ঠিক কিভাবে লেখা শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। কারন ছাত্রলীগের এই মেধাবী সন্ত্রাসী সোনাগুলোর রাজনৈতিক জীবন এতটাই বৈচিত্রময় যে কোনটা রেখে কোনটা লিখব, তা বুঝে উঠাই মুশকিল। তবে শুরু যখন করেছি তখন এই লুইচ্চাগুলোর চরিত্র লিখে শেষ করবই। যা আছে কপালে। কাজের কথাই আসি।
প্রথম কথা হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি স্থায়ী না। এটা নির্ভর করে কোন দল ক্ষমতায় তার ওপর। যদি ক্ষমতায় আওয়ামীলীগ (BAL) থাকে, তবে ধরে নেন ছাত্রলীগ আছে। আর বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নির্বাচনের দিন হল থেকে সুড়সুড় করে নেমে যাবে। তাই ছাত্রলীগের হল পলিটিক্স এর প্রধান শর্ত হল, আওয়ামীলীগ (BAL) কে ক্ষমতায় থাকতে হবে।
আপনারা জানেন, দেশের অন্যান্য পাবলিক ইউনিভার্সিটির মত এখানেও তীব্র আবাসন সংকট রয়েছে। ফলে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা হলে একটা সিটের আশায় চাতক পাখির মত চেয়ে থাকে। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগায় ছাত্রলীগের হারামখোরগুলো। অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত পরিবারের হওয়ায় তারা বাধ্য হয় এই অবর্নণীয় কষ্ট মেনে নিতে।
এখানে হলে ওঠার প্রক্রিয়াটাও ভিন্ন। ইচ্ছা করলেই আপনি হলে উঠতে পারবেন না। হলে উঠানো বা হল থেকে নামানোর ক্ষেত্রে হল প্রশাসন এর কোন ভূমিকা নেই। সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা। যেন তারাই হলের প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর, দাড়োয়ান, গেটম্যান, টয়লেট ক্লিনার, মামা ইত্যাদি সব কিছু।
আপনি কি হলে উঠতে চান? তাহলে আসুন হলে উঠার নিয়মটা জেনে নিই।
প্রত্যেকটি হলে ছাত্রলীগের দুইটি গ্রুপ রয়েছে। একটি প্রেসিডেন্ট গ্রুপ অপরটি সেক্রেটারী গ্রুপ। প্রত্যেকটি গ্রুপেই কিছু নেতা, পাতি নেতা আর কিছু চেংরা পোলাপান আছে। উভয় গ্রুপের মধ্যে দা-কুমড়া, অহি-নকুল, সাপে-নেউলে সম্পর্ক। কেউ কাউকে দেখতে পারে না। আমি আগের লেখাতে বলেছি, এরা শিবির এবং ছাত্রদল এর চেয়ে নিজ দলের অন্য গ্রুপের নেতা-কর্মীকে পেটাতে বেশি মজা পায়। তাদের দৃষ্টিতে গ্রুপিং করলে নাকি দল এক্টিভ থাকে (ভুদাই তত্ত্ব)।
প্রত্যেক গ্রুপের সপ্তাহে দুই দিন (সাধারণত রাত ১০টায়) গেস্ট রুম হয় (যেমন জসীমউদ্দীন, জিয়া, অমর একুশে হল)। কোন কোন হল সপ্তাহে পাঁচ থেকে ছয় দিনও গেস্ট রুম করে (যেমন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, মহসিন হল, শহীদুল্লাহ হল)। এই প্রোগ্রামটা গেস্ট রুমে (অভ্যার্থনা কক্ষ) হয় বিধায় এর নামকরণ করা হয়ছে গেস্ট রুম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রই এই জঘন্য শব্দটির সাথে পরিচিত। সাধারণ ছাত্রদের কাছে গেস্ট রুম একটা আতংকের নাম। এর চেয়ে কবরের আযাব অনেক মজা। গেস্ট রুমের দিন ওই গ্রুপের সবাইকে যথাসময়ে গেস্ট রুমে আসতে হবে। না আসলে তল্পি-তল্পা সমেত হল থেকে নেমে যেতে হবে। তাই ঘড়ির কাটায় ১০টা বাজলেই পিপীলিকার মত কোন এক অজানা টানে সবাই জড়ো হতে শুরু করে।
আপনি হলে উঠতে চাইলে নির্দিষ্ট দিনে আপনাকে গেস্ট রুমে হাজির হতে হবে। যদি কোন বড় ভাইয়ের রেফারেন্স থাকে তবে কাজটি আপনার জন্য সহজ হবে। না থাকলেও চলবে। আপনাকে গেস্ট রুমে এসে পেছনের দিকে ভদ্রভাবে দাঁড়াতে হবে। চেয়ারে বসতে পারবেন না, বসলেই খবর আছে। ভয় পাবেন না, আপনাকে মারধোর করবে না, তবে নিকৃষ্ট ভাষায় অপমান করবে। প্রথম দিন বলে কথা।
গেস্ট রুমের শুরুতেই একটু খেয়াল করলে ছাত্রলীগের চরিত্র বুঝতে আপনার মোটেও কষ্ট হবে না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, সম্মান এর বালাইটুকু এদের মধ্যে নেই। সবাই নেতা সাজতে চায়। গেস্ট রুমে গালিগালাজ ছাড়া তেমন কিছু হয়না। মূলত গেস্ট রুমের মূল উদ্দেশ্য হল, জুনিয়রদের উপর ফাপর নেয়া। কে কত জুনিয়রকে গালি দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে গেস্ট রুমে। তবে একটু কথা আছে, যদি ক্যাম্পাসে কোন বড় প্রোগ্রাম থাকে যেমন সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল, আফার আগমন অথবা অন্য গ্রুপের সাথে মারামারির কোন এজেন্ডা, তবে সেই দিনের গেস্ট রুম বেশ গুরুত্ব বহন করে। গেস্ট রুম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরের পর্বে করব। আজ হলে উঠা নিয়েই কথা বলি, না কি?
গেস্ট রুম চলাকালীন এক পর্যায়ে নেতা গোছের কোন এক বড় ভাইয়ের (সম্ভবত সোফায় বসা মাঝের জন) মুখে বলতে শুনবেন, “এই কে কে হলে উঠতে চাস, সামনে আয়”। সাথে সাথে পাতি নেতাগুলো চেঁচিয়ে উঠবে, “এই তাড়াতাড়ি আয়, সামনে দাঁড়া”। বলে রাখা ভাল, আপনাকে ডাক দেবার সঙ্গে সঙ্গে সামনে চলে যেয়ে, “সাবধান” ভঙ্গিতে হাত পেছনে দিয়ে দাঁড়াতে হবে। ভয় পাবেন না। দেরি করলেই নগদে গালি শুনতে হবে। খেয়াল রাখবেন, সামনের সাড়িতে বসা সবাই আপনাকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করবে। তবে উত্তর দেবার ক্ষেত্রে নেতা গোছের লোকটাকে বেশি গুরুত্ব দিন। প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় দয়া করে কোন নেতার চোখের দিকে তাকাবেন না। এতে করে আপনার প্যান্টটি নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে। সাময়িকভাবে আপনার মনে হতে পারে আপনি হাশরের মাঠে উপস্থিত আছেন।
এরপর আপনার নাম, ডিপার্টমেন্ট, কোন জেলা থেকে এসেছেন, ব্যাকগ্রাউন্ড মাদ্রাসা নাকি কলেজ ইত্যাদি মৌলিক কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেসা করা হবে। তবে উত্তর দেবার ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। যেমন আপনার বাড়ি যদি পাবনা বা সাতক্ষীরা হয় তবে উত্তর দেবার ক্ষেত্রে এইসব জেলার নাম এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করুন। কারণ ছাত্রলীগের দৃষ্টিতে এইসব জেলার মানুষ থেকে পাখী পর্যন্ত সবাই নাকি জামায়াত শিবির করে। আবার ব্যাকগ্রাউন্ড মাদ্রাসা হলে তেমন প্রোবলেম হবে না। কিন্তু তামিরুল মিল্লাত হলে ঘাপলা হতে পারে। একটু সাবধান। ভয় পাবেন না। মারবে না তবে নগদে গালি খেতে হবে। আবার আপনি BBA, Economics, Law ইত্যাদি বিভাগের ছাত্র হলে আপনাকে প্রথমে হলে তুলতে চাইবে না। কেননা এইসব ডিপার্টমেন্ট এর ছাত্রদের ক্ষেত্রে পড়ালেখার চাপ একটু বেশি থাকে। তাই Politics এ সময় দিতে পারে কম। অবশ্য পরে হলে তুলে নেবে। So no tension.
যে সব প্রশ্ন করতে পারে তার একটি সংক্ষিপ্ত ধারণাঃ
১।কখনোও শিবির বা ছাত্রদল করেছেন কিনা? – উত্তরঃ ‘না’
২।কখনোও মিছিল বা Politics করেছেন কিনা? – উত্তরঃ ‘না’
৩।স্থানীয় দুই একজন ছাত্রলীগ নেতার নাম জানেন কিনা? – উত্তর না জানলে নির্ভয়ে বলুন ‘জানিনা’
৪।জীবনের লক্ষ্য কি? পড়ালেখা নাকি পলিটিক্স?- উত্তরে অবশ্যই পলিটিক্স বলতে হবে। এর পরে জাতির উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য আপনাকে শোনা লাগতে পারে।
লেখার শিরোনামে বলেছি এখানে আপনাকে প্রিলি এবং ভাইভা সর্বমোট দুইটা পরীক্ষা দিতে হবে। বুঝতে সমস্যা হচ্ছে তাইতো? আচ্ছা ঝাইরা কাশি।
প্রিলি পরীক্ষা হল, আপনি যে ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ সমর্থক, হাসিনা আফারে প্রাণের চাইতেও বেশি ভালবাসেন, বঙ্গবন্ধুর নামে দিন রাত যিকির করেন, জীবনে কোন দিন শিবির করেন নাই ইত্যাদির প্রমাণ স্বরুপ আপনার এলাকার স্থানীয় ছাত্রলীগ অথবা আওয়ামীলীগ নেতার সাক্ষর করা প্রত্যয়ন পত্র দাখিল করিতে হইবে। অন্যথায় হলে উঠিতে পারিবেন না। কারণ ইদানিং নাকি ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে শিবির আর ছাত্রদল ক্যাম্পাসে প্রবেশ করছে এবং ক্যাম্পাস কে অস্থিতিশীল করার পায়তারা করছে। যত সব ধান্দাবাজ, নিজের দল ঠেকানোর ক্ষেমতা নাই, যত দোষ নন্দ ঘোষ। এই হল লিখিত পরীক্ষা। আর ভাইভা’র কথা তো আগেই বলেছি।
ধরুণ আপনি সব পরীক্ষায় পাস করেছেন। এখন হলে উঠবেন। তবে এক্ষেত্রে আপনাকে বন্ড সই করার মত কিছু শর্ত মানতে হবে। যেমন, নিয়মিত মধুর ক্যান্টিনে যেয়ে বড় ভাইদের দো’য়া নিয়ে আসতে হবে (মধুর ক্যান্টিন কি এবং কেন যেতে হয়, তা অন্য পর্বে আলোচনা করব), যে কোন প্রোগ্রামে যাবার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হবে, নিজের নিরাপত্তার জন্য অন্তত একটি চাপাতি রুমে রাখতে হবে, বড় ভাইদের দেখলে সশ্রদ্ধা সালাম ও হ্যান্ডসেক করতে হবে (সালাম এবং হ্যান্ডসেক এর নির্দিষ্ট ধরণ অন্য পর্বে আলোচ্য), আফাকে ভালবাসতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। গেস্ট রুম শেষ হলে আপনাকে দল বেধে রাতে ক্যাম্পাসে শোডাউন দেয়া লাগতে পারে (হল থেকে TSC পর্যন্ত)। তাদের মতে, এতে নাকি দলে Unity বাড়ে। শোডাউনের সময় আগে আগে থাকার চেষ্টা করুন। এতে সহজেই বড় ভাইদের নজরে পরার সম্ভাবনা আছে। যা পরে আপনার কাজে লাগতে পারে।
এত কিছুর পরও আপনার ভাল একটা রুম (সিঙ্গেল/ডাবল) পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। আল্লাহর উপর ভরসা করে আপনাকে গণরুমে উঠতে হবে। গণরুম হল, যে রুমে কমপক্ষে ১২ জন থেকে ২০ জন বাস করে। তবে এই সংখ্যা হল ভেদে বিভিন্ন হতে পারে। যেমন সর্বোচ্চ ৪০-৪৫ জন। আবার কপাল বেশি খারাপ হলে বারান্দাতেও ঠাঁই হতে পারে। যেমন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বারান্দা এজন্য খুব বিখ্যাত। একটা ঘটনা বলি, আমার এক বন্ধু যে দিন সলিমুল্লাহ হলের বারান্দা থেকে রুম পেয়েছিল সেদিন আমাদের কয়েকজনকে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিল। আমি যে গণরুমে উঠেছিলাম তাতে আমি সহ মোট ১৮ জন ছিল। বড় ভাইদের দৃষ্টিতে আমি নাকি সৌভাগ্যবান। হলে উঠার পূর্বে ছাড়পোকার কামড় খাওয়ার অভ্যাসটা করে নিলে ভাল হয়। যাই হোক কেউ কেউ গণরুম কে গণভবন বলেও ডাকে। গণরুম ছেড়ে কবে ভাল একটা রুম পাবেন, এটা নির্ভর করবে আপনার Political Performance এর উপরে। এজন্য কয়েকটা তেল মারা পদ্ধতি আপনাকে কাজে লাগাতে হবে। যেমন, মাঝের মধ্যে রাতে সময় পেলে নেতাদের রুমে যান, এতে সে বুঝবে আপনি তার অনুগত। আবার মাঝে মাঝে মোবাইলে টাকা পাঠাতে পারেন। যদিও এটি ব্য্যবহুল, তবে দ্রুত কাজে দেই। কিছু গিফট দিলে তো কথায় নেই, সে সবার আগে আপনাকে রুম দেবার চেষ্টা করবে। তবে এই তেলবাজি একটু সাবধানে করতে হবে। কেননা অন্যসব নেতারা বুঝে ফেললে আপনি টার্গেটে পরে যেতে পারেন। তবে মোটকথা হল, যতই চেষ্টা করেন এক বছরের আগে রুম পাওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে বলে আমার মনে হয় না। যদিও অনেক বড় ভাই ৮-১০ বছর ধরে একা একটা রুম দখল করে বসে আছে। আমার অবশ্য সময় লেগেছিল প্রায় ১৩ মাস।
যাই হোক এই মোটামুটি আপনার হলে উঠার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটীলতা। এই পরামর্শগুলি মেনে চললে আশা করা যাই কোন ঝামেলা ছাড়াই হলে উঠার এক দুর্লভ সুযোগ আপনার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তবুও পাগলা কুত্তা আর ছাত্রলীগ থেকে একটু সাবধান। কেননা ছাত্রলীগ পারে না এমন কোন কাজ স্বয়ং আইনেস্টাইনও আবিস্কার করতে পারেনি। হলে উঠার পর আপনার কাজ কি হবে তা নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করব। যদি আপনারা সঙ্গে থাকেন। অবশ্যই পরামর্শ দিবেন। আর চোখ রাখুন পরের পর্বে।
“ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, ছাত্রলীগ থেকে দূরে থাকুন”
[বি.দ্র. সারাদেশে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আপনাদের ছোট ভাই-বোন এবছর ভর্তি হলে তাদের সাথে লেখাটি শেয়ার করুন। আশা করা যায় তারা উপকৃত হবে।]
পরবর্তী পোস্টঃ ১১ জানুয়ারি, রাতঃ ৮টা

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




