ছোটগল্প:- ফাটা পায়জামা
অনেক বছর আগের কথা। হন্নে হয়ে চাকরির পিছনে ছুটে বেকার জীবনের মরীচিকা অতিক্রম করে সবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। চাকরিটা ছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশা।যাকে আবার সকলে মহান পেশা হিসেবেই অভিহিত করে। শুরুতে আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিত বন্ধুমহল সকলের কাছ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনের বন্যার জোয়ারে বাস্তবে আমার তখন প্লাবনে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু সেই আনন্দের ফল্গুধারার মধ্যেও একটা শীতল স্রোত মৃদুমন্দ গতিতে আমার শরীরে প্রবাহিত হয় যা কিছুটা হলেও আমার স্নায়বিক শক্তির গতিবেগকে মন্দিভুত করেছিল।আসলে আনন্দের পাশাপাশি মহান পেশায় সকলের কাছে সতর্কতার অগ্রিম বাণী শুনে উপলব্ধি হয় নিজের যাবতীয় সুখশান্তি বিসর্জন দিয়ে জাতির জন্য বলিপ্রদত্ত হওয়াটাই এখন থেকে আমার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। সেই কঠিন কাজে কতটা নিজেকে সমর্পণ করতে পারবো জানি না। কিন্তু মাথার মধ্যে সারাক্ষণ গুরুজনদের ভারিক্কি কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল বয়সটাও বোধহয় আমার এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গেছে মনে হয়।
আপনারা যারা বিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে পরিচিত তারা জানেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির ভূমিকা বা প্রেসিডেন্ট সাহেবের কার্যপরিধি আমি শুরুতেই এমন একজন প্রেসিডেন্ট সাহেবকে পেয়েছিলাম যাকে আজোও ভুলতে পারিনি।বলা যেতে পারে শিক্ষকতার সৌজন্যে এক বিরল প্রেসিডেন্ট সাহেব'কে দর্শন করার সুযোগ হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট সাহেব অন্য নামে 'সভাপতি' নামে পরিচিত। কিন্তু গল্পে উল্লেখিত প্রেসিডেন্ট সাহেব সামনে কাউকে সভাপতি মশায় বলতে শুনলে অমনি ধমক দিতেন। প্রেসিডেন্ট স্যার ভিন্ন অন্য কোন নামে ডাকতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিতেন। জেলা পরিষদ অফিসের বড়বাবুর দায়িত্ব থেকে অবসর নেওয়ায় ওনার ধারনা হয়েছিল, দেশের তাবৎ আই পি এস বা আই এ এস অফিসারদের সঙ্গে উনিও একাসনে কাজ করার যোগ্য। শৈশবে ভাগ্যবিড়ম্বনায় লেখাপড়ার তেমন সুযোগ না মেলায় ওনার পক্ষে নাকি এসব ভারিক্কি পদ পাওয়া সম্ভব হয়নি- এটাই ওনার খেদ। তবে নিজের প্রতি এই বঞ্চনা থাকলেও যোগ্যতায় জ্ঞানগর্ভে উনি ওনাদের সমপর্যায়েই। জেলা পরিষদ ভবনে গিয়ে কান পাতলেই নাকি সে কথা শোনা যায়। স্বয়ং ডিএম সাহেব নাকি সমস্যায় পড়লে উনার কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন।মুখে প্রায়ই বলতেন সমাজের জন্য ওনার অনেক দেওয়ার বাকি আছে। উনি সাধ্যমত সমাজের প্রয়োজনে নিজেকে নিংড়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তার জন্য সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। ওনাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে জাতির বিরাট ক্ষতি। সমাজের অজ্ঞতা দূর হবেনা । অবশ্য দেশ বা সমাজের চালিকা শক্তিই যদি নিরেট মূর্খ হয় তাহলে অবশ্য আশার কোনো আলো নেই বলে ওনার খেদোক্তি বহুবার শুনেছি।
এহেন মান্যবর ব্যক্তি নিজের জীবনে তেমন সাফল্য না পেলেও শাসকদল ওনার যোগ্যতা অনুধাবন করে এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি হিসেবে স্থানীয় বিদ্যালয়ের সভাপতির পদে নিযুক্ত করেছেন। তবে এখানেও কিছুটা আশান্বিত হলেও খেদ থেকেই গেছিল। স্থানীয় কলেজের গভর্নিং বডিতে জায়গা না পাওয়ায় ঠারেঠোরে উনি নিজের ক্ষোভের কথা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। যাইহোক মাননীয় প্রেসিডেন্ট সাহেব অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী হওয়ায় প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল সাড়ে দশটায় বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতেন। দুপুরে একটু টিফিন খেতে বাড়িতে গেলেও ফিরতেন তাড়াতাড়িই। বলাবাহুল্য প্রধান শিক্ষক সহ বাকি শিক্ষকদের উপর ওনার এহেন খবরদারিতে বিদ্যালয়ের পরিবেশ রীতিমতো বিরক্তিকর হয়ে উঠেছিল । সামান্য কারণেই একে ধমকানো ওকে ধমকানোর সঙ্গে নিজের ফাঁকা কলসির শব্দ শুনতে শুনতে আমাদের কান তখন ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল সঙ্গে জীবন হয়ে ওঠে রীতিমতো ওষ্ঠাগত প্রাণ। আমি নবীন হওয়ায় সমস্যা তেমন না হলেও বাকিরা হয়ে উঠেছিলেন রণংদেহী। কিন্তু সামনে কেউ টু-শব্দ করার সাহস দেখাতেন না। বেচারা শিক্ষকদের প্রতিদিন আড়ালে ওনার সঙ্গে শাসকদলের মুন্ডুপাত করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। উল্লেখ্য প্রেসিডেন্ট সাহেব শিক্ষকদের এভাবে কড়া ট্রাকিংয়ে রাখায় বাইরের পরিবেশও ছিল স্থানীয়দের কাছে খুবই উপভোগ্য। তবে আমরাও ছিলাম খুব সাবধানী। এলাকার হাওয়া প্রতিকুল বুঝে কখনোও আমরা নিজেদের হতাশা স্থানীয়দের কাছে প্রকাশ করতাম না।
ভদ্রলোকের হৃদয় ছিল সমুদ্রসীমা ভালোবাসার আঁধার (আধার নয়)। তবে তা সুরক্ষিত ছিল শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের দিদিমনিদের জন্য। খুব মায়াবী দৃষ্টি ছিল ওনাদের প্রতি ওনার।সামনে পড়লে মিষ্টি করে দিদিমনিদের 'মা' বলে সম্বোধন করতেন।আর মেল টিচাররা ছিল যেন ওনার শত্রুপক্ষ।বয়সে ওনার সন্তানতুল্য হলেও তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল 'ভাই' ডাক।আমরা মজা করে বলতাম,সম্ভব হলে উনি সব মেল টিচারদের ট্রান্সফার করিয়ে ফিমেল টিচার নিয়ে আসবেন এবং বিদ্যালয়কে একটা হায়ব্রিড বয়েজ স্কুল তৈরি করবেন। করিৎকর্মা প্রেসিডেন্ট সাহেবের মেল টিচারদের টাইট দেওয়ার চেষ্টার অন্ত ছিল না।আসা যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি যখন তখন এর তার ক্লাসে ঢুকে যাওয়া,শিক্ষক কি পড়াচ্ছেন খোঁজ নেওয়া, সম্ভব হলে ছাত্রদের প্রশ্ন করা, না পারলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে আরও দরদ দিয়ে পড়ানোর পরামর্শ দেওয়া; বলা ভালো হ্যাটা(সকলের সামনে অবজ্ঞা করা বা একপ্রকার বুলিং) করার মধ্যে দিয়ে আমাদের সেসময় দিন কাটছিল। বিরক্তিকর হলেও ওনার বিরুদ্ধে কথা বলার উপায় ছিল কার্যত অবরুদ্ধ।
ভদ্রলোক সাদা পায়জামা পড়তেন।আর উপরে পড়তেন ছোট সাদা ফতুয়া। শৈশবে গান্ধীজিকে দেখেছিলেন বলে দাবি করেন। আমরা এক ধাপ এগিয়ে ওনাকে, গান্ধীবাদী আন্দোলনের নেতা বললে তখন অবশ্য একটু লজ্জা পেয়ে বলতেন,
- ঐ যে আর্থিক অনটনের জন্য সুযোগ থাকলেও গান্ধীবাদী আন্দোলনে যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
আরো বলতেন,
-অনেকগুলো পেটের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে থাকায় জীবনের অনেক স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে গেছে।
আমরা গান্ধীজিকে দেখিনি ইতিহাসে পড়েছি। কাজেই ওনার আচরণ যাই হোক প্রকাশ্যে একজন গান্ধী দর্শনধারীকে দেখতে পাওয়া এটাই ছিল সে সময় আমাদের বড় প্রাপ্তি।ফলে ওনার সব অসয়লেত( একটা আঞ্চলিক শব্দ অর্থ বিরক্তিকর আচরণ) মেনে নিতে বাধ্য ছিলাম। একদিন প্রেসিডেন্ট সাহেব ক্লাস পরিদর্শন করার বেশ কিছুক্ষণ পরও দেখি ছেলেরা একটু অমনোযোগী। একবার নোটিশ করেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। বুঝতেই পারি ওদের মধ্যে একটা কৌতুহল চলছে। কিন্তু কেউ মুখে বলছে না সে কথা। এবার হাসিহাসি মুখে বকবো না বলে একটু আশ্বাস দিতেই,
-স্যার প্রেসিডেন্ট স্যারের পায়জামার নিচে ফাটা আছে।
কথা দিয়েছি বকাবকি করবো না। নিজের হাসিকে অন্তরে লুকিয়ে রেখে পড়াশোনায় ফিরতে আদেশ করি। এবার অবশ্য ওরা আমার কথা শুনে বাধ্য ছেলের মতো কাজে মনোযোগী হয়। অস্বীকার করবো না ছেলেদের কাছ থেকে এমন একটি রসালো খবর পেয়ে ভিতরে ভিতরে রীতিমতো উত্তেজিত হতে থাকে। রসিয়ে রসিয়ে স্টাফ রুমে গল্প করার জন্য ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা অনুভব করি। পরেরদিন সকালে প্রেসিডেন্ট সাহেব বিদ্যালয় এলে পিছন থেকে লক্ষ্য করি ছেলেরা ঠিকই বলেছে।ওনার পায়জামার দুই পায়ের সংযোগস্থলে রীতিমতো অনেকটা ফাটা। হাঁটার সময় পিছন থেকে ফাটলটি স্পষ্ট চোখে পড়ছে।স্টাফরুমে একজন ছিল লোকাল সংবাদদাতা। পেটে তার কোনো কথা আটকে থাকতো না। সুযোগ বুঝে তার কানে একবার কথাটি তুলতেই আমার কাজ শেষ। গোটা বিদ্যালয়ের রটে গেল প্রেসিডেন্ট সাহেবের নতুন নাম।এই ভাবে উনি ফাটা পায়জামায় পরিনত হলেন। উল্লেখ্য এর পরে ছেলেরা ওনাকে লক্ষ্য করে পিছন থেকে ফাটা পায়জামা বলে ডাকতে থাকে।উনি মাঝে মাঝে হম্বিতম্বি করে,
- কে বললো? কে বললো? বলে খুঁজতে থাকেন।অমনি অন্যদিক থেকে আবার ভেসে আসে একি কথা। গোটা স্কুলের ছেলেরা ব্যপক মজা পেল এমন একজন উঁচু দরের মানুষকে খ্যাপানোর সুযোগ পেয়ে।
ঘটনা এখনোও শেষ হয়নি। শেষবারের মতো বিদ্যালয়ের অ্যানুয়াল স্পোর্টসের সময় পতাকা উত্তোলন ও ভাষন দিয়ে যেইনা নিজের চেয়ারে বসেছেন অমনি পাগলের মতো চুলকানিতে ছটফট করতে করতে থাকেন। ছেলেদের মধ্যে কোনো একজন আগে থেকেই প্রেসিডেন্ট সাহেবের জন্য বরাদ্দ স্পেশাল চেয়ারে বিছুটি লাগিয়ে রেখেছিল।যা সরাসরি ওনার পায়জামার সেন্টারে আঘাত করে।সেই জ্বালায় উনি পাগোলের মতো ছটফট করতে করতে সেই যে মাঠ ছেড়ে চলে গেছিলেন আর কখনও স্কুলমুখো হননি।
লোকাল পার্টিতে ওনার এই ফাটা পায়জামায় কিসসা জানাজানি হয় এবং ওনার বামাক্ষ্যাপার বিষয়টিও প্রকাশ্যে চলে আসে।মা বলে সম্বোধন করে উনি দিদিমনিদে মাথায় হাত দিতেন। এমনকি দু একজনকে অ্যাপ্রুভালের পেপার ঠিক করতে পরশের হাত মাথা থেকে পিঠে পর্যন্ত নেমেছিল। নিজেদের সম্ভ্রমের জন্য সেসময় বিষয়টি প্রকাশ্যে না এলেও ঘটনা পরে সামনে আসে।যে কারণে পার্টি থেকে ওনাকে আর স্কুলে আসতে নিষেধ করা হয়।ওনার এই পদস্খলনের সঙ্গে সঙ্গেই অবসান ঘটে খ্যাপাটে বুড়োর অসদাচরণের অধ্যায়েরও।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:- গল্প হলেও সত্যি।