১
সামনের শ্যাওড়া গাছটার ডালে বসে জিড়িয়ে নিবে ভাবল সে। প্রচন্ড ক্লান্তি নিয়ে কোনরকমে উড়ে গিয়ে বসল শ্যাওড়া গাছটার পাতাভর্তি একটা ডালে। এ শহরে শ্যাওড়া গাছ তেমন দেখা যায় না। শেষবারের মত কবে সে এরকম সুন্দর একটি শ্যাওড়া গাছ দেখেছে মনে করতে পারল না। অনেক সময় ধরে রোদে উড়তে উড়তে পিঠটা যেন পুড়ে গিয়েছে। পিঠের যে পুরু পালক তাকে রোদ থেকে বাঁচিয়ে রাখে, সেটাই এখন কষ্টের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। পিঠ গিয়েছে ঘেমে। কয়েকবার ডানা ঝাপটাল পাখিটা।
চৈত্র মাসের শেষ দিনে অন্য সবকিছুর মত গরমের তীব্রতায় হাঁপিয়ে উঠেছে সে। অসুস্থ শরীর নিয়ে বাইরে যেতে মানা করেছিল তার স্ত্রী। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? নিজেরা হয়তো খেয়ে না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারত, কিন্তু তাদের তিনটা ছোটছোট বাচ্চা, উড়তে পারে না, সারা দিন ট্যাও ট্যাও করে ডাকে। পাখিটা আর চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে পারল না।
শরীরটা একটু ঠান্ডা হতেই চারপাশে তাকাল সে। একটা বড় রাস্তার পাশের গাছে বসে আছে। রাস্তাটার এক বিন্দু যায়গা ফাঁকা নেই, গাড়ি আর গাড়িতে ঠেসে আছে। গাড়িগুলোর পিপপিপ শব্দ মোটেই ভাল লাগে না তার কাছে। আসলে এই শহরের কোন কিছুই ভাল লাগে না। ছোটবেলায় যেখানে ছিল সেখানে সবকিছু কত সুন্দর ছিল! কত গাছ ছিল সেখানে! তাদের বাসাটা ছিল বড় একটা কৃষ্ণচুড়া গাছের মগডালে। কৃষ্ণচুড়া ফুলগুলো ফুটলে অনেক প্রজাপতি আসত সেখানে, ফুলে ফুলে বসত। একটা প্রজাপতির সাথে তার খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে ছিল। প্রজাপতিটা ডানা থেকে রং লাগিয়ে দিত পাখিটার গায়ে। একদিন অবাক হয়ে পাখিটা দেখল, সেই লম্বা কৃষ্ণচুড়া গাছটা কেটে ফেলছে কিছু মানুষ। শুধু তাদের গাছটাই না, আশেপাশের সবগুলো গাছ কেটে ফেলেছে তারা। তখন তাদের বাসায় দুইটা ডিম ছিল। পাখিটা আশায় বসে থাকত তার একটা ভাই আর একটা বোন হবে। কিন্তু সব আশাই ধপাশ করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। পরে সেখানে অনেকগুলো বাড়ি বানিয়েছে, তাদের কৃষ্ণচুড়া গাছটা থেকেও উঁচু উঁচু। যেন মানুষই বাস করবে সব যায়গায়, আর কাউকে থাকতে দিবে না। সেই থেকেই মানুষের উপর মহাবিরক্ত পাখিটা। তখনই চলে আসে এখানে, এই পঁচা শহরে। সে তার স্ত্রীর সাথে পরিকল্পনা করেছে তাদের বাচ্চাগুলো বড় হলে এখানে আর থাকবে না, সবুজ কোন যায়গায় চলে যাবে। যেখানে সারাটা দিন কানের সামনে অদ্ভূত গাড়িগুলো পিপপিপ করবে না।
পুউউউউউ শব্দ শুনে ভাবনায় ছেদ পড়ল। দূর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। ট্রেনে করে মানুষ অনেক অনেক দূরের দেশে চলে যায় পাখিটা জানে। কেউ হয়তো তার আপনজনের কাছে, কেউবা আবার আপনজনের কাছ থেকে দূরে। তার নিজের আপনজনদের কাছ থেকে দূরে যাবার কথা চিন্তাই করতে পারে না পাখিটা; ওদের জন্যই তো বেঁচে আছে সে। ডানা মেলে উড়াল দিল সে কটকটে রোদের মধ্যে। যত তারাতারি সম্ভব খাবার যোগার করে নিয়ে যেতে হবে। গরমের মাত্র চুড়ান্তের চেয়েও কয়েক ডিগ্রি উপরে। পাখিটা তার জীবনে এতটা গরম কখনোই দেখে নি। অনেক পাখি মারা যাচ্ছে এবারের গরমে। গরমে এত পাখি মারা যায় তা তার বাপ-দাদার মুখেও কখনো শুনেনি। কেন যে এত গরম তার কারণ সম্পূর্ণই অজানা পাখিটার কাছে। তবে সে শুধুমাত্র জানে, একমাত্র গরমই না, সবদিক থেকেই পরিবেশটা ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে, বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
পাশের গলিটায় একটা খোলা ডাস্টবিন দেখতে পেল পাখিটা। পঁচা শহরে পঁচা খাবার ছাড়া আর কি পাওয়া যাবে? অপ্রশস্ত রাস্তাটার পাশে একটা কেঁচো মরে পরে থাকতে দেখে সেখানে নামল সে। পাঁ দুটো রাস্তার কালো পিচের সাথে লাগতেই যেন পুরে গেল। তাড়াহেুড়ো করে মৃত কেঁচোটাকে ঠোঁটে তুলতেই পাশের ড্রেনের নোংরা পানির দিকে চোখ গেল। সাথেসাথেই বুকটা ধ্বক করে উঠল পাখিটার। তার মত দেখতে একটা পাখি ভেসে যাচ্ছে। পা দুটো উপরের দিকে তোলা। গরমে অনেক পাখি মারা গেলেও নিজের চোখে আগে দেখে নি। অবশ্য যারা বেঁচে আছে তাদের অবস্থাও যাচ্ছে তাই। সে আর তার স্ত্রীর অবস্থাও সেরকম। যথেষ্ট অসুস্থ, কিন্তু তবুও বাচ্চাদের অন্তত বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজের অসুস্থতার কথা ভুলে গিয়েছে তারা। কেঁচো মুখে নিয়ে উড়ে যাবার সময় আড়চোখে আবার দেখে নিল দুর্ভাগা পাখিটার দিকে।
বাসার কিছুটা দূর থেকেই বাচ্চাদের চি চি শব্দ শুনতে পেল সে। দূর থেকেই বাসার মধ্যে চারটা অবয়ব দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। নেমে গিয়ে বাচ্চাদের মুখে কেঁচোটা ধরিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে পাখিটা দেখল, বাচ্চারা কেঁচোটা ফেলে দিয়ে আবার চি চি করে ডাকতে শুরু করেছে। পাশে তাদের মা ঘুমুচ্ছে। এই ভর দুপুরে তো তার ঘুমানোর কথা না! পাখিটা তার পা দিয়ে স্ত্রী-কে নাড়া দিল, কোন সাড়া শব্দ নেই। ক্ষীপ্রগতিতে যখন তার স্ত্রীর শরীরটা উল্টে দিল, সাথেসাথে সে চোখ বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য হল। এরকম দৃশ্য যে তাকে দেখতে হবে, তা পাখিটা কখনো কল্পনাই করতে পারে না। তার স্ত্রী মারা গিয়েছে, এ কথা ভাবতেই তার চোখ দিয়ে পানি চলে এল। কত কথা, কত স্মৃতি একের পর এক ভেসে উঠতে লাগল ভেজা চোখে! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে উড়তে শুরু করল উদ্দেশ্যহীন ভাবে। পেছনে পরে রইল বাচ্চাদের চি চি ডাক আর তার স্ত্রীর মৃতদেহ।
২
সূর্য ডোবার সাথেসাথে গরমের তীব্রতা একটু একটু করে কমতে শুরু করে। সূর্য অবশ্য অনেকক্ষণ আগেই ডুবে গিয়েছে। পাখিটা তার বাসায় বাচ্চাদের পাশে নিয়ে বসে আছে। তাদের পাশে কেঁচোটার একটা অংশ পরে আছে। বাকিটুকু বাচ্চাগুলো খেয়ে নিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। পাখিটা নিজে সারা দিন কিছু খায় নি, কিন্তু সেদিকে কোন খেয়াল নেই তার। স্রোতের মত ভাবনাগুলো ভেসে আসছে তার মনে। হঠাৎ পাখিটা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলে বাচ্চাগুলো লাফিয়ে উঠল। নাহ্, আর মন খারাপ করে বসে থাকবে না সে। যে চলে গেছে তাকে নিয়ে অহেতুক মন খারাপ করে বসে থেকে লাভ কি? বাচ্চাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণই এখন তার উপর। নিজে মনমরা হয়ে পরে থাকলে বাচ্চাদের কি হবে? গপাগপ কেঁচোর টুকরাটা খেয়ে নিল পাখিটা। সারাদিন পরে পেটে কিছু যাওয়াতে একটু ঠান্ডা হল যেন। উত্তর দিক থেকে বাতাস বইছে। ঠান্ডা বাতাস। শহরের সবগুলো প্রাণের মত এই পাখি পরিবারটাও ঠান্ডা বাতাস পেয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
‘গল্প শুনবি?’ পাখিটা বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করল। আসলে তার এমন কোন কাজ দরকার যার মাধ্যমে স্ত্রীর কথা ভুলে থাকা যায়।
‘চি চি শুনব।’ বাচ্চাগুলো আগ্রহী হয়ে উঠে। বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে।
‘অনেকদিন আগে একদেশে ছিল একটা সুন্দর বাগান। সে বাগানে কত সুন্দর সুন্দর গাছ ছিল! আম গাছ ছিল, জাম গাছ ছিল, জাম্বুরা গাছ ছিল।’
‘জাম্বুরা কি বাবা?’
‘জাম্বুরা হচ্ছে বাতাবী লেবু।’
‘চি চি তারপর?’ বাতাসের বেগ আরও বাড়ছে।’
‘তো সেই বাগানে আরও কত ফুলগাছ ছিল! লাল ফুল, হলুদ ফুল, গোলাপী ফুল। সেখানে অনেক পাখি ছিল-লম্বা ঠোঁট পাখি, নীলকন্ঠী পাখি, সবুজ পাখি। আরও ছিল প্রজাপতি-লাল প্রজাপতি, হলুদ প্রজাপতি, কমলা প্রজাপতি।’
বাচ্চারাও বাবার সাথে সাথে বলতে লাগল, ‘লাল প্রজাপতি, হলুদ প্রজাপতি, কমলা প্রজাপতি।’
হঠাৎ একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল। তারপর আরেকটা। পাখিটার হার্টবিট বেড়ে গেল। এভাবে বাতাস বইতে থাকলে তাদের বাসা?
বাতাসের সাথে একটু একটু বৃষ্টি হতে লাগল। পাখিটা বাচ্চাদের তার ডানার নিচে লুকালো। এরকমটা করে তার অভ্যাস নেই। বাচ্চাদের ডানার নিচে লুকিয়ে রাখা তাদের মায়ের কাজ। ধুর! আবার তার কথা মনে পরে গেল!
বাতাস থামার কোন লক্ষণ নেই। একটা থেকে পরেরটা আরও শক্তিশালী, বিধ্বংসী। পাখিটা একা হলে পাশের সাদা দালানটার মধ্যে ঢুকে বসে থাকত। কিন্তু তার বাচ্চা…? বাতাসের সাথে বৃষ্টিও একটু একটু করে বাড়ছে। হঠাৎ পাখিটা উড়াল দিল কোথাও কিছু পাওয়া যায় কিনা তা দেখতে। পাশের সাদা বাড়িটার ছাদে একটা পলিথিন পড়ে থাকতে দেখে তাড়াতারি উড়ে চলে গেল সেখানে। পলিথিনটা মুখে নিয়ে ছাদের পাচিল পর্যন্ত সবে এসেছে, তখনই একটা শক্তিশালী দমকা বাতাসে সে ছিটকে পড়ল ছাদের উপরে। মাথাটা ছাদের শক্ত কংক্রিটে ঠুকে গেল। তবে পড়ার আগে পলকের জন্য দেখতে পেল গাছের ডালটা তাদের বাসা সহ ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে পিচঢালাই রাস্তায়। আর তারপর সবকিছু অন্ধকার।
৩
খুব কষ্টে চোখ খুলল সে। যায়গাটা একেবারেই অপরিচিত। মাথায় কিছুই কাজ করছে না তার, সে কোথায়? কোথায় থাকার কথা তার? মাথার মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যাথা হচ্ছে। যথেষ্ট কড়া রোদ উঠেছে, কিন্তু সে পড়ে আছে ছায়ায়। পিঠের নিচে নরম কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করছে সে। উপরে নীল আকাশটা দেখা যাচ্ছে। একেবারে নীল। আকাশটা যেন ঘুরছে। আকাশের কোথাও সুন্দর সাদা মেঘ দেখা যায় কিনা তা দেখার জন্য পাখিটা তার মাথা একটু ঘুরাল। সাথে সাথে আৎকে উঠে পেছনে সরে গেল। একটা মানুষ তার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। তবে সরতে গিয়ে বুঝতে পারল তার সারাটা শরীর ব্যাথায় কুঁকড়ে আছে। পাখিটাকে লাফিয়ে সরে যেতে দেখে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটাও হকচকিয়ে গেল। মেয়েটার হাতে রান্নাঘর থেকে একরকম চুরি করে আনা সাদা ভাত। মায়ের চোখ ফাকি দিতে তাকে চুরিই করতে হয়েছে বলা যায়। মা দেখতে পেলে একশ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হত।
মেয়েটা হাতে ভাত নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে। শেষমেষ সাবধানে ভাতগুলো স্পঞ্জের উপর রেখে পেছনে সরে দাঁড়াল। এই স্পঞ্জটাও সে রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসেছে। পাখিটা গরম ছাদের উপর শুয়ে কষ্ট পাবে, তাই আলগোছে তুলে রেখেছিল নরম স্পঞ্জের উপর।
পাখিটা শেষ কবে ভাত খেয়েছে ভুলে গিয়েছে। শুধুমাত্র সাদা ভাত তার কাছে কখনোই ভাল লাগে না। কিন্তু এই মুহূর্তে ভাত তার কাছে রসোগোল্লার মত দেখাচ্ছে। খপ করে কিছু ভাত ঠোঁটে তুলে নিল সে। কিছুদিন আগে সে একদিন ভাত খেয়েছিল তার বাচ্চাদের নিয়ে…। তার বাচ্চা...? তার বাচ্চা কোথায়? মুহূর্তের মধ্যে তার মনে পড়ে গেল তার সাথে যা যা হয়েছে সবকিছু। তার স্ত্রীর হিট-স্ট্রোকে মৃত্যু, ঝড়ে তাদের বাসা…। ঠোঁট থেকে ভাতগুলো তার অজান্তেই পড়ে গেল। সাথে সাথে উড়ে চলে গেল গাছের কাছে। মেয়েটা তার পেছনে পেছনে ছাদের পাচিল পর্যন্ত এল।
কিন্তু একি? তাদের বাসাটা যে গাছের উপরে ছিল সেই গাছটা প্রায় মাঝখান থেকে ভেঙে গিয়েছে। নিচে পড়ে আছে ভাঙা ডাল-পালা। মানুষজন তড়িঘড়ি করে টেনে সরিয়ে নিচ্ছে সেগুলো। কিন্তু তার বাচ্চা কোথায়? বাসা কোথায়? হৃৎপিন্ডের ভেতর থেকে একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল। কিন্তু সে আওয়াজ সে ছাড়া আর কেউ শুনতে পেয়েছে কিনা কে জানে? সবগুলো ডাল সরিয়ে নেয়া পর্যন্ত সে গাছটার ভাঙা কান্ডের উপর বসে থাকল। নাহ্, কোথাও নেই। বছরের প্রথম কালবোশেখী তার জীবনটাকেও লন্ডভন্ড করে দিয়ে গিয়েছে। পাখিটা পাগলের মত এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল-বড় রাস্তার ঐপাড়ে, ওদিকে নয়তলা বাড়িটার চারপাশে, কিন্তু কোথাও নেই। কেথায় যাবে সে? কি করবে? কোন উপায়-অন্তর না পেয়ে আবার সেই ছাদের উপর এসে ধপ করে পড়ে গেল। হতাশা, কষ্ট, দুঃখ, রোদ, গরম, ক্ষুধা-ছোট্ট ব্রেনটা এতকিছুর ভার আর সহ্য করতে পারল না। আবারো মূর্ছা গেল পাখিটা।
পাখিটা অনুভব করতে পারল না, নরম দুটো হাত তাকে আবারো রোদ থেকে তুলে স্পঞ্জের উপর শুইয়ে দিয়ে ট্যাঙ্কির নিচে ছায়ায় রেখে দিয়েছে।
৪
কে যেন কথা বলছে। শব্দ শুনে পাখিটা সচেতন হয়ে উঠল। মুহূর্ত সময় পরে বুঝতে পারল সে কোথায়, কেন সে এখানে। তার চোখ খুলতে ইচ্ছা করছে না। আসলে তার তার অবস্থাটা এমন, যেন চোখ খোলার মত শক্তিও নেই তার।
‘কিরে তোর পাখি কি মরেই গেল নাকি?’
‘না না কি বলিস? মরবে কেন? খুব অসুস্থ মনে হয়। সজাগ হয়ে উঠে খাবারগুলো খেলে হয়তো ভাল ফিল করবে।’
পাখিটা চুপচাপ কথা শুনে যাচ্ছে। সে মানুষের কথা কিছুই বুঝতে পারে না। কিছু কিছু টিয়াপাখিকে সে অবশ্য চেনে যারা হয়তো মানুষের কথা বুঝতে পারে, একটু একটু বলতেও পারে মানুষের মত। পাখিটা হঠৎ ধুরুস-ধারুস শব্দ শুনতে পেল তার মাথার উপরে। তার ব্রেন শরীরের সব শক্তিকে এক করে তাকে লাফিয়ে উঠতে বাধ্য করল। চোখ খুলে দেখতে পেল সে একটা পানির ট্যাঙ্কির নিয়ে শুয়ে আছে? পানির ট্যাঙ্কি সম্পর্কে তার মোটামুটি ধারণা আছে। তার এক পরিচিত পাখি ট্যাঙ্কির মধ্যে পড়ে মরে গিয়েছিল। শব্দটা ক্ষতিকর না বুঝতে পেরে সে শান্ত চোখে মানুষগুলোর দিকে তাকাল। সেই মেয়েটা আর তার এক বান্ধবীর মুখ বারবার উঁকি দিচ্ছে। তার সামনে কিছু খাবার পড়ে আছে। পাউরুটির একটা টুকরা, একটা নরম বিস্কিট আর কিছু ভাত। পাখিটা মারাত্মক রকমের কৃতজ্ঞতা বোধ করল। কিন্তু এখন কৃতজ্ঞতা দেখানোর সময় নেই। গোগ্রাসে খেয়ে ফেলল যতটুকু খাওয়া সম্ভব। ট্যাঙ্কির কোণার দিকে কিছু পানি পড়ে আছে। সেখান থেকে পানি খেয়ে নিল। তারপর আবার চুপচাপ শুয়ে পড়ল।
পাখিটা বুঝতে পারছে মানুষগুলো ভাল, কোন ক্ষতি করবে না। আর করলে করুক, স্ত্রী আর বাচ্চাদের ছাড়া তার এখন আর বাঁচতেও তেমন ইচ্ছা করে না। উফ্, আবারো ওদের কথা মনে পড়ে গেল! পাখিটা খুব চেষ্টা করল ওদের কথা না ভেবে থাকতে, কিন্তু পারল না।
পাখিটাকে উঠে খেতে দেখে আনন্দে নিঃশব্দে হাততালি দিয়ে উঠল মিলি। তার বান্ধবী রুমা ভ্রু-কূঁচকে তাকাল তার দিকে, ‘এখানে এত খুশি হওয়ার কি আছে?’
ট্যাঙ্কির পাশ থেকে উঠে এসে হাঁটতে হাঁটতে মিলি বলল, ‘খুশি হওয়ার কিছু নাই মানে? দেখিস নাই কি সুন্দর টুকটুক করে উঠে খাবার খেল? আহা বেচারার খুব কষ্ট হচ্ছে মনে হয়।’
‘ধুর, পৃথিবীতে কোটি কোটি পাখি আছে, সবারই কষ্ট আছে, এগুলো নিয়ে বসে থাকলে চলবে? জানিস, আমাদের বারান্দায় আগে পাখি আসত, রাতে থাকত। একদম নষ্ট করে ফেলত বারান্দাটা, ওয়াক থু! এসবের চেয়ে আমার অ্যাংরি বার্ড, ফ্ল্যাপি বার্ড এগুলোই ভাল।’
মিলি রুমার টি-শার্টে ফ্ল্যাপি বার্ডের ছবিটা দেখে হেঁসে ফেলল।
‘তুই কম্পিউটার গেমস খেলতে খেলতে একটা কম্পিউটার হয়ে গেছিস। তোর ভেতরে প্রাণের জন্য মায়া মহব্বত কিচ্ছু নাই।’
‘এত মায়া থাকার দরকার নাই। আমি তোর মত মাদার তেরেসা না। এখন যাই রে, কাল স্কুলে দেখা হবে।’
রুমা চলে গেলে মিলি আবার ট্যাঙ্কির নিচে উঁকি দিল। পাখিটা আবারো ঘুমাচ্ছে। আহারে, খুবই অসুস্থ মনে হয়। রুটিটার অর্ধেক খেয়েছে, ভাতগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। খুব মায়া হল তার। নিচে আসতে আসতে রুমা মনে মনে ভাবল, রাতে খাবার সময় আবার কিছু তরকারি টরকারি দিয়ে যাবে।
৫
আজ প্রায় বিশ দিন পাখিটা এখানেই থাকে। এই বিশটা দিন পাখিটার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। প্রতিটা দিন সকালে আবার স্কুল থেকে ফিরেই মিলি তার কাছে চলে আসে। তার জন্য বিভিন্ন রকম খাবার নিয়ে আসে। কত রকমের যে খাবার! একবার একটা মড়া পাখি নিয়ে এল। সেটা দেখে তার মন যা খারাপ হল! মিলি যতই বলে এটা একটা পুতুল, তার পক্ষে তো আর বোঝা সম্ভব না। স্ত্রী, বাচ্চাদের কথা মনে প্রবলভাবে গেথে থাকলেও সে এখন হাঁসতে পারে। তার এখন বেঁচে থাকতে ইচ্ছা হয়, আবার ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছা হয়। তার কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে সে মাঝেমধ্যে উড়ে গিয়ে চমৎকার চমৎকার কিছু জিনিস এনে মিলিকে দেয়। ছোটছোট রঙচঙে সুন্দর পাতা, ঘাস, ফুলের কলি বা আস্ত ফুল সে ঠোটে করে নিয়ে আসে। মিলি আনন্দে হাততালি দিয়ে ফুলগুলো তার চুলে লাগিয়ে রাখে। তখন কি যে ভাল লাগে পাখিটার কাছে!
আজকেও একটা ঘাসফুল নিয়ে এসে পাখিটা অপেক্ষা করছে মিলির জন্য। তার যখন আসার কথা তারচেয়ে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। সূর্যটা লাল হয়ে গেছে, একটু পরেই ডুবে যাবে। পাখিটা এদিক ওদিক হাঁটতে লাগল সময় কাটানোর জন্য। হঠাৎ মিলিকে দৌড়ে আসতে দেখে যায়গামত গিয়ে বসল। মিলির সামনে ফুলটা রাখল। কিন্তু মিলির মুখে হাঁসি নেই কেন আজ? সে উৎসাহে হাততালি দিয়ে উঠেছে না কেন? তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে কেন? পাখিটার বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল।
ফুলটা হাতে নিয়ে আরও কষ্ট লাগল মিলির। সে কোন রকমে কান্না থামিয়ে বলল, ‘তোর কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি আজকে। আমি আজকেই কানাডা চলে যাব, আর দেখা হবে না তোর সাথে। জানিস, আমার বয়স যখন তিন মাস, তখন নাকি কারা যেন আমাকে চুরি করে এই নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন আমার আসল বাবা-মা আমাকে খুঁজে পেয়েছে। আমাকে নিতে এসেছে তারা। তারা আমাকে এতকিছু সব বলে নি, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছি সবকিছু। আজই আমাকে নিয়ে যাবে। আমি কাউকে কিচ্ছু বলি নি। শুধুমাত্র একবার বলেছি একটা খাঁচায় করে তোকে নিয়ে যেতে পারব কিনা। তারা না বলে দিয়েছে। তোর সাথে আর দেখা হবে না, ভাল থাকিস।’
মিলি কান্না করতে করতে চলে গেলে পাখিটা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কথা বুঝতে না পারলেও মিলির কথার ভঙ্গিতে অনেককিছু আন্দাজ করতে পারে সে। সে শুধুমাত্র বুঝতে পেরেছে খুব খারাপ কিছু ঘটেছে, খুব খারাপ কিছু। কিন্তু মিলি তাকে ছেড়ে চলে যাবে এ কথা সে চিন্তাও করতে চাচ্ছে না। সারাটা রাত সে অস্থির হয়ে কাটাল। পরদিন সকাল গড়িয়ে যখন দুপুর হয়ে এল কিন্তু মিলি এল না, তখনই তার কাছে পরিষ্কার হল গতকাল মিলি কি বলেছে। ছোট্ট হৃৎপিন্ড বোঝাই করে কষ্ট নিয়ে দিগন্তের দিকে ডানা মেলল তখনই। এ শহর তার সব কাছের প্রাণকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
আর কোনদিন এ শহরের দূষিত বাতাস পাখিটার স্পর্শ পায় নি। কোনদিন না।