গত বছরের পহেলা বৈশাখ। যথারীতি নিজের বাঙালিত্ব প্রমান করার জন্য কাকডাকা ভোরে আমি উপস্থিত হলাম চারুকলায়। উদ্দেশ্য যতটা না নিজের বাঙালিত্ব প্রমান করা, তার চেয়ে বেশি ছবি তোলা। এত রং এর মেলা পৃথিবীর আর কোথাও একসাথে দেখা যায় কিনা আমার সন্দেহ (অন্তত অস্ট্রেলিয়াতে দেখ যায় না এ বেপারে আমি নিশ্চিত)।
চিপা থেকে আমিও পিচ্চির একটা ছবি তুলে ফেলি।
তো যাই হোক, মনে মনে খুব খুশি যে আজকে ভালো কিছু ছবি তুলতে পারব। কিন্তু সেই কাক ডাকা ভোরে যেয়ে আমি একটু না, পুরাই বেকুব হয়ে গেলাম। কিঞ্চিত লজ্জাও পেলাম, হাতের ক্যামেরা লুকানোর বিফল চেষ্টা করলাম। কারণ কি? কারণ আর কিছুই না। আমার মনে হলো চারুকলার সামনে যত না দর্শক আছে, তার চে বেশি ফটোগ্রাফার দাড়িয়ে আছে!! তাও যে সে ফটোগ্রাফার না, সবাই এত বড় বড় ক্যামেরা নিয়া দাঁড়িয়ে আছে যে মনে হয় ওগুলা ক্যামেরা না, কামান ষ্টেনগান মেশিনগান টাইপ কিছু, এখনি গুলি বের হয়ে আসবে। আসেপাশে যে পরিমান সাটার চাপার শব্দ শুনতে পেলাম তাতে মনে হতে লাগলো মেশিনগান দিয়া গুলি বের হচ্ছে। এইদিকে এক পিচ্চির ছবি তোলার জন্য বেশ কিছু ফটোগ্রাফারের মধ্যে পারলে ধাক্কা ধাক্কি হাতাহাতি হয়ে যাবার মত অবস্থা। কে কত ভালো এংগেল থেকে ছবি তুলতে পারে তার একটা “সুস্থ প্রতিযোগিতা”।
যাই হোক এসব তামাশা দেখতে দেখতে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হলো। সব ফটোগ্রাফাররা যুদ্ধ শুরু করল তাদের ষ্টেনগান মেশিনগান নিয়া রাজু ভাস্কর্যের কত উচায় উঠবে তা নিয়া। আমি অধম দঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাকের সামনের বাম্পারের উপর একটা পা রাখার জায়গা পেলাম মাত্র (এক পা, আরেক পা তখন শুন্যে ঝুলন্ত ) । তাও কয়েকজন ফটোগ্রাফারের ধমক শুনে নড়াচড়া বন্ধ করে খালি দাড়িয়ে থাকার অনুমতি পেলা। এর মধ্যে হটাত দেখলাম মানুষরুপি এক জানোয়ার রাজু ভাস্কর্যের একদম উপরে উঠে পাঞ্জাবি স্টাইলে ডিস্কো করা শুরু করছে। মনে হলো চাব্কায়া পিঠের চাল তুলতে পারলে শান্তির মা ফিরে আসত। বাঙালির বাঙ্গালিত্তের মাত্রা সপ্তমে চড়লে যা হয় আরকি।
এই সেই জানোয়ার
দেখতে দেখতে বঙ্গাব্দ ১৪১৭ শেষ হয়ে ১৪১৮ চলে এলো। সময় যে কত দ্রুত যায় তা ঘুরে ফিরে এইসব বছরগুলো যখন আসে তখন বুঝা যায়। তা না হলে আমরা সবাই যেভাবে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলতে থাকি, তাতে আমাদের কখনো ভবদয় হওয়ার কথা না. কখন সময়ের সাথে ভেসে ভেসে বাঙালিত্ব হারিয়ে আমরা “ইংলিশ মেন” হয়ে যাই তার খেয়াল না থাকলেও বছরের এই দিনে যে এক দিনের জন্য আমাদের সবাইকে বাঙালি হতে হবে সেই খেয়াল কিন্তু সবারই থাকে। অবশ্য একদিনের জন্য বাঙালি সাজা অনেকটা “ফ্যশন” হয়ে গেছে আজকাল । বছরের বাকি ৩৬৪ দিন যারা ইংরেজী বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করেন তারাও এই একদিন ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা কপচিয় নিজেকে সংস্কৃতিবান প্রমান করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কিন্তু এসব কিছুর পরেও এটাই বাঙালির সবচে বড় উত্সব যার প্রতি ইঞ্চিতে , প্রতিটা মুহুর্তে থাকে প্রানের ছোয়া।
এই উচ্ছাস আর কোথায় পাব?
আমার সাথে পহেলা বৈশাখের মনে হয় একটা বৈরী সম্পর্ক আছে । যতদিন নর্থ সাউথে পড়েছি, ততদিন পহেলা বৈশাখ কি তা ভুলে থাকতে হয়েছে । কেন? কারণ নর্থ সাউথে এই স্প্রিং সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয় ৮/৯ এপ্রিল থেকে আর শেষ হয় ২০/২২ তারিখের দিকে। এর মধ্যে অবধারিত ভাবে ১৫ তারিখ একটা পরীক্ষা পরবেই সবার। এর কোনো মাফ নাই। তাই NSU লাইফে পহেলা বৈশাখের মজা চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলেতেই সিমাবদ্ধ ছিল। খালি দাতে দাত চেপে অপেক্ষা করতাম কবে এই আজব থেকে রক্ষা পাব।
সেই NSU লাইফ অনেক আগেই শেষ কিন্তু আজকে ঢাকা থেকে কত দূরে। খুব খুব মিস করব পহেলা বৈশাখ কে। এত প্রাণ এত আনন্দ এত উচ্ছাস আর কোথায় পাব?
আবাল বৃদ্ধ বনিতা ধনি গরিব সব এক কাতারে আর কোন উতসবে হয়
বছর ঘুরে এলো আরেক প্রভাতি …ফিরে এলো সুরের মঞ্জরী….পলাশ শিমুল গাছে লেগেছে আগুন…এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি ….মেলায় যাইরে…….
সবার বছরের প্রতিটা দিন পহেলা বৈশাখ হোক। নব বর্ষের শুভেচ্ছা
সব ছবি গত বছরের পহেলা বৈশাখের ।
ছবি বড় করে দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১১ রাত ১১:১৮