মাস সাতেক পরে কোনো এক সন্ধ্যায় আসা এক মুজাহিদকে দেখে আমি চমকে উঠি। একদম একই রকম দেখতে;একই রকম উচ্চতা। এমনকি গায়ের রঙও একদম একই। শুধু তাই নয়, শুরুতে সালাম দিলে, গলার স্বরের মধ্যেও মিল পাই। লোকটাকে দেখামাত্র মনের মধ্যে উথালপাথাল হতে থাকে।তা সত্ত্বেও কেন জানি মনে হয়েছিল এখনই কিছু জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে ন। যে কারণে নিজের জিজ্ঞাসু মনকে অতিকষ্টে চেপে রাখি। সেদিন মনে এতো জিজ্ঞাসা নিয়েও খেদমতের কোনো ত্রুটি রাখিনি। যন্ত্রের মতো নীরবে একটার পর একটা কাজ করে গেছি। রাতের খাওয়ার পরে দুই জন ঘরের দুই দিকে শুয়ে পড়ি। শুরুতে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়াই আমার লক্ষ্য ছিলো লোকটা চালচলন চাহনির দিকে। আমার প্রতি কোন কুদৃষ্টি না পাওয়ায় ভেবেছিলাম অন্তত আজ রাতটা ভালোই যাবে। তেমন কোনো অসুবিধা ঘটাবে না। ওর সম্পর্কে একটু ভালো চিন্তা করেই বোধহয় সেদিন একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার অনুমান সঠিক ছিল না। বেশিক্ষণ তখনও ঘুমাই নি। হঠাৎ বুকের উপর প্রচন্ড চাপ অনুভব করি। একেবারে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ঘোরের মধ্যে থাকায় বিষয়টা মাথায় আসেনি যে কেউ আমাকে এমন করে চেপে ধরতে পারে।চোখ খুলতেই বুঝি মুজাহিদ আমার বুকের উপর চেপে বসেছে। আমি ঝটকা মেরে নিজেকে কোনোক্রমে ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করি,
- তুমি রফিক ভাই না?
কথার মাঝে হঠাৎ রমিসা বুবুকে না থামিয়ে পারলাম না। জিজ্ঞেস করি,
- আচ্ছা বুবু রফিক ভাই মানে তোমার সেই খালাতো ভাই?
- হ্যাঁ। আমার সেই খালাতো ভাই।যে আমার বিয়ের ঘটকালি করেছিল।
আমি আবার জিজ্ঞেস করি,
- সে তো হাফেজ।সে এমন একটা কাজ করতে পারলো?
- না পারার কি আছে?ওরা যে মুজাহিদ। ওদের নাকি এসব কাজে কোন পাপ নেই।
বাস্তবে আমি অবাক হই একজন হাফেজের এমন কান্ডকারখানা শুনে।তাও আবার উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর না কোথা থেকে হাফেজ পাশ করা।
কিছুক্ষণ থেমে বুবু আবার বলতে লাগলো,
- আমার কথা শুনে রফিক ভাই যেন আকাশ থেকে পড়ে। এমনিতেই ওর কথা বলার সমস্যা কখনও দেখিনি।আর পাঁচ জনের মতো স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতো। তবে মায়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম রফিক ভাইয়ের মা সোফিয়া খালা নাকি একবার বলেছিল, চাপে পড়লে ওর সামান্য কথা আটকে যায়। আমাদের বাড়িতে যতবার এসেছে এমন অস্বাভাবিকতা অবশ্য কখনোই চোখে পড়েনি। যে কারণে আর যাইহোক তাকে তোতলা বলা যায় না।কিন্তু আজ আমার মুখে নিজের নাম শুনে মুখ দিয়ে ওর কোনো শব্দই বের হচ্ছিল না। চোখে ভূত দেখার মত বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কোনোক্রমে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করে,
- তু..ই এ.খা.নে এ.লি কে.ম.নে র.মি.সা?
আরো কি সব যেন বলছিল।ওসব কথায় তখন আর আমার মন ছিল না। চোখের সামনে ও নিশ্চিত হতেই মূহুর্তে রাগ সপ্তমে চড়ে যায়। হাতের কাছে এমন একটা শয়তানকে পেয়ে খালি হাতে ফেরাবো? কুড়িয়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো দম নিয়ে সেকেন্ডের মধ্যে ঘুরে গিয়ে দেওয়ালের পাশে কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা রাইফেলটাকে শক্ত করে ধরতেই বলা ভালো আমার এমন ভয়ানক মূর্তি দেখে ও প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। অদ্ভুত একটা শব্দ করে হুমড়ি খেয়ে একদম সামনে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে। তোতলামো ততক্ষণে সামলে নিয়ে বলতে থাকে,
- রমিসা তোর পায়ে পড়ি।আমাকে মারিস না বোন।
আর একবার বিশ্বাস কর আমাকে। একবার সুযোগ দে ভাই আমাকে। আমি তোকে এখান থেকে বের করবোই।আমাকে মারলে তুই সে সুযোগ হারাবি। নতুবা সারা জীবন তোকে এখানে পচে পচে মরতে হবে।
ওর এই নাটুকে কথায় আমার সর্বাঙ্গে জ্বালা দিয়ে ওঠে। গায়ের শক্তি কয়েকগুণ যেন বেড়ে যায়। মনে হয়েছিল সামনে বাঘ এলে তাকেও শেষ করে দিতে পারবো। যাইহোক ওর কথা শেষ না হতেই বাঘিনীর মতো হুঙ্কার দিয়ে বলি,
- তোকে বিশ্বাস? জানোয়ার!বলে সমানে গায়ের শক্তিভোর ওর সঙ্গে লড়াইয়ে নামি। দুজনের ধস্তাধস্তিতে আচমকা সশব্দে একটা গুলি বেরিয়ে যায়।তবে গুলিটা কারো গায়ে লাগেনি। উল্টো দিকের দেওয়ালে গিয়ে লাগে।ও লাফিয়ে উঠে ছিটকে পড়ে আরেক দিকের দেওয়ালে। আমিও যেন হঠাৎ বোকা হয়ে যাই। আচমকা গুলি বেরোতেই বুঝতে পারি কাজটি করা ঠিক হয়নি। খুবই খারাপ লাগছিল সেসময়ে। কিছুটা অসহায় হয়ে হঠাৎ রাইফেলটি মেঝেতে ফেলে দিই।ও এতক্ষণে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। রাইফেলটি ফেলতেই এবার এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
গোলাগুলির শব্দ এখানে অবশ্য নতুন কিছু নয়। সেই প্রথম দিন আসা থেকে আশপাশ থেকে প্রায়ই এমন শব্দ শুনে আসছি। একপ্রকার সয়ে গেছি শব্দটার সঙ্গে। কাজেই স্থানীয়দের এসব নিয়ে মাথাব্যাথা ছিল না। তবে রফিকের চলে যাওয়ার পরপরই দেখি আবছা অন্ধকারের মধ্যে একজন উঁকি দিচ্ছে। আমি অবশ্য ওসবে পাত্তা না দিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করে পড়ে থাকি।
ঘুম সে রাতে আর আসেনি। বলা ভালো পারিনি ঘুমাতে।ভেবেছিলাম রফিক ভয় পেয়ে বাইরে চলে গেছে;পরে আবার ফিরে আসবে।তাই দরজা বন্ধ রাখলেও কান খাঁড়া করে ছিলাম যে এলেই যাতে দরজাটা খুলে দিতে পারি।আর এই কারণেই সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি।ভয় হচ্ছিল আচমকা ফিরে এসে না আমাকে আক্রমন করে বসে। আবার দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল রাতের বেলা কোথায় কাটিয়ে দিচ্ছে সে কথা ভেবে। কিন্তু নাহা সে রাতে আর ও ফেরেনি। ও না ফেরায় আমার চিন্তাটা আরও বেড়ে যায়। ঘরের মধ্যে ওর ঝোলাটা ছিল। ওগুলো নিয়ে গেলে হয়তো এতটা চিন্তায় থাকতে হতো না।
পরেরদিন সকালেও ও না ফেরায় ধরে নেই আর ফিরবে না। অচেনা তো নয় আমারই খালাতো ভাই, সারারাত বাইরে কাটিয়েছে ভেবে সকালে তবুও একটু দয়া হচ্ছিল। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছিল। কিন্তু দুপুরের পর থেকে ওর উপর এতদিনে তৈরি হওয়া রাগগুলো আবার আমাকে উত্তেজিত করে। খাবার দিতে আসা লোকটা অনেকটা দূরে থাকতো জানতাম। লোকটি আকার ইঙ্গিতে কিছু বলতে চাইতো। ভাষা না বুঝলেও ইঙ্গিত ভালো লাগতো না।যে কারণে কোনদিন মুখ তুলে তাকায় নি। কিন্তু সেদিন ঘরের ভেতর ঢুকে কি সব বলতে থাকে। উঁকিঝুঁকি মেরে পোঁটলার আড়ালে রাইফেলটি তুলতেই আমার বুকের ভেতরে পানি যায় শুকিয়ে।চিন্তায় পড়ি রাইফেল তুলছে কি আমাকে মারার জন্য? কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওর সঙ্গে আমার রাইফেলটিও সঙ্গে নিতেই বুঝতে পারি ওর ঘরে ঢোকার উদ্দেশ্য। রাইফেলটাতে যে কতটা মায়া পড়ে গেছিল বুঝতে পারিনি। সেদিন হাত ছাড়া হতেই খুবই হতাশ হয়ে পড়ি। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে আবার ঐ রফিকের উপরে। ক্ষোভে অভিমানে তখন রীতিমত ফুঁসতে থাকি। হতাশায় ক্ষোভে দুঃখে খুবই অসহায় লাগতে থাকে।গতরাতের ঘটনাগুলো একেএকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এসবের মধ্যে ওর কথাগুলোও মনে পড়ে যায়। আমাকে কিনা বলে এখান থেকে উদ্ধার করবে। মনে মনে গালি দেই,ভন্ড প্রতারক কোথাকার। এখন মনে হচ্ছে গুলিটা ফসকে না গিয়ে বরং ওর বুক তাক করে মারলেই ভালো হতো।ওরকম শয়তান লম্পটকে জীবনের মতো শেষ করে দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু ততক্ষণে ও যে পাখি হাতের বাইরে চলে গেছে।
সেদিন মাঝ রাতে আচমকা পরপর কয়েকটি শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বালিশে শুয়ে থাকায় মনে হচ্ছিল শব্দটা একেবারে কানের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে। ধরফর করে উঠে বসতেই আবার শুরু হয় একনাগাড়ে গুলি। এবার নিশ্চিত হই শব্দটা দরজার বাইরে থেকেই আসছে। সঙ্গে কাদের ফিসফিসানিও কানে আসে। মূহুর্তে একটা গভীর ভাবনা আমাকে গ্রাস করে। মুজাহিদরা তো কখনোই তারা দল বেঁধে আসেনা।তার উপরে আজ পর্যন্ত কোনদিন তাদের এমন সময়ে আসার কোনো নজির নেই। কখনও এমন গোলাগুলিও তারা করিনি। তাহলে বাইরে কারা?নাকি রফিক ভাই লোকজন নিয়ে এসেছে আমাকে মারবে বলে। মূহুর্তের ভাবনায় আমার হাত পা অবশ হয়ে আসে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০২২ রাত ৯:২১