বলে আলাদা ভাবে অন্য কোন বাতির ব্যবস্থাও করা হয় নি ।
আমার বাবা রেগে আগুন । কোন কাজ যখন ঠিক মত হয় না তখন তার সামনে যাওয়ার উপায় থাকে না । এতো লোকজনের ভেতরে তার চিৎকার যেন থামে না । আমার বড় ভাই দৌড়ে গেল কাছের দোকানে । অনেক গুলো মোমবাতি কিনে নিয়ে আসা হল । ঘরে আবারও আলো জ্বললো । এর মাঝে একটা কাঁচের জগ পরে ভেঙ্গে গেল কিভাবে যেন । বড় ভাইয়ের এক বন্ধু সেই কাঁচ হাত দিয়ে পরিস্কার করতে গিয়ে হাত কেটে একাকার অবস্থা । বেচার সেই কাটা হাত দিয়ে ঠিকমত খেতেও পারে নি পরে ।
এরপরের বছর গুলো এখনও নিয়ম করে আমার ভাজিতার জন্মদিন পালন করা হয় । তবে এখন আর সেই ঘটা করে নয় । কেক নিয়ে আসা হয়। কাছের বন্ধুবান্ধবদের কেবল ডাকা হয় । এইবার সে ক্লাস নাইনে উঠেছে । এই তো পরশুদিন তার জন্মদিন আবার ।
একটা সময়ে নিজের জন্মদিন নিয়ে ছিল দারুন উত্তেজনা । কিন্তু একটা বয়স পার হওয়ার পড়েই বুঝতে পারলাম যে জন্মদিন মানেই হচ্ছে নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া যে তোমার দিন আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে । তুমি আগের থেকে আরো একটু বেশি বুড়ো হয়ে যাচ্ছো । মৃত্যুর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছো । এছাড়া এই জন্মদিনটা আমাদের মনেও করিয়ে দিন চলে যাচ্ছে । কত কিছু করার ছিল কত স্বপ্ন ছিল যার অনেক কিছুই পূরণ হয় নি । এই কারণে জন্মদিন গুলো আর আগের মত আনন্দ বয়ে আনে না ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২৩ দুপুর ১:১২