“জীবন এতো ছোট কেন”
নীচু জাতের ছেলে নিতাই । তার বংশ পরম্পরায় ডাকাত । তাকেও ডাকাত হতে হবে । কিন্তু ভাগ্যে হয়ত তার জন্য অন্য কিছু লিখে রেখে ছিল । হয়ত এমন কিছু যার জন্য কেউ তৈরি ছিল না । নিতাইয়ের বংশ হচ্ছে ডোম মানে চুরি ডাকাতি করা । তাদের ছেলে হবে কিনা কবি ।
নিতাই পরিবার ছেড়ে তারা এক স্টেশনে ওঠে । সেখানেই দেখা হয় রাজার সাথে । রাজা তারা কবি গান শুনে মুগ্ধ হয় । তাকে ওস্তাদ বলা শুরু করে । ওইদিকে নিতাই স্টেশনেই কুলি মুটেগিরি শুরু করে । কিন্তু যারা মধ্যে কবিতা বাস করে তাকে কি আর বেধে রাখা যায় । কবিতা বের হয়ে আসবেই । তাই রাজা নিতাই কে নিয়ে প্রায় বসে বসে কবি গান তৈরি করে । নিজস্ব সুর আর কথা মিলিয়ে সুন্দর করে ছন্দ তৈরি করে ।
রাজার শ্যালিকা প্রতি দিন আসত দুধ দিতে । এভাবেই পরিচয় হয় নিতাইয়ের সাথে । নিতাইয়ের কবিতা আর গানে সেও মুগ্ধ হয় । তাই অনেক সময় টাকা বাকি রেখেও তাকে দুধ দিয়ে যেতো । নিতাইও তাকে ভাল লাগতে শুরু করে । নিতাই ভাবে এটা কি ভালবাসার টান । নিতাইয়ের কাছে তার কৃষ্ণবর্ন ভাল লাগে । তাই যদিও সে হাসে, তারপর সে লিখে ফেলে
“কালো যদি মন্দ হবে গো, কেশ পাকিলে কান্দো কেন গো” ।
“চাঁদ তুমি আকাশে থাকো – আমি তোমায় দেখব খালি ।
ছুতে তোমায় চাই নাকো হে – সোনার অঙ্গে লাগবে কালি ।”
কিন্তু নিতাই জানে রাজার শ্যালিকা বিবাহিত । তার সংসার আছে । সে জেনে বুঝে তার সংসার ভাঙ্গতে পারে না । তাই সে ঠিক করে চলে যাবে অনেক দূরে । যেখানে তাকে হয়ত নতুন ভাবে সব কিছু শুরু করতে হবে । তার চেয়ে বড় কথা মনের ব্যথ্যা দূর করতে হবে । ঠিক সেই সময় সেই স্টেশনে হাজির হয় এক ঝুমুর গানে দল ।
সেখানেই পরিচয় বসন্ত বা বসন এর সাথে । মেয়েটি নিতাই কে জড়িয়ে ফেলে । তার কথা গান আর নাচে নিতাই মুগ্ধ হয় । মনে হয় একেই খুজে বেরিয়েছে এত দিন । সে ঝুমুর গানের দলের সাথে স্টেশন থেকে চলে যায় । পিছনে ফেলে যায় তার পরিবার, রাজা, রাজার শ্যালিকা, স্টেশনের লোকজন যারা তাকে ভালবাসে । তবুও এটাই জীবন সে মেনে নেয় ।
বসন্ত ও ঝুমুর গানের সাথে নিতাইয়ের যাত্রা শুরু হয় । ধীরে ধীরে নিতাইয়ের নাম ডাক ছড়িয়ে পরে । অনেকেই তার কথা গানে মুগ্ধ হয় । নিতাই ধীরে ধীরে সবার মাঝে একটা পরিচয় তৈরি করে ফেলে । বসন্তের সাথেও তার দিন গুলো সুন্দর ভাবেই কাটতে থাকে । তবুও তার মাঝে মাঝে পেছনের কথা মনে হয় । আসার আগে শুনেছিল রাজার শ্যালিকা নাকি পাগলের মত আচরন করছে । সেটার দায় যেন তার ই ।
তবুও জীবন চলে নিরবধি । এক সময় বসন্ত অসুস্থ হয়ে পরে । তারপর নিতাই ও তার গাট ছাড়া হয়ে যায় । যেন বসন্ত তাকে মুক্ত করে দিয়েছে ঠিক তেমন । নিতাই দিশা হারিয়ে ফেলে । তার কোন কিছুতেই আর মন লাগে না ।
এরপর কি করবে নিতাই?
কবি বইটা যতখন পড়েছি আমি মুগ্ধ হয়েছি । সত্যি বলতে এত দারুন করে লেখা যে আমি বলতে পারছি না । বইটির প্রতিটি লাইন যেন জীবনের দর্শন তুলে ধরেছে । ছন্দ মিলিয়ে ফেল্লেই কবিতা হয় না । কবিতার জন্য গভীর ভাব থাকতে হয় । থাকতে হয় জীবনবোধ । জীবনের গভীরতা জানতে হয় । যারা কবিতা লেখেন তাদের শক্তি অনেক । তারা শব্দ জটে সুন্দর করে তুলতে ধরতে পারেন যেকোন কিছু ।
বইটির ভাল না লাগার দিক হচ্ছে সাধু ভাষায় লিখিত । এখন হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে সাধু ভাষায় লেখে বলেই কি খারাপ লেগেছে । আসলে তেমন নয় । আমরা যারা বর্তমানে বই পড়ি তারা অনেক আগে থেকেই এটার সাথে পরিচিত । সাধু ভাষা চলিত ভাষায় মধ্যে পার্থক্য সব কিছু । কিন্তু আপনি নতুনদের মধ্যে সাধু ভাষার বই কিভাবে জনপ্রিয় করবেন । চলিত ভাষার হলে বুঝতে সুবিধে হবে তারা পড়ার আগ্রহ পাবে(এটি আমার ব্যক্তিগত মতামত) । আমি সাধু ভাষাকে ছোট করে দেখছি না । কিন্তু যারা নতুন বই পড়ুয়া আছে তাদের কাছে বই সহজ ভাবে পড়তেই তাদের ভাল লাগবে ।
বইটি অনেক প্রকাশনী প্রকাশ করেছে । আমি যেটি পড়েছি সেটি বায়ান্ন’৫২ থেকে প্রকাশিত । তাদের বইয়ের বাধাই আমার কাছে ভাল লেখে । এছাড়া কাভারটাও চমৎকার ।
“এই খেদ আমার মনে-
ভালোবেসে মিটল না এ সাধ, কুলাল না এ জীবনে!
হায়- জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে” ।।
বইঃ কবি
লেখকঃ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৪৫