বাতায়নের সূক্ষ্ম ছিদ্র পথ দিয়া রৌদ্রের সরু রেখা যখন বিছানায় আসিয়া পড়িয়াছে, তখনও রাত্রির সুষুপ্তির অবসান হয় নাই। কম্বলের উষ্ণতায় এক অনাবিল সুখানুভূতি। পাখ পাখালির কলকাকলি সবেমাত্র নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাইবার পাঁয়তারা করিতেছে। এমন সময় এপাশ ওপাশ করিতে করিতে বালকের নিদ্রা ভঙ্গ হইল। চক্ষু কচলাইতে কচলাইতে শয্যাপ্রান্ত হইতে নামিয়া বালক ভাবিতে লাগিল-- অন্য সকলের ছুটির দিনে, এই শুক্রবারে তাহাকে বিদ্যালয়ে যাইতে হইবে। পিতৃদেব তাহাকে কেন যে মিশন স্কুলে ভর্তি করাইয়াছিলেন তাহা ভাবিয়া তাহার বড়ই রাগ হইল। প্রস্তুতিপর্ব সমাপ্ত করিয়া বালক দেখিল তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও ভগ্নী তখনও ঘুমাইতেছে। একেতো শীতের মধ্যে স্কুলে যাইতে হইবে, তাহার উপর আবার কার্টুনটাও (Teenage Mutant Ninja Turtles ) দেখা হইবে না। বালকের চক্ষু ছলছল করিল, বুক ভারি হইয়া উঠিল।
বেশ কিছু সময় অতীত হইয়াছে। ঠিক কত সময় আজ তাহা আর স্মরণযোগ্য নহে। দূরদর্শন যন্ত্রের কল্যাণে ক্যাপ্টেন প্লানেট কার্টুন দেখিয়া বালকের মানসপটে নূতন স্বপ্নের উদয় হইয়াছে। যদি তাহার ঐ রকম পাঁচটি অঙ্গুরি (আংটি) থাকিত! পাঁচটি না হোক অন্ততঃ একটিও যদি থাকিত! সুযোগ পাইলেই সে আঙুলে অঙ্গুরি পরিয়া আর্থ, ফায়ার, উইন্ড, ওয়াটার, হার্ট শব্দ উচ্চারণ করিয়া পরীক্ষা চালাইতো। বলাবাহুল্য, কখনো কিছু ঘটিত না, সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইত।
নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাইতে কে না চাহে! পরিতাপের বিষয় হইল জীবন নির্ঝঞ্ঝাট নহে। এখানে যেমন সুখ আছে তেমনি দুঃখ আছে; আছে মিলন, আছে বিরহ; আরও রহিয়াছে কলহ। বালকের জীবনও ইহার ব্যতিক্রম নহে। বালক যদিও শান্তিপ্রিয় ছিল, তথাপি কালেভদ্রে সহপাঠীদিগের সহিত মনোমালিন্য, আড়ি লওয়া এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত হইয়া যাইত। একবার এক বলবান সহপাঠীর সহিত গায়ের জোরে না পারিয়া অন্যান্য সহপাঠীর নিকট আপন সম্মান যখন প্রায় ধূলিসাৎ হইতে বসিল, রাগে দুঃখে যখন মাথার চুল ছিড়িয়া ফেলিবার উপক্রম হইল, তখন সম্মান রক্ষার এক ক্ষীণ সম্ভাবনা মস্তিষ্কে উঁকি দিতে লাগিল। প্যপায় দ্যা সেইলরম্যান এর স্পিনাক পাইলে নচ্ছারটাকে উত্তমরূপে প্রহার করিয়া উচিত শিক্ষা দেওয়া যাইত। উহাকে পরবর্তিতে শায়েস্তা করিবার মানসে বালক কলহে নিবৃত্তি দিল। সেইদিন বাড়িতে ফিরিয়া বালক তন্ন তন্ন করিয়া সমস্ত কৌটা খুঁজিয়া দেখিল। জিরা, দারুচিনি, মরিচ গুড়া, হলুদ গুড়া, গরম মশলা, পাঁচ ফোড়ন প্রভৃতি পাওয়া গেল। স্পিনাক কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না।
টম এ্যান্ড জেরির জেরিকে তাহার ভালো লাগিতো। অবশ্য মাঝে মাঝে টমের দূরবস্থা দেখিয়া বেচারার জন্য যে কিঞ্চিৎ সহানুভূতি বোধ হইত না তাহা নহে।
নির্জন দুপুরের মৌনতা কেন যেন একাকীত্বের কথাকে বড় বেশি করিয়া স্মরণ করাইয়া দেয়। কখনো দুপুরে ঘুম ভাঙ্গিয়া গেলে সময় যখন কাটিতে চাহিত না তখন বালক দরজার কোণায় খুঁজিয়া খুঁজিয়া দেখিত। খুঁজিত ক্যাসপার দ্যা ফ্রেন্ডলি ঘোস্ট এর সেই নিঃসঙ্গ ভুতকে।
.............................................................................
আকাশে অনেক মেঘ করিয়াছে। পাণ্ডুর পৃথিবী মুহুর্মুহু বজ্রের গর্জনে মূর্ছা যাইতেছে। বাতাসের ঝাপটায় ভাঙা জানালার কপাট এপাশ ওপাশ করিতেছে। বৃষ্টির ফোঁটা আকাশের ক্রন্দন হইয়া অধঃ মুখে যাত্রা আরম্ভ করিয়াছে। ঝাপসা বর্ষণ মুখর দিনে বালক বড়ই আনমনা হইয়া পড়িয়াছে। বালকের স্মৃতির ক্যানভাসেও আজ ঝড় উঠিয়াছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১০ বিকাল ৪:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






