কোরা ডট কমে একজন প্রশ্ন করেছে– এলন মাস্ক, বিল গেটস, ম্যাক্স লেভসিন, স্টিভ জবস, পিটার থিয়েল, বিনোদ কশলা, অলিভার এম্বার্টন, গেইল ল্যাকম্যান ম্যাকডোয়েল, অরেন হফম্যান-এদের মতো অসাধারণ উদ্যোক্তাদের তরুণ বয়সটা কেমন ছিলো? বয়স যখন দশ থেকে বাইশ বছর তখন কি করতে ভালোবাসতো তারা? তারা কি অন্য সবার মতোই ছিলো নাকি সবার মধ্যে তাদের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট ছিলো? এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন স্বয়ং অরেন হফম্যান। লাইভ র্যাম্প নামের লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে ওঠা একটি দারুণ, ক্রিয়েটিভ ডেটা অনবোর্ডিং অর্গানাইজেশনের সিইও তিনি। তো লোকটার কথাবার্তা এতটাই ভালো লেগেছে এতোটাই ভালো লেগেছে যে সেগুলো নিজের মতো করে লিখে ফেলতে ইচ্ছে হলো। যে পয়েন্টগুলো তিনি দিয়েছেন সেগুলো নিচে দিচ্ছি।
একা থাকা
তিনি বলেছেন, তারা ছোটবেলায় অনেক বড় একটা সময় কাটিয়েছেন একা একা। মানে বাইরের মানুষজন ভাবতেও পারবে না কতটা সময় একা একা কাটিয়েছেন তারা। একা থাকার কারণে চিন্তা ভাবনা করার সময় আর সুযোগটা মিলেছে তাদের। নিজের ইচ্ছেমতো শিখেছেন, কল্পনায় ভেসে বেরিয়েছেন, সবার চেয়ে আলাদা কিছু স্বপ্ন দেখেছেন। অর্থাৎ নিজের একটি জগত তৈরি করে নিয়েছেন ছোটবেলায়, পরবর্তিতে যে জগতের নায়ক হবেন।
অনেক অনেক অনেএএএক বই পড়া
সেই একা থাকা সময়ে তাদের সবাই বই পড়ে পড়ে তাদের কল্পনা শক্তি বহুগুণে বাড়িয়েছেন। শুধুমাত্র যে হ্যারি পটারের মতো সহজ সহজ বই পড়েছেন তা কিন্তু নয়। কঠিন কঠিন বইয়ের মাঝে আনন্দ খুঁজে নিয়েছেন। ফিকশন পড়েছেন, নন ফিকশন পড়েছেন, সারা দুনিয়ার চমৎকার চমৎকার সব লেখকদের কল্পনার সাথে পরিচিত হয়েছেন। কিছু বই তাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। তারা কোরআন পড়েছেন, বাইবেল পড়েছেন, বৌদ্ধ ধর্মের বই পড়েছেন, প্রাচীন মিথোলজিও বাদ যায় নি। শুধুমাত্র স্কুলে যেসব লেখকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের বাইরে তারা নিজেদের পছন্দের লেখকদের খুঁজে নিয়েছেন।
তাদের সবাই জীবনের বড় একটা সময় কাটিয়েছেন এনসাইক্লোপেডিয়া পড়ে পড়ে। অনেকে এনসাইক্লোপেডিয়ার সবগুলো খন্ড পড়ে শেষ করে ফেলেছেন। আসল কথা হলো নতুন নতুন বিষয় জানার অস্বাভাবিক আগ্রহটা তাদের সবার মধ্যে কমন ছিলো।
ক্লাসে ঢুকার সময় হয়তো তাদের হাতে কোন বই বা ম্যাগাজিন কিছু একটা ছিলো। এমনও হয়েছে বই পড়তে পড়তে দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে বসেছেন। এবং মজার ব্যাপার হলো তাদের প্রায় সবার বাবা-মা আরেকটু কম কম পড়তে বলেছেন!
আজকের দিনে এনসাইক্লোপেডিয়া ইন্টারনেটে একেবারে ফ্রি। কিন্তু তার আকার এতই বড় যে সারা জীবনেও পড়ে শেষ করা যাবে না। তাই বলে পড়া তো আর থেমে থাকতে পারে না। আগ্রহের বিষয়গুলো সম্পর্কে যত পড়াশুনা করা যায় করে ফেলা উচিত।
খেলাধূলা
ছোটবেলায় তাদের সবাই খেলাধূলা করতেন। তবে তাদের খেলা অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা ছিলো। অর্গানাইজড প্লে বলতে যা বুঝায় তারা কেন যেন সেসব থেকে একটু দূরে থাকতেন। বেডরুম, বাসার চিলেকোঠা অথবা কাছের কোন পার্ক তাদের একা একা খেলার সবচেয়ে পছন্দের যায়গা ছিলো। এভাবেই তাদের কল্পনাকে তারা দুরন্ত করে গড়ে তুলেছেন।
নিজেকে সিক্রেট এজেন্ট, ড্রাগনের রাজা অথবা খেলনা সৈন্যদের সেনাপতি ভেবে নিয়েছেন। ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন অথবা পরিবারের কোন সমস্যায় সক্রিয় অংশ নিয়েছেন ছোটবেলাতেই।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
অবাক ব্যাপার হলো, সফল মানুষগুলো যে কতকিছু আগুনে পুড়ে ফেলেছেন, উড়িয়ে দিয়েছেন, ভাসিয়ে দিয়েছেন, কত পোঁকা যে ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন, পাখির জন্য বাসা বানিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তার ধারণা মতে, উপরে যাদের নাম আছে তাদের সবাই একাধিক ইলেক্ট্রিক শক খেয়েছেন (কখনো দূর্ঘটনা আবার কখনো ইচ্ছে করে)।
তারা তৈরি করতেন, সৃষ্টি করতেন, দেখতেন, পর্যবেক্ষণ করতেন। আর সেসব পর্যবেক্ষণের পরিদর্শক আর বিচারক ছিলেন তারা নিজেরাই।
সৃষ্টিশীল কাজকর্ম
উপরের সবাই তাদের ডান মস্তিষ্কের ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত। ছোটবেলার বড় একটা সময় সবাই কাটিয়েছেন নতুন কিছু তৈরি করতে গিয়ে, সৃষ্টিশীল কাজ করতে গিয়ে। কেউ গল্প লিখতেন, কেউ নাটক লিখতেন, ছবি আঁকতেন, ভাষ্কর্য বানাতেন, কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন, কম্পিউটারে প্রোগ্রাম লিখতেন আরও কতো কি।
সৃষ্টি বনাম ভোগ
পড়া, ভালো ভালো মুভি দেখা, গান শোনা এসব সময়কে ভোগ করার ভালো ভালো উপায়। কিন্তু এসবে নতুন কিছু সৃষ্টি হয় না, শুধুমাত্র সময়টা ভোগ করা হয়।
সফল মানুষরা সময়কে ভোগ করার চেয়ে নতুন কিছু তৈরি করাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের কাছে ইনপুট নেয়ার চেয়ে আউটপুট তৈরি করা বেশি উপভোগ্য। তাই কিছু না কিছু বানিয়েছেন, কিছু না কিছু শুরু করেছেন। এই শুরু করা বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের সময়ে তৈরি করা খুবই কঠিন এক কাজ। কারণ, ভোগ করার জন্য এতো এতো উপায় আমাদের সামনে রয়েছে যে সেসবের আনন্দ ত্যাগ করা সহজ নয়। সফল মানুষেরা যখন আস্তে আস্তে বড় হয়েছেন, খুব তারাতারি ভোগ করার বিষয়গুলোর উপর বিরক্ত হয়ে গিয়েছেন। কারণ, তখন তো এতোকিছু ছিলো না, শুধুমাত্র গল্পের বই আর টেলিভিশন কতক্ষণ? কিন্তু এখন এসবের সাথে আরও অনেক অপশন যুক্ত হয়েছে। সত্যি বলতে ট্যাবলয়েড কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে ডিজাইনটাই এভাবে করা হয়েছে যাতে বেশি করে ভোগ করা যায়। এসবের চেয়ে ডেস্কটপ কম্পিউটার সৃজনশীল কাজের জন্য বেশি উপযোগী।
স্কুলের সামাজিক চাপ
স্কুল হলো সামাজিক চাপের একটি যাতাকল। স্কুলে শুধুমাত্র একটু ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য আর রোল নম্বর আগে রাখার জন্য যে অমানবিক চাপ আর অসুস্থ প্রতিযোগীতার মুখে পড়তে হয় তাতে একটা বাচ্চার নিজের বলে কোন সময় থাকে না। আর নিজের একা কোন সময় না থাকলে সে সৃজনশীল হবে কিভাবে? নিজের মতো কাজ করবে কিভাবে? উপরের কোন পয়েন্টই তখন আর মানা সহজ হবে না।
স্কুলে ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে, পরীক্ষায় ভালো করতে হবে ঠিক আছে। তবে তা শুধুমাত্র পরীক্ষায় প্রথম সারিতে থাকার জন্য নয়। অহেতুক চাপ নিয়ে নিজের কল্পনাশক্তিকে পিষে ফেলা কোন কাজের কথা না। আর বাবা-মা সন্তানকে স্কুলে দিয়েই নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকেন, তার নিজের বলে একটা জগত তৈরি করতে সাহায্য করতে হবে সে কথা বেমালুম ভুলে যান। তাই স্কুলে গিয়ে সামাজিক চাপের মুখে পড়ে নিজের একলা জগতটা যেন না হারিয়ে যায় সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কথাগুলো অসাধারণ না? আমরা নিজেরা ছোটবেলায় যে পরিবেশটা পাই নি, আমাদের ছোটদের জন্য যদি সে পরিবেশটা নিশ্চিত করে ফেলা যায় তাহলে দারুণ হয় না?
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৫ রাত ১০:২৬