পবন সরকার
যার অভিনয় দেখে হাসি ঠাট্টাসহ অনেকের অবহেলা, অবজ্ঞা, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ, অশ্রদ্ধার অন্ত নেই সেই হিরো এখন বাংলাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বলিউড পর্যন্ত পৌঁছেছেন। কোটরগত চোখ আর ভাঙাচুড়া মুখোবয়বের ছোটখাটো লিকলিকে হ্যাংলা পাতলা কালোকুলো চেহারা নিয়ে সারা পৃথিবীতে যিনি আজ পরিচিত তিনি হলেন হিরো আলম। সিনেমার নায়ক হতে গেলে সুন্দর চেহারা, ভালো কন্ঠ, ভালো শিক্ষা এবং ভালো অভিনয় করার সক্ষমতা থাকতে হয়। এসব কিছুই নেই হিরো আলমের অথচ সে এখন পৃথিবীতে হিরো হিসাবে পরিচিত। অভাবের কারণে গ্রামে গ্রামে যে ছেলেটি চানাচুর, আচার বিক্রি করতো সেই ছেলে শুধু নিজের ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বজুড়ে পরিচিত মুখ। বর্তমানে তিনি আরো আলোচনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছেন রাজনীতিতে এসে। জাতীয় পার্টি থেকে এমপি হওয়ার জন্য ফরম কিনে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। আমরা অনেকেই তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে থাকি। কিন্তু তার আজকের অবস্থান দেখে মনে হয় তিনি একটি মডেল হিসাবেই বিশ্বে বিবেচিত হবেন। শুধু ইচ্ছা শক্তি সাহস আর পরিশ্রমের মাধ্যমে একটি লোক জিরো থেকে হিরো হতে পারে সে উদাহারণ বিশ্বে খুব কমই আছে। যদিও এমপি ইলেকশনের প্রার্থী হিসাবে হিরো আলম ফরম কিনে বিশ্ব জুড়ে আলোচানায় এসেছেন কিন্তু অতীতের কষ্টের জীবন দেখলে অনেকের বিবেকে নাড়া দিবে।
হিরো আলম বগুড়া জেলার এরুলিয়া ইউনিয়নের এরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার জন্মটাই খুব দরিদ্র পরিবারে। অভাব সংসারে টেনেটুনে যখন ক্লাস সেভেনে উঠেছেন তখনই তার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্দশা। বাবা কাউকে কিছু না জানিয়েই হঠাৎ আরেকটি বিয়ে করে রাতের বেলা বউ নিয়ে হাজির হন। অভাব সংসারে দ্বিতীয় বিয়ে করায় প্রতিবাদ করেন হিরো আলমের মা। প্রতিবাদে তুমুল ঝগড়া লেগে যায়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে হিরো আলমের বাবা হিরো আলমের মাকে শারীরিকভাবে অকথ্য নির্যাতন করতে শুরু করেন। মায়ের উপর শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে হিরো আলম এর প্রতিবাদ করেন। শারীরিক নির্যাতনের হাত থেকে মাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে যান। হিরো আলম অল্প বয়সের ছোটখাটো মানুষ। মাকে রক্ষা করতে গিয়ে রক্ষা তো করতেই পারেন নাই উল্টো আরো বাপের হাতে মার খান। শুধু মার দিয়েই ক্ষান্ত হন নাই একটা পর্যায়ে হিরো আলমের বাবা তার মাকেসহ হিরো আলমকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। যখন তাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তখন রাত প্রায় তিনটা। আকাশ ভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টির ভিতরেই তাদেরকে বাড়ি থেকে লাঠিপেটা করে বের করে দেয়। বাপের অমানুষিক অত্যাচারে কুলাতে না পেরে বৃষ্টির মধ্যেই তারা পাশের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেই বাড়ির বারান্দায় ভিজা কাপড়চোপরে মা বেটা দুইজন সারা রাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটায়। ভোর হলে বাবার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করে কিন্তু হিরো আলমের বাবা তাদেরকে বাড়িতে ঢুকতেই দেয় না আবার মেরে তাড়িয়ে দেয়। বাড়িতে ঢুকতে না দেয়ায় মাকে নিয়ে হিরো আলম বিপদে পড়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে অন্যবাড়িতে গিয়ে থাকার জন্য একটি ঘর ভাড়া করে। কয়েক দিন ভাড়ার ঘরে থাকলেও টাকা পয়সা না থাকায় সেখানেও থাকা সম্ভব হয় না। অবশেষে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে মাকে নিয়ে নানীর বাড়ি রওনা হন।
নানীর বাড়িটি ছিল গ্রামে। গ্রামের জমির আইল পথ দিয়েই হেঁটে যেতে হয়। মা বেটা দুইজন জমির আইল পথ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলেন। এই সময় বিধাতা তাদের অসহায় অবস্থা থেকে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে দেয়। হঠাৎ করেই হিরো আলমের মা জমির আইলের উপর একটি কানের দুল কুড়িয়ে পায়। কুড়িয়ে পাওয়া কানের দুলটি ছিল স্বর্ণের। সেই দুলটি মাত্র আট শত টাকায় বিক্রি করে হিরো আলম আঁচার আর চানাচুরের ব্যবসা শুরু করেন। মা বাসায় বসে আঁচার চানাচুর বানায় আর হিরো আলম গ্রামে গ্রামে সেই আঁচার চানাচুর ফেরি করে সারাদিন বিক্রি করে। এভাবেই তাদের দিন কাটতে ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে নানীর বাড়িতেও তাদের বেশিদিন থাকা সম্ভব হয় না। একটা পর্যায়ে নানীর বাড়ি ছেড়ে আবার ভাড়া বাসায় উঠেন। ভাড়া বাসায় থেকেই হিরো আলম সারাদিন চানাচুর বিক্রি করেন আর বিকাল হলে স্থানীয় বাজারে একটি ভিসিডির দোকানে বসে সময় কাটান। চানাচুরের দোকান করার সময় তার জীবনে আরেকটি ঘটনা ঘটে। তাদের পাশের গ্রামেই একজন ছিলেন সন্তানহীনা। এই লোকটি তার অসহায় অবস্থা দেখে তাকে দত্তক নেন। কিন্তু তারও আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তারপরেও তিনি তাকে দত্তক নিয়ে নিজের সন্তানের মতই লালন পালন করেন।
"বিজু দা হিরো" সিনেমার চুক্তি হওয়ার পর
ভিসিডির দোকানে বসতে বসতেই একটা পর্যায়ে দোকানীর সাথে তার সক্ষ্যতা গড়ে উঠে। দুই বছর পরে সেই ভিসিডির দোকানী বিদেশ যাওয়ার জন্য দোকান বিক্রি করতে চাইলে হিরো আলম দোকানটি কেনার আগ্রহ পোষণ করেন। কিন্তু দোকান কিনতে চাইলেও কেনার মত কোন টাকা পয়সা না থাকায় বাধ্য হয়ে স্থানীয় ঋণদান সংস্থা থেকে ষোল হাজার টাকা ঋণ নিতে হয়। এই ঋণের টাকা দিয়েই দুইটি ভিসিডি প্লেয়ার এবং কিছু ভিসিডিসহ দোকনটি কিনে নেয়। কিন্তু এই দোকানের আয় দিয়ে পরিবারের খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে হিরো আলম দিনে চানাচুর বিক্রি এবং বিকালে ভিসিডির দোকান চালিয়ে দিনাতিপাত করতে থাকেন। কিছুদিন এভাবেই সে ভালো আয় রোজগার করতে ছিল কিন্তু হঠাৎ এলাকায় ডিসের লাইন এলে তার ভিসিডির ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। তখন সে বিপাকে পড়ে। বাধ্য হয়ে নিজের আয় রোজগার বাড়ানোর জন্য ডিসের লাইনের ব্যবসা শুরু করেন। ডিসের ব্যবসা শুরু করতে গিয়েও বিপদে পরেন। টাকার অভাবে ডিসের ব্যবসা শুরু করতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে আবার ঋণদান সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ডিসের ব্যবসা শুরু করেন।
ডিসের ব্যবসা করতে গিয়ে প্রতি দিনই তাকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি আলাদা একটি ভিডিও চ্যানেল চালাতে হয়। ভিডিও চ্যানেল চালাতে গিয়েই তার মনে হয় এই ভিডিও চ্যানেলে যদি নিজের অভিনয়ে একটি ছবি ছাড়তে পারতাম তাহলে জীবনটা ধন্য হতো। সেই ইচ্ছা থেকেই নিজের টাকা খরচ করে নিজের অভিনয়ে ভিডিও তৈরীর প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ভিডিও বানাতে গিয়েও বিড়ম্বনার শিকার হন। যাকে নায়িকা ঠিক করা হয়েছে সে যখন মেকাপ নিয়ে অভিনয় করতে গেছে অভিনয়ের শুরুতেই নায়কের বিদঘুটে চেহারা দেখে অভিনয় করবে না বলে বেকে বসে। এইরকম চেহারার নায়কের সাথে সে অভিনয় করবে না। নায়ক তার পছন্দ হয় নাই। নায়িকা মুখের উপরে অবজ্ঞাসুলভ আচরণ করে চলে যায়। তখন বাধ্য হয়ে সে অন্য নায়িকা যোগাড় করে কিন্তু তারাও হিরো আলমের চেহারা দেখে অভিনয় করতে রাজী না হলে বাধ্য হয়ে সে বেশি টাকা দেয়ার বিনিময়ে অভিনয় করায়। নায়িকা বেশি টাকার বিনিময়ে অভিনয় করালেও শর্ত দিয়ে বসে, অভিনয়ের সময় কোন ভাবেই হিরো আলম তার শরীরে কোন প্রকার স্পর্শ করতে পারবে না। স্পর্শ না করেই অভিনয় করতে হবে। এই শর্তেই হিরো আলম রাজী হয়ে অভিনয় শুরু করেন।
এভাবেই তার অভিনয়ে ভিসিডি তৈরী হতো আর ডিসের চ্যানেলে ভিসিডিগুলি প্লে করতো। এমতোবস্থায় হিরো আলম ফেসবুকে একটি আইডি খোলেন। সেখানে নিজের নামে আইডি খুলতে গিয়ে দেখে আলম নামে অনেক আইডি খোলা আছে সেই কারণে তিনি আলম নামের সাথে হিরো শব্দ যোগ করে হিরো আলম নামে ফেসবুক আইডি খোলেন। সেই থেকেই তিনি আশরাফুল আলম বা শুধু আলম থেকে হিরো আলম হয়ে উঠেন।
হাসি ঠাট্টার পাত্র হিরো আলমকে অনেকেই অবজ্ঞা অবহেলা করলেও এই চেহারা নিয়ে “মার ছক্কা” নামে একটি বাংলা ছবিতে সাইড নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আরো চমক লাগার মত খবর হলো বলউডের পরিচালক ও প্রডিউসার প্রতাপ কুমার তাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুঁজে পেয়ে সরাসরি তার সাথে যোগাযোগ করেন এবং “বিজুদা হিরো” নামে মুভির নায়ক হিসাবে তাকে চুক্তিবদ্ধ করেন। বলিউডের ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার বাস্তব কাহিনীটি স্মরণ করলে রুপ কথার কাহিনীর মতই মনে হয়। কিন্তু হিরো আলমের জীবনে ঘটনাটি বাস্তবেই ঘটে গেছে।
শুধু নিজের ইচ্ছা শক্তি, সাহস এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে একটা বিদঘুটে চেহারার লোক শখের বশে নিজের অভিনীত ভিডিও বানাতে গিয়ে বলিউড পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ হতে পারে এটা হয়তো অনেকে কল্পনাও করতে পারেন না। দেশে অনেক নামী দামি সুদর্শন নায়ক নায়িকা আছেন তারা বলিউড যেতে না পারলেও একজন বিদঘুটে চেহারার চানাচুর বিক্রেতা হয়ে বলিউডের নায়ক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করাটা হিরো আলমের সফলতাই মনে করি। নায়কের চেহারা না থেকেও অসম্ভবকে সম্ভব করার যে নজীর হিরো আলম সৃষ্টি করল এইজন্য আমি তাকে স্যাল্যুট জানাই। বর্তমান বিশ্বে বাস্তবেই সে একটা উদাহারণ সৃষ্টি করল।
আরো স্যাল্যুট জানাই বাবা থেকে প্রত্যাখাত হওয়ার পরে সহায় সম্বলহীন হিরো আলমের টোকাই হওয়ার কথা অথচ শুধু নিজের চেষ্টায় টোকাই না হয়ে তারাকা খ্যাতি অর্জনসহ বর্তমান বাংলাদেশে এমপি হওয়ার স্বপ্নও দেখছেন। অনেকে হয়তো এমপি হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত যত এমপি হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন হিরো আলমের চেয়েও যোগ্যতা কম ছিল। হিরো আলম তো ক্লাস সেভেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন অনেক এমপি ছিলেন নিজের নামটাও লিখতে পারতেন না। যারা হিরো আলমের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন-- ঐসব এমপি এদেশের কি আইন প্রনয়ন করে গেছেন এবং বিদেশের মাটিতে তারা এদেশের কি ভাব্মূর্তি তুলে ধরেছেন?
কাজেই এমপি হওয়ার নিম্নতম যোগ্যতা নির্ধারণ না করে হিরো আলমের যোগ্যতা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা আমি মোটেই উচিৎ মনে করি না, আগে এমপি হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা হোক তারপরে হিরো আলমের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হোক।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৫৫