la década-তে আমি প্রতি রবিবারে আসি। সন্ধ্যার পরে পরে রেস্টুরেন্ট অভিযানের কারণ আসলে অনেকগুলো। লেখক লেখক ভাব নিয়ে চলি তো, কারণ জানতে চাইলে কয়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেলা যাবে, কিন্তু তার বেশিরভাগই সম্ভবত আপনার কাছে ফালতু ঠেকবে। আপনার কাছে যে গরুর গোবর বিচ্ছিরি লাগে, তার মধ্যেও আমরা লেখকেরা বিশ্বব্রক্ষান্ডের গোপন রহস্যের সন্ধান পাই। এ কথাটা আমার না, আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলেছিল তবে একটু অন্য ভাবে। তার ভাষ্যমতে, “লেখক হালারপুত হালাগো তো কোন কাম নাই, গোবরের একটা পোঁকা নিয়া যদি লেখে এমন ভাব লইব, মনে হইব স্বর্ণের টুকরা নিয়া লিখতাছে। মনডায় চায় জাইত্তা ধইরা গোবর খাওয়াইয়া দেই, হালার পুত হালারা।”
সে যা-ই হোক, এখন আমি যেখানে বসে আছি সেখানে গোবর থাকার কোন চান্স নেই। একটু গোবর যদি কোথাও থেকে খুঁজে বের করতে পারি, তাহলে কমপক্ষে তিনজনের চাকরি চলে যাবে। তবে la década-তে শুধুমাত্র রবিবার সন্ধ্যার পরে আসার একটামাত্র কারণ, ঠিক এ সময়ে এখানে আমার পছন্দের ব্যান্ডদল গান গায়। ওদের গানগুলো যে তত ভাল লাগে তা না, বরং গানের সাথে ওদের যে অঙ্গভঙ্গি, সেটা খুবই লোভনীয় লাগে। ওদের দেখলে মাঝেমধ্যে ডারউইনিজমে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। প্রথম যেদিন ওদের দেখলাম, সেদিন একজন চোখ বন্ধ করে হাঁটতে হাঁটতে ভায়োলিন বাজাচ্ছিল। কি চমৎকার না ছিল তার হাঁটার ভঙ্গি! বেচারা বুঝতেই পারে নি স্টেজের কোণায় চলে এসেছে। যা হবার তা-ই হল, হঠাৎ ধপাশ করে শব্দ শুনে যখন সবাই স্টেজের দিকে তাকাল, ততক্ষণে ভায়োলিনের একটা স্ট্রিং গিয়েছে ছিড়ে। তবে বাদকের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়, তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে এমন ভাব নিল, যেন ঠাস করে পরে যাওয়াটা আধুনিক ভায়োলিন বাজানোর একটা আর্ট।
তবে মানুষজনের এদিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই, গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ টেবিলে কাপল বসে থাকে। তাদের কাজকর্ম তো আরও মজাদার। একদিন এসে দেখি একজন লোক হাটুগেড়ে মেঝেতে বসে আছে। মানুষজন উৎস্যুক দৃষ্টিতে তাকালেও কিছুই বলতে পারছে না। উচ্চবিত্তদের এই একটা সমস্যা, যা করতে ইচ্ছা হয় তা সহজে করতে পারে না। মধ্যবিত্তদের এ সমস্যা তো আরও প্রকট, তাই তারা তাদের শব্দভান্ডার থেকে ‘ইচ্ছা’ নামক শব্দটা বাদ দিয়ে দিয়েছে। তবে নিম্নবিত্তদের এধরনের কোন সমস্যা নেই, যা করতে চায় ধাপ আর ধাপ করে ফেলে। তো আমি হাটুবাবার পাশের টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, এভাবে বসে আছেন কেন, যোগব্যায়াম করছেন নাকি?’
লোকটা আমার দিকে নাকমুখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ফেসবুক গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রথম দেখা আজ। ওকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এভাবে বসে আছি।’
কয়েক মিনিট পরে একটা মেয়ে এল। লোকটা মেয়েটাকে একটা ফুলের তোড়া দিয়ে বলল, ‘আই লাভ ইউ।’ মেয়েটা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ভ। বারবার বলছে, ‘আপনি উঠে বসুন, চেয়ারে বসুন।’ লোকটা আরও উৎসাহিত গলায় বলতে লাগল, ‘তুমি আই লাভ ইউ না বললে আমি উঠব না।’ মেয়েটা নিজে লজ্জায় বসতে পারছে না, লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। শেষমেষ যেন বাধ্য হয়েই আই লাভ ইউ বলল মেয়েটা। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে লোকটা তখনও উঠল না, বরং বলল, ‘আমাদের রিলেশনের প্রথম দিনে আমি আজ এভাবেই বসে থাকব তোমার প্রতি ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে।’ মেয়েটা যতই উঠতে বলে, সে নাছোড়বান্দা। খাবারের অর্ডার দিলে মেয়েটা গাপুশ-গুপুশ খেয়ে একরকম দৌড়ে পালাল। মেয়েটা চলে যাবার একটু পরে একজন লোক একটা হুইল চেয়ার নিয়ে এসে হাটুবাবাকে হুইল চেয়ারে তুলল। আমি তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বানরবাবাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, অনেক বুঝে ফেলেছি, বেশি বুঝলে বিপদ।
আজ অবশ্য আমার পাশের টেবিলে কোন হাটুবাবা নেই, ২৩/২৪ বছর বয়ষ্ক এক ছেলে বসে আছে একা। ছেলেটার মধ্যে কিঞ্চিত অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও এখানে যারা আসে তাদের মধ্যে অস্থিরতা বিষয়টা ততটা কমন না। সে যা-ই হোক, ছেলেটা বারবার তার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আমি বুঝলাম সে কোন মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। ‘করো বাবা, অপেক্ষা করো,’ মনে মনে বলে আমি অন্য দিকে তাকালাম। আমার আরেকপাশের টেবিলে একজোড়া হাজবেন্ড-ওয়াইফ (দেখে তাই মনে হচ্ছে) একের পর এক আইটেম গিলে যাচ্ছে। এতদ্রুত হালুম-হুলুম করে খাবে গরীবেরা, বড়লোকেরা কেন? তারা একটা একটা করে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মুখে দিয়ে আধঘন্টা চিবুবে, একঢোক কোকা কোলা খেয়ে আবার আরেকটা…। তার পাশের টেবিলে একজোড়া কমবয়ষ্ক কাপল, খুবই হ্যাপি মনে হচ্ছে দেখে। হয়তো নতুন রিলেশন, তাই এতটা হ্যাপি। কয়েক মাস গেলে ওই কোণার টেবিলের কাপলের মত অবস্থা হবে হয়তো। ঝগড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। কত নম্বর বিপদসঙ্কেত তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না, তবে ঘূর্ণীঝড় যেকোন সময় তাদের মাঝখান দিয়ে চলে যেতে পারে। ছেলেটা পরে আছে সবুজ রংয়ের চেক শার্ট। চোখ বন্ধ করলাম আমি। ঠিক চার বছর আগে এরকম… থাক, ওসব বলে আর কি হবে?
আমার পাশের টেবিলে একজন এসেছে। কিন্তু চোখ খুলে আশাভঙ্গ হল, একজন বয়ষ্ক লোক। ২৩/২৪ বছরের ছেলেটা তার জন্য এতটা অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিল? তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে বাবা-ছেলে। এরকম যায়গায় বাবা-ছেলেকে একসাথে দেখা যাওয়াটা-ও রেয়ার কেইস। একটু আশাবাদী হলাম। কান খাড়া করে রাখলাম।
‘তুই আজই চলে যাবি? আমার কোয়ার্টারে চল!’
‘না বাবা, যেতে হবে। কাল অফিস আছে।’
কে যাবে, কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারলাম না। বানর বাবাদের দিকে চোখ আর অফিস বাবার দিকে কান দিয়ে শুনতে থাকলাম।
‘রংপুর থেকে এইমাত্র এলি। আমার কোয়ার্টারে গেলি না, আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে এলি, আর কারণটা-ও বলছিস না। ঘটনাটা কি আমাকে খুলে বল তো।’
‘সবই বলব বাবা। আগে খাবার অর্ডার করি।’
ও আচ্ছা, রংপুর থেকে ঢাকা এসে আজই আবার রংপুরে চলে যাবে। বাবা ঢাকায় চাকরি করলেও তার কোয়ার্টারে না গিয়ে la década-তে নিয়ে এসেছে তাকে – ঘটনা বুঝতে পেরে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লাম। খাবারের অর্ডার করেই তারা হুট করে পারিবারিক আলোচনায় ঢুকে গেল।
‘তোর মা কেমন আছে?’
পারিবারিক এসব আলোচনা শোনার কোন মানে হয় না। আমি সেই বিবাহিত কাপলের দিকে তাকালাম। তাদের খাওয়া শেষ। লোকটা নিশ্চয়ই অনেক বেশি খেয়েছে। হাত-পা ছড়িয়ে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে।
‘আজকের পর ফার্দার তুমি আমাকে ফোন দিবা না।’
মেঘের গর্জনের শব্দ শুনে কোণার টেবিলের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ঘূর্ণীঝড় আঘাত হেনেছে। মেয়েটা উঠে হনহন করে চলে যাচ্ছে। সবুজ চেক ছেলেটা হা করে বসে আছে চেয়ারে। কি করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ সে-ও মেয়েটার পেছনে পেছনে যেতে শুরু করল। ঠিক চার বছর আগে এরকম একটা সবুজ চেক শার্ট কিনেছিলাম বঙ্গবাজার থেকে। ২২০ টাকা।
বানর বাবাজিরা গান গেয়েই যাচ্ছে। এরা তো দেখছি বহু ভাষাবিষারদ বানর সম্প্রদায়! একবার একভাষার গান, তো আরেকবার অন্য ভাষা।
‘বাবা, এবার তোমাকে বলি কেন তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।’
আমার কান আবার খাড়া। এতক্ষণে লাইনে এসেছে ২৩/২৪ বছর।
‘বিষয়টা আসলে খুব ছোট। কিন্তু আমার কাছে খুব আনন্দের। আজকে আমি আমার জীবনের প্রথম চাকরির প্রথম বেতন পেলাম। ভাবলাম তোমাকে নিয়ে সেলিব্রেট করি। তাই সকালেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলাম।’
থতমত খেয়ে গেলাম। প্রথম চাকরির প্রথম বেতন নিয়ে তো বন্ধুবান্ধবের সাথে, গার্লফ্রেন্ডের সাথে সেলিব্রেট করার কথা। রংপুর থেকে ঢাকায় এসে বাবার সাথে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে সেলিব্রেট করা – বিষয়টা আমার মত মানুষের কান থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত যেতে অনেকটা সময় নিয়ে নেয়। হতভম্ভ হয়ে আমি বাবার মুখের দিকে তাকালাম। কোন কথা নেই তার মুখে, শুধুমাত্র দু-ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল তার গাল বেয়ে। তবে তার মুখে আনন্দের যে আভাটা দেখতে পেলাম, ওহ, আমার জীবনে এরকমটা কখনো দেখিনি। এটাকে যে কিভাবে ব্যাখ্যা করব – আসলে আমার মত মানুষের পক্ষে তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না।
বাবা টেবিল থেকে টিস্যু তুলে নিলেন। ছেলের চোখও আর্দ্র। হুট করে কোন কথা নেই বার্তা নেই ছেলে বলে উঠল, ‘আই লাভ ইউ বাবা।’
দুজনের চোখের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। বাবা শক্ত করে ছেলের হাত চেপে ধরলেন। এই হাতদুটো একসাথে থাকলে সম্ভবত আর কিছুই লাগে না। দুজনের চোখমুখে এরকম কিছুই লিখা দেখেতে পেলাম।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। la década’র হস্তীকায় দরজার দিকে পা বাড়ালাম। অনেক বুঝে ফেলেছি, বেশি বুঝলে বিপদ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১:০০