সকাল বেলা স্নান করা তারানাথের অনেক দিনের অভ্যাস । সেই ছোটবেলা থেকে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে সকাল বেলা পুজো দেওয়ার আগে স্নান সেরে আসে । সূর্য দেবতাকে পুজো দেবার পর সে বাদবাকি কাজ করে । স্নান করার সময় সে এমনভাবে আসেপাশে তাকায় যেন মনে হয় চারিদিকে ময়লা আর্বজনা সব নোংরা,সে তার গায়ের চামরা এমনভাবে ঘষে যেন মনে হয়,তার সব চামরা তুলে নতুন চামরা লাগাতে পারলে সে খুশি হত । আশেপাশের কাউকে তার মানুষই মনে হয় না।সে জাতে ব্রাক্ষন । নিচু জাতের লোক হলে এমনভাবে তাদের দিকে তাকায় যেন তারা ড্রেন থেকে এসেছে । আর অন্য ধর্মের হলে তো কথাই নেই ,তাদের ছুঁলে জাত যাবে । সকালবেলা নদীর শান্ত জল ,হিমেল হাওয়া তারানাথের মনটা ভালো করে দেয় ।তারানাথের আজ পুজার জন্য ডাক এসেছে । যেতে হবে পাশের গ্রামের হিরালাল এর বাড়িতে।তারানাথ অবশ্যি না করে ছিল প্রথমে । তার একটা কারন ও আছে । হিরালালের পারিবারিক অবস্থা বেশি ভাল না । পুজা শেষে বেশি সম্মানিও পাওয়া যাবেনা । তারানাথ আশা করেছিল হয়ত আরো ভালো কোন প্রস্তাব আসবে । কিন্তু আর অন্য কোন পুজার নিমন্ত্রন না আসার কারনে শেষ মেশ নিরুপায় হয়ে সে রাজি হইল । তারানাথ মাঝে মাঝে চিন্তা করে আগে থেকে দামাদামি করে সম্মানির টাকাটা ঠিক করে রাখতে পারলে ভাল হতো । কিন্তু না এই রকম নিয়ম শাশ্ত্রে নেই । তাই তার শাশ্ত্রের উপর রাগ হইলেও মুখে সে কখনোই তা প্রকাশ করত না । তারানাথ অবশ্যি শাশ্ত্রকে মাঝে মাঝে নিজের কাজেও ব্যবহার করে । সে অবশ্য এটাকে অপব্যবহার হিসেবে ভাবে না । সে এটা তার অধিকার মনে করে।হাজার হোক সে জাতে ব্রাক্মন । এটা তার প্রাপ্য । তারানাথের নাক ডাকার বড় অভ্যাস। সে এমনভাবে নাক ডাকে মনে হবে কেউ তাকে জবাই করছে,মনে হয় ঘরবাড়ি ভেংগে তার ঘরে পরেছে। এটা নিয়ে তার প্রথম প্রথম বৌ এর সাথে চরম ঝগড়া হত। ঝগড়া নিরসন করার জন্য তারানাথ একটা ফন্দি বের করে। সে তার বৌকে বোঝায় যে শাশ্ত্রে যে সব মহামুনির নাম বলা আছে তারা সবাই নাক ডাকত ।এটা এক ধরনের সাধনা । শ্বাস প্রশ্বাস নেবার সময় হরি নাম জপ করা। এটা কি যে সে কর্ম। সবাই পারে না। কেউ যদি নাক ডাকে আবার নিজে বুঝতে না পারে তবে তা সাধনা নয়। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
তারানাথের বউ বদমেজাজী হলেও তারানাথের এই সব ভুজুং ভাজুং কথার অর্থ বোঝে না, বোঝার চেষ্টা ও করে না। সত্যি বলতে কি যদি ও সে তারানাথকে সারাদিন ডাটের উপর রাখে কিন্তু সে তারানাথকে ভয় ও পায়। সে ঘটনা অবশ্য অন্য একদিন বলা যাবে।
ঘটি জল নিয়ে তারানাথ বাড়ি এসে ভেজা কাপর ছেড়ে নতুন ভাজ দেয়া ধূতি পরল। কপালে চন্দনের ফুটা দিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে সে তার ছেলেকে ডাক দিল। তার ছেলের নাম হরিনাথ। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবল... বা বা ছেলেটি একেবারে আমার মত হয়েছে। চুল, নাক , কান সব আমার মত। ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল “বাবা বাইরে বেশি ঘুড়াঘুড়ি করো না, চারিদিকে পানি,সাতার ভালো করে শিখা হলে কোন চিন্তা নাই”। ছেলেটি ও মাথা নেড়ে সায় দেয়। তারপর তারানাথ তার পুজার উপকরন নিয়ে হিরালাল এর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। রাস্তায় অনেকের সাথেই তার দেখা হল। কেউ কেউ তাকে প্রনাম করল,কেউ কেউ রাস্তা ছেড়ে দিল, কেউ বা নাক বরাবর হেটে গেল। কেউ তারানাথকে প্রনাম না দিলে তার অনেক অপমানিত বোধ হয়। তারানাথ তখন ভাবে আজকাল মানুষ কেমন আদব কায়দা ভুলে যাচ্ছে। তবে বেশি রেগে গেলে তারানাথ অবশ্য ভাবে “সব কয়টাকে মা কালির মন্দিরে নিয়ে বলি দেবার দরকার, কালি মায়ের ও মানুষের রক্ত পান করা হল, আর আমার ও খায়েশ মিটল”।
এইসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে তারানাথ বাজারে ঘাটে এসে উপস্থিত হল। আহা নদীতে কি বান ডেকেছে, কি স্রোত। নদী পার হলে ঐ পাড়ে হিরালাল এর বাড়ি। নদীতে ডিংগী নৌকা চলে। ঢেউ এর তালে তালে নৌকা দুলে কিন্তু কখনো ডুবে যায় না। নদীর পারে কিছু ধান বোঝাই বড় নৌকা বাধা আছে। কিছু নগ্ন কিশোরের দল ঐ নৌকার মাচা থেকে পানিতে লাফালাফি করছে। তারানাথ ভাবল “সব কয়টা শেখ(মুসলমান) এর ছেলেমেয়ে সব কয়টা সাক্ষাৎ অসুর, কি বেয়াদব, কোন কাজকাম নাই, পড়াশুনা নাই, সারাদিন সয়তানি করে। আর আমাদের ছেলেমেয়েরা কি ভদ্র, মানুষের মত মানুষ হবে”।
তারানাথ আবার ঐ দিকে তাকিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে কি কি যেন বলল এবং একচিলতে বাকা হাসি তার দাড়িগোফ ভেদ করে ফুটে উঠল। আচমকা তার বড় সুখ সুখ লাগতে লাগল।
নদী পাড় হয়ে আরো কিছু দূর হেটে তারানাথ হিরালালের র্জীন আধাপাকা বাড়িতে গিয়ে উঠল। সে বাড়ির চারপাশে তাকাল। সে মনে মনে যা ভেবেছেল হিরালালের দৈনদশা তার চেয়েও বেশি। আবারো তার সম্মানির টাকার কথা মনে পরল। হিরালাল অত্যন্ত আদর যন্তের সাথে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। তারানাথ তাদের সাথে হাল্কা কিছু কথা বলে পুজার প্রস্তুতি শুরু করে দিল, এবং চেহারার মাঝে এমন ভাব ফুটিয়ে তুলল যাতে মনে হয় তার সময়ের অনেক দাম। তার সময় উকিল কিংবা ডাক্তার এর মত পয়সা প্রসব করে। পুজা শেষ করে তারানাথ শাস্ত্র থেকে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এর জীবন দর্শন সর্ম্পকে আলোচনা করল। সবাই কে সাধারন অনারম্বর জীবন যাপন করার জন্য উপদেশ দিল। টাকা পয়সা কম হলে কি কি লাভ আর বেশি হলে কি কি ক্ষতি তা নিয়ে কথা বলল। হিরালালের বাড়ির সবাই বলতে লাগল “আহা কি মহান, গুরূজির জয় হোক”। লেকচার দেয়া শেষ হলে তারনাথকে তারা যথা সম্ভব খাওয়াল, ভোজন পর্ব শেষ হলে হিরালাল তারানাথের সামনে এসে ইতস্তত করতে বলল “ গুরুজি আপনি সত্যি মহান, জানি আপনার কাছে পৃথিবীর ধন সম্পদ অর্থহীন।” তারানাথ এই শুনে বিজ্ঞের বিমর্ষ মুখে মাথা নাড়ল।
হিরালাল বলল “অপরাধ না নিয়ে এই সম্মানিটুকু নিয়ে এই অধমকে মার্জনা করুন।” বলে সে তারানাথের হাতে কয়টা টাকা গুজে দিল। এই কয়েকটা টাকা দেখে সে অত্যান্ত রাগান্নিত ও বিমর্ষ হল। মনে মনে ভাবলো “না এত দেখি খুবি ছোটলোক। এই কয়টা টাকা তো মানুষ ফকির কে ভিক্ষাও দেয়না ”। তবে সে মুখে কিছুই বলতে পারল না। কারন একটু আগে সে ধন সম্পত্তি নিয়ে একটা বিরাট ভাষন দিয়েছে। রাগে গজগজ করতে করতে সে হিরালালের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসল। তখন তার চোখের সামনের সব কিছুই অসহ্য মনে হতে লাগল।
“না সারাটা দিন মাটি” মনে মনে ভাবল সে। নদী পার হবার সময় আবারো সেই কিশোরদের দেখা গেল। তারানাথের আরো অসহ্য লাগতে লাগল। হটাৎ নৌকার একপাশ থেকে একটি ছোট ছেলেকে পরে যেতে দেখল সে। প্রথমে ভাবল ইচ্ছা করেই লাফালাফি করছে, কিন্তু না ক্ষানিক সময় পরেও ছেলেটিকে মাথা তুলতে দেখা গেল না। তারানাথ বুঝল ছেলেটা সাতার জানে না। কিন্তু সে কাউকে কিছু বলল না এই ব্যাপারে। মনে মনে সে ভাবল ডুবুক মরুক সব গুলা অসুরের দল। তার আরো মনে পরল এইতো কিছু দিন আগে
কয়েকটা ছেলেমেয়ে মিলে তার আম গাছের সব আম সাবার করে দিয়েছিল। ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে তারানাথ তার বাড়িতে গেল। সারাদিনের ক্লান্তিতে তার চোখে ঘুম নেমে আসল। সে দাওয়াই খানায় একটা জম্পেশ ঘুম দিল। সন্ধ্যার একটু আগে তার বৌ তাকে ডাকাডাকি করে তুলল। ঘুম থেকে উঠে সে তার বৌ এর উপর রেগে গেল।
কিন্তু তার বৌ বলল “হরিনাথ কে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না”।
তারানাথ বলল “আরে আশেপাশে আছে কোথাও, খুজে দেখ, যাবে আর কোথায়।”
তার বৌ বলল “দেখেছি, কিন্তু কোথাও নেই, দুপুর বেলায় খেতেও আসেনি”।
এই কথা শুনার পর তারানাথের মনে উথাল পাথাল হাওয়া বইতে শুরু করলো, তার মনের আকাশে নানা রকম সন্দেহের রোদ উকি দিতে লাগল। তবু সে নানা রকম মন্ত্র আওরাতে লাগল এবং মনকে বোঝাতে লাগল।
ধিরে ধিরে সূর্য ঘুমালো। আধার তার ডালপালা মেলতে শুরু করল। তারানাথের মনেও আধার ঘনাতে শুরু করল। তার বৌ কেদেকেটে অস্থির হয়ে উঠল। তারানাথ পাড়াতে খুজতে বের হল। সবাই কে জিজ্ঞাসা করল কেউ হরিনাথ কে দেখেছে কি না। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারল না।
সারারাত তারানাথের ঘুম হলনা। সে মনে মনে ইশ্বর কে নানা কছু দেবার প্রলভন দেখা, যাতে হরিনাথ ফিরে আসে এবং তার যেন কন বিপদ না হয়। কিন্তু তার এই প্রলভন কতটুক কাজে লাগল বোঝা গেল না।
সকাল বেলা পাশের বাড়ির গোপি তারানাথকে এসে খবর দিল রাতে জেলেদের জালে নাকি একটা শিশুর মৃতদেহ উঠে এসেছে। শুনে তারানাথের কলিজা ফাটার উপক্রম হল। সে দিকবিদিকের মত চারদিকে তাকাতে লাগল যেন আশেপাশে মহাশূন্য। জেলেরা খবর পেয়ে মৃত হরিনাথকে তার বাড়িতে নিয়ে আসল। তারানাথের বৌ বারবার মুর্ছা গেল। চারদিকে আকাশ বাতাস শোকে ভারি হয়ে উঠল। এই দুখিনী মাকে সান্তনা দেবার কারো কোন ভাষা থাকল না।
শুধুমাত্র একটি প্রানী উঠোনের এক কোনায় জড়সর হয়ে বসে রইল, সে প্রাণীটি তারানাথ, তার চোখে অশ্রু নেই।
হটাৎ সে আস্তে আস্তে হেটে তার ছেলের কাছে গেল। তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে উঠল “ হে ভগবান আমার পাপের শাস্তি আমার ছেলেকে কেনো দিলে ?”
আশেপাশের কেউ কিছু বুঝতে পারল কি না বোঝা গেল না ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




