১৯৯৫ সালে প্রথম প্রকাশিত 'গাভী বিত্তান্ত'তে যে গাভীর বৃত্তান্ত আছে সেটি সাভার ডেইরী ফার্মে অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড় ও সুইডিশ গাভীর ক্রসে উৎপাদিত; ছিপনৌকার মত গড়ন, সুন্দর চোখ, উন্নত গ্রীবাবিশিষ্ঠ একটি গাভী 'তরনী'।
উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র বাংলাদেশের প্রাচীন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তরনী হচ্ছে এই উপাচার্য সাহেবের প্রিয় গাভী। মূলত এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং উপাচার্য মিয়া মুহাম্মদ আবু জুনায়েদের কার্যক্রমের মাধ্যমে লেখক আহমদ ছফা সেসময়কার আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিবেশকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন উপন্যাসের একদম শুরুতেই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসম্প্রদায় বেশ কয়েকটি দলে বিভক্ত। শুধু তাই নয়, তাদের মাঝে নোংরা রাজনীতির প্রচলনও আছে। একইভাবে ছাত্ররাও নোংরা রাজনীতি নিয়ে, নিজেদের মাঝে দলাদলি করতে ব্যস্ত। দেখা যায় অপেক্ষাকৃত সৎ এবং নিরীহ একজন অধ্যাপক উপাচার্য হওয়ার পর কিভাবে তার ক্ষমতার একরকম অপব্যবহারই করেন। হাজার অসৎ মানুষের ভীরে তার সততাও হারিয়ে যেতে থাকে। তিনি লক্ষ করেন তিনি সৎ থাকতে চাইলেও পারছেন না। তার নিজদলের লোকেরাও সুবিধা আদায় করতে না পেরে তার বিরুদ্ধে চলে যায় যা সত্যিকার অর্থে নোংরা রাজনীতিকেই বোঝায়। পাশাপাশি তার দায়িত্বে অবহেলা অথবা উদাসীনতাও লক্ষ্য করা যায়। প্রায় সময়ই দেখা যায় ছাত্রছাত্রীদের তার বাসভবনের সামনে আন্দোলন করতে। খুব ছোট ছোট বিষয় নিয়ে এমনকি খুনখারাপি পর্যন্ত ঘটতে থাকে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। এই নোংরামি আরো বেশি প্রকাশ পায় যখন দেখা যায় উপাচার্য সাহেবের প্রিয় গাভী তরনীকে নিয়ে ক্যাম্পাসে গল্প শুরু হয়। যেমন দেখা যায় কে বা কারা যেন আবু জুনায়েদ সাহেবকে 'গো আচার্য' সম্বোধন করে লিফলেট বিতরণ করে তার বিরুদ্ধে সবাইকে আরো উস্কে দেয়। অন্যদিকে তার প্রিয় গাভীর জন্য বাসভবনের সাথে একটা 'প্রাসাদোপম' গোয়াল তৈরি করা হয়। তার নিজ পরিবারে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকে এই গাভীকে কেন্দ্র করে। আবু জুনায়েদ সাহেবের গাভী-প্রীতি দেখে তার স্ত্রী পর্যন্ত তাকে সন্দেহ করে বসেন।
এখানে মিয়া মুহাম্মদ আবু জুনায়েদ ও তার সহকর্মীদের দিয়ে লেখক তৎকালীন প্রেক্ষাপটকে অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। আর স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সে প্রকৃতপক্ষে অহংকারী, বোকা এবং হিংসুটে। মানুষকে তার দুর্বলতা কিংবা নিচু অবস্থান নিয়ে খোঁটা দিতেও দেখা যায়। আসলে এসবের মাধ্যমে একজন dominant মহিলাকেই রূপায়িত করা হয়েছে। পরিশেষে, লেখকের সেন্স অব হিউমারের প্রশংসা করতেই হয়। তাঁর লেখা অন্যান্য বইয়ের মত এখানেও অসংখ্য ছোটছোট ঘটনা আর লাইনের মাধ্যমে তিনি তার সেন্স অব হিউমারের পরিচয় দিয়েছেন। হালকা ধাঁচে লিখলেও তাতে তৎকালীন সমাজের প্রকৃত অবস্থা গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।