somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ চলো পালাই

০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নিস্পন্দ বাতাসে নিঃসঙ্গ পাখির পালক গোধুলীর প্রারম্ভে সবুজ ঘাসে গা ভাসায় একাকী। বিস্তৃর্ণ মাঠে সাদা-কালো ফুটবলটায় পায়ের কেরামতি প্রদর্শন করে রুমে ফিরে সবাই, রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে। শুধু ফিরেনা সে। ইদানিং মন খারাপের রং মেখে আকাশের বুকে কালো মেঘের বিচরণ অবলোকন করা তাঁর জীবন রুটিনে যুক্ত হয়েছে নতুন ভাবে।

সেই বাড়ি থেকে ভার্সিটির হল-এ আসার পর থেকেই মনের মধ্যে নীরব যন্ত্রনা বাসা বেঁধেছে। ভ্রমর যেভাবে হুল ফোটায়, সেভাবেই কষ্টের হুল ফোটেছে তাঁর নরম হৃদয়ে। স্যারের লেকচারে মন নেই, রাতের তাস খেলায় বিবির চেহারা ঝাঁপসা লাগে, মনযোগ নেই সহপাঠীদের জমানো আড্ডায়। সারাদিন এদিক-ওদিক, কাজে-অকাজে ছোটাছুটির পর রাতের প্রথম প্রহরে রুমে ফিরে কটমটে দুর্দশাগ্রস্ত তোষকের তলায় ছাড়পোকার আস্তানা আর টেবিলের উপর ধুলি মাখা বইয়ের ফাঁক-ফোঁকরে চোখ বুলায় রূপম। হৃদয় ছিড়ে নিরাশার বাতাস ঢেলে দিয়ে রুমের বড় ভাইকে বলে- ভাই, আজও কোন চিঠি আসেনি ! না, কোনো চিঠি আসেনি। রূপম জানে, কোনো চিঠি আসবে না আর। তবুও তো মনের মধ্যে কিছু আশা-প্রত্যাশা রয়ে যায়। তলানি বলে একটা কথা আছে না! যেখানটায় এক বিন্দু আশা লেপ্টে থাকে পৃষ্টটানের সুত্র মেনে।

ভোর ছ’টা বাজার পনের মিনিট আগেই ঘুম ভাঙ্গে রূপমের। আজ থেকে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু, তাই এই সাতসকালে উঠা। মাথা উকি দেওয়া সোনালী সূর্যের এমন রূপ-লাবন্য খুব একটা দেখা হয়না তাঁর। পড়ার টেবিলে বসে আনমনে শিশির বিন্দুর সাথে সূর্যের প্রেমালিঙ্গন লক্ষ্য করছে সে। সুঁই যেভাবে কাপড়ে মাথা গুঁজে পরক্ষণেই উকি দেয়, সেভাবেই মনে পড়ে বীথির কথা।


মোটা ফ্রেমের চশমাওয়ালা লোকটিকে তাঁর রুমের দিকে আসতে দেখেই চেয়ার থেকে হুড়মোড় করে উঠে দাঁড়াল রূপম। দরজা খুলে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকে লোকটির প্রতীক্ষায়। আগন্তুক দরজায় এসে বলে- আপনার একটা চিঠি আছে রূপম ভাই।

হ্যাঁ, এটা বিথীর চিঠি। দু’পাতায় চার পৃষ্ঠার চিঠির গায়ে বিথীর কোমল হাতের পরশ লেগে আছে। নরম রোদের সোনালী আভা চিঠির গায়ে চকচক করছে যেন। বিথীর সাথে সামান্য বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি, কিছু ভূল বুঝাবুঝির এমন পরিনতি! কল্পনাও করেনি রূপম। তবে এটা ঠিক, বাস্তবতা কখনো কল্পনাকে হার মানায়। এটা কী বিথীর শেষ সিদ্ধান্তু, চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত ? তাহলে কি আশার শেষ বিন্দু বলে কিছু থাকবে না ? চোখের কোনে অজান্তেই ঠান্ডা-শীতল জলের বিন্দু বাসা বাঁধে তাঁর।

টেবিলে রাখা টিকটিক করা ঘড়িটার দিখে তাকিয়ে দেখে দশটা বাজার কয়েক মিনিট বাকি। রূপম তাঁর অশান্ত মনকে জানিয়ে দেয়, বাড়ি যেতে হবে। এগারোটার ট্রেন। আর প্রায় এক ঘন্টা হাতে আছে। রুমের ঘুমন্ত বড় ভাইকে ধাক্কা দিয়ে বলে- ভাই বাড়ি যাবো, কিছু টাকা দেন। কিরে, তোর না আজ পরীক্ষা! রাখেন ভাই পরীক্ষা, জীবনের পরীক্ষায় ফেল মারছি আমি!


আজ ট্রেনে যাত্রীরা গিজগিজ করছে। যাত্রী পরিপূর্ণ ট্রেনটি আজ অজগরের মতো হেলেদুলে এগুচ্ছে। দরজায় দাঁড়িয়ে রূপম কাঁপাকাঁপা হাতে পকেট থেকে ভাঁজ করা চিঠিটা বের করে। আগে মায়ের লিখা চিঠিগুলো এভাবে যত্ন নিয়ে পড়তো সে। একটা চিঠি কয়েকবার পড়তে হতো। মা লিখতেন- কেমন আছিস বাবা, কবে বাড়ি ফিরবি, খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করিসতো ? এরকম হাজারো প্রশ্ন থাকতো চিঠির গায়ে।

প্রিয় রূপম,
তোমার-আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার কথা মনে পড়ে ? সেই প্রাইমারি স্কুলের দিনগুলোর কথা। আমি যখন থ্রী’তে পড়ি তুমি তখন ফাইবে। সে বার কী হলো, আমাদের স্কুল আর বিবিয়ানা স্কুলের মধ্যে ফুটবল খেলার প্রতিযোগীতা। স্কুলে তখন উৎসবের আমেজ। খেলায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের স্কুলের তোমাদের টিম বিবিয়ানা স্কুলের কাছে হেরে যায়। সবাই তখন তোমাকে দোষারোপ করে। বলে- তোমার দোষেই নাকি গোল খেয়েছে আমাদের স্কুল। আমার তখন কী যে কান্না ! কী যে লজ্জা! এ কীসের কান্না রূপম? কেনো এতো লজ্জা পাচ্ছিলাম আমি ?

সেই শীতের বিকেল। আমি এসএসসি পাশ করি আর তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে। তোমাদের বাড়ির পাশে সরিষা ফুলের চিকন পাড় দিয়ে বান্ধবীর সাথে হাটছিলাম। হলুদ রং আমার এতটা ভালো না লাগলেও নিরীহ সরিষা ফুলগুলো আমাকে খুবই টানে। গোধুলী বেলার বিদায়ী সূর্যটা সেদিন হলুদ ফুলগুলোর পাপড়িতে যেন যৌবনের সুধা ঢেলে দিয়েছিল। আমি যখন সরিষা ফুলের সৌন্দর্য্য অবাদে গিলছিলাম তখন তোমার উপস্থিতি আমাকে কিছু সময়ের জন্য ফুলের সৌরভ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। গ্রামের কোনো ছেলে পাঞ্জাবী পরে বিকেলের মিষ্টি বাতাস গায়ে মাখবে, তা ভাবিনি। সত্যি বলতে কি, তোমার এই দর্শনেই আমি হোঁচট খেয়েছিলাম। আমার হৃদয়ের রন্দ্রে রন্দ্রে কেমন যেন শীতল বাতাস ছোঁয়া দিয়ে গেল। আমার মনে তখনই প্রেম জাগে। হৃদয় ভাঙ্গার আওয়াজ শুনতে পাই আমি।


জানো রূপম, সে রাতে আমার চোখের পলক আর এক হয়নি! পরের দিন সকাল বেলা তুমি আমার হাত ধরে বুক সোজা করে অথচ ভীরু সুরে বললে- ভালবাসি তোমাকে। আমার তখন কী অনুভুতি হয়েছিল জানো ? খুব কান্না পাচ্ছিল আমার। বরফের মতো তিলেতিলে গলে আমি তোমাতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।


চিঠির এ পর্যন্ত পড়ে থমকে গেল রূপম। আসলেই তো, সেদিন বিকেলে বীথিকে দেখে মনে হয়েছিল এই মাত্র কোন শ্বেত-শুভ্র বক পাখি সরিষা বাগানে আশ্রয় নিয়েছে। হলুদ ফুলের দ্যূতি বিথীর চোখ-মুখের লাবন্য দ্বিগুণ করেছিল। সেদিনই যে বীথি'র সাথে রূপমের প্রথম কথা, প্রথম চোখের ভাষা আদান-প্রদান হয়েছে, তা নয়। তবে অন্যদিনের চেয়ে একটু অন্যরকম। রূপমের মনেপড়ে, সেই রাতে বিছানায় এপিট-ওপিট ছাড়া কিছুই করার ছিল না তাঁর।


রূপম, তুমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাও আমি তখন অসুস্থ মায়ের সেবা দিতে রান্না ঘরের হাল ধরার সুযোগ পাই। তুমি যখন পড়ার টেবিলে বসে নিউটনের প্রথম সুত্র আর দ্বিতীয় সূত্র নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ আমি তখন মাছের ঝুল কম না বেশী হবে, লবন আরো লাগবে কিনা, সে চিন্তায় ব্যস্ত। আমার আর কলেজে যাওয়া হয়নি। ট্রেনের মতো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছে যাই আমি। আমার পড়াশুনা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে তোমাকে পাওয়ার আশা কমতে থাকে। তবে তোমার বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষায় থাকতাম প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ।


রূপম, শেষবার যখন তুমি বাড়ি এলে, তখন তোমার পরিবর্তন আমাকে বুঝিয়ে দিল তুমি কীভাবে স্রোতে ভাসা কচুরিপানার মতো নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছ। মা ঠিকই বলেছেন। বলেছেন, পুরুষরা নাকি দূরে গেলে পাথর হয়ে যায়, হাজার বছরের পুরানো পাথর। পাথরের গায়ে শেওলা হয়ে বেঁচে থেকে লাভ কি বলো ? তাছাড়া তুমিতো বলেই দিয়েছো তোমার মা-বাবা আমাকে মেনে নিবেন না। সুতরাং ছেলে হিসেবে তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া উচিত তোমার। থাকনা পড়ে আমাদের ভালবাসা।

তাই, আমার মা-বাবার অভিমতেই আমি বিয়ে করছি আমার মতোই সাধারণ এক ছেলেকে। আগামী ২২ শে শ্রাবন আমার বিয়ে। আমাদের জন্য আশীর্বাদ করো রূপম।
ভালো থেকো তুমি।
বীথি


চিঠিটা ভাঁজ করে আবার পকেটে রেখে দেয় সে। গত কয়েক বছরে বীথির সাথে জড়ানো স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে এখন, ঠিক এই মুহুর্তে। ট্রেনের প্রতিটি মানুষের মুখের দিকে তাকায় রূপম। আহারে, সবাই কতো না সুখে আছে। রাস্তার দুপাশের গাছগুলো তাঁর কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। একে একে পালিয়ে যাবে সবাই। ট্রেনের ফেরিওয়ালা দাঁত ভেংচি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে আজ। ট্রেনের মধ্যে সে যেন এক অন্য প্রজাতির, অন্য গোত্রের।

রূপম শক্ত করে পা ফেলে ফ্লাটফর্মে। পাষাণ ট্রেনটি যাবার বেলা দুরন্ত বেগে একপ্রস্ত ধুলোর স্তর মেখে দেয় রূপমের চোখে-মুখে। দু’হাতে মুখ মুছে সে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে। কাল বীথির বিয়ে, মনে পরতেই শিহরনে শরীরে লেগে থাকা ধুলিকণা ঝরে পরে মাটিতে। মনের মাঝে এক অজানা শক্তি উকি মারে তাঁর।

আজ রাতের আকাশে পূর্নিমার চাঁদ। শিশির মাখা সবুজ পিচ্ছিল দূর্বা ঘাস মাড়িয়ে বীথি হাঁটছে রূপমের নির্ভরতার হাত ধরে। রূপম বলে- একটু খেয়াল করে পা ফেলো তো। তাঁর বন্ধুরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। শহরে যাওয়ার জন্য প্রথম গাড়িটাই ধরতে হবে তাদের। হাতে আর সময় নেই। একটু পরই নতুন সূর্য উঠবে। নতুন করে স্বপ্ন দেখবে তারা। রুপম বিথীর কানের কাছে মুখ রেখে বলে- তোমার জন্য আমার পরীক্ষাটা মিস হয়েছে ! ধুর, রাখতো তোমার পরীক্ষা! আগে চলো পালাই।



সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:৩৩
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×